গত ৭ই অক্টোবর শনিবার, প্যালেস্তাইনের গাজা উপত্যকার শাসনকারী হামাস -এর যোদ্ধারা আচমকা ইসরায়েলের ভিতরে ঢুকে আক্রমণ চালায় যাতে প্রায় ১২০০ নাগরিক নিহত হয় এবং অনেক ইসরায়েলীয়কে হামাসের বাহিনী বন্দী করে গাজায় নিয়ে চলে আসে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ইসরায়েল জবাবী বিমান হামলা শুরু করে এবং ৯ই অক্টোবর সরকারী ভাবে প্যালেস্তাইনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। যদিও ১৫ই অক্টোবর তারিখের পর থেকে আজ পর্যন্ত অর্থাত্ ২৯ দিন ধরে নিজেদের আত্মরক্ষার যুক্তি সামনে রেখে ইসরায়েল যা করে চলেছে তাকে মোটেও যুদ্ধ বলা যায় না, – এটা হলো সম্পূর্ণ ভাবে “গনহত্যা”।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু যুদ্ধ ঘোষণা করার সময়ই উল্লেখ করেছেন যে, “মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র বদলে দেওয়া হবে”। অর্থাত্ এইরকম চরম পরিকল্পনা আগে থেকেই করা ছিল।
১৯১৭ সাল থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত প্যালেস্তাইনের জমির দখলকারী নিয়ন্ত্রক ছিল ব্রিটেন। আর বিগত ১৯১৭ সালে নভেম্বরে তুরস্ক সেনাদের হটিয়ে জেরুজালেমের দখল নেয় ব্রিটিশরা। মূলত: আরব জনগোষ্ঠীদের কথা মাথায় না রেখে এক তরফা ভাবে প্যালেস্তাইনের জমিতে ইহুদীদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গঠনে সাহায্য করবার কথা জানিয়ে সেই সময়ের ব্রিটেনের পররাষ্ট্র সচিব লর্ড আর্থার জেমস বেলফোর, ইহুদী আন্দোলনের নেতা লর্ড ব্যারন রথসচাইল্ডকে একটি চিঠি দেন, যা “বেলফোর ডিকলারেশন” নামে চিহ্নিত।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৭ সালে প্যালেস্তিনীয়দের নিজ জমিতে রাষ্ট্রসংঘ দুটি রাষ্ট্র তৈরী করার সিদ্ধান্ত নেয়। ইহুদীরা নামমাত্র জমির দখলকারী হলেও তাদের মোট জমির ৫০% অধিকার দিয়ে দেওয়া হয় এবং বিপুল সংখ্যক প্যালেস্তিনীয়দের জন্য বরাদ্দ করা হয় বাকী অর্ধেক। স্বাভাবিক ভাবেই আরবরা রাষ্ট্রসংঘের এই সিদ্ধান্ত মেনে নেয়নি।
পরবর্তীতে মুসলমান, খৃষ্টান ও ইহুদী সকলের জন্য পবিত্র স্থান জেরুজালেমের দখল নেওয়ার জন্য প্রত্যকেই চেষ্টা করতে থাকে। ১৯৪৭ সালের শেষ দিক থেকে লড়াই শুরু হয়; ১৯৪৮ সালের মার্চ থেকে ইহুদীরা, আরবদের উপর নৃশংস আক্রমণ চালাতে থাকলে আরবরা প্যালেস্তাইনে তাঁদের নিজ বাসভূমি ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। ১৯৪৮ সালের ১৪ই মে ব্রিটিশরা প্যালেস্তাইন ছেড়ে চলে গেলে সেইরাতেই ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্ম হয়। যুদ্ধ চলতে থাকে। এরপর বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা ইহুদীরা, আদি ভূমিপুত্র প্যালেস্তিনীয়দের সরিয়ে ইসরায়েলের দখলীকৃত জায়গাগুলিতে এসে বসতি স্থাপন করতে শুরু করেন।
সামরিক কৌশলগত দিক থেকে আমেরিকা আরব দুনিয়ায় তাদের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য, আবার খনিজ তেল ও অন্যান্য পদার্থের উপর তাদের দখল বজায় রাখার জন্য ব্রিটিশরা, ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনে উদ্যোগী হয়ে ছিল। নিজভূমে পরবাসী প্যালেস্তিনীয়দের উপর ৭৫ বছর ধরে ইসরায়েলের দখলদারী সামরিক আক্রমণকে আরব ও মুসলিম দুনিয়া বাদে প্রায় সব দেশ মান্যতা দেওয়ার চেষ্টা করে গেছে।
