কুশকর্নী যাত্রা

তারা হাঁটছেন। হেঁটেই চলেছেন। শব যাত্রায় হেঁটে চলেছেন। বুকে আগলে নিয়ে চলেছেন কুশকর্নীর মৃতদেহ।  সাশ্রু নয়নে তারা হেঁটে চলেছেন মরা কুশকর্নীর পাড় ধরে। তাদের কেউ নদীয়া থেকে এসেছেন, কেউ হুগলী থেকে, কেউ হাওড়া থেকে। কয়েকজন কুশকর্নী পাড়ের মানুষ পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছেন। একের পর এক গ্রাম অতিক্রম করছেন তারা। কুশকর্নীর পাড়ের গ্রামগুলি। ‘ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড়’ থেকে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে আসছেন মানুষ, দলে দলে। কুশকর্নীর শব দেহে নীরবে পুষ্প বর্ষন করছেন। পায়ে পায়ে এগিয়ে চলেছেন তাদের সঙ্গে। অগ্রহায়ণের শীতের বেলা গড়িয়ে চলেছে দ্রুত। উৎসস্থল থেকে মোহনা অব্দি এগিয়ে চলেছেন তারা। শোক বিহ্বল মুখে এসে পড়েছে অস্তরাগের লালিমা। একটা কান্না গুমরে গুমরে উঠছে নদী পাড়ের গ্রামগুলো থেকে। তারা হাঁটছেন। তাদের যাত্রাপথের পাশে পড়ে রয়েছে রক্তাক্ত দেহ কুশকর্নী। একদা এই কুশকর্নীর আমোদে আমোদিত হয়ে উঠতো এই জনপদ গুলি। বর্ষার দুকূল ছাপিয়ে সৌভাগ্যের প্লাবন আসতো তার বুকে। প্লাবিত অববাহিকার বুক জুড়ে রোপন করা হত সোনার ফসল। এমনই হেমন্তের দিনে সেই ফসল ঘরে ঘরে বয়ে নিয়ে আসতো সমৃদ্ধির বার্তা। কুশকর্নীর কুলু কুলু কলতানে মিশে যেত ইতু লক্ষীর শাঁখের আওয়াজ, নবান্নের গন্ধ। জন্ম জন্মান্তরের নদীর সাথে সেই সম্পর্ক বড় আপন, বড় নিবিড়।

এই তো কিছুদিন থেকে, দু দশ বছর হয়তো, কোথা থেকে এলো সব দানবের দল। তারা বালি নিলো, নদীর পাড়ের গাছ নিলো, নদী গর্ভের মাটি তুলে ইঁটের বেসাতি শুরু করলো। ভরভরন্ত নদীর দেহ শুকিয়ে আসতে লাগলো ধীরে ধীরে। ধুঁকতে ধুঁকতে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে লাগলো কুশকর্নী। এরপর যখন হাঙরের মতো বিশালাকায় যন্ত্র এসে নদীর বুক থেকে খাবলে খাবলে তুলতে লাগলো রক্ত, মাংস, অস্থি মজ্জা, কবেই যেন আমাদের প্রাণের ধারা শুকিয়ে গেলো। মরে গেলো স্রোতস্বিনী , প্রাণ প্রবাহী কুশকর্নী। আর বর্ষায় জেগে ওঠেনা, আর ফসল ফলে না, আর হেমন্তের দিনে সোনারূপে সেজে ওঠেনা, আর কলাই এর লতা চলার পথে পায়ে পায়ে মায়ায় জড়ায় না। সব শেষ হয়ে গেছে।  সেই শোক মিছিল বেরিয়েছে আজ। গলায় তাদের কান্না ভেজা মরমী সুর, ‘ নদীর লাইগ্যা কাঁদি মোরা, গাছের লাইগ্যা কাঁদি’। সেই কান্নার স্রোত বয়ে চলেছে সাহাবাদ থেকে গাংমুড়ি, আড়ালী থেকে লাউজোড়, হরিপুর থেকে খটঙ্গা সর্বত্র। অজান্তেই সেই কান্নার সুরে সুর মিলিয়েছে ময়ূরাক্ষী। হৃদয় নিংড়ানো কান্নার স্রোত দমকে দমকে বয়ে গেলো কুশ কর্নীর পাড়ে পাড়ে। আচমকা সেই কান্নার স্রোত ঠেলে উজান বেয়ে এগিয়ে আসতে লাগলো একটি দেহ, শীর্ণ কিন্তু দৃপ্ত, কোমল কিন্তু সোচ্চার, একটি প্রতিরোধের আহ্বান, একটি প্রতিবাদ। স্বজন হারা কান্না থেকেই শক্তি সঞ্চয় করে উঠে আসছে একটি দৃপ্ত প্রতিবাদ। এগিয়ে চলো প্রতিবাদ, এগিয়ে চলো, আমাদের বাঁচার শক্তি দাও, আমাদের ক্ষুধার আহার দাও, আমাদের তৃষ্ণার জল দাও, আমাদের শান্তির ছায়া দাও, আমাদের নদীকে বাঁচিয়ে দাও।

আরও পড়ুন – তিলাবনী শুধু একটি পাহাড় না, তিলাবনী আমাদের মা – আমাদের ভাষা – আমাদের পরিচয়