নমস্কার,
জলপাইগুড়ি, ২৯ এপ্রিল, ২০২৩
আমি বিশ্বাস করি, এই ‘বিপন্ন তিস্তা’ কনভেনশনের উদ্দ্যেশ্য ও মূল বিবেচ্য বিষয় কনভেনশনে উপস্থিত সকলে নিশ্চয় সহমত পোষণ করবেন যে আমাদের তিস্তা আজ বিপন্ন। তিস্তাপাড়ের মানুষদেরও একই অভিজ্ঞতা। ইকলিজক্যাল সিটিজেন হিসেবে যে সমস্ত অধিকার নিয়ে একটি নদী তার উৎস থেকে মোহনা পর্যন্ত এগিয়ে চলে তিস্তার ক্ষেত্রে তা খর্ব করা হয়েছে বার বার। বিগত চার-পাঁচ দশক ধরে। আজকের কনভেনশনের মূল উদ্দেশ্য হল সেই অধিকার ভঙ্গের সুদূরপ্রসারী প্রভাব নিয়ে চর্চা। মূল লক্ষ্য, কিভাবে সেই সমস্ত অধিকার ফিরিয়ে দিয়ে আমাদের তিস্তাকে ইকলিজক্যাল সিটিজেন হিসেবে স্বীকার করে নেওয়া যায়, সে বিষয়ে জরুরি সিদ্ধান্ত গ্রহণ।
কী সেই অধিকার যা থেকে আমাদের তিস্তাকে বঞ্চিত করা হয়েছে? মুক্ত প্রবাহ, স্বচ্ছতোয়া জল, জলজ বাস্তুতন্ত্রের প্রতিপালন, প্লাবনভূমির ওপর অবাধ বিচরণ, প্রতি বর্ষায় পরিপূর্ণ নদীখাত, দু-তিন বছর অন্তর নিয়মিত ছোট বন্যায়। নিজের প্রবাহপথকে সচল করে তোলা, দীর্ঘ ব্যবধানে যে বড় বন্যা আসে তাতে প্লাবনভূমির নির্মাণ কাজ সুষ্ঠভাবে চালিয়ে যাওয়া এবং সে বানে ছড়িয়ে পড়া নতুন পলিতে আবাদি জমির পুষ্টি সঞ্চার এ সবের কোনওটাই আর তিস্তার ক্ষেত্রে নিয়ম করে ঘটে না। এক কথায়, একটি নদীর বয়ে আনা জল আর পলির সাথে তার গতি পথের ভূমি- ঢাল, স্থানীয় জলবায়ু, মাটি, বন-জঙ্গল, প্রাণ বৈচিত্র, অববাহিকার জনবসতি এ সবের সঙ্গে যে এক স্থিতিশীল আন্তঃ সম্পর্ক গড়ে ওঠে, তিস্তার ক্ষেত্রে সেই সম্পর্কটাই ভেঙে পড়েছে।
এর জন্য স্পষ্টত দুটি কারণঃ (১) বিশ্বউষায়ণ এবং জলবায়ুর পরিবর্তন এবং (২) তথাকথিত সর্বগ্রাসী উন্নয়নের তাগিদে মানুষের নদী অনুশাসনের উন্মাদনা। আর এই উন্মাদনার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে মূলতঃ বাঁধ, বারাজ আর সেচখাল নির্মাণের মধ্যদিয়ে।
তিস্তার জন্ম উত্তরপূর্ব সিকিমের ৬২০০ মিটার উচ্চতায় পাউহুনরি পর্বতের কাংসি হিমবাহ থেকে। উৎসপ্রবাহের নাম লাচেন চু। চুংথাং এ পৌঁছানর পর বাঁদিক থেকে লাচুং চু নামে আরেকটি জলধারা এসে তাতে মেশে। তারপর, এই দুয়ের মিলিত স্রোত ভিস্তা নাম নিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং জেলার সেবকে এসে তিস্তা পাহাড় ছেড়ে সমতলে পা রাখলো। এরপর, জলপাইগুড়ি, কুচবিহার জেলা পেরিয়ে পৌঁছোয় বাংলাদেশে। ওদেশে প্রবাহের সময় বাম তীরে থাকছে লালমণিরহাট, কুড়িগ্রাম, আর ডান তীরে নীলফামারি, রংপুর, আর গাইবান্দা জেলা। শেষে, গাইবান্দা জেলার হরিপুর ঘাটে ব্রহ্মপুত্রে গিয়ে মিশেছে। প্রবাহপথের মোট দৈর্ঘ্য ৪১৪ কিমি। অববাহিকার মোট আয়তন ১২,১৫৯ বর্গকিমি। প্রায় ৩০ মিলিয়ন মানুষের বাস, যার ৭১ শতাংশ রয়েছে বাংলাদেশে। অথচ অববাহিকার মাত্র ১৬.