জনজীবন বিঘ্নকারী পরিবেশ ধ্বংসকারী মাইনিং প্রকল্পের বিরুদ্ধে গড়চিরৌলির জনজাতিদের লড়াইয়ের পাশে দাঁড়ান

আন্দোলনের উপর পুলিশী হামলা: জিন্দাল স্টীল, লয়েড মেটাল এন্ড এনার্জি লিমিটেড সহ একগুচ্ছ কোম্পানির বেশ কয়েকটি মাইনিং প্রকল্পের বিরুদ্ধে মহারাষ্ট্রের গড়চিরৌলি জেলার সুরজগড় অঞ্চলের ৭০ টির বেশী গ্রামের আদিবাসী মূলনিবাসী জনগণ ২৫০ দিন ধরে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। স্থানীয় জনজাতি মানুষদের লড়াইকে ছত্রভঙ্গ করতে বিভিন্ন থানা থেকে বিশাল পুলিশ বাহিনী মোতায়েন করা হয় (২০ নভেম্বর, ২০২৩)। সুরজগড়ের মূল প্রতিবাদ স্থলের সমস্ত জিনিসপত্র লণ্ডভণ্ড করে বীরপুঙ্গব পুলিশ বাহিনী আন্দোলনরত নেতৃত্ব স্থানীয় বেশ কয়েকজন পরিবেশ কর্মীকে জোর করে হেলিকপ্টারে চাপিয়ে গড়চিরৌলি নিয়ে যায়।  কয়েকদিন আগে থেকেই ড্রোন-ক্যামেরা সহযোগে পুলিশ এই অঞ্চলের ছবি তুলতে থাকে। ওদের কাছে এই খবরও পৌঁছে যায় যে, নেতৃত্ব স্থানীয় কয়েকজন সক্রিয় কর্মী দিল্লির পথে রওয়ানা হয়েছেন একটি পরিবেশ কর্মসূচিতে যোগ দিতে। এই সুযোগে ৮ জন লড়াকু নেতাকে তুলে আনার পাশাপাশি তাঁদের মোবাইল ফোনও কেড়ে নেওয়া হয়, ভেঙে দেওয়া হয় গ্রামের একাধিক কুঁড়েঘর।

জনজীবন বিঘ্নকারী পরিবেশ ধ্বংসকারী মাইনিং প্রকল্পের বিরুদ্ধে গড়চিরৌলির জনজাতিদের লড়াইয়ের পাশে দাঁড়ান

আন্দোলনকারীরা অত্যন্ত দুঃখের সাথে, খেদের সাথে জানাচ্ছেন – “৮ মাসের বেশি সময় ধরে কর্পোরেট বাহিনীর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিবাদ প্রতিরোধ জারি থাকলেও, আমাদের লড়াইয়ের পাশে কোনো রাজনৈতিক দল / নেতৃত্ব এসে দাঁড়ায়নি।” FFF (ফ্রাইডেজ ফর ফিউচার) এর নানান ফেসবুক পেজ ও  হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ থেকে জানা যাচ্ছে কয়লা ও লৌহ আকরিক খনির বিরুদ্ধে সংবাদপত্রে নানান খবর, রিপোর্টিং প্রকাশিত হয়েছে। মন্ত্রী পারিষদের কাছে সরাসরি চিঠিও পাঠানো হয়েছে। তবুও শান্তিপূর্ণ অহিংস গণতান্ত্রিক আন্দোলনে পুলিশবাহিনী লেলিয়ে দিয়ে লড়াকু নেতাদের তুলে নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি, মূল প্রতিবাদ স্থলে ব্যাপক ভাঙচুর করা হয়। স্থানীয় জনগণের জীবনযাত্রা বিঘ্নকারী ও পরিবেশের উপর নতুন করে ভয়ানক বিপর্যয় নামিয়ে আনা প্রকল্পগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারী আইনজীবী লালসু নগোটি রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার পরিষদে  অনলাইন বৈঠকে বিরোধিতা করার সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যেই পুলিশী হানা নামিয়ে আনা হলো।

