একবার একটা জায়গা দিয়ে একটা নদী বয়ে যেত, তার পাশে ছিলো জঙ্গল। সেই জঙ্গলে রাষ্ট্র ব্যবস্হার নিয়মে মানুষ এসে বসতি স্থাপন করলো। একদিন এই ব্যবস্থাই জঙ্গল কেটে সাফ করলো দোহাই দিল নদীর জল কাজে লাগিয়ে চাষের সুবিধা করবে। চাষীরা চাষ করতে গিয়ে দেখলো নদীর জল কমে যাচ্ছে, চাষের ক্ষতি হচ্ছে পর্যাপ্ত ফসল আর ফলছে না, চাষের কাজ না হলে এবার তারা কী করবে!
এই সংকটের সমাধান বাস্তবে অনিশ্চিত, কারণ এই ব্যাপারে মানুষের বোঝার জায়গায় একটা গলদ থেকে যাচ্ছে— বেশ কিছু প্রজন্ম ধরে এই ধারণাটাই তৈরী হয়েছে যে জীবন ধারণের নীরাপত্তাহীনতায় চাষের ক্ষতির তুলনায় নদী কিংবা জঙ্গলের নষ্ট হয়ে যাওয়া টা গৌণ। অথচ জল— জঙ্গল — জমি পারস্পরিক সম্পর্কের সূত্রে জড়িত এই ভাবনাটা তারা ভুলে গিয়েছে, ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। উন্নত হওয়ার তাগিদে মানুষ প্রাপ্তি, অপ্রাপ্তির হিসাব করতে শিখেছে, সংরক্ষণ ও সংযোগের ক্ষেত্রটি ভুলতে বসেছে।
কোপাই নদী তার বর্তমান সংকটে পতিত হয়েছে ব্যবস্থা নির্ধারণকারী মানুষের এই বোধ হীনতার জন্য।
গতবছরের মার্চ মাসে বাহা পরবের সময় ঝাড়খণ্ড-পশ্চিমবঙ্গ সীমান্ত লাগোয়া জোক পাহাড়ি গ্রামে গিয়ে শাল নদীর কথা শুনেছিলাম, জানা গেল এই শাল নদীই কোপাই হয়ে পশ্চিমবঙ্গে প্রবাহিত হয়েছে। নদীর উৎপত্তি ওই অঞ্চলের কিছু দূরেই খাজুরী গ্রামে—নদী বাঁচাও জীবন বাঁচাও আন্দোলন ও ডি গ্রোথের পক্ষ থেকে যা এবছরের শেষের দিকে আমরা দেখতে গিয়েছিলাম।
বাহা পরবের সময় জোক পাহাড়ী গ্রামের বাসিন্দারা বলেছিল কয়েক বছর যাবৎ বৃষ্টির জলের অভাবে নদীর শুষ্ক হয়ে ওঠার কথা — সেই সঙ্গে তারা এটাও জানিয়েছিল এর ফলে তাদের নদী থেকে চাষের জন্যে পর্যাপ্ত জল সেচ হচ্ছে না, চাষের কাজ বন্ধ রেখে তারা অনেকেই অনান্য জীবিকা গ্রহণ করেছে, এমনকি বর্তমান প্রজন্মের কেউ কেউ প্রথমবার আয় উপার্জনের জন্য গত এক বছরের মধ্যে গ্রামের বাইরে দূর কোনো শহরে বা অন্য রাজ্যে কাজ নিয়ে চলে গেছে।এবার আসি মাস খানেক আগের কথায়, ডিসেম্বরের ২১ তারিখ নদী–পরিবেশ কর্মী তপন সিনহার উৎসাহে কোপাই নদীর উৎস সন্ধানে যাওয়া হয় ঝাড়খণ্ডের খাজুরী গ্রামে।
খাজুরী বাসস্টপে নেমে কিছুটা পিছনে গিয়ে ডানপাশের রাস্তা ধরে আমরা গ্রামের মধ্যে ঢুকে পড়ি। বিশ্বভারতীর ভূগোলের অধ্যাপক মলয় মুখোপাধ্যায় তিরিশ বছর আগে কোপাই এর উৎস নির্ধারণ করেছিলেন এই খাজুরী গ্রামে অবস্থিত একটি জলাশয় থেকে, সেখান থেকে কোপাই এর মোহনা কাদোয়া হাঁসুলী বাঁক (এখানে কোপাই নদী বক্রেশ্বরের সাথে মেশে) পর্যন্ত তারা একটি পদযাত্রাও করেছিলেন তখন — তারই ২৫ বছর পূর্তিতে গত ২০১৭ সালে খাজুরীর একটি দূর্গা মন্দিরের কাছে কোপাই এর ওই উৎস জলাশয়টি নির্দেশ করে