১. ভূমিকা – সামুদ্রিক তিমি পরিবারের অন্তর্গত গাঙ্গেয় ডলফিন (নদীর ডলফিন), ভারত, নেপাল এবং বাংলাদেশের গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা এবং কর্ণফুল্লি নদী ও উপনদীতে পাওয়া জলজ স্তন্যপায়ী প্রাণীর একটি বিপন্ন প্রজাতি। গাঙ্গেয় ডলফিন প্লাটানিস্টা গাঙ্গেটিকা গাঙ্গেটিকা, (Platanista gangetica gangetica) ভারতে সোঁস (হিন্দি), শুশুক/শিশুক (বাংলা) বা হিহু (আসাম) নামেও পরিচিত। ভিন্ন প্রকারের তিমি, সামুদ্রিক ডলফিন এবং পরপইসের মত গাঙ্গেয় ডলফিনও, স্তন্যপায়ী – প্রাণী এবং শ্রেণিবিন্যাসের সিটেসিয়া (Cetacea) শ্রেণীর অন্তর্গত।
সিটেসিয়া (Cetacea) শ্রেণীতে ৩টি উপশ্রেণী রয়েছে-
১. আর্কিওসেটি (Archeoceti) (বিলুপ্ত)
২. মিস্টিসেটি (Mysticeti) (দন্তহীন)
৩. ওডোন্টসেটি (Odontoceti) (দন্তযুক্ত)
পৃথিবীতে ১৪ প্রজাতির দাঁতহীন সিটেসিয়া এবং ৭৪ প্রজাতির দাঁতযুক্ত সিটেসিয়া পাওয়া যায়। গাঙ্গেয় শুশুক সেরকমই একটি একটি দাঁতযুক্ত সিটেসিয়ান যা ডলফিন প্রজাতির অন্তর্গত। সিটেসিয়ার মোট ৮৮ টি প্রজাতির মধ্যে ৪১ টি প্রজাতি ডলফিনের অন্তর্গত। বেশিরভাগ ডলফিনই নোনা জলে/ সমুদ্রে পাওয়া যায়, তবে কিছু প্রজাতি নদীতে (মিষ্টি জলে) পাওয়া যায় যার মধ্যে গাঙ্গেয় শুশুক অন্যতম। এই প্রাচীন প্রাণীটি প্রায় ১০ কোটি বছর ধরে এই পৃথিবীতে উপস্থিত রয়েছে।
১.১. মিষ্টি জলের ডলফিন প্রজাতি
৭৭ CE-এর দিকে প্লিনি দ্য এল্ডার তাঁর হিস্টোরিয়া ন্যাচারালিস পত্রিকায় গঙ্গা নদীতে বসবাসকারী ডলফিনদের নাম প্রকাশ করেছিলেন প্লাটানিস্টা (Platanista), যা নামকরণ করা প্রথম সিটাসিয়ানদের মধ্যে একটি এবং তারাই সুপারফ্যামিলি প্ল্যাটানিস্টোডিয়ার (Platanistoidea) একমাত্র বর্তমান সদস্য, যেটি ৩৪ থেকে ২৪ মিলিয়ন বছর আগে (অলিগোসিন যুগের Oligocene epoch) মধ্যে বিচ্যুত হওয়া প্রথম সিটাসিয়ান বংশগুলির মধ্যে একটি। এখনও অবধি, এই শ্রেণীতে শুধুমাত্র একটি একক অবশেষ প্রজাতি স্বীকৃত ছিল: দক্ষিণ এশিয়ার নদী ডলফিন যা দুটি ভৌগলিকভাবে পৃথক, এবং সংলগ্ন মিষ্টি জলের নদীতে অবস্থিত দুটি উপ-প্রজাতির সমন্বয়ে গঠিত।
ক) গাঙ্গেয় ডলফিন বা শুশুক (প্লাটানিস্টা গাঙ্গেটিকা) (Platanista gangetica) – এই বিপন্ন প্রজাতিটি ভারত, নেপাল এবং বাংলাদেশের গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা এবং কর্ণফুল্লি নদী ও উপনদীতে পাওয়া যায়।
খ) সিন্ধু নদীর ডলফিন (প্লাটানিস্টা গাঙ্গেটিকা মাইনর) (Platanista gangetica minor) – এই প্রজাতিটি পাকিস্তানের সিন্ধু নদী এবং ভারতবর্ষে সিন্ধু নদীর উপনদী পাঞ্জাবের বিয়াস এবং সুতলজ নদীতে বিচরণ করে
গাঙ্গেয় ডলফিন বা শুশুক এবং সিন্ধু নদীর ডলফিনকে ১৯৯৮ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত, একটি একক উপ-প্রজাতির বিভাগে রাখা হলেও ব্রাউলিক ২০২১ সালে প্রকাশিত মেরিন ম্যামাল সায়েন্স জার্নালে তার নতুন গবেষণায় প্রমাণ করেন যে সিন্ধু এবং গঙ্গা নদীর ডলফিনের মধ্যে স্পষ্ট জিনগত পার্থক্যর সাথে সাথে দাঁতের সংখ্যা, শরীরের রঙ, বৃদ্ধির ধরণ এবং মাথার খুলির আকারেরও পার্থক্য রয়েছে। যার ফলে দক্ষিণ এশীয় নদী ডলফিনের দুটি উপ-প্রজাতি, সিন্ধু নদীর ডলফিন (প্ল্যাটানিস্তা গ্যাঙ্গেটিকা মাইনর) (Platanista gangetica minor) এবং গঙ্গা নদীর ডলফিন (প্ল্যাটানিস্তা গ্যাঙ্গেটিকা গাঙ্গেটিকা) (Platanista gangetica gangetica) – প্রতিটিকে আলাদা পূর্ণ এবং ভিন্ন প্রজাতি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
