পাহাড়িগোড়া পাহাড়ের কথা

পাহাড়িগোড়া পাহাড়ের তিনদিক দিয়ে রাস্তা। এক রাস্তার পাশে এসে দাঁড়ায় বাস। আরেক রাস্তায় স্থানীয়দের চলাচল। “দাঁড়া এখন ডিনামাইট ব্লাস্ট হচ্ছে স্কুল যাবি না” ৯০ শতক থেকে এমন ভাবেই দাঁড়িয়ে পড়েছে কয়েক প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা। জানালো ধীরেন চন্দ্র মাহাতো ও কৃষ্ণপদ মাহাতো।

পাহাড়িগোড়া পাহাড়ের কথা

পুরুলিয়া জেলার পাড়া ব্লকের সাঁওতালডি থানার অন্তর্গত সিন্দুরপুর মৌজায় পাহাড়িগোড়া পাহাড় (জে.এল নং-৫৯, প্লট নং-৬৭৭)।

শীতের সময়ে মাঘের শুরুতে যখন পাহাড়ের গা থেকে সবুজ কমে আসে, পাহাড়ের লালচে ধূসর মূর্তির সময়ে হয় পাহাড়চন্ডির মেলা বা পাহাড়িগোড়ার মেলা। হাজার হাজার মানুষের সমাগম। মাহাতো ছাড়াও দূর দুরান্ত থেকে আসা মূলত আদিবাসী মানুষের শিল্প, সংস্কৃতির সমাহার, সমাগম। মাঠ জুড়ে বসে হাট। ধামসা, মাদল, বাঁশি এসবের তাল সুরে এইকটা দিন পাহাড়ের বুকে সভ্যতার খাতিরে ক্ষত তৈরীর বিকট আওয়াজ বন্ধ থাকে।

“পাহাড় ও পরিবেশ বাঁচাও” কমিটির সভা

ফোনে “পাহাড় ও পরিবেশ বাঁচাও” কমিটির একনিষ্ঠ কৃষ্ণপদ মাহাতো ও সভাপতি ধীরেন মাহাতো এর সঙ্গে কথা বলতে বলতে ভেসে উঠছিল বাংলা ছেড়ে ঝাড়খণ্ডে প্রবেশ করে আনাচে কানাচে হওয়া বহু ছোটো ছোটো মেলায় দিন কাটানোর চনমনে স্মৃতি। যৌথতা ও স্বতঃস্ফূর্ততার পূর্ণ না হলেও এখনও বেশ নিটোল রূপ সেসব জায়গায়। বড় বড় সাউন্ড সিস্টেমের সংস্কৃতি পৌঁছে গেছে সমস্ত জায়গায়। পোচই ও মহুয়ার সংস্কৃতির গন্ধ ফেলে ঢুকে পড়েছে সস্তার বিষ মদ। ইউটিউবে পাহাড়িগোড়া মেলার ভিডিও দেখছিলাম। পাহাড়িগোড়াও বোধহয় সেরকমই এক ক্ষেত্র পূর্ণ না হলেও নিটোল।  মনে পড়ছিল তিলাবনি পাহাড় বাঁচানোর জন্য স্থানীয় শিল্পী গান লিখেছিল “পাহাড়টাকে না বাঁচলে হবেক সর্বনাশ গো, তিলাবনী পাহাড় হামদো মিটায় বড় আশ রে…”। এই গান রেকর্ড করেছিলাম তিলাবননী পাহাড়ের সামনের মাঠে বসে। ধীরেন দা বললো, পাহাড় টাই না থাকলে পাহারিগোড়া নাম টা রেখে আর কী হবে ?

নবীন পাহাড় হিমালয়ের চূড়ো ছোঁয়ার কী ভীষণ হাতছানি। তবু তার রেহাই নেই। আর ভূখণ্ডের প্রবীণ পাহাড়গুলির বাহু বোধহয় অকেজো, ত্বকের জেল্লা চোখ কাড়ে না কিংবা শুধুই সম্পদের হাতছানি। পাহারিগোড়ার প্রবীণ বুকে ডিনামাইট ফাটিয়ে, পাথর বেঁচতে বেঁচতে বিরাট ক্ষত চিহ্নে জল ভরে একটি জলাশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। বাজারি পত্রিকা হলে পাথর খননের আগে ঠিক জুড়ে দিত ‘অবৈধ’ শব্দ। যে ব্যবস্থায় প্রশাসন বাপ ঠিক করে দেয় বৈধ ও অবৈধের মাপকাঠি।

এতদিনের খনন কার্যে প্রাণ গিয়েছে সাতজন প্রান্তিক শ্রমিকের। এ পাহাড় গবাদি পশুদেরও বিচরণ ক্ষেত্র। এই ধ্বংসলীলায় পাহাড়ের বুক হয়ে উঠেছে সেসব পশুদের ক্ষেত্রে অচেনা। মারা পড়েছে তারাও। বহু দিন ধরে ব্যাহত হয়েছে পাহাড়ের উপরে উপাসনা স্থলে নিত্য আনাগোনা। বছর খানেক বন্ধ আছে খনন, ডিনামাইট ব্লাস্ট, পাথর বেঁচা।

পাহাড়িগোড়া পাহাড়ের কথা

কৃষ্ণপদ দা জানালেন ধীরে ধীরে আগের চেহারায় ফিরছে পাহাড়, পাহাড়ের উপর গাছপালা পশুপাখিদের আনাগোনা। আবার দেখা যাচ্ছে হায়না, নেকড়ে, শিয়াল।”পাহাড় ও পরিবেশ বাঁচাও” কমিটির উদ্যোগে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচী ও শুরু হয়েছে। এমনই দেখতে চাই আমরা এই পাহাড়কে, একসঙ্গে বললো কৃষ্ণপদ ও ধীরেন।

ষাট একর এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এই পাহাড় রায়তি সম্পত্তি। স্থানীয়রা আশঙ্কা করছেন আবার পাহাড় কাটার কাজ শুরু হবে। কলকাতা হাইকোর্টে মামলাও দায়ের হয়েছে। এই সমস্যা থেকে পুরোপুরি মুক্তি পাওয়ার জন্য তারা দাবী রেখেছেন এই পাহাড় কে ঘিরে পর্যটন শিল্প গড়ে তোলার। এতে করে রোজগারও তৈরী হবে স্থানীয় মানুষদের।

এসব কিছুর পরে যে সম্ভাবনা থেকে যায় বা যে প্রশ্নগুলি জুড়ে রাখা দরকার, পর্যটন শিল্প কে স্রেফ মুনাফার চোখে না দেখে ও এই শিল্প কে জীববৈচিত্র্য বিরোধী করে গড়ে না তোলার কতটা সদিচ্ছা প্রশাসন দেখাবে! পাহারগোড়ার পাশাপাশি তিলাবনী, পাঞ্জনিয়া, বেরো গ্রামের চন্ডী পাহাড় ও ঠুরগার উপর নেমে আসা লুঠ এবং শোষণের পাকাপাকি ইতি টানুক প্রশাসন।

ছবি সংগৃহীত

আরও পড়ুন – মনিপুর – Kino-Eye