খবর হচ্ছিলো- আর হচ্ছে না ক’দিন। গাজায় সদ্য জন্মেই ঠান্ডায় জমে দম আটকে বাচ্চা মরছে – আলসিফা হাসপাতালে ইনকিউবেটরে দেওয়া ছিলো ওদের। নিওনেটাল কেয়ারের ইনকিউবেটরগুলো বন্ধ কারণ বিদ্যুৎ নেই, হাসপাতালে বিদ্যুৎ সংযোগ টিকিয়ে রাখতে তেল দরকার। তেল ঢুকছে না – গাজা অবরুদ্ধ। পশ্চিম এশিয়ায় প্রাচীন প্রবাদ ছোট থেকে শুনে আসছি যারা তেলের দখল চায় তারা যুদ্ধের পক্ষে, যারা যুদ্ধাস্ত্র বেচার কার্টেল চালায় তারা যুদ্ধ লাগায়। তারা খবরের কাগজও চালায়। হেড লাইন কি হবে আর কোন খবর চাপা হবে-ছাপা হবে না- ভুলিয়ে দেওয়া হবে। অনেকেরই এখন আর সকালের টাটকা কাগজ পড়ার সময় হয়না ফেবু’তে হৈচৈ হলে জেনে যাই। তাই সোশ্যাল মিডিয়ায় হ্যাসট্যাগিং বা ট্রেন্ড সেট হয়। জাতি দাঙ্গা শুরু হতে মে মাসে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ হয়ে গেছিলো। আড়াই মাস বাদে চালু হতে – ঘিরে ধরে কুকি মেয়েদের নগ্ন করে হাঁটানো হচ্ছে – ভাইরাল হয়ে গেলো। তারপরে অ্যাসল্ট রাইফেল বুকে ঝুলিয়ে প্রতিপক্ষের একটা কাটা মাথা হাতে হাঁটছে এক ‘মণিপুরী’ যুবক ‘ডিপফেকস : দ্য কামিং ইনফোক্যালিপ্স ‘!
হোয়াটস্ অ্যাপে ডাক আসে। আবার কলকাতা যাবো – যুদ্ধ বিরোধী মিছিল। আবার বুকে প্ল্যাকার্ড ঝুলিয়ে হাঁটবো বিদ্যাসাগর মূর্তির পাদদেশ থেকে ধর্মতলা -‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না’ – শেষ কিছুদিন আবার আমরা ভুলে গেছিলাম -যুদ্ধ চলছে মনিপুরেও। নতুন যুদ্ধ শুরু হয়ে পুরনো যুদ্ধকে পিছনে ঠেলে দেয় – ভিতরের পাতায়। কেমন আছো ‘প্রশান্ত দন’, কিষানীরা দন নদীর পাড়ে আর কয়লা খনির কসাক শ্রমিকেরা, কেমন কাটছে কিইভ-এর বড়দিন? ইউক্রেন কেমন আছে এই মারাত্মক শীতে – ওদের পাওয়ারগ্রিডগুলো ধ্বংস করে জমিয়ে মারতে চাইছে মস্কো- পড়েছিলাম, মিছিলেও হেঁটেছি – তারপর আবার অন্য কোথাও অন্য কোনও গণহত্যা। নতুন মিছিল, পুরনো স্লোগান, ‘গো ব্যাক ম্যাকনামারা- আমার নাম তোমার নাম…’। জায়নবাদী জাতিবিদ্বেষ না রাষ্ট্রপুঞ্জে মার্কিন সমর্থন কিসের জোরে নেতানিয়াহু’রা বলছে ‘মুছে দেবো নিশ্চিহ্ন করে দেবো- ওদের’।- শুধু ‘হামাস’কে নয় গোটা ফিলিস্তিনকেই – জর্ডন নদীর পশ্চিমপাড়ে আর গাজায় চলমান গণহত্যা আসলে – ‘অপর'(নানা অর্থেই ‘other’)কে মুছে দেওয়ার!