৪৮ শতাংশ রয়েছে ওদেশের সীমানার ভেতর। বাংলাদেশ অংশে অববাহিকার গড় জনঘনত্ব প্রতি বর্গকিমিতে ১,০৯১ জন। পশ্চিমবঙ্গে প্রতি বর্গকিমিতে ৫২৫ জন, আর সিকিমে সংখ্যাটা কমে দাঁড়ায় ৮৭ জন। মোট জনসংখ্যার ৭৮ শতাংশই থাকেন গ্রামে, আর শহরবাসী ২২ শতাংশ।
অববাহিকার উচ্চ অংশে (সিকিমে) কাংসি সহ মোট ৩৯৮ টি হিমবাহ তিস্তার প্রবাহকে পুষ্ট করে। তাদের সম্মিলিত অবদান মোট প্রবাহের ১০ শতাংশ। কিন্তু তারা আজ অধিকাংশই শীর্ণকায়। ২০১৯ সালে ওয়াদিয়া ইনস্টিটিউট অব্ হিমালয়ান জিওলজি এবং সিকিম ইউনিভার্সিটি যৌথভাবে ২৩ টি হিমবাহের ওপর সমীক্ষা চালিয়ে দেখেছে এদের মধ্যে ১৮ টিই পিছিয়ে যাচ্ছে। আর এটি ঘটছে ১৯৯১ ২০১৫ সালের মধ্যে। ২০০০ সালের পর থেকে এই বরফ গলনের হার অতিমাত্রায় বেড়েছে। এর মূলতঃ দুটি কারণঃ এক, গ্রীষ্মকালীন উত্তাপ বৃদ্ধি, এবং দুই, তুষারপাতের ঘাটতি। ফলশ্রুতিতে উৎস অঞ্চলে গ্লোসিয়াল লেক আউটবার্স্ট আর ফ্ল্যাশফ্লাড বৃদ্ধির প্রবণতার কথাও বলা হয়েছে ওই একই গবেষণায়।
উৎস অঞ্চলে বরফ গলে গেলে মধ্য এবং নিম্ন অববাহিকায় নদীর জলপ্রবাহ তো বেড়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু ১৯৮৫- ২০০৬ এই সময়ে নিম্ন অববাহিকায় বাংলাদেশের কউনিয়া স্টেশনে ১৯৮৫ ২০০৬ সালের মধ্যে নদীর প্রবাহ কমেছে লক্ষণীয় মাত্রায়। বছরে ৬০ কিউমেক হারে। এ তথ্য মিলেছে ২০১৭ সালে জার্নাল অব্ ডিসাস্টার এন্ড রিস্ক স্টাডিস এ প্রকাশিত আরেকটি গবেষণাপত্রে। ওই সময়কালে বাংলাদেশের ওয়াটার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড এর প্রকাশিত তথ্যেও একই প্রবণতা লক্ষ করা যায়। অথচ, অববাহিকার ওই অংশে বৃষ্টি কিন্তু কমেনি। বাংলাদেশ অংশে বরং বৃষ্টিপাত খানিক বেড়েছে। পশ্চিমবঙ্গের অংশে বার্ষিক গড় বৃষ্টি একই রকম, তবে অল্প সময়ে বেশি বৃষ্টির প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