গ) ইয়াংজি (Yangtze) নদীর ডলফিন বা ‘বাইজি’ (Baiji) (লিপোটস ভেক্সিলিফার) (Lipotes vexillifer) – এই প্রজাতিটি পূর্বে চীনের ইয়াংজি (Yangtze) নদীতে পাওয়া গেলেও, মাত্রাতিরিক্ত মাছ ধরা ও দুর্ঘটনাজনিতভাবে বারংবার জালে ধরা পরার ফলে এই প্রাণীটি ২০০৬ সালে পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায়।
ঘ) আমাজন নদীর ডলফিন বা ‘বোটো’ (Boto) (ইনিয়া জিওফ্রেনসিস) (Inia geoffrensis)- এই প্রজাতিটি দক্ষিণ আমেরিকার অরিনোকো, আমাজন নদী অববাহিকায় পাওয়া যায়।
ঙ) (Franciscana) ফ্রান্সিসকানা নদীর ডলফিন বা ‘লা প্লাটা’ (La Plata) (পন্টপোরিয়া ব্লেইনভিল্লেই) (Pontoporia blainvillei) – এই মিষ্টি জলের ডলফিন প্রজাতিটি দক্ষিণ-পূর্ব ও দক্ষিণ আমেরিকার উপকূলীয় আটলান্টিক জলে পাওয়া যায়। এটি একমাত্র নদীর ডলফিন গোষ্ঠীর সদস্য যেটি একচেটিয়াভাবে মিষ্টি নদীর জলে বসবাস করার পরিবর্তে সমুদ্র এবং নোনা জলের মোহনায় বাস করে।
২. পুরাণ ও ইতিহাসের পাতায় গাঙ্গেয় শুশুক
শ্রীমদ্ভাগবদগীতার ১০ নং অধ্যায়ের ৩১ তম শ্লোকে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন যে “আমি শুদ্ধিকরণের বায়ু, যোদ্ধাদের মধ্যে আমি রাম, মাছেদের মধ্যে আমি হাঙর আর নদীর মধ্যে আমি গঙ্গা”। জার্মান ভাষায় হাঙ্গরকে ডলফিন বলা হয়। পৌরাণিক কাহিনীতে, গঙ্গা যখন স্বর্গ থেকে পৃথিবীতে নেমেছিলেন, তখন তিনি মাছ, ব্যাঙ, কচ্ছপ ইত্যাদির পাশাপাশি গাঙ্গেয় শুশুককেও নিয়ে এসেছিলেন। সুতরাং পৌরাণিক মতে গাঙ্গেয় শুশুককে ভগবান শিবের বার্তাবাহক হিসাবে দেখা হয়।
মুঘল সাম্রাজ্যের প্রথম সম্রাট বাবরের আত্মজীবনীমূলক বাবরনামা বা তুজক-ই-বাউরিতেও গাঙ্গেয় শুশুকের বর্ণনা পাওয়া যায়। ১৫০০ খ্রিস্টাব্দে “বাবরনামা” য় “জল-হগ সমস্ত হিন্দুস্তানের নদীতে রয়েছে” উক্তিটিতে “সমস্ত হিন্দুস্তানের নদী” দ্বারা, বাবর সম্ভবত উত্তর ভারতের নদীগুলোর কথা বলছিলেন, যেখানে তিনি ভ্রমণরত অবস্থায় গাঙ্গেয় শুশুকের উপস্তিতি লক্ষ্য করেছিলেন।
ভারত শুরু থেকেই বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে অগ্রণী। বিশ্বের প্রথম বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ভারতে পাওয়া যায়, মহান সম্রাট অশোকের রাজত্বে (২৭৪-২৩২ খ্রিস্টপূর্ব)। গাঙ্গেয় শুশুক সংরক্ষণের জন্য প্রামাণিক উল্লেখ পাওয়া যায় অশোক স্তম্ভের এডিক্টের ৫ তম আদেশে যেখানে উল্লেখ আছে যে, সম্রাট অশোক যখন ২৬ বছরে পদার্পণ করেন, তখন তিনি একটি আদেশ দ্বারা কিছু বন্যপ্রাণী শিকার নিষিদ্ধ করেছিলেন যার মধ্যে ‘বেদব্যাকস পুপুতকা’-র (গাঙ্গেয় শুশুক) উল্লেখ আছে। প্রাকৃত ভাষায়, ‘পুপুতকা’ বলতে গাঙ্গেয় শুশুককেই বোঝায়।
৩. জীববিদ্যা এবং বাস্তুবিদ্যা