তারা একটি marking stone স্হাপন করে। আমরা যখন সেখানে গেলাম তখন সেই marking stone আমাদের নজরে আসে নি, কারণ খাজুরী বাসস্টপ থেকে সেই উৎস মুখটির ব্যাপারে লোকজনকে জিজ্ঞেস করাতে অনেকেই সেটির সঠিক অবস্থান বলতে পারেনি অর্থাৎ সেই marking stone টি সমন্ধে সেখানকার স্হানীয়রা ওয়াকিবহাল নয়। অগত্যা আমরা নিজেরাই আন্দাজ মতো খাজুরীর ভিতরে ঢুকে একটি ক্যানেলের কাছাকাছি এলাম। ক্যানেলের উপর একটা কালভার্টে উঠে একজনকে কোপাই এর উৎস জিজ্ঞেস করায়, একটা ছোটো জলা দেখিয়ে দিল, যেটা একটা ধান জমির প্রান্তভাগে কিছুটা জায়গা জুড়ে অবস্থান করছে —সে এটাও বললো সেখানে বারো মাস জল থাকে। তার বর্ননা মতো আমরা ওই জলাটির কাছে গিয়ে সবই দেখতে পেলাম কিন্তু সেই marking stone টি পেলাম না। এরপর আমরা সেই জায়গা ছেড়ে বেরিয়েই আসছিলাম তখন আরেকজন স্হানীয়র সাথে কথা সূত্রে দেখিয়ে দিল কোপাইয়ের মূল উৎসটা— ক্যানেলের ওপারে একটা পুকুরের মতো। কাছে গিয়ে স্পষ্ট বোঝা গেল এই পুকুরটা মানুষের খনন করা পুকুর গুলোর মতো নয়, পুকুরের পাড়টি খাড়া নেমে আসেনি। স্থানীয় ওই লোকটির কাছ থেকে সৌরভ byte নিতে গিয়ে বেশ কিছু বিষয় জানতে পারলো— যেমন যে ক্যানেলটি আমরা দেখতে পেলাম সেটিকে সেচের জন্য কেটে নিয়ে আসা হয়েছিল অজয় নদীর একটি ব্যারেজ থেকে, কিন্তু নামেই সেচের ক্যানেল জানলাম সেখানে গত কয়েক বছরের মধ্যে কোনোরকম জল সরবরাহ করাই হয়নি। কোপাই এখান থেকে শুরু হলেও এই নদী এখানে শাল নদী নামে বেশি পরিচিত, কারণ এই সমস্ত জায়গাটাই আগে নিবিড় শাল বনে ঢাকা ছিল তার মধ্যে দিয়ে এই নদী বয়ে যেত বলে নদীর এখানে এই নাম। আমরা এরপর উৎস মুখ থেকে আরও কিছুটা উজানের দিকে এগোলাম। যথারীতিভাবে মন খারাপ করে দিয়ে চোখে পড়লো নদীর পাড়ের ইট ভাটা গুলো। তারপর পাঁচমহলির কাছে নদী তিরতিরিয়ে পায়ের পাতা ভিজিয়ে বয়ে চলেছে। নদী পেরিয়ে একটু জিরোতে বসলাম পাড়ের উঁচু একটা অংশে, কোথায় কী শাল বন! সব সাফ হয়ে গেছে — সামনে শুষ্ক নদীখাতে ধানের আল দেওয়া হয়েছে আর আমাদের মনের ভিতর দিয়ে নৈরাশ্যের স্রোত বয়ে যাচ্ছে তখন। তপন দা জীবনানন্দের একটা লাইন বললেন
“সেই সকল শস্য অগণন মানুষের শব — শব থেকে বিচ্ছুরিত স্বর্ণের বিস্ময়… ”
প্রকৃতির ঐশ্বর্য নষ্ট করে মানুষের এই স্বর্ণ সন্ধানের লালসা আর কতদিন চলবে! যখন নদীর পাড়ে ওই শাল বনের গাছ গুলো কাটা পড়ছিল তারাও হয়তো শেষ বারের মতো এই প্রশ্নটা জানতে চেয়েও কোনো উত্তর খুঁজে পায়নি। তাই ওখানকার হাওয়ায় এই কথা গুলো দীর্ঘশ্বাস হয়ে এখনো ভেসে বেড়ায়। জোকপাহাড়ী গ্রামের বাসিন্দারা বলেছিল বৃষ্টির অভাবে নদী শুকিয়ে যাওয়ার কথা — শুধু কী তাই! একটা জঙ্গলে যে পরিমাণ গাছ কাটা পড়েছে তার কোনো প্রভাব পড়বে না, এমনটা ভাবা অবিবেচকের কাজ হবে। লেখার শুরুটায় কথার ছলে যেটা উল্লেখ করেছিলাম সেটা এই কোপাইয়ের দুর্দশা’র কথা।