তাহলে ভিস্তা কি জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কা সামাল দিতে ব্যর্থ? এমাপের নদীগুলির তো এক সেলফ রেগুলেটরি মেকানিজম থাকে এবং তা দিয়ে এধরনের আঘাত দিব্যি যুঝে নেওয়ার কথা। তিস্তার কি তা নেই? এর উত্তর পাওয়া যায় ওই সর্বগ্রাসী উন্নয়ন উন্মাদনায়। নব্বইয়ের দশকে অববাহিকার সমতল অংশে দুটি বড় মাপের ব্যারেজ এবং সেচখাল প্রকল্প চালু হয়েছে। একটি জলপাইগুড়ির পজলডোবায়, আরেকটি বাংলাদেশে লালমণিরহাট জেলার দুয়ানিতে। ভারতের সেচ প্রকল্প অনুযায়ী তিনটি পর্যায়ে ৯.২ লক্ষ হেক্টর জমি সেচের আওতায় আনার কথা। এখন পর্যন্ত বাস্তবে এসেছে ১.৯৭ লক্ষ হেক্টর। তিনটি জলবিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্রও ওই একই প্রকল্পের আওতাভূক্ত। উৎপাদন হয় ৬৭.৫ মেগাওয়াট। মোট লক্ষ্যমাত্রা ১০০০ মেগাওয়াট। বাংলাদেশের তিস্তা প্রকল্পের সেচের লক্ষ্যমাত্রা ৭.৪৯ লক্ষ হেক্টর। এখন পর্যন্ত ১.১১ লক্ষ হেক্টর জমিতে জল পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়েছে।
সেচের কারণে জল তুলে নিলে নদীর প্রবাহ কমে যাবে এ তো স্বাভাবিক। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। সেচের প্রয়োজন শুখা মরসুমে। হিমালয়ান এডাপ্টেশন, ওয়াটার এন্ড রেসিলিয়েনস্ রিসার্চ (HI AWARE) ২০১৭ সালে হিসেব কষে দেখিয়েছে যে, শুখা মরসুমে নদীতে প্রবাহ পাওয়া যায় মাত্র ১৯৭.৭৬ কিউমেক। ওদিকে সেচের লক্ষ্যমাত্রার পুরোটা মেটাতে গেলে গজলডোবায় প্রয়োজন 1243.25 কিউমেক, আর বাংলাদেশে দরকার হবে ৭২৮.১৪ কিউমেক। ওই পরিমাণ জল তো বর্ষাতেও মেলা ভার। আর তাই বর্তমান সেচ আওতাভুক্ত জমিতেও প্রয়োজনীয় জলের চাহিদা মেটান। যাচ্ছে না। তাহলে নদীকে ধ্বংস করে। এই অলীক অবাস্তব প্রকল্পের কি আদৌ কোনও প্রয়োজন আছে। আমাদের যুক্তিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আজকের এই কনভেনশনে।
সেচ প্রকল্প নিয়ে প্রশ্ন তোলার আরও অনেক সংগত কারণ আছে। প্রকল্পদুটি তৈরি হয় সত্তরের দশকে। তখন জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিষয় বিবেচনায় রাখা হয়নি। ইতিমধ্যে দুই দেশেই চাষাবাদ প্রযুক্তিরও বিস্তর পরিবর্তন ঘটেছে। দেশজ ফসল বৈচিত্র্য আর নেই। এসেছে উচ্চফলনশীল জাত। ওসবের জন্য অনেক বেশি জলের দরকার। চলতি সেচ প্রকল্প তা মেটাতে ব্যর্থ। আর তাই চাষিরা তুলে নিচ্ছে মাটির তলার জল। তাতে ভৌম জলস্তর নেমে গেল। গজলডোবার ভাটিতে কোথাও কোথাও এই জলস্তর নেমেছে ৭.