স্থানীয় মানুষরা কেন আন্দোলনের পথে:

ছত্তিশগড় সীমান্তের নিকটবর্তী গড়চিরৌলি জেলার তদগতা অঞ্চলটি ঘন জঙ্গল, সবুজ গাছপালা, উর্বর কৃষিজমি সমৃদ্ধ। এখানে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে মূল্যবান টিক ও পাম গাছ। স্থানীয় জনগণের মূল জীবিকা –চাষবাস, পশুপালন ও জঙ্গল নির্ভর জীবনযাত্রা। সুন্দর নৈসর্গিক পরিবেশে সরল জীবনধারায় অভ্যস্ত গ্রামের মানুষদের উন্নতিসাধনের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে তিনটি উন্নয়ন (!) প্রকল্প হাজির করা হলো। জঙ্গল কেটে মাটির গভীর থেকে কয়লা, লোহা সহ অন্যান্য আকরিক খনন, মাওবাদী সন্দেহে সাধারণ জনগণকে ব্যাপক হারে ধরপাকড়, পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর আয়তন ও সংখ্যাবৃদ্ধি। গ্রামের সাধারণ জনগণ জঙ্গল- কৃষি-পশুপালন নির্ভর জীবনযাত্রাতেই খুশি ছিলেন, তাঁরা চাননি তথাকথিত জনমোহিনী উন্নয়ন প্রকল্প। তাঁদের দাবি, চাওয়া পাওয়া খুব সামান্যই। তাঁরা চান – ২০০৬ সালের বনাধিকার আইন লাগু করে জঙ্গলের উপর তাঁদের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া হোক। কিন্তু নাকের বদলে তাঁরা পেলেন নরুন। চালু হয়ে যাওয়া প্রকল্প সাইট থেকে নির্গত বিষবাষ্প, কালো ধোঁয়া, কয়লার গুঁড়ো: চাষের জমি, রাস্তাঘাট, কুয়োর জল, শাকসব্জি সহ সমস্ত কিছুকে পুরু আস্তরণে ঢেকে দিল। আরো বড় একটি উপহার তাঁরা পেলেন। সংসদীয় ক্ষমতার বলে বলিয়ান কেন্দ্রীয় সরকার দুটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশ আইন আমুল বদলে দিল। আইন পাল্টে দেওয়া, বদলে দেওয়ার পিছনে মূল উদ্দেশ্য হলো: জঙ্গল জমিন পাহাড় সহ দেশের সব প্রাকৃতিক সম্পদ নির্বিচারে বিনা বাধায় কর্পোরেটের হাতে তুলে দেওয়ার সুকৌশলী চক্রান্ত।

‘দমকনদ্বাহি বাঁচাও সংঘর্ষ সমিতি’র পক্ষ থেকে পরিবেশ আন্দোলনের সমস্ত সংগঠন, পরিবেশ কর্মী এবং সাংবাদিক, আইনজীবীদের কাছে পুলিশি বর্বরতার বিরুদ্ধে এবং জনজাতিদের অসম লড়াইয়ের পাশে দাঁড়ানোর জন্য আবেদন রাখা হয়েছে। ২৫০ দিন ধরে চলা লড়াই আন্দোলনকে গুঁড়িয়ে দিতে এর আগেও বেশ কিছু আন্দোলনকারীদের আটক রাখা সহ তাঁদের বিরুদ্ধে মিথ্যা কেস দেওয়া হয়েছে। পুলিশের অজুহাত কি? এই আন্দোলন নাকি মাওবাদীদের মদতে চলছে। এই এক নয়া তরিখা বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার গুলোর। আদিবাসী মূলনিবাসী জনজাতিদের আন্দোলন সম্পর্কে জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য লাগিয়ে দাও মাওবাদী, আরবান নকশাল, ইত্যাদি প্রভৃতি তকমা। সাপ মরলো, লাঠিও ভাঙল না।

