সৌন্দর্যশাস্ত্র ও দলমিলিয়ে দেওয়ালচিত্র রাজনগর, বীরভূম

প্রশ্ন হচ্ছে সৌন্দর্যশাস্ত্র (aesthetics) থেকে রাজনীতির দূরত্ব ঠিক কতখানি ?

আজ থেকে প্রায় 32/33 বছর আগে কলকাতার ফুটপাথ থেকে খুব কম দামে, আমার তখনকার সাধ্যের মধ্যে ডুরান্ট সাহেবের (Will Durant) “ফিলসফির গপ্পো” বইখানির (Stories of Philosophy) একটা বেআইনি সংস্করণ কিনি। ওটাই সম্ভবত আমার কেনা প্রথম দর্শন সংক্রান্ত কোনো বই। এখনো পরিষ্কার মনে আছে, বইটির ভূমিকায় উনি বলছেন যে দর্শনের পাঁচটা স্তম্ভের কথা, যা যথাক্রমে নীতিশাস্ত্র, সৌন্দর্যশাস্ত্র, তর্কশাস্ত্র, রাজনীতি আর অধিবিদ্যা। আজকে বুঝি যে ব্যাপার গুলো খুব আলাদা কিছু না। অর্থাৎ, নীতিশাস্ত্রের মধ্যে যেমন সৌন্দর্যশাস্ত্র, তর্কশাস্ত্র, রাজনীতি আর অধিবিদ্যা ঢুকে আছে, ঠিক তেমনই সৌন্দর্যশাস্ত্রের মধ্যে ঢুকে আছে নীতিশাস্ত্র, তর্কশাস্ত্র, রাজনীতি আর অধিবিদ্যা। অর্থাৎ প্রতিটি শাস্ত্রই একে অপরের সাথে জট পাকিয়ে আছে, ঠিক যেন একটা বিনুনির মতো। দর্শনের বিনুনি।

দেওয়ালচিত্র

অর্থাৎ আমি বলতে চাইছি, এই যে ছেলেমেয়েদের নিয়ে তাদের গ্রামের মাটির দেওয়ালে আমরা ছবি আঁকছি, তার নিশ্চিন্তে একটা সৌন্দর্যের দাবি আছে। কিন্তু শুধুমাত্র সৌন্দর্যের দাবিই ব্যাপারটা শেষ হয়ে যায় না। এবং এই জায়গাটাই পরিষ্কার করা দরকার।

আমরা গ্রামে গ্রামে ঘুরে বুঝেছি যে, এই যে আমাদের গ্রামগুলোতে সাবেকি মাটির বাড়িগুলো ছিলো, আস্তে আস্তে তার জায়গা দখল করে নিচ্ছে ইট, বলি, সিমেন্টের বাড়ি। এবং সেই সব কংক্রিট প্লাস্টারের বাড়ি তৈরির পেছনে রাষ্ট্র তথা সরকারের ইন্ধন আছে। সরকারি স্কীমে গ্রামের লোকজনকে এই পাকা বাড়ি বানানোর জন্য পয়সা দেওয়া হচ্ছে। এক দু টাকা নয়, পরিবার পিছু প্রায় এক দের লাখ করে টাকা দেওয়া হচ্ছে। যুক্তিটা কি? লোকগুলো ভালোভাবে থাকবে। খরা বা বন্যার হাত থেকে সহজে বাঁচতে পারবে। এই টাকার উৎস কি? অবশ্যই করদাতাদের গাঁটের কড়ি।

দেওয়ালচিত্র

এখন প্রশ্ন হচ্ছে যে, এই যুক্তি রাষ্ট্র তথা সরকারকে বোঝালো কে? অবশ্যই পন্ডিতেরা। মনে রাখতে হবে যে এই পুঁজিপোষিত রাষ্ট্র করদাতাদের পয়সায় ভাড়াটে পন্ডিত পোষে। এবং এইসব পন্ডিতেরা ছড়িয়ে আছেন বিভিন্ন বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিকল্পনা কমিশনহয়ে সুদূর জাতিসংঘ পর্যন্ত। এই সব ভাড়াটে পন্ডিতদের অবধারিত পেশা হচ্ছে পুঁজি ও রাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষা করা (ইংরেজিতে Intellectual mercenary যাকে বলে)। এবং তার বদলে পুঁজি ও রাষ্ট্র তাদের অমুক পুরস্কার, তমুক পুরস্কারে ভরিয়ে দেয়, বা অমুক পোস্ট, তমুক পোস্ট পাইয়ে দেয়। 

অর্থাৎ, একটু চিন্তা করলেই বুঝতে অসুবিধা হয়না যে এই পন্ডিতেরা এমন বুদ্ধি বার করেছে যাতে করদাতাদের পয়সায় সিমেন্ট, লোহা এবং আবাসন শিল্প রমরমিয়ে ব্যবসা করতে পারে। এবং তা করতে গিয়ে যদি প্রকৃতি ও পরিবেশের সাড়ে সর্বনাশও হয় তাতেও থোড়াই কেয়ার। তা করতে গিয়ে যদি মাটির নিচে থেকে চুনা পাথর তুলতে হয় তুলবে, লোহা তুলতে হয় তুলবে। কয়লা তুলতে হয় তুলবে। বালি তুলতে হয় তুলবে। তুলবে, তুলে সব শেষ করবে। ধ্বংস করবে প্রকৃতি ও পরিবেশ, না করে ছাড়বে না।