ওখানে ঐ খোঁয়ারে ঘোঁত ঘোঁত ধ্বনি ভোটে বিল পাশ হচ্ছিলো- কয়েকটি ছেলেমেয়ে হলুদ ধোঁয়া ছড়িয়ে চেঁচিয়ে মনে করিয়ে দিলো – ‘মনিপুরে দাঙ্গা চলছে থামাও!’ আবারও ১৩টি মানুষ খুন হয়ে গেছে। মণিপুরে। গত কয়েকদিন আগেই টেঙনৌপাল এর লেইথুতে আবার – ১৩টি লাশ খুঁজে জড়ো করেছে সেনাবাহিনী। আরও পাওয়া যাবে? কেউ জানে না- যেতেই পারে। মে মাসে জাতি দাঙ্গা শুরু হওয়ার পর ‘ডেডলিয়েস্ট’!
মায়ানমার বর্ডার থেকে দশ কিলোমিটার দূরে সাইবোল সদরের কাছে টেঙনৌপল মাচি থানার মধ্যে পড়ে। আগে মোরে, সেনাপতি, বিষ্ণুপুর-চূড়াচাঁদপুর ইস্ট আর ওয়েস্ট কাঙপোকপি জেলায় মরেছে – মানুষ। টেঙনৌপলে আগে সেভাবে দাঙ্গা হয়নি। এবার হলো। জানলাম সাইবলে ক’দিন আগে আসাম রাইফেলস এর উপর আইইডি হামলা হয়েছিলো। সেনা মোতায়েন শুরু হয়েছিলো। কদিন ধরে কারা মারতে এলো? কারা মরলো? গত একমাসে কাকচিং, জিরিবাম এই জায়গাগুলোতে সীমান্তের ইন্ডিয়ার দিকে আবার উদ্বাস্তু ঢল নেমেছে মায়ানমারে। সামরিক ‘জুন্টা’র ‘তাতমাদো’-র বিরুদ্ধে ‘থ্রি ব্রাদারহুড’-এর বিদ্রোহী অ্যালায়েন্স-এর ‘অপারেশন ১০২৭’ যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর। বার্মিজ জুন্টা শুরু করেছে আরেক গণহত্যা। শি জিনপিং এর গণপ্রজাতন্ত্রী চীন-এর মায়ানমার নিয়ে মাতব্বরি পড়েছে অস্বস্তিতে- জুন্টা না বিদ্রোহী ব্রাদারহুড কার পক্ষে যাবে নাকি স্থির করতে পারছে না! এদিকে অমিত শা অজিত দোভালের গোঁসা- চীনের ‘সম্প্রসারণবাদী’ মদতেই নাকি মনিপুরে ‘চিন-কুকি’দের চালানো আফিং ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে রাখছে মায়ানমারের ড্রাগ কার্টেল। কুকিদের চালানো ‘নার্কোটেররিজম’ মনিপুরে দাঙ্গা থামতে দিচ্ছে না – ‘র(RAW)’ নাকি খুঁজে পেয়েছে এই সূত্র – বিদেশমন্ত্রী রাজনাথ সিং আন্তর্জাতিক মঞ্চে কেঁদে চলেছে।
‘মনিপুরে মে মাসের পর সরকারি অস্ত্রগার থেকে লুঠ হয়ে যাওয়া ৪৫০০ আগ্নেয়াস্ত্র ফেরত আনতে পারেনি বীরেন সিং সরকার। ব্যবহৃত হয়ে চলেছে ‘আমাদের’ হাতে ‘ওদের’ বিরুদ্ধে।’ বা ‘ওদের’ হাতে ‘আমাদের’ বিরুদ্ধে- চূড়াচাঁদপুরে দাঙ্গা আক্রান্তদের ক্যাম্পে বসে অকপটে বলেছিলেন এক কুকি যুবক! ক’দিন আগেই ‘ইউনাইটেড ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট অফ মনিপুর’-এর সঙ্গে ইন্ডিয়া সরকারের ‘শান্তি চুক্তি’ হয়েছে। স্বাধীন মনিপুরের দাবীতে গেরিলা যুদ্ধ চালানো UNLF মেইতেই’দের সবচেয়ে বড়ো সশস্ত্র সংগঠন। হটাৎ এই মেইতেই – আদিবাসী দাঙ্গা পরিস্থিতিতে ছ’দশক