গঙ্গা নদীর ডলফিন বা শুশুক সাধারণত ধূসর বা হালকা বাদামী রঙের হয়, তবে পেটে নীচের অংশে গোলাপি আভাও থাকতে পারে। পৃষ্ঠীয় পাখনা (Dorsal Fin) খুবই ছোট, এবং এটি পিঠের একটি নিম্ন মাংসল পিণ্ড, যা সাধারণত উচ্চতায় মাত্র কয়েক সেন্টিমিটার। ডলফিনদের একটি খাড়া কপাল, এবং নমনীয় ঘাড় থাকে যা কশেরুকার (Vertebrae) সাথে অসংযুক্ত ফলে তারা তাদের মাথা এদিক ওদিক ঘোরাতে সক্ষম হয়। তাদের একটি প্রসারিত চঞ্চু (Snout) রয়েছে যা কিছুটা উপরের দিকে বাঁকতে পারে। এটি মহিলাদের শরীরের মোট দৈর্ঘ্যের ২0% পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। এদের লম্বা, ধারালো দাঁত (Teeth) (মোট ১২৫ থেকে ১৩০ টি) থাকে যা মুখ বন্ধ থাকলেও দেখা যায়। শরীরের পাশের পেক্টোরাল ফ্লিপারগুলি (Flippers) বড় এবং প্যাডেল আকৃতির।
গাঙ্গেয় শুশুকের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল যে তাদের ক্ষুদ্র অপিরিণত চোখ (Rudimentary Eye) দিয়ে তারা কেবল আলো এবং অন্ধকারের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে এজন্য এদের ‘ব্লাইন্ড ডলফিন’ও (Blind Dolphin) বলা হয়। এটা বিশ্বাস করা হয় যে গঙ্গা নদীর জলের অস্বচ্ছতার কারণে, বিবর্তনের প্রক্রিয়া চলাকালীন, এই প্রজাতিটি তাদের দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছিল। বেঁচে থাকার বিষয়টি মূলত তাদের শ্রবণশক্তির উপর নির্ভর করে। নদীর ঘোলা জলে শুধুমাত্র চলাফেরার জন্যই নয় বরং খাদ্যগ্রহণ এবং অন্যান্য জীবনধারণের বৈশিষ্ট্যগুলির জন্য মূলত তারা অ্যাকোস্টিক/ধ্বনি তরঙ্গ যোগাযোগের (Acoustic Communication) উপর নির্ভর করে। গাঙ্গেয় শুশুক বিস্তৃত ফ্রিকোয়েন্সির শব্দ শুনতে পায় এবং ক্লিক/টিকটিক, বার্স্ট/ভোঁ, টুইটার/কিচিরমিচির (Clicks and Bursts) শব্দ সৃষ্টি করতে পারে যেগুলির ফ্রিকোয়েন্সি থাকে ১৫ থেকে ৬০ kHz এর মধ্যে। গাঙ্গেয় শুশুক সোনার এবং প্রতিধ্বনি নির্ধারণের (Sound Navigation & Ranging and Echolocation) মাধ্যমে তার আশেপাশের সকল জৈব এবং অজৈব পদার্থের সম্পূর্ণ আভাস লাভ করে।
৪. পছন্দের আবাস্থল
প্রধানত, গাঙ্গেয় শুশুক নদীর গভীর অংশে পাওয়া যায় এবং তারা দ্বীপ (Mid Channel Island), নদীর বাঁক (Meander) এবং দুটি নদীর মুখকে (Confluence) অর্থাৎ সঙ্গমস্থলকে তাদের প্রিয় আবাসস্থল বলে মনে করে যেখানে কাউন্টার এডি কারেন্ট (Eddy Current) তৈরি হয় এবং যা প্রায়শই এমন জায়গা যেখানে লোকেরা মাছ ধরতে পছন্দ করে, কারণ এই সকল জায়গায় পর্যাপ্ত পরিমাণে ডলফিনের খাবার অর্থাৎ মাছ পাওয়া যায়। সাধারণত দেখা গেছে খাবারের সন্ধানে তারাও অগভীর স্রোতের দিকে চলে যায়। যদিও এখন বাঁধ এবং ব্যারেজ (Dams and Barrages) এই শুশুকের স্বাভাবিক চলাচলকে অনেকাংশেই সীমাবদ্ধ করে দিয়েছে, কিন্তু বর্ষা ঋতুতে, শুশুকেরা উজান থেকে ছোট নদীতে চলে যায়, এবং তারপরে কম জলের শীতের মৌসুমে নীচের দিকে বৃহত্তর নদীতে ফিরে আসে।
৫.প্রজনন এবং বৃদ্ধি
গঙ্গা নদীর ডলফিনদের মিলন এবং প্রজনন সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা না গেলেও এটি প্রমানিত যে তারা সারা বছর প্রজনন করে এবং বেশিরভাগ বাচ্চার জন্ম অক্টোবর-মার্চের মধ্যে ঘটে। গর্ভাবস্থার সময় (Gestation period) প্রায় ৮ থেকে ৯ মাস। জন্মের সময়, বাচ্চাগুলি (calf) প্রায় ৭০ সেমি লম্বা হয়, তবে প্রাপ্তবয়স্করা প্রায় ২.৬ মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে পারে এবং প্রাপ্তবয়স্কদের ৯০ কেজি পর্যন্ত ওজন হতে পারে। লম্বা রোস্ট্রামের (Rostrum) কারণে মহিলারা সাধারণত পুরুষ ডলফিনদের চেয়ে লম্বা হয়। স্ত্রী গাঙ্গেয় শুশুক একটি একক সন্তানের জন্ম দেয়, সাধারণত কয়েক মাসের মধ্যে তাদের দুধ ছাড়ানো হয়। পুরুষ শুশুক ১৮ বছর বয়সে এবং স্ত্রী শুশুক সাধারণত ১০ বছর বয়সে যৌন পরিপক্কতায় (Sexual maturity) পৌঁছায়। গাঙ্গেয় শুশুকের জীবনকাল (Lifetime) প্রায় ২৫-২৮ বছর।
