বিস্তৃত মালভুমির মাঝে দাঁড়িয়ে অসংখ্য তারা ও একফালি চাঁদের রাত। আলাদা করে এই রাতের কথা বর্ণনা করতে হয় কারণ কলকাতার আকাশে প্রচন্ড জেল্লা ছাড়া কোনো বস্তুই আর চোখে পড়ে না। মোটর বাইকে করে পেরোতে থাকা গ্রামগুলি মিটমিটে বৈদ্যুতিক আলো ও একফালি আভায় ঘুমিয়ে পড়ার প্রস্তুতিতে নীরব কম্ম করে চলেছে। আমাদের কলকাতার শরীর ঘড়ি অনুযায়ী এই অবেলায় হাজির হয়েছিলাম ‘সুন্দরখেলে’ গাঁয়ে। আমাদের এক সাথীর বাড়ি। বাঁদনা পরব কবে জানতে চাওয়ায় সাথী নরেন মুর্মু বললো “২৫ শে পৌষ, আজ পৌষের ২ তারিখ”। চায়ের বদলে এখানে জোটে “পোচৌই হান্ডি(হাড়িয়া)”। শুরু হলো কথপোকথন।
হেডলাইনের সঙ্গে এই কথাগুলির সামঞ্জস্য আপনি খুঁজে নাও পেতে পারেন। তবু, “কীসের খোঁজ পেয়েছি, তার তথ্য কী কী” এইটুকুই সব নয় বলে বিশ্বাস করি। তাই, “কীভাবে খোঁজ পেয়েছি” আমার কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ।
গত বছর শীতের শেষভাগে আমি আর উত্তরবঙ্গের নদীসাথী রূপক দা গিয়েছিলাম ‘ তাঁতলই ‘ বা বামনাবাদের দেওয়া নাম ‘তন্ত্রেশ্বর’। গতবছর ‘কুশকর্ণী নদী সমাজ’ যখন পদযাত্রা করলো নদী বাঁচানোর ডাক দিয়ে, আনন্দবাজার নদীর ভদ্দরলকি নামটাই লিখলো “কুশকর্ণিকা”। যাই হোক, প্রসঙ্গে ফিরি, শব্দ বেড়ে গেলে নাকি পাঠক কমে যায়। অর্থনীতির বইতে যদিও এসব হিসেব স্পষ্ট ভাষায় থাকে না।
বক্রেশ্বর আমাদের চেনা নাম। বাঁধানো, সাজানো, গোছানো উষ্ণপ্রস্রবণ রয়েছে সেখানে। টিকিট কেটে স্নান করতে যায় মানুষ। উন্নয়নের রক্ষণাবেক্ষণের খরচ আছে! ‘ তাঁতলই ‘ উষ্ণপ্রস্রবণ ঠিক এর উল্টো যাপনে বাঁচে। এখানে দু পাড়ের বনের মাঝে নাইতে আসে মূলত গাঁয়ের খেটে খাওয়া মানুষেরা। কোনো টিকিট নেই , বাঁধানো পাড়ও ছিল না এতদিন। গত মাস ছয়েকে, খানিক পাড় বাঁধিয়ে সিঁড়ি করেছে । উন্নয়ন বা বিকাশ থেমে নেই। এই জল মেশে সিদ্ধেশ্বরী নদীতে।
নরেন দা কে ‘ তাঁতলই ‘ তে স্নান করতে যাবো বলে, আবছা অচেনা রাস্তাটিকে ঝালিয়ে নিচ্ছিলাম। নরেন দা শেষে বললো, “যাও করে এসো, এ আর বেশীদিন থাকবে না”।
– কেনো ?
– তাঁতলই এর একটু আগেই সিদ্ধেশ্বরী নদীতে বাঁধ দিচ্ছে, জল জমে সব শেষ হয়ে যাবে।
– কোন জায়গায় ?