ধরে লড়াই চালানো ইউএনএলএফ ইন্ডিয়া সরকারের সঙ্গে শান্তি চুক্তিতে এলো – কেন ? তাৎপর্যের, যখন এবারের দাঙ্গায় ইম্ফল ভ্যালী থেকে কুকিদের উৎখাত করতে সশস্ত্র ‘মেইতেই লিপুন’ আর ‘আরামবাইটেঙ্গল’ কে সাহায্য করেছে ইউএনএলএফ – বলে অভিযোগ তুলছে কুকি’রা । ইম্ফলে যেমন মেইতেই’রা দাবী তুলছে এক্ষুনি ‘SOO’ বাতিল করে সরকার আবার ‘সামরিক সমাধানে’ কুকি’দের ‘ঠান্ডা করা'(!)-র রাস্তা নিক। (*SOO – সাসপেনশন অফ অপারেশন চুক্তি। স্বাধীন ‘কুকি-ল্যান্ড’ এর দাবীতে লড়াই চালাতে থাকা ২৫টি সশস্ত্র সংগঠন এর সঙ্গে ইন্ডিয়া সরকারের অস্ত্র বিরতি- যা পার্বত্য মনিপুরে ২০০৬ থেকে ত্রিপাক্ষিক চুক্তির ভিত্তিতে লাগু রয়েছে)।
‘শান্তি চুক্তি’ নিয়ে প্রশ্ন উঠছে, এই ‘চুক্তি’গুলো নিয়েই প্রশ্ন উঠবে। প্রশ্ন তুলছে উত্তর-পূর্বের মানুষই-কারণ ঘর তাদেরই পুড়েছে অতীতে, পুড়ছে এখনও। অতীতে বারবার এই ‘শান্তি চুক্তি’র নামে ‘renegade’ (আত্মসমর্পণকারী-যেমন SULFA)দের ব্যবহার করে ‘সাময়িক স্বস্তি’-কে ভোটের লাইনে দাঁড় করিয়ে আসলে যা চাপা দেওয়া হয়েছে তা উত্তরপূর্বের ‘আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার’এর লড়াই।এর মধ্যেই মনিপুরে কিছু অঞ্চলে AFSPA তুলে নেওয়ার ‘গাজর’ ঝুলিয়ে এই ‘শান্তি চুক্তি’ চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। দিল্লীতে গিয়ে ‘পেমবেই গোষ্ঠী’ শান্তি চুক্তিতে সই করেছে – আর ‘এটা চুক্তি নয় মাথা ঝুঁকিয়ে মেনে নেওয়া কারণ যে স্ব-শাসনের জন্য এতদিনের লড়াই আমাদের সেটাই এই চুক্তি মানলে ছেড়ে দিতে হবে আমাদের’- বলে UNLF এর মধ্যেই ছিলো যে ‘কোইরেঙ গোষ্ঠী’- তারা চুক্তি থেকে সরে দাঁড়িয়েছে। অনেকেই অস্ত্র নিয়ে সরে গেছে মায়ানমারের ‘ক্যাম্প’ গুলোতে।
অতি সম্প্রতি হওয়া ULFA-র সঙ্গে আসাম ও কেন্দ্রীয় সরকারের ত্রিপাক্ষিক চুক্তি নিয়ে আরেকটি বিরোধী স্বর সরব হয়েছে যাতে আবার আলফা-য় ভাঙ্গনের জোরালো ইঙ্গিত! অভিযোগ স্পষ্ট -এই যে ‘শান্তি চুক্তি’- এ আসলে দীর্ঘদিন দেশ ছেড়ে পালিয়ে থাকা নেতৃত্ব অনুপ চেটিয়া, অরবিন্দ রাজখোয়া-দের নিজেদের মাথা বাঁচাতে ‘আত্মসমর্পন’! – কারণ অমিত শা এই শান্তি চুক্তির পরেই ঘোষণা করেছে ‘আলফা এবার ভেঙে দেওয়া হবে’। ‘দিল্লী যাকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদ’ বলে বরাবর দেগে দিতে চেয়েছে তা আসলে ভারতে ‘বহুত্বের কন্ঠস্বর ‘- যা ধামাচাপা দেবে তা সময় গেলে ফিরে আসবেই, নানা চেহারায়- এটাই ‘return of the repressed’!