বিগত ২০০৭ সাল থেকে ১৬ বছর ধরে ৪১ কিলোমিটার লম্বা ও কমবেশী ১০ কিলোমিটার চওড়া গাজা স্ট্রিপকে ইসরায়েল ও মিশর স্থল, জল এবং আকাশপথে সামরিক বেষ্টনী দিয়ে অবরুদ্ধ করে রেখেছে। প্রায় ৭৫% প্যালেস্তাইনের জমি দখল করে রেখেছে, নির্বিচারে মানুষ মেরে চলেছে। গণতন্ত্র, নাগরিক অধিকার, ইত্যাদি কোনো কিছুর বিন্দুমাত্র অস্তিত্ব নেই।
৭ই অক্টোবর থেকে ১২ই নভেম্বর তারিখ পর্যন্ত গত ৩৭ দিনে এখনো পর্যন্ত ইসরায়েলের প্রায় ১৪০০ জন নাগরিক হত হয়েছেন এবং ৫৬০০ জন আহত হয়েছেন (প্রথম দিনের আচমকা আক্রমণ ধরে)।
ইসরায়েলী বাহিনীর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী,- “প্রথম ৬ দিনে গাজাতে প্রতি ঘণ্টায় ৪২টি বোমা ফেলা হয়েছে, ১৫ জনকে হত্যা করা হয়েছে, ৩৫ জন আহত হয়েছে, ১২টি করে বাড়ী ধ্বংস করা হয়েছে”। গত ৩৭ দিন ধরে ইসরায়েলের সমর বাহিনীর আকাশ, জল ও স্থলপথের অবিরাম আক্রমণে এখনো পর্যন্ত কমপক্ষে ১১০০০ জন প্যালেস্তিনীয় নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে এবং ২৭৫০০ জন আহত হয়েছেন, যার মধ্যে ২০% শিশু, কয়েক লক্ষ মানুষ তাঁদের নিজেদের আবাস ছেড়ে পরিবার পরিজন নিয়ে প্রাণ বাঁচাতে দক্ষিণ গাজার দিকে সরে যেতে বাধ্য হচ্ছেন, যদিও তাতে নিস্তার পাচ্ছেন না, রাস্তাতেও আক্রমনের মুখে পড়ছেন। বিদ্যালয়, হাসপাতাল, রাষ্ট্রসংঘের বাড়ী, ইত্যাদি সব কিছুর উপর আছড়ে পরছে ইসরায়েলীয় বোমা।
আমাদের ঘরের বালক-কিশোর-তরুন-যুবকরা কম্পিউটারে এফ.পি.এস. (ফার্স্ট পার্সন শ্যুটার) বিভাগের অন্তর্গত কল অফ ডিউটি, ভ্যালোরেন্ট, ইত্যাদি মারনাস্ত্র দিয়ে অন্যকে খুন করার অবাস্তব খেলায় মগ্ন। ফলে যখন বাস্তবে এই ভয়ংকর ঘটনা ঘটে চলেছে আর প্যালেস্তাইনের গাজা স্ট্রিপের, ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের, জলসহ খনিজ তেল ও অন্যান্য পদার্থ আহরণ ও ব্যবহার করে শুধুমাত্র মুনাফা ও আরো মুনাফার লক্ষ্যে প্রকৃতি-পরিবেশের উপর দখল নেওয়ার জন্য বিশ্বের সরকারী মদতপুষ্ট কর্পোরেট সংস্থাগুলি তাদের টাকায় চলা দূরদর্শনের বিভিন্ন চ্যানেলে ইসরায়েলের এই ঘৃণ্য আক্রমনের পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে ব্যস্ত; তখন পর্দায় রক্ত দেখতে, খুন করতে অভ্যস্ত এই প্রজন্মের মনে তা আর কোনো অনুরণন তুলছে না।
খেলার খবর, রাজনৈতিক নেতা-মন্ত্রীদের অন্যায়, খবরের কাগজের প্রথম পাতায় স্থান পাচ্ছে আর ইসরায়েলের হামলায় প্যালেস্তাইনে শিশুসহ কত মানুষ মারা গেল তার প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে ৬নং বা ৭নং পাতায়। গাজা স্ট্রিপে ঘটে চলা ঘটনা যদি আমাদের এবং পরিবারের সঙ্গে হত তখনো কি আমরা নীরব থাকতে পারতাম? প্রশ্ন উঠে আসছে আমাদের নিজেদের মধ্যে বিবেকবোধ, সংবেদনশীলতা, মানবতা, ইত্যাদি বিষয়গুলি আদৌ আর বজায় আছে কিনা। আমরা দি ডিগ্রোথের পক্ষ থেকে সময়ের দাবী মেনে স্প্ষ্টভাবে সোচ্চারে প্যালেস্তাইনের সাধারণ বাসিন্দাদের উপর ইসরায়েলের এই নারকীয় দখলদারী হামলা এবং গণহত্যার বিরোধীতা করছি এবং নিন্দা করছি।
পিডিএফ ডাউনলোড করুন
https://thedegrowth.com/wp-content/uploads/2023/11/যুদ্ধ-নয়-গণহত্যা.pdf