চিপকো আন্দোলনের প্রেক্ষাপট- সার্ধ শতবর্ষ পূর্তিতে একটি সময়ানুগ আলোচনা

স্বাধীন ভারতে পরিবেশ বিষয়ক আন্দোলনগুলির মধ্যে অন্যতম হল চিপকো আন্দোলন। বাণিজ্যিতভাবে গাছকাটা ও বন উজাড় করে দেওয়ার সরকারের যে নীতি, তার বিরোধিতা করে ১৯৭০ এর দশকে প্রতিবাদীরা গাছকে জড়িয়ে ধরে গাছকাটার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। এই আন্দোলনে পুরুষরা অংশগ্রহণ করলেও আন্দোলনের প্রান ছিল মহিলাদের স্বতঃস্ফূর্ত নিবেদিত চেতনা। মহিলারাই বনাঞ্চল ধ্বংসের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন। তাই এই আন্দোলনকে একটি নারীবাদী আন্দোলন বললে অতিশয়োক্তি হয় না। ১৯৮৭ সালে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি হিসাবে এই আন্দোলনকে রাইট লাইভলিহুড সম্মানে ভূষিত করা হয়। পরবর্তীকালে ভারতবর্ষে যত পরিবেশ বিষয়ক আন্দোলন হয়েছে তার প্রত্যেকটি কোনোনা কোনোভাবে এই আন্দোলন দ্বারা প্রভাবিত।

কোন আন্দোলন রাতারাতি শুরু হয় না। তার একটা প্রেক্ষাপট থাকে। প্রদীপ জ্বালানোর আগে থাকে সলতে পাকানোর ইতিহাস। এই আন্দোলনের প্রেক্ষাপট বুঝতে আমরা বেশ খানিকটা পিছিয়ে যাব। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের সময়। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই বিদ্রোহ নিষ্ঠুরভাবে দমন করেছিল। কিন্তু ব্রিটেনে আসীন তৎকালীন ব্রিটিশ রাজ এটা বুঝেছিলেন যে একটা কোম্পানিকে দিয়ে আর যাইহোক এতো বড় দেশ চালানো সম্ভব নয়। ফলে ব্রিটেনের রানিমা সমস্ত ক্ষমতা তার নিজের হাতে তুলে নেন আর তিনি এদেশের সম্রাজ্ঞী হয়ে বসেন। ক্ষমতা কুক্ষিগত ও কেন্দ্রীভূত করতে এবং দেশীয় সম্পদের লুঠপাটকে আরও সংগঠিত করতে তিনি সচেষ্ট হন। সারা দেশ জুড়ে শুরু হয় রেলপথের বিস্তার, যোগাযোগ ব্যবস্থার সম্প্রসারন, নতুন নতুন কলকারখানার স্থাপন, খনিজ সম্পদের উত্তোলন এবং দেশীয় শিল্পের ধ্বংসসাধন ইত্যাদি। এর সাথে ধাপে ধাপে বাড়তে থাকে বনজঙ্গল এবং প্রাকৃতিক সম্পদের ধ্বংসসাধন।

আমাদের দেশে বনজঙ্গলগুলিকে কেন্দ্র করে অসংখ্য মানুষ যাদের আমরা সাধারণত উপজাতি গোষ্ঠী ভুক্ত মানুষ বলি তারা হাজার বছর ধরে বসবাস করে আসছে। তারা বন থেকে জ্বালানী কাঠ, ফলমূল, বিভিন্ন উপজাত দ্রব্য এবং পশুখাদ্য সংগ্রহ করে। তারা তাদের বেঁচে থাকার জন্য সামান্য কৃষিকাজও সম্পাদন করে। এবং তারা সব কিছুই করে পরিবেশের বিন্দু মাত্র ক্ষতি না করে। তারা এটা বোঝে যে পরিবেশ তাদের মা। পরিবেশ আছে বলেই তাদের অস্তিত্ব টিকে আছে। বর্তমান উত্তরাখণ্ডের গাড়োয়াল অঞ্চল ও এর ব্যতিক্রম ছিল না। কিন্তু ক্রমাগত অরণ্য ধ্বংসের ফলে পশুখাদ্যের অভাব দেখা দিল। ভূমিক্ষয় বাড়ল। তার পরিনতি হিসাবে এল বিধ্বংসী বন্যা। ভূগর্ভস্থ জলের স্তর কমতে থাকল। অসহায় হয়ে সাধারণ মানুষ তাদের জন্মভূমি ছেড়ে শহরের ঘনবসতিপূর্ণ  অঞ্চলে পাড়ি জমাতে শুরু করল। এখানে তারা বেছে নিল শ্রমিকের জীবন, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ এবং অপুষ্টি। মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে নেমে এল ব্রিটিশ সরকারের বনসংরক্ষণ বিষয়ক আইন Indian Forest Act, 1927. এর দ্বারা বনাঞ্চলে আদিবাসী মানুষদের অধিকারকে আরও খর্ব করা হল। ১৯৬০এর দশকের মধ্যে পুরো ব্যাপারটি অসহনীয় হয়ে উঠল।