৫.খাদ্য
পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে যে গাঙ্গেয় শুশুকের সক্রিয় খাওয়ার সময় সকাল ৭-১০ টা এবং সন্ধ্যা ৩-৫ টা পর্যন্ত। সিন্ধু নদীর ডলফিনের মতো গাঙ্গেয় শুশুকেরও পার্শ্ব সাঁতারের (Side Swimming Behaviour) বিশেষত্ব লক্ষ্য করা গেছে। এটি নদীর তলদেশে ফ্লিপার পিন করে খাবারের শব্দ শোনার চেষ্টা করে বলে মনে করা হয়। সেজন্য এদের একমুখী সাঁতারের ডলফিনও বলা হয়। এরা ছোট আকারের (১০ সেমি-২০ সেমি) অনেক প্রজাতির মাছ যেমন ইলিশ, চিংড়ি, চেলা, ভোলা, ফ্যাশা, ট্যাংরা, বাচা, ঘেরা, শামুক এবং অপরিণত জলজ পোকামাকড় খায়। কাদা থেকে মাছ ধরার জন্য ডলফিনের দীর্ঘ চোয়ালের উভয়েরই অভিযোজন রয়েছে, যার সাহায্যে এটি কাদার ভিতর থেকে মাছ ধরে। তাদের চোয়ালের দাঁত, খাদ্য চিবানোর জন্য কার্যকর নয় বরং শিকারকে ধরা ও গিলে ফেলার জন্য ফলে এরা খাবার ধরার পর উভয় চোয়ালের সাহায্যে তা গিলে ফেলে। কখনও কখনও শুশুক বড় মাছকে তাড়া এবং আঘাত করলেও, তারা তাদের খেতে পারে না, কারণ তাদের গলার বাঁক কম থাকে, যা বড় মাছকে গিলে ফেলার পক্ষে যথেষ্ট নয়। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে গাঙ্গেয় শুশুকেরা মৎস্যজীবীদের ফেলা জাল থেকেই মাছ ছিনিয়ে নিয়ে, জালের ক্ষতি করে।
৫.ব্যাবহার
সিন্ধু নদীর ডলফিনের মতো, গঙ্গা নদীর শুশুকেরাও একটি অনন্য পার্শ্ব সাঁতারের আচরণ (Side Swimming Behaviour) তৈরি করেছে যা তাদের অগভীর জলের মধ্য দিয়ে চলাচল করতে সহায়তা করার জন্য একটি অভিযোজন (Evolution)। শুশুক খুবই সীমিত সময়ের জন্য জলের উপরে উঠে আসে শ্বাস নিতে। জলের ওপরে তাদের দেখা যায় গড়ে ১.২৬ সেকেন্ডের জন্য এবং জলের নিচে গড়ে ১০৭.৬ সেকেন্ডের জন্য। এই কারণে তাদের সঠিক ভাবে পর্যবেক্ষণ করা খুব কঠিন হয়ে ওঠে। অন্যান্য ডলফিন প্রজাতির মতো, তারা ইকোলোকেশন (Echolocation) ব্যবহার করে দিক নির্ণয় করে, কিন্তু নদীর পরিবেশের জটিলতার কারণে গঙ্গা নদীর শুশুককে প্রায় অবিরাম শব্দ নির্গত করতে হয় এবং প্রতিফলিত শব্দ থেকে দিক নির্ণয় সঠিক রাখতে হয়। গাঙ্গেয় শুশুক প্রায়শই একা থাকে, তবে তাদের ছোট দলে একত্রিত হয়ে মাছ শিকার করতেও দেখা গেছে উপনদীর সঙ্গমে। সাধারণত সদ্যোজাত শিশুর (Neonate) সাথে মা শুশুককেও দেখা যায়।
৬.গাঙ্গেয় শুশুকের গুরুত্ব
গাঙ্গেয় শুশুক একটি নদীর বাস্তুতন্ত্রের জন্য সূচক প্রজাতি (Indicator species)। খাদ্য শৃঙ্খলের (Food chain) শীর্ষে থাকা, এই প্রাণীটি একটি স্থানীয় এবং বিরল জলজ স্তন্যপায়ী প্রাণী যা শুধুমাত্র ভারত এবং পার্শ্বীয় উপমহাদেশে পাওয়া যায়। গাঙ্গেয় শুশুক আমাদের প্রাকৃতিক জলজ ঐতিহ্যের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বর্তমানে এই লুপ্তপ্রায় প্রজাতির জনসংখ্যার শেষ শক্ত ঘাঁটি আমাদের ভারতের গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্রে নদী অববাহিকা কারণ এই প্রজাতি নেপাল ও বাংলাদেশে প্রায় বিলুপ্তির পথে। গাঙ্গেও শুশুক সুস্থ এবং স্বাস্থ্যকর নদীর ধারক ও বাহক এবং একটি চমৎকার বাস্তুতন্ত্রের (Healthy Ecosystem) সূচক।