৫ মিটার পর্যন্ত। ফলে নদীর সঙ্গে ভৌম জলের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হল। নদী গেল শুকিয়ে। কেননা সমতলে নদী শুখা মরসুমে ভৌমজলে পুষ্ট থাকে। আর বর্ষায় বৃষ্টির জলে। আবার শুখা মরসুমে জল নেই, তাই ধ্বংস হল জলজ বাস্তুতন্ত্র। আধুনিক কৃষিপ্রযুক্তিতে মাটি ক্ষয় হয় অনেক বেশি। তাতে নদীর তলায় বেশি বেশি করে পলি জমল। নদীখাত হল অবরুদ্ধ। বর্ষায় বন্যার প্রবণতা বেড়ে গেল। পাড়বাঁধে তিস্তাকে বেঁধে ফেলা হয়েছে দুদেশেই। ভাতে ছোট বন্যা আর হয় না। চাষের জমিতেও আর পলি পড়ে না। মাটিও আর পুষ্টি পায় না। বাড়ছে রাসায়নিক সারের ব্যবহার। ওদিকে আবার নগরায়নের উচ্ছিষ্ট জল। সবমিলিয়ে নদীর জল পেল বিষিয়ে। একসময়ের স্বচ্ছতোয়া তিস্তা উন্নয়নফাঁদে পড়ে তার অধিকার হারাল। এবিষয়ে আমাদের অবস্থান নির্দিষ্ট করা প্রয়োজন।
তিস্তার অধিকারে আরেকটি হস্তক্ষেপ হল জলবিদ্যুৎ। ‘ওয়াটার পলিসি জার্নাল’ এর জুন, ২০২০ সংখ্যায় যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তাতে, পশ্চিমবঙ্গ আর সিকিমে তিস্তা অববাহিকার পাহাড়ি অংশে বর্তমানে ৪৭ টি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প রয়েছে রূপায়ণের বিভিন্ন পর্যায়ে। মোট উৎপাদন ক্ষমতা ৬৭৫৩.৫ মেগাওয়াট। প্রতিটি প্রকল্প কেন্দ্রে সারাদিন ধরে জল সঞ্চয় করে পিক আওয়ারে তা ছাড়া হয় টারবাইন ঘোরাবার জন্য। পিক আওয়ার বলতে সন্ধ্যে ৬ টা থেকে রাত ৯টা যখন বিদ্যুতের চাহিদা সবচাইতে বেশি। বেশিরভাগ প্ল্যান্টে ওই সময়তেই উৎপাদন হয়। বাকি ২১ ঘন্টা যোগানের তুলনায় চাহিদা থাকে কম। আর তাই সে সময় জল ধরে রাখা, যাতে পিক আওয়ারে জলপ্রবাহের প্রয়োজনীয় গতিবেগ পাওয়া যায়। ফলে নদীতে জলপ্রবাহের যে সময়গত শৃঙ্খলা থাকার কথা সেটা আর থাকছে না। আঘাত আসছে জলজ বাস্তুতন্ত্রে। তাছাড়া এই জল ধরে রাখা আর ছাড়ার সময়গত পার্থক্যে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ক্যানেল মারফত সমতলে চাষের জমিতে জলবন্টন। আবার জলাধারে জলস্তর বাড়লে পাহাড়ের ঢালে মাটির আর্দ্রতাও বেড়ে যায়। আর তাতে বাড়ে ভূমিধস প্রবণতা। ওদিকে সঞ্চয় করা জলে যে পলি মিশে থাকে সেটা জলাধারেই থিতিয়ে পড়ে। এই জলাধার ভরাট, সঞ্চিত পলির ব্যবস্থাপনা সে এক বড় চ্যালেঞ্জ। এতে পাল্টে যাচ্ছে পাহাড়ি নদীখাতের ভূমিরূপ। সবমিলিয়ে নদীর জল, জলজ বাস্তুতন্ত্র্য, নদী-খাতের ঢাল, ভূমিধস প্রক্রিয়া এসবের মধ্যে যে স্থিতিশীল আন্তঃসম্পর্ক, সেটা ধসে গেছে। তিস্তার জন্য এমনটা কখনই তিস্তার প্রাপ্য ছিল না।