নদী পাড়ের অতীতের গাছ গুলি একসময় মাটির তলায় নিজেদের শিকড় বিস্তৃত করে, মাটির তলাকার জলস্তরকে ভূপৃষ্ঠের উপরের সাথে সংযোগ করিয়েছিল এবং দীর্ঘ সময় ধরে বৃষ্টির জল সেখানে প্রবেশ করে এক অফুরন্ত জলের উৎসে পরিণত হয়েছিল — যা থেকে এই নদীর সৃষ্টি হয়। কিন্তু বর্তমানে মানুষ যেভাবে র্নিবোধের মতো উন্নত হওয়ার জন্য ধ্বংস যজ্ঞ চালিয়েছে তাতে তো এই নদী এবার অবলুপ্তির পথেই এগোবে।
গত ১৩ই জানুয়ারী শান্তিনিকেতনের গোয়ালপাড়া সংলগ্ন অঞ্চলে কোপাই এর উপর অবৈধ নির্মাণের ঘটনা জানা যায়। বেশ কয়েকটি কংক্রিটের পিলার দিয়ে সেখানকার একটি প্লট মালিক নদীর উপরেই নির্মাণ কাজ শুরু করেছিল — ঘটনাটি জানাজানি হতেই বিশ্বভারতীর অধ্যাপক, পড়ুয়া ও স্হানীয় একটি সংগঠন মিলিত ভাবে কোপাই নদী পাড়ে অবস্থান প্রতিবাদ করে। এরপর প্রশাসনের তরফ থেকে ওই নির্মাণ কাজটির অবৈধতা যাচাই করে সেটিকে বন্ধ করে দেওয়া হয়।
কিন্তু এখান থেকেই অনেক গুলো প্রশ্ন উঠে আসে— সাময়িক প্রতিবাদের সম্মুখীন হয়ে প্রশাসন নির্মাণ কাজটি বন্ধ করার পদক্ষেপ নিলেও, এটি যে আবার চালু হবে না তার কোনো নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে কি? একটা নির্মাণ কাজের কংক্রিট পিলার নিশ্চয়ই রাতারাতি দাঁড় করানো যায় না, বেশ কিছুটা সময় ধরে এই কাজটা চলে —তো সেক্ষেত্রে এই সময়ের মধ্যে স্হানীয় মানুষ থেকে প্রশাসনিক আধিকারিক কারোরই নজরে কি এই ব্যাপারটা আসেনি, নাকি তারা প্রথমটাই এই নির্মাণ কার্যের অবৈধতা নিয়ে সচেতন ছিলেন না বা জেনেও ব্যাপারটি এড়িয়ে গিয়েছিলেন ? কোপাই এর উৎস থেকে মোহনা পর্যন্ত প্রায় ৩০ টির মতো ইঁটভাটা আছে ( বেশি বই কম নয় ), এগুলোর মধ্যে কটি প্রশাসনিক স্তরে বৈধতা পেয়েছে বা নিয়মিত তাদের বৈধতা নির্ণয় করা হচ্ছে কি না ? একটা সময় ধরে কোপাই নদীর উৎস মুখে যে পরিমাণ বনাঞ্চল ছিল তা কেটে ফেলার পর ওই অঞ্চলে একই পরিমাণ বৃক্ষ রোপণের প্রকল্প গ্রহণ করে নদীর প্রাকৃতিক বহমানতা বজায় রাখার ব্যাপারে সরকার কতখানি তৎপর?
খুব স্বাভাবিক এই প্রশ্ন গুলো তুলে নদী বাঁচাও জীবন বাঁচাও আন্দোলন বহুবার নানা ক্ষেত্রে সরব হয়েছে। নদীকে শুধু জীবন ধারণের সম্পদ না মনে করে তার নিজস্ব স্বাহ্য, ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য গুলিকে অপরিবর্তিত রাখার বিষয়ে মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক ও সামাজিক সচেতনতার প্রচার করার পাশাপাশি, নদীর যথার্থ দেখভালের জন্য সরকার নির্দিষ্ট অবিরল নির্মল নদী পর্ষদ গঠনের দাবী জানাচ্ছে নদী বাঁচাও জীবন বাঁচাও এর জন আন্দোলন।