৭.সংরক্ষণ অবস্থা
গাঙ্গেয় শুশুক ১৯৯৬ সাল থেকে আইইউসিএন রেড লিস্টের (IUCN Red List) অধীনে “বিপন্ন” (Endangered) প্রাণীর তকমা পেয়ে আছে। গাঙ্গেয় শুশুককে ভারতীয় বন্য প্রাণী আইন (১৯৭২) অনুযায়ী তফশিলি ১ এর তালিকা ভুক্ত করা হয়েছে, এবং ২০০৯ সালে ভারতের জাতীয় জলজ প্রাণী এবং আসামের (ভারত) রাজ্য জলজ প্রাণী হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছিল। এই বিপন্ন প্রজাতি সাইটস (CITES) এর অ্যাপেন্ডিক্স (Appendix) ১ এবং সি এম এস কপের (CMS COP) অ্যাপেন্ডিক্স (Appendix) ২ –তে তালিকা ভুক্ত করে সংরক্ষণের জন্য সর্বোচ্চ সুরক্ষা অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।
৮. জনসংখ্যা
ভারতে বর্তমানে প্রায় ৩৫০০ শুশুক রয়েছে। বিশ্বের ৯০% এর বেশি শুশুক ভারতের নদীতে অবস্থিত। এই প্রজাতি রসংখ্যা ঐতিহাসিক বিবরণ থেকে বর্তমানে প্রায় ৪0% পরিসীমা হ্রাস হয়েছে । বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে গঙ্গা নদীর ডলফিনের সংখ্যা প্রায় ৪000-৫000 -এর মধ্যে ছিল। পরে একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে উপনদী গুলি মিলিয়ে সংখ্যা ১৮00তে নেমে এসেছে বলে জানা গেছে। সাম্প্রতিকতম পরিসংখ্যান অনুযায়ী গাঙ্গেয় শুশুকের সংখ্যা গঙ্গা নদীর অববাহিকায় এবং অন্যান্য উপনদী মিলিয়ে ২৬৪৪ (উত্তরপ্রদেশে ৮০০টি, মধ্যপ্রেদেশের চম্বল নদীতে ৮০ টি,বিহারে ১০৯৬ টি, পশ্চিমবঙ্গের ফারাক্কা থেকে কাকদ্বিপ অবধি ৩৫৮ টি), এছাড়াও ব্ৰহ্মপুত্ৰ এবং তার উপনদী গুলি মিলিয়ে তাদের সংখ্যা ৯৮৭, যা কিনা উনিশ শতকের পর থেকে কমপক্ষে 50% থেকে 60% হ্রাসের ইঙ্গিত করে। এদিকে সিন্ধু নদীর ডলফিন ভারতে ৬-৮টি এবং অধিকাংশই, পাকিস্তানে বসবাস করে (WWF -Pakistan)। ২০০২ সালে বাংলাদেশ সুন্দরবনে আনুমানিক ২৫টি গঙ্গা নদীর ডলফিনের উপস্থিতি আছে।
৯. গাঙ্গেয় শুশুকের বিপদ
নদী ও জলবিকাশ পরিযোজনা (River and Water Development Projects) – গাঙ্গেয় শুশুকের প্রধান বিপদের মধ্যে রয়েছে জল-সম্পর্কিত অবকাঠামো যেমন বাঁধ, ব্যারেজ, এবং ডাইভারশন (Dams, Barrages and Diversion) এবং বিভিন্ন রাজ্য ও রাষ্ট্রীয় নদী ও জলবিকাশ পরিযোজনা (River Development Projects) যা প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ এবং বাসস্থানের বিভাজন ঘটায়। বাঁধ এবং ব্যারেজ ডলফিনের আবাসস্থলকে খণ্ডিত করে, জনসংখ্যার সংযোগ হ্রাস করে এবং নদীর অংশে প্রাণীদের বিচ্ছিন্ন করে। এগুলি জলের প্রাপ্যতা এবং বাসস্থানের গুণমান হ্রাস করে এবং পরিযায়ী মাছের (Anadromous and Catadromous Fish) পথ রোধ করে নদীর আবাসস্থলকেও প্রভাবিত করে। কৃষিকাজের জন্য নদী থেকে অত্যাধিক পরিমাণে জল নিকাশির ফলে নদীর নাব্যতা ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে এবং শুশুকের বসবাসের পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠছে। এছাড়াও নদীর পাড়ে অত্যাধিক পলি (Excessive Siltation) জমার ফলেও জলের নাব্যতা কমে যাচ্ছে।