আরও একটি বিষয় হল, ১৯৬২ সালের চীন-ভারত সংঘর্ষ। এই সংঘর্ষে ভারত একপ্রকার পরাজিতই হয়। চীন অত্যন্ত ক্ষিপ্র গতিতে ভারতে প্রবেশ করে ভারতীয় ভূখণ্ড দখল করে এবং অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে তারা নিয়ন্ত্রণ রেখার ওপারে চলে যায়। সাথে করে নিয়ে যায় দেশের গরিমা। তখন চীন তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশ। তার না ছিল পারমানবিক শক্তি না অর্থনৈতিক শক্তি। ভারতের পরাজয়ের পেছনে অনেক কারন ছিল কিন্তু তার মধ্যে অন্যতম ছিল সীমান্তবর্তী অঞ্চলে পরিকাঠামোর অভাব। এই আঘাত বুঝিয়ে দিল যে চীন পাকিস্থানের মত hostile country থেকে নিজেকে রক্ষা করতে গেলে সীমান্তবর্তী অঞ্চলে পরিকাঠামো নির্মাণ অধিক প্রয়োজন। এর ফলে অরণ্য ধংসের প্রবনতা আরও বাড়ল।

প্রখ্যাত গান্ধীবাদী সমাজকর্মী চণ্ডী প্রসাদ ভাট ১৯৬৪ সালে বর্তমান উত্তরাখণ্ডের চামোলী গোপেশ্বরে দাশোলী গ্রাম স্বরাজ সঙ্ঘ স্থাপন করেন। উদ্দেশ্য ছিল বনজসম্পদ ব্যবহার করে সেখানকার মানুষদের জন্য ক্ষুদ্র ও কুটীর শিল্পের বিকাশ ঘটানো। কিন্তু এই কাজটি করতে গিয়ে তারা যে সমস্যাগুলির সম্মুখীন হল তা হল ব্রিটিশ সরকার প্রণীত দমনমূলক অরণ্য সংক্রান্ত আইন এবং ঠিকাদারি ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থার দ্বারা বনজসম্পদের পন্যায়িতকরন করা হত। শহর থেকে আগত ঠিকাদারদের কাছে বনের অংশবিশেষ এর নিলাম করা হত। এরপর ঠিকাদার শহর থেকে শ্রমিক এবং যন্ত্রপাতি নিয়ে এসে নিলামে ওঠা অংশের বৃক্ষচ্ছেদন এবং তার বাজারজাতকরণ করত। স্থানীয় বাসিন্দারা অত্যন্ত স্বল্প মজুরির কাজ পেত, অন্যদিকে শহর থেকে আগত শ্রমজীবী মানুষের চাপে স্থানীয় পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হতে থাকল। ১৯৭০ সালে অলকানন্দা নদীতে যে ভয়াবহ বন্যা হয় তার ফলে বদ্রিনাথ থেকে হরিদ্বার পর্যন্ত ৩২০ কিলোমিটার ব্যাপী নদীর দুপাশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্লাবিত হয়। বাঁধ নির্মাণ, সেতু নির্মাণ, রাস্তাঘাট তৈরি প্রভৃতি সিভিল ইঞ্জিনিয়ারীং কাজের ফলে ভূমিধ্বস, ভূমিক্ষয় প্রভৃতি সমস্যাগুলি আর প্রকট হয়ে ওঠে। গাড়োয়াল হিমালয়ের দৈনন্দিন জীবনযাপন আরও দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। ফলে মানুষের মধ্যে পরিবেশ সংক্রান্ত সচেতনতা বাড়তে থাকে। পরিবেশ রক্ষার তাগিদে তারা আস্তে আস্তে জোটবদ্ধ হতে শুরু করে। মহিলারাও ছোট ছোট দলে সঙ্গবদ্ধ হতে শুরু করে। বিভিন্ন স্থানে ছোট ছোট সভা, আলোচনাচক্র, মিছিল প্রভৃতি চলতে থাকে জনজাগরনের উদ্দেশ্যে। আন্দোলন আস্তে আস্তে গতি পেতে শুরু করে। প্রথম প্রতিরোধটি গড়ে ওঠে ১৯৭২ সালের শেষেরদিকে। সঙ্ঘ তাদের শিল্পকর্ম সম্পাদনের জন্য সরকারের কাছ থেকে বছরে ১০ টি আশ গাছের আবেদন করে। বনবিভাগ তাদের আবেদনকে নাকচ করে এবং এলাহাবাদ থেকে আগত সাইমন কোম্পানিকে টেনিস র‍্যাকেট তৈরি করার জন্য ৩০০ টি গাছের ইজারা