– জামজুরি।
পরেরদিন এক নদীর পাড় থেকে চলেছি আরেক নদীর পাড়ে। কুশকর্ণী থেকে সিদ্ধেশ্বরী। ময়ূরাক্ষীর দুই উপনদী। বীরভূম থেকে দুমকা জেলা। কখনো জঙ্গলে রাস্তার নিশান ধরে, কখনো পিচের রাস্তা ধরে এগিয়ে চলছি। গুলিয়েও ফেলছি রাস্তা। গুগল ম্যাপ এখানে খুব একটা এঁটে উঠতে পারে না। পথিকদের মধ্যে কখনও কেউ হিন্দি বোঝে কেউ আবার বাংলা। তাদের বেশিরভাগই সাঁওতালি বোঝে শুধু আমরা বুঝি না। এগুলি বাংলা আর ঝাড়খণ্ডের সীমান্তবর্তী অঞ্চল। জামজুরি পৌঁছলাম বেলা ১টা নাগাদ, পৌষের ৩ তারিখ। গত বছর এই দিনেই ঝাড়খণ্ডের আরেক গ্রাম যোগপাহাড়ি তে দেখেছিলাম এক প্রানবন্ত প্রথা। একটি ছেলে গ্রামে সভা হবে বলে গাছের পাতা সমেত ডাল এক হাতে উঁচিয়ে ধরে দ্রুত হাঁটতে হাঁটতে সে খবর বলে চলেছে গোটা গ্রাম জুড়ে। হয়তো দুমকা জেলার আরেক গ্রামেই এরকমই কোনো এক ছেলে নদীর উপর ব্যারেজ বিরোধী বার্তা নিয়ে ডাল উঁচিয়ে ঘুরে বেড়াবে।
ব্যারেজের জন্য যে খোঁড়াখুঁড়ি চলছে সেই খনন কার্যের থেকে উঠে আসা পাথর দিয়ে একটি টিলা তৈরী হয়েছে।
২০২২ সালের নভেম্বরে, ঐতিহাসিক প্রজেক্ট আখ্যায়িত করে ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী এর ভিত স্থাপন করেন। প্রজেক্টের পরিকল্পনা অনুযায়ী ঐতিহাসিক। কারণ, এই ব্যারেজের জন্য একটি ঘরও উচ্ছেদ করা হবে না। এ দেশে উন্নয়নের নামে উচ্ছেদ যখন স্বাভাবিক ঘটনা তখন উচ্ছেদ না হওয়াটা ‘ঐতিহাসিক’ই বটে! এই বাইনারি তে এখনও “অবিরল ও নির্মল নদী” এই ভাষ্য ঢুকতে পারে নি। সিদ্ধেশ্বরী নদীর উপর এই প্রকল্প হওয়ার কথা ছিল বহু আগে, মূলত পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিরোধিতায় হয়ে ওঠে নি।
প্রায় ১৩০০ কোটি টাকার “মসলিয়া-রানিশ্বর মেগা লিফট সেচ” প্রজেক্ট। ১৫৮ মিটারের ব্যারেজ। মসলিয়া জেলা তে ১৭০৬৬ হেক্টর ও রানিশ্বরে ৫২১৭ হেক্টর কৃষিজমিতে জল পৌঁছে দেওয়ার আশ্বাস এই প্রকল্পে রয়েছে। মসলিয়ার ২০৪টি গ্রাম ও রানিশ্বরের ৭২টি গ্রাম মোট ২৭৬টি গ্রাম এই প্রকল্পের আওতায় রয়েছে। ২৭৬ টি গ্রামের মোট জনসংখ্যা ১২১৭১৫ জন, এদের মধ্যে আদিবাসীদের সংখ্যা ৬৮৪৭৫। মোট ১৭টি পঞ্চায়েত এলাকা। মুরগুনি ও জামজুরি গ্রামের মাঝে এই ব্যারেজটি এবং ব্যারেজের গেটটি মুরগুনি গ্রামে। এই প্রকল্পে জমি অধিগ্রহণের জন্য বরাদ্দ হয়েছে প্রায় ৯৮ কোটি টাকা।
ভারতের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (১৯৫১-১৯৫৬) সিদ্ধেশ্বরী নদীর উপর এই ব্যারেজের প্রস্তাব ওঠে। একই পরিকল্পনায় মাসাঞ্জর বাঁধ নির্মাণ হয়। তৎকালীন বাংলা ও বিহারের সরকারের বনিবনা না হওয়ায় সিদ্ধেশ্বরী নদী বহাল রাখতে পেরেছিলো তার অবিরল ধারা। ১২ মার্চ ১৯৪৯ সালে বিহার ও পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে সিদ্ধেশ্বরী-ময়ূরাক্ষী-নুনবিল নদী সংক্রান্ত আন্তঃরাজ্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এরই সূত্র ধরে ১৯৭৮ এর জুলাই মাসে ঠিক হয় পশ্চিমবঙ্গ নিজস্ব তহবিল থেকে সিদ্ধেশ্বরী-নুনবিল বাঁধ নির্মাণ করে ১৯৭ MCM জল ব্যবহার করবে এবং অবশিষ্ট জল বিহার রাজ্য কে দিতে হবে। একই সঙ্গে রানিশ্বর ব্লকে সেচের জন্য ১২.