অনিচ্ছাকৃত জালে ধরা পড়া (Overfishing and Accidental bycatch) – অত্যাধিক মাছ ধরার কারণে এবং নদীতে অসিংখ্য পরিমাণ মাছের জাল (Fishing pressure) থাকার জন্য গাঙ্গেয় শুশুক অন্যান্য অনেক সিটাসিয়ান (Cetacean) প্রজাতির মতো, প্রায়শই মাছ ধরার জালে জড়িয়ে পড়ে এবং তারপরে শ্বাস নিতে উপরে না আসতে পারার কারণে ডুবে মারা যায়। এইভাবে অনিচ্ছাকৃত ভাবে জালে জড়িয়ে শুশুকের মৃত্যুর হার দিনে দিনে ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। অত্যাধিক পরিমাণে মাছ ধরার কারণে বিশেষত মীন ও মশারী জাল (Mosquito net) ব্যাবহারের ফলে নদীর জলে মাছের সংখ্যা ক্রমাগত হ্রাশ পাচ্ছে যা শুশুকের খাদ্য তালিকার মধ্যে প্রধান।
হত্যা ও শিকার (Intentional killing and poaching) – গাঙ্গেয় শুশুকের জনসংখ্যা হ্রাসের অন্যতম মূল কারণ হল ইচ্ছাকৃত ভাবে শুশকের হত্যা এবং শিকার। মূলত মৎস্যজীবীদের জাল ছিঁড়ে মাছ ছুরি করার প্রতিশোধ এবং শুশুকের তেলের (Dolphin Oil) জন্যই তার শিকার করা হয়। প্রচলিত লোককথা অনুযায়ী শুশুকের তেল ভেষজ ওষুধ হিসাবে বাত এবং শরীরের অন্যান্য ব্যাথা বেদনার (Arthritis) উপশমে সাহায্য করে। শুশুকের তেল ব্যাবহার করে ঘেরা ও বাচা মাছ ধরার প্রচলনও নজিরবিহিন নয় যা শুশুকের সংখ্যা ক্রমেই কমতে এক মারণ বিপদ হিসাবে কার্যকর।
দূষণ (Pollution) – গাঙ্গেয় শুশুকের জনসংখ্যা হ্রাসের অন্যতম প্রধান কারণ হল পরিবেশ দূষণ (জল দূষণ এবং শব্দ দূষণ)। জল দূষণের প্রধান উৎস গুলির মধ্যে শহরাঞ্চলের নিকাশি ব্যাবস্থা (Domestic wastes), কলকারখানার সমস্ত বহ্য পদার্থ (Industrial effluents), কৃষি জমির কীটনাশক (Agricultural runoffs) এবং নদীতে বিষ প্রয়োগ করে মাছ ধরার প্রক্রিয়া অন্যতম যেগুলি সরাসরি, নিকাশি ব্যাবস্থার মাধ্যমে এবং বৃষ্টির জলে ধুয়ে নদীর জলে এসে মেশে ও নদীর জলের গুণমান অত্যাধিক ভাবে হ্রাশ করে। দূষিত নদীর জলে মিশ্রিত ভারী ধাতু (Heavy metal), ও কলকারখানা ও কৃষিকাজ থেকে নির্গত অন্যান্য ক্ষতিকর পদার্থ (অরগানোক্লোরিন) (Organochlorine) গাঙ্গেয় শুশুকের স্বাভাবিক স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। যেহেতু গাঙ্গেয় শুশুক দৃষ্টিহীন এবং পুরোপুরি ভাবে ধ্বনি ও প্রতিধ্বনির উপর নির্ভরশীল, নদীতে চলাচল করা ফেরী, বারজ (Barge), ছোট ও বড় জাহাজের থেকে নির্গত ভীষণ আওয়াজ শুশুকের দিক নির্ণয়ের পথে বাধা হয়ে দাড়ায় এবং শব্দ দূষণ ঘটায়, যার ফলে দিক ভুল করে নদীতে ভাসমান এই সকল যানবাহনের সাথে ধাক্কা খেয়ে তাদের মৃত্যু হয়। এছাড়া ড্রেজিং-এর (Dredging) কারণে নদীর ভূতলের বাস্তুতন্ত্র সমস্ত বিঘ্নিত হয় যা নদীর পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।
১০. গাঙ্গেয় শুশুকের রক্ষণাবেক্ষণ পরিকল্পনা
সুরক্ষিত এলাকা নির্বাচন ও অভয়ারণ্য ঘোষণা (Identification and declaration of dolphin hotspot as protected area) – বিক্রমশীলা গাঙ্গেয় শুশুক অভয়ারণ্য (ভিজিডিএস) (Vikramshila Gangetic River Dolphin Sanctuary) গঙ্গার বুকে প্রায় ৬০ কিমি বিস্তৃত বিহারের সুলতানগঞ্জ ও কাহালগাঁওর মধ্যে একমাত্র মনোনীত গাঙ্গেয় শুশুকের জন্য সুরক্ষিত এলাকা যা ১৯৯১ সালে বিহার সরকার অভয়ারণ্য হিসাবে ঘোষণা করে, যেখানে প্রায় ১২৭ থেকে ১৪৫ টি শুশুক বর্তমান। সেরকমই বিজ্ঞানসম্মত গবেষণা ও সার্ভের মাধ্যমে শুশুকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এলাকা (Critical Dolphin Hotspots) খুঁজে সেগুলিকে রাষ্ট্রীয় অভয়ারণ্য বা সুরক্ষিত এলাকা হিশেবে ঘোষণা করা প্রয়োজন।