প্রকল্প এলাকার বর্তমান পরিস্থিতি:

১৭৯ মিলিয়ন টন লৌহ আকরিক, ১৭২ মিলিয়নটন টন লাইম স্টোন এবং অন্যান্য খনিজ উত্তোলনের বৃহৎ প্রকল্পগুলির মধ্যে  ‘লয়েড এনার্জি লিমিটেড’ ২০১৬ সাল থেকেই পুরোদস্তুর কাজ শুরু করে দিয়েছে। ২০০৭ সালে কোম্পানিকে (ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নাকি!) সুরজগড় গ্রামের ৩৫০ হেক্টর জমি ২০ বছরের লিজ-মালিকানা তুলে দেওয়া হয়। তাদের মাইনিং প্রকল্পের কাজ সুচারুভাবে চালানোর জন্য বর্তমান সরকার এই লিজ-ডিডের মেয়াদ আরও ৩০ বছর বাড়িয়ে দিয়েছে। সোনায় সোহাগা! বলা হচ্ছে, এই প্রকল্পটি মহারাষ্ট্রের সর্ববৃহৎ মাইনিং সাইট হতে চলেছে। লয়েড কোম্পানি ছাড়াও জিন্দাল স্টিল, ‘কর্পোরেট ইস্পাত অ্যালয়’, ‘গোপানি আয়রন’ এর মতো ২৫ টি কোম্পানিকে সরকারের তরফে মোট ১৮ হাজার একর জমি- জঙ্গল ব্যবহারের ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে।

অথচ PESA (Panchayats Extension to Scheduled Areas act,1996) আইনানুসারে এই ধরনের বৃহৎ প্রকল্পে ছাড়পত্র দেওয়ার আগে গ্রামসভায় জনশুনানি বাধ্যতামূলক। যে সভা থেকে সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা —তাদের জমিজমা, ব্যবহৃত জঙ্গল এলাকা, ঐতিহ্যশালী বনজসম্পদ অন্যদের ব্যবহার করতে আদৌ দেওয়া হবে কিনা। গ্রামবাসিদের বক্তব্য –ক্ষমতার বলে বলিয়ান সরকার ও কর্পোরেট বাহিনী এইসবের ধারেকাছে দিয়েও হাঁটেনি। এটাই আজ কেন্দ্র ও নানা কিসিমের রাজ্য সরকারের দস্তুর। উড়িষ্যার ধিনকিয়ায় পস্কোর কয়লা-ইস্পাত প্রকল্প সহ এই বাংলার দেউচা পাঁচামি কয়লাখনি প্রকল্প, পুরুলিয়ার ঠুগরায় প্রায় ৪ লক্ষ বনানী উচ্ছেদ করে অন্তত দশটি গ্রামকে জলের তলায় ভাসিয়ে দেওয়ার বিনিময়ে অবৈজ্ঞানিক অযৌক্তিক পাম্প স্টোরেজ প্রকল্প: সমস্ত ক্ষেত্রেই গ্রামসভার শুনানি, পরিবেশ দপ্তরের অনুমতির বালাই নেই। স্থানীয় আদিবাসী জনজাতির মানুষজন জীবনজীবিকা, পরিবেশ বাঁচাতে বাধ্য হয়েই পথে নামছেন, দাঁত কামড়ে পড়ে থাকছেন লড়াইয়ের ময়দানে। নদীমাতৃক সুজলা সুফলা, উত্তরে হিমালয় ও তিনদিকে সাগর পরিব্যাপ্ত ভারতবর্ষের ঐতিহ্যবাহি প্রকৃতি পরিবেশ হাঙ্গর কর্পোরেটের দানবীয় আগ্রাসন থেকে এখনো কিছুটা মাত্রায় হলেও টিকিয়ে রেখেছেন মূলত আদিবাসী-বনবাসী মানুষজন তাঁদের মরনপণ লড়াইয়ের মধ্য দিয়েই। আমাদের নিজেদের বেঁচে থাকার স্বার্থে, পরবর্তী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করার স্বার্থে আমাদের রাজ্য সহ ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে চলমান পরিবেশ আন্দোলন গুলিকে বাঁচিয়ে রাখা দরকার,  দরকার এইসব লড়াকু মানুষগুলোর পাশে  সবরকম সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া।