দেওয়ালচিত্র
দেওয়ালচিত্র

এখন, এই লোকগুলো তাদের সাবেকি পরিবেশবান্ধব মাটির বাড়িতে ছিল। তাদেরও bandwagon effect (ব্যান্ডওয়াগন প্রভাব, অর্থনীতির ভাষায় এই শব্দ ব্যবহৃত হয় মানুষের অন্যকে দেখে কোনো কিছু করার প্রবণতা কে বোঝাতে) এর সর্বনাশা নেশায় মাতিয়ে দিলো। ও করছে, ওরা করছে, তাই আমাকেও করতে হবে পাকা বাড়ি। আর টাকা দেওয়ার জন্য তো গৌরী সেন আছেই। অর্থাৎ নিশ্চিন্তে ভেঙে ফেল এতদিনকার বাপ ঠাকুরদার তৈরি মাটির বাড়ি। তার জায়গায় পাকা দালান তলো। আর পায় কে আমাদের।

কিন্তু এই লোক গুলো জানে না যে সারা পৃথিবীতে যে কার্বন নিঃসরণ হয় তাতে সিমেন্ট শিল্পের অবদান প্রায় ৮%. তাতে লোহা এবং ইস্পাত শিল্পের অবদান অন্তত পক্ষে ১০/১২%. এবং ওরা এও জানেনা যে আর কিছুদিনের মধ্যেই পৃথিবীতে পানীয় জলের সাথে বালি তথা সিলিকার গুরুতর সংকট দেখা দেবে।

এবং তার সাথে এই লোকগুলো এও জানেনা যে পাকা বাড়িতে গরম বেশি হয়, শীত বেশি করে। ওরা জানেনা যে পাকা বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ খরচ অনেক বেশি। ওরা জানেনা যে পাকা বাড়ির আয়ু মাটি বাড়ির তুলনায় অনেক কম। ওরা জানেনা যে পাকা বাড়ি ফ্যাশন আর মাটির বাড়ি স্টাইল। এবং সব থেকে বড় কথা হলো, ওরা জানেনা যে মাটির বাড়ির আবেদন, সে বাস্তুতান্ত্রিক বিচারেই হোক বা সৌন্দর্যেশাস্ত্রের বিচারে, অনেক, অনেক বেশি।

দেওয়ালচিত্র
দেওয়ালচিত্র

তাই আমরা বেছে বেছে গ্রামের ছেলেমেয়েদের নিয়ে ওদের কয়েকটি পরে থাকা মাটির বাড়ির দেওয়ালচিত্র আঁকছি। সে ছবি একান্তই নিষ্পাপ ছবি। অর্থাৎ ছবির বিষয়বস্তুর মধ্যে সরাসরি কোনো রাজনীতির কথা নেই। কিন্তু, গ্রামের মাটির বাড়ির দেওয়ালচিত্র আঁকাটা, এই বিশেষ কাজটিই একটা প্রতিবাদ হয়ে উঠছে। সে ওই সব শিশুদের সাথে অনুচ্চারিত কণ্ঠস্বরে নীরবে নিঃশব্দে বলছে, বলে চলেছে। ”মাটির বাড়ি, তুমি খুব সুন্দর”। অর্থাৎ, এই সৌন্দর্যের আবেদন এক রাজনৈতিক আবেদনের রূপ পরিগ্রহ করেছে। এবং একই সঙ্গে এক নৈতিক আবেদন (বা এক বস্তুনৈতিক আবেদন)

যা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে সিমেন্ট কংক্রিটের ওই পাকা বাড়িগুলি কুচ্ছিত, এবং তার পেছনের রাজনীতি-অর্থনীতিটা আরো বেশি কুচ্ছিত, কুচ্ছিত কারণ ওগুলো পরিবেশ/বস্তুবান্ধব নয়। ওগুলো ওগুলো বস্তু-অনৈতিক।

আর সব থেকে আনন্দের ব্যাপার এই যে, আমরা উদ্বুদ্ধ করতে পেরেছি এই বাচ্ছাগুলোকে দেওয়ালচিত্র অঙ্কনের জন্য । তাই এখন এদের একান্ত বাসনা এই যে, এই সুন্দর সুন্দর দেওয়ালচিত্র আঁকা মাটির বাড়িগুলি, যা আসলে অনেক বেশি সুন্দর, তা যেন বড়রা ভেঙে ফেলার কথা মোটেই না ভাবে। এটাই আমাদের পরিবেশ প্রতিরোধ আন্দোলনের নান্দনিক/রাজনৈতিক সূত্র।

আরও পড়ুন – শহীদ শংকর গুহ নিয়োগী