শুশুক দিবস (Dolphin Day) – বিহার সরকারের সাহায্যে ভারত সরকার ২০০৯ সালে ৫ই অক্টোবর গাঙ্গেয় শুশুককে সর্বচ্চ সুরক্ষা প্রদানের জন্য তাকে জাতীয় জলজ প্রাণী (National Aquatic Animal) হিসেবে ঘোষণা করে। এখন বিহার সরকারের উদ্যোগে সারা ভারত প্রতি ৫ই অক্টোবর ডলফিন দিবস হিসাবে পালন করে, যেখানে ডলফিনের সুরক্ষা, সংরক্ষণ এবং প্রচারের জন্য সাধারণ মানুষকে, বিশেষ করে মৎস্যজীবী ভাইদের সচেতন করা হয়।
উদ্ধার এবং মুক্তি প্রচেষ্টার মাধ্যমে দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুহার কমানো (Reducing incidental mortality through rescue and release efforts) – ২০০০ সালে পাকিস্তানে ডলফিন-ভিত্তিক বাসস্থান সুরক্ষা এবং পুনরুদ্ধার একটি কর্মসূচি শুরু হয়েছিল যেখানে গভীর বিচ্ছিন্নপুলে বা সেচ খালে আটকা পড়া সিন্ধু নদীর ডলফিন উদ্ধার করা হয় যেখানে তাদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা নেই। গাঙ্গেয় শুশুকের জন্য ভারতে একটি অনুরূপ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
পর্যটন (Eco-Tourism)- যদিও ডলফিন-ভিত্তিক পর্যটন এখনও গঙ্গায় নেই, তবে সম্প্রতি চালু হওয়া কলকাতা এবং বারাণসীর মধ্যে নদী পর্যটন বিদেশী পর্যটকদের গাঙ্গেয় শুশুক দেখার জন্য আকৃষ্ট করছে। গঙ্গায় শুশুক দেখানোর এই পর্যটন প্রক্রিয়া, মৎস্যজীবীদের এবং স্থানীয়দের জন্য একটি সম্ভাবনাময় ও টেকসই আয়ের উৎস, এটা নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ যে সেই প্রক্রিয়া যেন কোনরকম ভাবেই গাঙ্গেয় শুশুককে ক্ষতিগ্রস্ত বা বিরক্ত না করে। পর্যটন শিল্প সেইসাথে সরকারী সংস্থাগুলির দ্বারা বিকশিত, গৃহীত এবং প্রচারিত, স্থানীয় মানুষ এবং সহযাত্রী পর্যটকদের জন্য নির্দেশিকা ও আচরণবিধি থাকতে হবে এবং সেগুলি মানা হচ্ছে কিনা তা নিশ্চিত করতে হবে যাতে ডলফিন পর্যটন গাঙ্গেয় শুশুকের জন্য বিপদের কারণ না হয়ে ওঠে।
বাসস্থান সুরক্ষা এবং পুনরুদ্ধার (Habitat protection and restoration) – গঙ্গায় এবং তার উপনদীগুলিতে বিদ্যমান সংরক্ষিত এলাকা যতটা প্রয়োজন তার তুলনায় সেই সংখ্যা অনেকাংশেই কম এবং এতো কম সংখ্যক সংরক্ষিত এলাকা নিয়ে এতো বৃহৎ এলাকায় গাঙ্গেয় শুশুকের সংরক্ষণ অসম্ভব। গাঙ্গেয় শুশুকের বাসস্থান সুরক্ষা এবং পুনরুদ্ধারের জন্য স্থানীয় বাসিন্দা ও মৎস্য জীবীদের সমর্থন অত্যন্ত দরকারি। তাদের সচেতন করা প্রয়োজন যে এই সংরক্ষণ ব্যবস্থা তাদের বিভিন্নভাবে উপকার করতে পারে। এইসকল সুরক্ষিত এলাকায় মাছ ধরা নিষিদ্ধ করে এলাকায় বসবাসকারী মৎস্যজীবীদের ভাতা দেওয়া প্রয়োজন যাতে তারা নিজেরাই উদবুদ্ধ হয়ে শুশুক সংরক্ষণে এগিয়ে আসে।
