সুকপে অঞ্চলের ধ্বস সম্পর্কিত সাক্ষাৎকার

১. আপনার নাম কী এবং আপনি কোন গ্রামের বাসিন্দা?

আমি মায়ালমিৎ লেপচা জম্ভুতে থাকি, সুকপে গ্রাম থেকে আরো উত্তরে।

২.আপনাদের সংগঠনের নাম কী এবং তিস্তা নদী বাঁচানোর স্বার্থে আপনারা এযাবৎ কতদূর এগিয়েছেন?

আমাদের সংগঠনের নাম আফেক্টেড সিটিজেনস অফ তিস্তা (ACT)। জম্ভূতে দুটি বাঁধ তৈরির প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল, ১৭ বছরের টানা আন্দোলনের কারণে সেই পরিকল্পনা এখনও পর্যন্ত সম্পন্ন হতে পারেনি।

৩. এই যে দুটি বাঁধ প্রকল্পের কথা আপনি বলছেন – সেই দুটি কোন কোন অঞ্চলে তৈরি করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল?

জাম্ভূতেই – আদিবাসী লেপচাজনদের জন্য সংরক্ষিত একটি অঞ্চলে এই বাঁধ তৈরির পরিকল্পনা করা হয়। আমাদের সংস্থা সরকারি মদত প্রসূত এই বাঁধ তৈরির বিরুদ্ধে রুখে দাড়ায়। গত ১৭-১৮ বছর যাবত আমরা এই বিরোধিতা চালিয়ে যাচ্ছি। সুকপে অঞ্চলে যে ধ্বস নেমেছে সেটি মূলত তিস্তা নদীর ওপরে স্টেজ V ড্যাম নির্মাণের কারণে ঘটেছে। ৫১০ মেগাওয়াটের এই ড্যামের তলা দিয়ে টানেল লিংক এবং ওপর দিয়ে হাই এক্সটেনশন তার যাচ্ছে। প্রতিবছর একাধিক বার ফাটল ও ধ্বস জনিত এই সমস্যার কথা সরকারকে জানানো সত্ত্বেও সুকপের বাসিন্দারা কোনো প্রকারের সরকারি সহায়তা পাননি।

৪. গ্রামবাসীদের পুনর্বাসনের কোন ব্যাবস্থা সরকারি পক্ষ থেকে কি নেওয়া হয়েছে?

১৯৮৯ সাল থেকে স্টেজ V ড্যাম নির্মাণের কাজ শুরু হয়। তখন থেকে আজ পর্যন্ত ড্যামের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামবাসীরা NHPC কতৃক পুনর্বাসন সংক্রান্ত কোনোরকম সহায়তা পাননি, এমনকি হালের এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেও কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। বর্তমানের এই আপৎকালীন পরিস্থিতিতে গ্রামের স্কুল এবং অফিসেই গ্রামবাসীদের ঠাই মিলেছে।

৫. আপনাদের এই ড্যাম বিরোধী  আন্দোলনের সঙ্গে সুকপে গ্রামের বাসিন্দারা কি জড়িত হয়েছে?

এখনো অবধি জড়িত হননি। তবে প্রতি বর্ষায় ক্রমাগত ধ্বস জনিত নানান সমস্যায় জর্জরিত সুকপের গ্রামবাসীরা পুনর্বাসনের দাবি নিয়ে রাস্তায় নামতেন। কিন্তু কোনো না কোনো কারণ বসত তারা আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তেন। জম্ভু থেকে আরো উত্তরে NHPC চালিত আরো ৩টি বাঁধ প্রকল্প রয়েছে। একটি স্টেজ iv যা ৫২০ মেগাওয়াটের, দ্বিতীয়টি আরো একটু ওপরের দিকে – এটি ৩২০ মেগাওয়াটের, এবং তৃতীয়টি হলো রংজিত ড্যাম অর্থাৎ স্টেজ iii – যা সিকিমের সর্বোচ্চ মেগাওয়াট সম্পন্ন ড্যাম – ১২০০ মেগাওয়াট বিশিষ্ট। ২০১৭ তে এটির পারমিশন হয়।

কিন্তু আমাদের জম্ভুতে যে বাঁধ তৈরির পরিকল্পনা করা হয়েছিল তীব্র আন্দোলনের জেরে তা এখনও সম্পূর্ণ হতে পারেনি।

৬. জম্মু থেকে সুকপের যোগাযোগ ব্যাবস্থা কতখানি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে?

