শীতকাল ফিরে এলো। এবং তার সাথেই ফিরে এলো উৎসবের মরশুম। কালীপুজো, দিওয়ালি, নিউ ইয়ারের মরশুম। এবং নানান রং বেরঙের বাজি এর মরশুম।
বেশ কিছু বছর এই বাজি ফাটিয়ে উদযাপনের মানসিকতা কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে পরিবেশবিদ এবং পরিবেশ সচেতন মানুষের একাংশের মনে। এমনটা দেখা গেছে যে বাজির মধ্যে ব্যবহৃত মশলায় নানান রাসায়নিক যৌগ জীব জগতের জন্য সমূহ ক্ষতি ডেকে আনে। বাজির মধ্যে ব্যবহৃত সালফার এবং নানান নাইট্রোজেন যৌগ আগুনে পুড়ে তৈরি করে বিভিন্ন রকমের গ্যাস যেগুলো জীবজগৎ, গাছপালা এবং পরিবেশের উপর প্রভূত চাপ সৃষ্টি করছে। শব্দ বাজির ব্যাপক আওয়াজ থেকে হৃদযন্ত্রের উপর প্রভাব এবং এই বিষাক্ত গ্যাস থেকে শ্বাসকষ্ট জনিত সমস্যা উত্তরোত্তর বাড়তে দেখা যাচ্ছে। মানুষের উপর বাজির কি প্রভাব সেটা বোঝার খুব সহজ একটা কেস স্টাডি হিসেবে আমরা দিল্লিকে দেখতে পারি। গোটা ডিসেম্বর এবং জানুয়ারি জুড়ে বাতাসের PM এবং সামগ্রিক AQI (এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স) – এর পতন দেখে বাজির কুপ্রভাব সম্পর্কে আর সন্দেহের অবকাশ থাকে না। এই সমস্ত ঘটনার মাঝে সবচেয়ে দুঃখজনক বোধহয় এটাই যে উৎসবের মরশুমে আমরা বোধহয় সবচেয়ে আনন্দ পাই আমাদের বাড়ির কচিকাঁচাদের আনন্দ থেকে। তাদের আনন্দের জন্যই রং বেরঙের তারাবাতি, চরকি, রঙমশালের মত বাজি নিয়ে আসি। অথচ বাজির থেকে নিষ্কৃত সালফার ডাইঅক্সাইডের মত গ্যাস বাতাসের থেকে ভারী হওয়ায় মাটির খুব কাছাকাছি ঘোরাফেরা করে। এবং বয়স জনিত কারণে উচ্চতা কম হওয়ায় এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় ছোটদের।
পরিবেশের উপর বাজির কুপ্রভাব নিয়ে আর নতুন করে কিছু বলার নেই। বায়ু দূষণ, শব্দ দূষণের পাশাপাশি বাজির প্যাকেজিং থেকে প্লাস্টিক দূষণ, জল দূষণ একেবারে গা সওয়া ঘটনা হয়ে গেছে মানুষের কাছে। বাজির আওয়াজে মৃত পাখিদের দেহ প্রতিবছরই খুব করুন খবর হিসাবে নানান মিডিয়ায় উঠে আসে এই উৎসবের পর পরই। শহরের ইকোসিস্টেম বলতে যেটুকু প্রাণী এবং গাছপালা বেঁচে আছে, তাদেরও অনেক ক্ষয়ক্ষতি এবং প্রাণহানি এই নির্দিষ্ট কিছু রাতেই হয়ে যায়।
বাজি নিয়ে কথা বলতে গেলে একটা দিক বারবারই আমাদের নজর এড়িয়ে যায়। সেটা হলো বাজি উৎপাদন এবং এই শিল্পের সাথে যুক্ত শ্রমিক। বাজিনির্মাণ কারখানায় না থাকে উপযুক্ত অগ্নিসুরক্ষা ব্যবস্থা, না থাকে স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থা। প্রচন্ড ঝুঁকিপূর্ন একটা কাজের মধ্যে বাধ্য হয়ে জুড়ে আছেন বহু মানুষ। এবং দুর্ঘটনা এখানে নিত্যদিনের সঙ্গী। বারুদ ফেটে হাতের আঙুল, হাত, পা উড়ে যাওয়া খুবই চলতি ঘটনা এই শিল্পে। তার সাথে আছে দীর্ঘদিন বাজি নির্মাণের ফলে শ্বাস এবং ত্বকের সমস্যা। তাই বাজি নিষিদ্ধ করার পক্ষে দাঁড়ালে আমাদের দায় বর্তায় এই বাজি শ্রমিকদের বিকল্প কর্মসংস্থানের এবং তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার দাবি জানানো।
গতকাল বিপ্লবী শিক্ষার্থী ঐক্য (আই এস ইউ), নদী বাঁচাও জীবন বাঁচাও আন্দোলন এবং থার্ড প্ল্যানেটের যৌথ ডাকে “বাজি উৎপাদন ও বাজি ব্যবহারের মানসিকতা” বিরোধী একটি সচেতনতামূলক পথসভা করা হয় বড়বাজারের ক্যানিং স্ট্রিট অঞ্চলে। উপস্থিত ছিলেন নদী বাঁচাও জীবন বাঁচাও আন্দোলনের পক্ষ থেকে সৌরভ, আই এস ইউর পক্ষ থেকে অরণি এবং অনুষ্ণা এবং থার্ড প্ল্যানেটের পক্ষ থেকে রাজিব এবং অনিমেষ। এছাড়া এসেছিলেন যাদবপুর বিশাবিদ্যালায়ের ছাত্রী সাইনা। পথসভা থেকে তিনটি দাবি আমরা রেখেছি:
১) বাজি উৎপাদন সম্পূর্ন বন্ধ করতে হবে।
২) বাজি উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত প্রান্তিক শ্রমিকদের বিকল্প কর্মসংস্থান এর ব্যবস্থা করা এবং অবিলম্বে তাদের স্বাস্থ্যের সুরক্ষার দিকে নজর দিতে হবে।
৩) গোটা জীব বৈচিত্র্যের কথা মাথায় রেখে সম্পূর্নভাবে বাজি পোড়ানো নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে।
পরিশেষে আরো একবার এটা মনে করিয়ে দিতে চাই। বাজি নিয়ে এই মামদোবাজি এই মুহূর্তে বন্ধ হোক!
আরও পড়ুন – মনিপুর – Kino-Eye