মানব সভ্যতা ধ্বংসের কিনারায়:

এক ভয়ঙ্কর ভবিষ্যতের মুখোমুখি হতে চলেছি আমরা, মানবসভ্যতা আজ ধ্বংসের গভীর খাদের কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছে। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের ছাড়পত্রে পরিবেশ বিপর্যয়কারী চালু থাকা ও আগামী দিনের নানাবিধ প্রকল্পগুলোর প্রতিটির সাথে পরতে পরতে অঙ্গাগীভাবে যুক্ত হয়ে রয়েছে ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ের রোজনামচা। যোশীমঠ সহ উত্তরাখণ্ডের হিমালয়ের বিস্তীর্ণ অংশে হড়পা বান-ফাটল-ধস, কুলু-মানালি-শিমলা সহ হিমাচলের ব্যাপক অংশের বিপর্যয়, হাজার হাজার বিপন্ন পরিবেশ- উদ্বাস্তু মানুষের স্রোত, লক্ষ হেক্টর কৃষিজমি – বসতবাড়ি জলের তলায় তলিয়ে যাওয়া, চাষের সংকট-কৃষকদের সর্বনাশ, গ্লোবাল ওয়ার্মিং – জলবায়ু পরিবর্তনের মতো পরিবেশ বিপর্যয়কারী সমস্ত ঘটনাগুলো একসূত্রে বাঁধা। আর ট্যুরিজম ইন্ডাস্ট্রির স্বার্থে, বাজারকে আরো প্রসারিত করার লক্ষ্যে, শহুরে নব্য টুরিস্ট

বাবুবিবিদের ক্ষণিকের আরাম বিলাস ব্যসন সরবরাহ করতে এবং তথাকথিত উন্নয়ন ও কর্পোরেটের আরো বিনিয়োগের লক্ষ্যে তছনছ করে দেওয়া হচ্ছে মৌসুমী বায়ুর আগমন সুনিশ্চিত করা, ভারত-নেপাল-তিব্বত সহ দক্ষিণ এশিয়ার পাহারাদার, নবীন ও এখনো ভঙ্গুর নৈসর্গিক হিমালয়কে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় হিমালয়ের অপরিসীম গুরুত্ব উপেক্ষা করে কতিপয় বর্বর মানুষ তাদের পাহাড় প্রমাণ লোভ লালসা চরিতার্থ করতে ধ্বংসযজ্ঞের খেলায় মত্ত। পাহাড় ফাটিয়ে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে নদীর স্বাভাবিক গতিপথ রুদ্ধ/ বদল করে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প সহ উন্নয়নের নানান ধারায় পরিব্যাপ্ত এই ধ্বংসযজ্ঞ। উৎপন্ন বিদ্যুৎ বেশি দামে প্রতিবেশী দেশে বিক্রি হয়ে গেলেও স্থানীয় মানুষের কল্যাণে তা লাগে না। কিন্তু তার দায় বহন করতে হয় পিছিয়ে পড়া প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকেই। হিমালয় থেকে উৎসারিত অলকানন্দা, ধৌলি, গঙ্গা সহ বড় নদীগুলো আজ মরানপন্ন। শহরের দূষণ আর আবর্জনার পাহাড়ে ছোট ছোট শাখা নদীগুলো শুকিয়ে জীর্ণ শীর্ণ মৃতপ্রায়। তাই অবিরল নির্মল গঙ্গার দাবিতে সরকারের অদূরদর্শিতার বিরুদ্ধে মাতৃসদনের সাধুসন্তদের লড়াইয়ে নামতে হয়, আমরণ অনশনের পথ বেছে নিতে হয়, নদীর জন্য শহীদ হতে হয়।