সংরক্ষণ সচেতনতা (Social Awareness and community based conservation) – গাঙ্গেয় শুশুকের সুরক্ষা এবং জনসংখ্যা পুনরুদ্ধারের জন্য স্কুলের ছাত্র ছাত্রী, স্থানীয় বাসিন্দা ও মৎস্য জীবীদের সমর্থন ও সচেতনতা অত্যন্ত দরকারি। সচেতনতা বাড়াতে গ্রামে গ্রামে স্থানীয় বাসিন্দা ও মৎস্য জীবীদের সাথে কথা বলা ও নদীতে শুশুকের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে অবগত করা প্রয়োজন। যাতে পরবর্তীকালে ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত ভাবে জালে ধরা পড়ে শুশুকের মৃত্যুর হার কম হয় এবং যাতে জালে ধরা পড়লে সচেতন মানুষেরা শুশুকদের আবার নদীতে জীবিত অবস্থায় ফিরিয়ে দেয় অথবা বনদপ্তরে নির্ভীক হয়ে খবর দিতে পারে। গাঙ্গেয় শুশুক সংরক্ষণ এবং ব্যবস্থাপনার জন্য স্থানীয় সম্প্রদায়ের সম্পৃক্ততা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
গবেষণা এবং সচেতনতার মাধ্যমে পরিবেশ দূষণ হ্রাস (Researching and reducing Environmental pollution) – যদিও শুশুকের উপর দূষণকারী পদার্থের প্রভাব দেখতে আরও গবেষণা প্রয়োজন ডলফিনের সুস্বাস্থ্যের জন্য সতর্কতামূলক নীতি ও নদী দূষণের সীমাবদ্ধতা ঠিক করা প্রয়োজন। গঙ্গা নদী ব্যবস্থায় বর্জ্যপদার্থ নিষ্কাশিত করার হ্রাস নিশ্চিত করার জন্য মানুষের সচেতন হওয়া দরকার যাতে শুশুক নদীতে নিষ্কাশিত বিষাক্ত পদার্থের সান্নিধ্যে না আসে।
১১. গাঙ্গেয় শুশুক সংরক্ষণের জন্য আইনি বিধান
ভারতের বন্যপ্রাণী (সুরক্ষা) আইন ১৯৭২ অনুসারে, গাঙ্গেয় শুশুক তফসিল-১ এর অন্তর্ভুক্ত। যার অর্থ হল, শুশুককে কোনরকমভাবে ক্ষতি করলে, তার দেহাবশেষ নিয়ে ব্যাবসা করলে, ইচ্ছাকৃত ভাবে শিকার বা হত্যা করলে, শুশুক সংরক্ষিত এলাকায় ইচ্ছাকৃত ভাবে মাছের জাল ফেললে, বন দপ্তরে খবর না দিয়ে শুশুককে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিয়ে গেলে এই আইনের ধারায় অপরাধীকে দোষী সাব্যস্ত করা হবে। এই আইনের লঙ্ঘন সর্বনিম্ন ৩ বছরের শাস্তিযোগ্য অপরাধ যা জরিমানা সহ ৭ বছর পর্যন্ত হতে পারে৷ এই আইনের লঙ্ঘন এবং পুনরাবৃত্তি করলে অপরাধী কে জেলের শাস্তির পাশাপাশি ২৫000/- টাকা পর্যন্ত জরিমানা করা হতে পারে। শুশুকের হত্যা এবং শিকার একটি আমলযোগ্য এবং জামিন অযোগ্য অপরাধ (Non-bailable offense)।
১২. উপসংহার
গাঙ্গেয় শুশুকের সংখ্যা তাদের বর্ধিত অঞ্চল থেকে দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে, যা একটি গুরুতর উদ্বেগের বিষয়, কারণ এই বিরল প্রাণীগুলি শুধুমাত্র ভারতীয় উপমহাদেশেই পাওয়া যায়। নদীতে তাদের উপস্থিতি প্রচুর জীব-বৈচিত্র্য নিশ্চিত করে যা জলজ পরিবেশগত ভারসাম্য বজায় রাখে। গাঙ্গেয় শুশুকের পরিবেশগত গুরুত্ব বিবেচনা করে, তাদের সংরক্ষণ আজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সংরক্ষণ শুধুমাত্র গাঙ্গেয় শুশুক নয়, নদীতে অবস্থিত এবং নদীর উপর নির্ভরশীল সকল প্রকার জলজ প্রাণীদের রক্ষা করতে পারি এবং নদীর সভ্যতাকে বাঁচানো জেতে পারে। এতে আমাদের সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ অটুট থাকবে। গাঙ্গেয় শুশুক এবং গঙ্গা নদী একে অপরের পরিপূরক। এই অদ্ভুত বিস্ময়কর প্রাণী-শুশুককে বাঁচিয়েই আমরা গঙ্গা নদীকে বাঁচাতে পারি। গঙ্গা যখন রক্ষা পাবে, তখন আমাদের প্রাচীন সভ্যতাও রক্ষা পাবে। তাই ‘শুশুক বাঁচিয়ে হবো মোরা নদীর শুশুক সাথী’ স্লোগান নিয়ে আসুন আমরা দেশের এই ঐতিহ্যবাহী প্রাণীটির সংরক্ষণে হাত বাড়াই।