দেয়। ১৯৭৩ সালের মার্চ মাসে যখন ঠিকাদার গাছ কাটার জন্য আসে তখন তাদের ঘিরে সঙ্ঘের লোকেরা স্লোগান দিতে থাকে। যার ফলে ঠিকাদার পিছু হটতে বাধ্য হয়। বনবিভাগ ও পিছিয়ে আসে, সাইমন কোম্পানির ইজারা বাতিল করে এবং সঙ্ঘের চাহিদামত তাদের বছরে ১০ টি আশ গাছ দিতে রাজি হয়। কিন্তু ব্যাপারটি এইখানেই থেমে থাকে না। তাদের বিপন্নতার এমন একটি পর্যায়ে এই প্রতিরোধটি গড়ে ওঠে যে এটি দ্রুত দাবানলের মত চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। যেখানেই গাছ কাটা হতে থাকে সেখানেই সঙ্ঘের মহিলা সদস্যরা গাছকে আঁকড়ে ধরে ঠিকাদারের কাজে বাধা সৃষ্টি করতে থাকে। এই সংঘাত চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায় যখন বনদপ্তর অলকানন্দা নদীর সমস্যাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে রেনি নামক গ্রামে ২৫০০ গাছ কাটার ইজারা দেয়। চণ্ডী প্রসাদ ভাট মহাশয় এই স্থানে উপনীত হন এবং গ্রামবাসীদের নিয়ে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ১৯৭৪ সালের মার্চ মাসের ২৫ তারিখ ঠিকাদারের লোকেরা অত্যন্ত সুচতুরভাবে স্থানীয় আন্দোলনকারীদের সরিয়ে দেয় এই বলে যে সরকার থেকে তাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হচ্ছে। আন্দোলনকারীরা সেখান থেকে সরে গেলে গাছ কাটার কাজ আবার শুরু হয়। এদিকে একটি ছোট মেয়ে গ্রামীণ মহিলা মঙ্গল দলের প্রধান গৌরা দেবীকে সেই খবরটি পৌঁছে দেয়। গৌরা দেবী তার মহিলা সহযোদ্ধাদের নিয়ে তৎক্ষণাৎ সেই স্থানে পৌঁছে যান এবং গাছ কাটতে বাধা দেন। ঠিকাদারের কর্মী তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করলে এবং গুলি করে মেরে ফেলার ভয় দেখালে তার অকুতোভয় হয়ে গাছেদের আলিঙ্গন করে গাছ কাটতে বাধা দেন। সারা রাত তারা এই ভাবে প্রতিরোধ করেন। সকালে এই খবর পেয়ে আন্দোলনকারীরা এবং চারপাশ থেকে অসংখ্য লোকজন জমায়েত করতে থাকে। অবশেষে চার দিন পর ঠিকাদাররা পিছু হটতে বাধ্য হয়। আন্দোলন তার প্রাথমিক সাফল্য লাভ করে।

উপসংহারে এই কথা বলা যেতে পারে যে এটি মূলত একটি পরিবেশ আন্দোলন হলেও এর পেছনে শতকের ও বেশি সময়ের বঞ্চনার ইতিহাস লুকিয়ে আছে। আজ আর একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে পরিবেশের সঙ্গে জীব জগতের বিশেষত মানুষের এক গভীর সম্পর্ক রয়েছে। তাই পরিবেশ নষ্ট হলে তা মানব জীবনে ভয়ানক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। এই আলোচনা থেকে এই কথাটি ও বোঝা যায় যে, যে কোন আন্দোলনের সফলতার পেছনে থাকে সাধারণ মানুষের সচেতনতা এবং তাদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। প্রকৃতি, পরিবেশ, মানুষকে অবহেলা করে, বিপন্ন করে এই প্রচলিত উন্নয়নের ধারনা বদলে ফেলে, মানুষ, প্রকৃতি ও পরিবেশকে  সহাবস্থানে নিয়ে এগিয়ে চলুক দেশ, এগিয়ে চলুক বিশ্ব।

আরও পড়ুন – অবলুপ্তির পথে কোপাই নদী ও তার উৎস, কিছু নীরিক্ষণ কিছু বিশ্লেষণ