আকরিক উত্তোলন ও পরিবেশ বিনষ্টি:

মাটির নীচে যুগ যুগ ধরে সঞ্চিত অমূল্য প্রাকৃতিক সম্পদ উত্তোলনের হাত ধরে সমাজ সত্যিকার অর্থে কতটা এগোয়, মানুষ আরও কতটা সভ্য হয়, সেসব প্রশ্ন ইতিউতি উঠতেও শুরু করেছে। সব গিলে খাওয়া উড়নচণ্ডী উন্নয়নের অজুহাতে প্রকৃতি নিধনের এইসব কর্মকাণ্ড দুরন্ত গতিতে এগোতে থাকলে, তা কী নিদারুণ পরিনাম ডেকে আনে তা বিপর্যস্ত বিধ্বস্ত অঞ্চলের অধিবাসীরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। অসম ও উত্তরবঙ্গে বিগত কয়েক মাস ধরে দফায় দফায় তুমুল বৃষ্টি, প্রবল বন্যা, বিপদসীমা পেরিয়ে ব্রহ্মপুত্র, মহানন্দা, তিস্তা, তোর্সা, জলঢাকা, রায়ডাকের ভয়ঙ্কর গর্জনে উত্তরবঙ্গের এক বড় অংশের জনগণের জীবন জীবিকা বিপর্যস্ত। উত্তরাখণ্ড থেকে হিমাচল পেরিয়ে প্রকৃতির রুদ্ররোষ ভীষণ ভয়ঙ্কর রূপে আছড়ে পড়লো সিকিমে তিস্তার উপর কয়েকশ প্রাণের বিনিময়ে, হাজার হাজার মানুষকে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করে।

আসলে, চারপাশের প্রকৃতি পরিবেশকে তার নিজস্বতায় রক্ষা না করলে আমাদের কারোর রেহাই নেই। বন্যায় ভেসে, তাপপ্রবাহে দগ্ধ হতে হতে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে খাদ্যশস্যের ফলন কম হওয়ার হাত ধরে তীব্র খাদ্যসংকট ও জলকষ্টকে সাথী করে দিন গুজরান করতে হবে: এই অমোঘ বাণী ঘাড় ধরে এবার শুনিয়ে যাচ্ছে রুষ্ট প্রকৃতি। তবুও বুলেট ট্রেনের স্পিডে এগিয়ে যেতে থাকে উন্নয়ন নগরায়ন-পুঁজির পুনরুৎপাদন-বাজার-ব্যবসা বাণিজ্য-মুনাফার সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ। এইসব অমানবিক অবৈজ্ঞানিক পদক্ষেপকে বাধাহীন মসৃণ সড়কে তরতর করে এগিয়ে নিয়ে যেতেই পরিবেশ আইনের পরিবর্তন। পরিবর্তনগুলো লক্ষ্য করলেই পাঠক নিশ্চিত হবেন, বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকারের কর্পোরেট-ভঝা রাজনীতির সাথে আজকের পরিবেশ নীতি, মনিপুর-কাশ্মীরে অস্থিরতা তৈরি, দেশজুড়ে বিভেদ বিভাজন বাড়িয়ে তোলা: সবকিছু দক্ষ শিল্পীর নিখুঁত টানে এক ফ্রেমে বাঁধা। তাই আমরা যখন শারদোৎসব আলোর বন্যায় ভাসি, তখন সিকিমের শতশত মানুষের লাশ ভেসে যায় তিস্তার জলে। দেশের উচ্চবিত্ত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় যখন দীপাবলি বা বিশ্বকাপ ক্রিকেটের উন্মাদনায় বুঁদ হয়ে থাকে, সেই সময় বিগত নয় দিন ধরে উত্তরকাশির নির্মীয়মান উন্নয়নের সুড়ঙ্গের গহীন অন্ধকারে ৪১ জন নির্দোষ শ্রমিক মৃত্যুর প্রতীক্ষায় দিন গোনেন। এটাই আমার দেশ!