এদেশে বিভিন্নতা আর বহুত্ব সংকটে – মন্দির উদ্বোধনের আবহে এ কথা ওঠা গুরুত্বপূর্ণ নিশ্চয়ই সঙ্গে নজর এড়িয়ে গেলে চলবে না – যে কোন সময়ে এই পাল্টা প্রশ্ন গুলো উঠছে – কেন তাড়াহুড়ো করে দেশের ‘বন সংরক্ষণ আইন’ আর ‘বনাধিকার আইন’ বদলে ফেলা হচ্ছে – পার্বত্য মনিপুরে কুকি ও অন্যান্য জনজাতি ‘আদিবাসী’ মানুষদের পাহাড় জঙ্গল থেকে উৎখাত করতে এত সোৎসাহে কেন্দ্র রাজ্যের সরকারগুলো ‘কাদের হয়ে’ খাটছে – আদানি সহ কয়েকটি কর্পোরেট গোষ্ঠীর হাঁ মুখে জঙ্গল আর খনিজ এর গ্রাস তুলে দিতে এত তাড়া ? বাবা রামদেবের রুচি সয়া কোম্পানির পাম তেল চাষের জন্য ‘ভেট’ দেওয়া হবে পার্বত্য মনিপুরের জমি?- অটোনমাস হিল কাউন্সিলগুলোর ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া চলছে। মাটির নিচের খনিজ ঋদ্ধ পাহাড় কব্জা করতেই জনজাতির মানুষদের দিকে সন্দেহ ‘ম্যানুফ্যাকচার’ করা? আর রটানো হচ্ছে মায়ানমার থেকে আসা চিনকুকি’রাই আফিং চাষ দখলে রাখতে দাঙ্গা জিইয়ে রাখছে? ৩৭১(C ) ধারা বদলে ইমফল ভ্যালির সংখ্যাগুর মেইতেইদের নতুন করে আদিবাসী স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তাব হটাৎ উঠলো কেন? (যা নিয়ে উত্তাল হলো এত বছরের নানা জনজাতির সহাবস্তানের সংস্কৃতিতে রপ্ত মনিপুর )- সংখ্যাগুরু মেইতেই’দের পাহাড় জঙ্গলে আদিবাসীদের জমি কেনার ছাড়পত্রের আয়োজন?
নজর টান দিলাম, আসামে আলফা-র পরেশ বড়ুয়া ফ্র্যাকশন ইন্ডিয়ার সরকার আর আলফা-র হালের শান্তি চুক্তি প্রত্যাখ্যান করেছে। কি বলেছে তারা ভেবে দেখার – এই চুক্তিতে ‘অসমের ভুগর্ভস্থ সম্পদে অসমিয়ার অধিকার নিশ্চিত করার কথা’ বলা নেই ‘!
এ পৃথিবীতে সব দাঙ্গা জল জঙ্গল জমির জন্য – এ পৃথিবীতে সব যুদ্ধ নিসর্গের বিরুদ্ধে!
এই যে The De Growth আমরা-বলছি ‘উন্নয়ন একটি মিথ্যা ‘- এই কথাটা উঁচু গলায় বলার জোরটা আসছে কারণ- প্রগতিপন্থী সভ্যতায় ‘ভূ সম্পদের বিত্তহরণ’ এর চেহারাটার সহজপাঠ দিয়েছেন যে ঠাকুরের ঠাকুর আমাদের রবি ঠাকুর। রক্ত করবীর অধ্যাপক আর নন্দিনীর কথোপকথন থেকে একটু নিয়ে নিই : ‘…ভালোর কথাটা এর মধ্যে নেই, থাকার কথাটাই আছে। এদের সেই থাকাটা এত ভয়ংকর বেড়ে গেছে যে লাখো-লাখো মানুষের উপর চাপ না দিলে এদের ভার সামলাবে কে? জাল তাই বেড়েই চলেছে। ওদের যে থাকতেই হবে।’
‘…কিন্তু থাকবার জন্যে মারতে হবে, এ কথা যারা বলে তারাই থাকে। তোমরা বল এতে মনুষ্যত্বের ত্রুটি হয়, রাগের মাথায় ভুলে যাও এইটেই মনুষ্যত্ব। বাঘকে খেয়ে বাঘ বড়ো হয় না, কেবল মানুষই মানুষকে খেয়ে ফুলে ওঠে।’
আরও পড়ুন – মনিপুর – Kino-Eye