ব্যুরো অব ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ড এর প্রকাশ করা ২০০২ সালের মানচিত্র অনুযায়ী পুরো সিকিম রাজ্যটাই রয়েছে চার নম্বর সিসমিক জোন এ। অর্থাৎ হাই রিস্ক জোন। হিমালয়ে থাকা হিমালয়ান ফ্রন্টাল ফন্ট, মেইন বাউন্ডারি থ্রাস্ট, এবং মেইন সেন্ট্রাল থ্রাস্ট, এই তিনটি চ্যুতি রেখা সিকিম কে ঘিরে রেখেছে। সুতরাং এতগুলো প্রকল্পের সম্ভাব্য বিপদ নিয়ে আশঙ্কা থাকছেই। সেন্টার ফর ফিনানসিয়াল অ্যাকাউন্টেবিলিটি’র ২০১৯ এর এক রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে যে, সিকিমে জলবিদ্যুতের স্থানীয় চাহিদার তুলনায় উৎপাদন অনেক বেশি। আর তাই সিকিম নিয়মিত বিদ্যুৎ বিক্রি করে পঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশ, রাজস্থানে। বাংলাদেশও ওই বিদ্যুতের এক বড় খদ্দের। সুতরাং প্রকল্পের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলবই আজকের এই কনভেনশনে। তিস্তার জীবন বাঁচাতে, মাটি-অরণ্য-ভূমিঢাল, জলবায়ু এসবের সাথে তার সমন্বিত পথচলার অধিকার ফিরিয়ে দিতে এই প্রকল্পগুলো ঘিরে জরুরি সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
তিস্তার অধিকার রক্ষায় পাহাড়ের সাধারণ মানুষের সংঘটিত লড়াই নদীপ্রমী মানুষের মনে সাহস যোগায়। গত দেড় দশক ধরে সিকিমের ডংগু উপত্যকায় তিস্তা ড্যাম স্টেজ-৪ এর বিরুদ্ধে ‘এফেক্টেড সিটিজেন অব তিস্তার যে আন্দোলন তা পাহাড়ের প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষায় এক অনন্য নজির। নেতৃত্বের প্রথম সারিতে রয়েছেন মিঃ গিয়াটসো যাকে ‘ওয়াটার ম্যান অব্ সিকিম’ এই উপাধিতে সাধারণ মানুষ গ্রহণ করেছেন। ২০০২-২০০৩ সালে ডংগু গ্রাম থেকে লড়াইটা শুরু হলেও তা জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরে সাড়া ফেলে দেয় ২০০৭-২০০৯ সালে যেসময় এফেক্টেড সিটিজেন অব্ তিস্তার লড়াকু নেতাকর্মীরা টানা ৯১৫ দিন অনসন চালিয়েছিলেন। রুখে দিয়েছিলেন প্রকল্প শুরুর কাজ। এই আন্দোলনে ব্যবহার করা নানান স্লোগান যেমন ‘Say No To Dam’, ‘No More Dam’, ‘River For Life’ এসব আজকে নানান প্রান্তে নদী সৈনিকদের মুখের বুলিতে পরিণত হয়েছে। এত সবের পরেও ২০১৪ সালে ‘তিস্তা ভ্যাম স্টেজ ৪’ প্রকল্পটি সংশ্লিষ্ট পরিবেশ মন্ত্রকের ছাড়পত্র পেয়েছে। হ্যাঁ, পেয়েছে বটে, কিন্তু একাধীক গ্রামঞ্চায়েত অরণ্য নিকেশ করার অনুমতি না দেওয়ায় প্রকল্পের কাজ তেমন এগোয় নি। নদীর অধিকার রক্ষায় এওতো এক বিরাট সাফল্য। এ লড়াইয়ে আমাদের অবস্থান কী? বুকচিতিয়ে পড়ে যাওয়া আমাদের ওই সহনাগরিকদের আমরা কী বার্তা দেব, এ সিদ্ধান্ত আজকেই নিতে হবে, এই কনভেনশনই সেটা ঠিক করে দেবে।