আমার গ্রামে পৌঁছানোর ৩টি রাস্তা আছে। ধ্বস নামার কারণে ন্যাশনাল হাই-ওয়েটি বন্ধ হয়ে গিয়েছে, যেটা মূলত সুকপে থেকে উত্তর সিকিমের বিভিন্ন জেলায় পৌঁছানর মূল রাস্তা। তাছাড়াও ডিকচু পর্বতমালার প্রায় দুই কিলোমিটারেরও বেশি পথ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এই ন্যাশনাল হাই-ওয়েটি রাষ্ট্রীয় প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা। আমরা এই ড্যাম বিষয়ক ক্ষতি সমন্ধে সরকারকে বারংবার সাবধান কারার পরেও তার এই সংবেদনশীল অঞ্চলে একের পর এক বাঁধ নির্মাণ করে চলেছে। এই তো সবে শুরু , ভবিষ্যতে আরও বৃহৎ দুর্ঘটনার অভ্যাস পাচ্ছি আমরা। জম্ভু অঞ্চলে বাঁধ নির্মাণের কাজ যতটুকু শুরু হয়েছিল তার প্রভাব আমাদের গ্রামে বর্ষায় ধ্বস ও বন্যার পরিমাণ আগের তুলনায় অনেক মাত্রায় বেড়ে গিয়েছে।

১৩ আগস্ট ২০১৬তে ইয়ংদং নামে তিস্তার একটি শাখা নদীর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে এক বিপুল ধ্বস নামে। এখনো পর্যন্ত সেই ক্ষতিগ্রস্থ অঞ্চলটির পুনঃনির্মাণ কার্য শুরু হয়নি। ওই অঞ্চলের ১২-১৩ টি গ্রাম এখনও পর্যন্ত সম্পূর্ণরূপে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। সরকার ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তার মেরামতির পক্ষে কোন রকম পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।

১. এই পরিস্থিতিতে বিপক্ষ রাজনৈতিক দল গুলির তৎপরতা কতখানি দেখা যাচ্ছে?

কোন রাজনৈতিক দল সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে বলে এখনও খবর পায়নি। তবে তারা NHPC কে এই ধ্বসের জন্য দায়ী করছে না। গতবছর এই বাঁধ অঞ্চলেও ধ্বস নেমেছে। সেখানকার সমস্ত রাস্তা ধ্বসে যায়। আমরা NHPC কেই এই দুর্যোগের জন্য দায়ী বলে মনে করি।

২.  জোশীমঠ ধ্বসে যাচ্ছে – এই সমন্ধে আপনার মতামত কি?

আমরা জোশীমঠ গিয়েছিলাম। সুকপের ধ্বস এবং জোশীমঠের প্রায় ৯ সেন্টিমিটার বসে যাওয়া – এই দুটি মোটেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বিচার বিবেচনা ছাড়া অযাচিত হারে বাঁধ নির্মাণ এর মূল কারণ। এর ফলে গোটা দেশবাসীর জীবনযাত্রা প্রভাবিত হবে বলে মনে করি কারণ এই তিস্তা নদীই পশ্চিমবঙ্গ হয়ে বাংলাদেশ পৌঁছেছে। তাই নদীর নিম্ন গতিতে‌ বসবাস করি জনগণেরও উচ্চগতির বাসিন্দাদের ক্ষতি এবং বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে তাদের আন্দোলন সমন্ধে ওয়াকিবহাল থাকা উচিত।

৩. সুকপের ধ্বস ও ক্ষতিগ্রস্থ মানুষদের সামনে রেখে কোন আন্দোলন গড়ে তোলার কথা ভাবছেন?

এই হাইড্রোলিক ড্যাম নির্মাণ ও তার কুফল ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ দুটি বিষয়। সিকিমের প্রায় প্রতিটি গ্রাম এই এক সমস্যার ভুক্তভোগী। জম্ভু তে দুটি বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে আমরা ইতিমধ্যে ক্রমাগত আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছি, আমাদের পক্ষে তাই সরাসরি সুকপেতে আন্দোলন গড়ে তোলা একটু কঠিন। তাছাড়াও অপরের ওপর ভরসা করার চেয়ে নিজেদের সরব হওয়াই অনেক বেশি কার্যকরী।

এই মারণ বচন পরিস্থিতিতে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষেরা যদি একত্রিত হয়ে আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেন তবেই এর সুরাহা হবে বলে আমার ধারণা l আমরা তাদের আন্দোলনকে পূর্ণ সমর্থন করবো।

ফিচার ছবি – সংগৃহীত