তিলাবনী গ্রামের স্বরূপ মাহাতো এর কলমে
আমাদের জীবনদাত্রী মা আজ আসহায় হয়ে চেয়ে আছে আমাদের দিকে আর একটি কথাই বলছে – ‘মানব জাতিকে সভ্য হতে শেখালাম আমি, আর আজ তোমরা আমারি দেহ ভেঙে উলঙ্গ করছো, তোমাদের রাজপ্রাসাদ গ্ৰানাইট দিয়ে চাক চিকন করবে বলে।
আমিই মানুষকে প্রথম আশ্রয় দিয়ে ছিলাম আমার গুহায় থাকতে দিয়ে। আমার জন্যই শিখলে তোমরা পাথর ঠুকে আগুন জ্বালানো, অস্ত্র বানিয়ে শিকার, কৃষি, যন্ত্রপাতি বানিয়ে কৃষিকাজ করা। অন্ন, খাদ্য, বাসস্থান কী নেই আমার দেয়ার মধ্যে ? তবু আমার উপর কেনো এতো অত্যাচার ?
এই প্রশ্নের উওর জানতে চাওয়াটা হয়তো এই যুগে এসে বড্ড বেমানান। এটাও বাস্তব ধিরির (পাথর) থেকেই ধরিত্রী এই পৃথিবী আমাদের প্রকৃতি, আমাদের পরিবেশ। একজন মা যেমন তার ছেলেকে আগলে রাখে সেরকমই একটি পাহাড় তার চারপাশের প্রাকৃতিক পরিবেশ সুস্থ রাখতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। জীববৈচিত্রের আবাস স্থলে পরিণত হয়।
প্রসঙ্গত তিলাবনী পাহাড়কে নিয়ে ঘটে চলা আন্দোলনে তিলাবনী, পড়াশিবনা, লেদাবনা, মাধবপুর ও তার পাশ্ববর্তী গ্ৰামের মানুষের ভূমিকা সত্যি ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে থাকার মতো “জীবন যাবে যাক কিন্তু তিলাবনী পাহাড় মায়ের সম্মান ও ভবিষ্যত প্রজন্মর বাঁচার আসা কিছুতেই শেষ হতে দেবে না”। ২০১৯ সালে রাজ্য সরকার একটি বেসরকারি কোম্পানীকে ১০ বছরের জন্য গ্ৰানাইট কাটার লিজ দেয়। তিলাবনী মৌজায় যার প্লট নং ১১১৪ এবং পরিমান ৪.৬ হেক্টর। আর এখানেই সরকার এবং কোম্পানী দুই পক্ষই চালাকি করে গনশুনানী থেকে বাঁচার জন্য এই পথ নিয়েছে, আদতে ১১১৪ নং প্লট ৫ হেক্টরের। কী করে বা কোন আইনে সম্ভব ৫ হেক্টরের প্লট থেকে ৪.৬ হেক্টর লিজ দেওয়া ? কেনো গণশুনানী করলো না সরকার ? কেনো কাজ শুরু করার আগে গ্ৰাম সভার মিটিং ডাকলো না ? কেনো গ্রামবাসীদের দেওয়া চিঠির কনো উওর দেওয়া হলো না ? তাহলে, এখানে কী অন্য কিছুর গল্প আছে ?
জুন মাসের ৩ তারিখে যখন কোম্পানীর (কোম্পানীর লোক ছিল, না অন্য কেউ ছিল জানা যায় নি) লোকজন ৫ থেকে ৬ টা ছোট চার চাকা গাড়ির সাথে বলেরো, জেসিবি মেশিন, ট্রাক্টর, ড্রিল মেশিন আর একটা বাইক নিয়ে এসেছিল। তাদের কাছে যখন গ্ৰামবাসীগন যখন উওর চাইতে যায়, তখন তাদের উওর…
- * আপনরা কে ?
- – আমরা টোডি মাইন্স এর লোক ।
- *এখানে কেনো এসেছেন ?
- – মাইনিং করতে ।
- *আপনাদের কে পারমিশন দিলো আর কাগজ টা একরার দেখাবেন দয়া করে ?
- – সরকার দিয়েছে আর আমাদের কাছে কাগজ নেই ।
- * তাহলে আপনাদের কোম্পানীর পরিচয় পত্র গুলো দেখান দয়াকরে ?
- – আমাদের কাছে কোন পরিচয় পত্র নেই ।
- *ফরেষ্ট এর জমিতে জেসিবি দিয়ে রাস্তা করছেন, এর কাগজ নিশ্চয় আপনার কাছে আছে ?
- – (সবাই চুপচাপ)
- * তাহলে কি করে বুঝবো আপনারা পাথর চোর না কোম্পানীর লোক ?
- – (কারো মুখে কোন শব্দ নেই সবাই চুপ)
- * লোকাল গভমেন্টের কে পারমিশন দিলো আপনাদের ?
- – বিডিও আসছে আধ ঘন্টার মধ্য ।
- *ঠিক আছে আপনারা বসুন বিডিও সাহেব আসুক তার পর কথা হবে …
- *(৩৫ থেকে ৪০ মিনিট পর ) বিডিও সাহেব আসছে ?
- – হ্যাঁ , রাস্তায় আছে ।
- * (৬০ থেকে ৭০ মিনিট পর) কত দুর ?
- – না, বিডিও মিটিং করতে ডিএম অফিস গেলো ।
- * আপনারা মিথ্যা বলছেন, তো কী জন্য বিডিও সাহেব আসবেন ?
- – (সবাই চুপ করে আছে )
- ঠিক আছে আপনারা যেই হোন না কেন, আপনারা এখান থেকে এখন চলে যান। আমরা যতক্ষন না সরকারের কাছ থেকে কোন উওর পাচ্ছি, ততক্ষন আমরা পাথর কাটার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবো ।
- -(সবাই চলে যায় )
পর দিন সকালে আনন্দ বাজার পত্রিকা তে দেখতে পাই বিডিও সাহেবের বক্তব্য -“যে সংস্থা ও পাহাড় থেকে খনিজ সম্পদ সংগ্ৰহের ছাড়পত্র পেয়েছে, সেই সংস্থার তরফে কিছু লোকজন এ দিন ওখানে কাজ করতে গিয়েছিলেন । কাজ করতে গিয়ে তাঁরা স্থানীয় মানুষজনের বাধার মুখে পড়েছেন। তবে তাঁরা প্রশাসনকে জানিয়ে যাননি। আমরা সংস্থাকে জানিয়েছি, অতিরিক্ত জেলাশাসক (ভূমি ও ভূমি সংস্কার) এর সঙ্গে আলোচনা পর, এই মর্মে তাঁরা যেন পদক্ষেপ করেন।”
এই সব ঘটনা ঘটে যাওয়ার কিছুদিন পর জুলাই মাসের ১ তারিখে ৮ জনের নামে নোটিশ পুলিশ এসে দিয়ে যায়। সবাই অবাক কী জন্য নোটিশ ? দেখার পর বোঝা গেল ৩রা জুন কোম্পানীর লোকজন কে মারামারি করার জন্য নোটিশ। গ্ৰামের মানুষ এর আগে কোনোদিন দেখেনি মিথ্যা মামলা কোনটা কে বলে, সেদিন দেখেছিল। গ্ৰামের মানুষের বিশ্বাস, সরকার আমাদের কথা না শুনলেও আইন আদালত আমাদের কথা শুনবে ।
আরও পড়তে পারেন – মাতৃসদন আশ্রম পরিবেশ আন্দোলনের নীরব পথ প্রদর্শক