তিস্তা জলবন্টন নিয়ে ভারত-বাংলাদেশ বিবাদ এখন তামাদি হয়ে গেছে। খানিকটা গা সওয়াও বটে। কিন্তু, পর্যাপ্ত জলপ্রবাহ না পাওয়ার অছিলায় জলবন্টনের মতো ইস্যু কে এড়িয়ে গেলে সেটা হবে নদীতীরবাসীর জীবন-জীবীকার অধিকারকে অস্বীকার করা। হেলসিঙ্কি রুল (১৯৬৬) বা বার্লিন রুল ( ২০০৪) এর মতো সুস্পষ্ট নিয়ম বিধি যখন রয়েছে তখন এই বিবাদের মীমাংসার জন্য দাবী তুলতেই হবে, তা সে নদীতে যে পরিমাণ জলপ্রবাহই থাকুক না কেন। দাবীটা এই কনভেনশন থেকেই উঠুক। এই বিবাদ না মিটলে সবচাইতে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন দুই ব্যারেজের মাঝে থাকা এপাড় বাংলা-ওপাড় বাংলা দুই অংশেরই চাষি আর মৎসজীবী মানুষ। কেননা তারা না পাচ্ছেন ক্যানেলের জল, না পাচ্ছেন নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ। জলাভাবে সংকুচিত হয়ে গেছে ওদের জীবন-জীবিকা।
একে একে অনেকগুলো প্রসঙ্গ উঠে এল। এসবের সারসংক্ষেপ করলে যেটা দাঁড়ায় তা হল, একদিকে জলবায়ুর পরিবর্তন আর অপরদিকে বাঁধ, ব্যারেজ এবং সেচখাল এই দুয়ের সাঁড়াশি চাপে তিস্তা আজ জরাগ্রস্থ। তার প্রবাহ কমেছে। জল দূষিত বিনষ্ট হয়ে গেছে জলজ প্রাণবৈচিত্র্য। গতিপথ পলি জমে অবরুদ্ধ। বাড়ছে বিধ্বংসী বন্যার প্রবণতা। বিপন্ন তিস্তা, বিপন্ন তিস্তাপাড়ের মানুষ। পরিবেশগত বিচারে, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, এবং ব্যবহারিক প্রয়োজনের নিরিখে ওই বাঁধ এবং বারেজের যৌক্তিকতা মূল্যায়ণ করা জরুরি। সিকিমের বাঁধ বিরোধী আন্দোলনে আমাদের সুস্পষ্ট অবস্থান স্থির করতে চাই। চাই জলবন্টন বিবাদের দ্রুত নিরসন। এককথায়, তিস্তাকে প্রাকৃতিক নিয়মে পথচলার অধিকার ফিরিয়ে দিয়ে তাকে বাঁচিয়ে তোলার উপায় খুঁজে বার করতে হবে।
তিস্তা নদী কেবল সিকিম, পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের মানুষের জন্য একটি জীবনরেখা নয়, আমাদের প্রাকৃতিক ঐতিহ্যের একটি অপরিহার্য অংশও। সে যে আজ বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে তা থেকে রক্ষা করার জন্য আমাদের অবিলম্বে ব্যবস্থা নিতে হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এই অত্যাবশ্যকীয় সম্পদ সংরক্ষণের দায়িত্ব আমাদের। তিস্তা বাঁচলে, তিস্তা অববাহিকার প্রাণবৈচিত্র্য বাঁচে। তবেই না বাঁচে তিস্তাপাড়ের মানুষ! আসুন, যে কোনও মূল্যে তিস্তা নদী রক্ষায় নিজেদের সামিল করার জন্য অঙ্গীকার করি। ধন্যবাদ।
বিপন্ন তিস্তা কনভেনশন
আয়োজক: অভিমুখ,জলপাইগুড়ি
প্রস্তাবনা লিখলেন
অধ্যাপক রূপক পাল
উত্তর বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়
আরও পড়ুন – যশোর রোডের গাছ ও পাগলা ঘোড়া