২৫শে জুলাই ২০২৩ সংসদে দুটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশ আইনের সংশোধনী বিল কেবলমাত্র ধ্বনিভোটে পাশ করিয়ে নেওয়া হলো  সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে। বন সংরক্ষণ সংশোধনী বিল ও জৈববৈচিত্র্য সংশোধনী বিল, ২০২১: পাশ করিয়ে নিয়ে আইনিভাবে যেটুকু যা বিধিনিষেধ ছিল, সেটাও তুলে দিয়ে আদিবাসী জনজাতির জঙ্গলের উপর অধিকার কেড়ে নিয়ে বাস্তবত তাঁদের উচ্ছেদ করে পাহাড় জঙ্গল ও আকরিক লুঠের অবাধ ছাড়পত্র দেওয়া হলো পেয়ারের কতিপয় বিগ কর্পোরেট হাউসকে। অরণ্য আইনের সংশোধনী বিলের মধ্য দিয়ে সুপ্রিমকোর্ট নির্ধারিত অরণ্যের সংজ্ঞা পরিবর্তন করে বেশ কিছু অরণ্যকে ব্যক্তি মালিকানার আওতায় ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হলো। স্বভাবতই অসংরক্ষিত বনাঞ্চলে আদিবাসী- বনবাসীদের অরণ্য-অধিকার খর্ব হতে বাধ্য। বাস্তবত দেশের অরণ্য ও জৈবিক সম্পদ বহুজাতিকদের সামনে উন্মুক্ত করে সমস্ত প্রাকৃতিক উত্তরাধিকারের সাথে জৈবিক সম্পদ সম্পর্কিত জ্ঞান বা মেধা সম্পত্তিরও অবাধ লুঠের ছাড়পত্র দেওয়া হলো।

কোন পথ বেছে নেব আমরা?

এতকিছু সত্ত্বেও জীবন জীবিকার স্বার্থে, পরিবেশ রক্ষার স্বার্থে, বনজ সম্পদ রক্ষা করার স্বার্থে লড়াকু মানুষগুলো কথা না শুনলে, লড়াইকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রের পোষা গুন্ডাবাহিনী তো রয়েছে। ওদের আর এক বড়ো সহায় পন্যসর্বস্ব ভোগবাদী জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত বাজার ও মুনাফার সূক্ষ্ম জালের ফাঁদে মনন -মগজ-মস্তিষ্ক বন্ধক রাখা এক বড় অংশের মধ্যবিত্ত জনগণের সীমাহীন নিষ্ক্রিয়তা, আন্দোলনের প্রতি অবজ্ঞা অবহেলা, আন্দোলনকারীদের প্রতি চরম উদাসীনতা। আমাদের সামনে এখন দুটো পথ খোলা: এই বীভৎস ভয়ঙ্কর পথের শরিক ও শিকার হয়ে দেশ তথা মানবসভ্যতাকে ধ্বংসের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া। অন্য পথ হলো: মানুষের নূন্যতম প্রয়োজন মেটাতে প্রকৃতির ভারসাম্যকে নষ্ট না করে, বিপর্যস্ত বিনষ্ট করে দেওয়া প্রকৃতি পরিবেশ মেরামতির দাবিতে, প্রকৃতির পুনরুদ্ধার ও পুনরুৎপাদনের কাজে সকলের ঐক্যবদ্ধ মিলিত প্রয়াসে মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে সঠিক দিশায় বিজ্ঞান প্রযুক্তির যুক্তিযুক্ত ব্যবহারে মানবতা ও সমাজ বিকাশের কাজে হাত লাগানো, চলমান আন্দোলন গুলোর সাথে পা মেলানো, লড়াকু মানুষগুলোর হাতে হাত রেখে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া।

‘কোন পথ সাথী, কোন পথ বেছে নিবি বল’?