৩০ MCM জলের ব্যবস্থা করার কথা ছিল। তৎকালীন বিহার থেকে বর্তমান ঝাড়খন্ড ১৯৪৯ এর চুক্তি থেকে এখন ২০২৩, দীর্ঘ ৭৪ বছরের চুক্তি অনুযায়ী কোনোরকম উদ্দ্যোগ নেয়নি পশ্চিমবঙ্গ এমনটাই ঝাড়খন্ড সরকারের কথা। বিপদে পড়েছে স্থানীয় কৃষিজীবী মানুষেরা। তাই মসলিয়া-রানিশ্বর মেগালিফ্ট সেচ প্রজেক্ট।
সিদ্ধেশ্বরী নদীর ৮৭০ বর্গ কিলোমিটার ক্যাচমেন্ট অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ জলের পরিমাণ ৩৪৮ MCM। উক্ত প্রজেক্টের পরিকল্পনা অনুযায়ী সেচের জন্য প্রয়োজন অনুমানিক ৬১.৮০ MCM। বারবার সরকারি রিপোর্টে উঠে আসছে এই সমস্ত অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ জলের পরিমাণ কমে যাওয়া এবং খরার প্রবণতা ক্রমাগত বৃদ্ধির কথা। সিদ্ধেশ্বরী নদী থেকে পানীয় জল বন্টন হয় বীরভূমের বিভিন্ন গ্রামে। এই বছর গ্রীষ্মকালে ১৫ দিন পর জল এসেছিল গ্রাম গুলিতে। আর সাধারণত দু তিনদিন পরপর ঘন্টা খানেকের জন্য জল আসে। ফলত স্থানীয় মানুষেরা ভূগর্ভস্থ জলের উপরই বেশী নির্ভরশীল।
জঙ্গল ছোটো করে ফেলা হচ্ছে, মাটিতে নেই শিকড়, তাই নেই জল ধরার আর ডাকার ক্ষমতা। অনিয়মিত বৃষ্টি, খরা হেতু কৃষিকাজ থেকে বিদায় নিচ্ছে অনেকেই। প্রজন্ম মাটিচ্যূত হলো, পাড়ি দিল শহরে দিনমজুরি করতে। জঙ্গল থেকে সংগ্রহের চর্চা, জ্ঞান, জীবধারণের সহায়ক ধারণা থমকে গেলো। যেদিকেই তাকাবেন খাঁ খাঁ করছে জমি গুলি। তপন দা বলছিলো “অবশিষ্ট বনভূমি, ভবিষ্যতের মরুভূমি”। বনভূমি বাড়ানোর প্রশ্নে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার চিরকালীন নীরবতাই বাস্তবায়িত করছে আগামীর “মরুভূমি”।
একটি ব্যারেজ হচ্ছে, গ্রামবাসীর কানে কানে ছড়িয়ে দেওয়া হলো “ঘরে ঘরে জল যাবে”। এরপরেই ব্যারেজ সংলগ্ন গ্রামবাসীদের “আপনাদের তাঁতলই ডুবে যাবে না তো?” প্রশ্ন করলেই, সকলের মুখেই আমতা আমতা অজানা। স্থানীয় এক যুবক বললো আমরা আর এই নদীতে স্নান করতে পারবো না, সব ডুবে যাবে, এই প্রজেক্ট যা বলছে তা হবে না। মিহির শাহ কমিটির ২০১৬ এর রিপোর্ট অনুযায়ী ১১৩mha জলসেচের আওতায় এসেছে বলা হয়, তবে কার্যত ৮৯mha মাত্র জলসেচের সুবিধা পায়। এই তথ্যের সঙ্গে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এই যে, ভারতে প্রায় 76% জমিতে চাষ হয় ভূগর্ভস্থ জলে। এই যে বারবার নদীকে বাজি রেখে অতীতে বারবার ফেল করা প্রজেক্ট কে ফিরিয়ে আনার প্রবণতা রাষ্ট্রের নাকি কর্পোরেট লবির। আর এই প্রবণতার শিকার চিরকাল প্রকৃতি সহ গোটা জীব বৈচিত্র্য।
তথ্যসূত্র
ঝাড়খণ্ড সরকারের জল সম্পদ বিভাগ, মিহির শাহ রিপোর্ট – ২০১৬
এই ঘণ্টা খানেকের তথ্য সন্ধান অভিযানে সঙ্গে ছিল দুই নদী কর্মী অভিজিৎ ও শিবম। এই অনুসন্ধানের ধারাবাহিকতায় আমরা চেষ্টা করবো আগামীতে স্থানীয় মানুষের মতামত বিস্তারিত তুলে ধরার।