সতীনাথ ভাদুড়ীর লেখা ‘ঢোঁড়াই চরিত মানস’ বাংলায় অনন্য ক্লাসিক সাহিত্য। লেখক লেখাপড়া না জানা ভারতবাসীর মননে-জীবনে রামায়ণ কিভাবে জুড়ে আছে তা দেখিয়েছেন এই উপন্যাসের মাধ্যমে। সমাজবাদী রাজনৈতিক কর্মী সাহিত্যিক হিসাবে সতীনাথ অন্তজ শ্রেণীর মানুষের জীবনকে দেখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এই উপন্যাস পড়ার মধ্য দিয়ে অন্য ভারতকে চিনতে শেখাও সম্ভব। বিজ্ঞানকর্মী যুক্তিবাদী চেতনায় প্রভাবিতরা ধার্মিক মানুষ থেকে দূরে থাকার পরামর্শ-অভ্যাসে থাকেন। কিন্তু ঢোঁড়াইয়ের ‘জীবন’ ধর্মগ্রন্থ থেকে মুখ সরিয়ে রাখতে তাদেরও বিরত করবে।মৎস্যজীবী মানুষ বিশেষ করে সমুদ্র মৎস্যজীবীদের সংগ্রাম বুঝতে গেলে জানা যায় টমাস কোচারির কথা। তাঁর জীবন যাপন অনেক বস্তুবাদীদেরকেও আগ্রহী করে তুলেছিল ধর্মযাজকদের সহকর্মী মেনে নিতে। ধর্ম বিশ্বাসী ফাদার স্ট্যান স্বামীর আশি বছর বয়সে গ্রেপ্তারের ঘটনাও ধার্মিক মানেই লড়াই আন্দোলনের দূরে থাকা মানুষ সেই ভাবনা থেকে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছিল। পরিবেশ আন্দোলনের বিভিন্ন মঞ্চ থেকে নাগরিক অধিকার আন্দোলনের জুড়ে থাকা স্বামী অগ্নিবেশকে জানাও জরুরী এই প্রসঙ্গে। তিনি গেরুয়া বস্ত্রধারী এমন এক ‘সন্ন্যাসী আন্দোলনকারী’ যিনি তার সমগ্র সক্রিয় জীবন অতিবাহিত করেছিলেন “বন্দুয়া মুক্তি মোর্চা” বা বন্ডেড লেবার লিবারেশন ফ্রন্ট এর মতন শ্রমিক সংগঠনে জুড়ে থেকে। বহু অসংগঠিত প্রান্তিক শ্রমিক মজদুরদের লড়াই সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন স্বামী অগ্নিবেশ। শ্রমিক দরদী স্বামী অগ্নিবেশকে দেখে কখনোই মনে হয়নি ধর্ম শোষণের যন্ত্র। বস্তুবাদী শ্রমিক নেতৃত্ব থেকে কর্ম নিপুনতায় কখনোই কম মনে হয়নি তাঁকে।
প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মকে ব্যবহার করে যারা ভারত তথা বিশ্ব জুড়ে শোষণ ও রাষ্ট্রক্ষমতা নিশ্চিত করেছেন বা করছেন, তাদের বিরুদ্ধে প্রখর লড়াই সংগ্রামে আমাদের দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থাকতে হবে। কোন ধরনের আপোষ না করে। কিন্তু মানুষের ভিড়ে সংগ্রামের সাথী চিনতে ভুল করলে তো শক্তির হ্রাস পাবে। বিভিন্ন ফ্রন্টে সংগ্রাম যা আমরা করতে চাই, তা দুর্বল হবে বলে আমার ধারণা। যদি এই মানুষ গুলিকে থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়। জানা দরকার নদী আন্দোলনের সমসাময়িক সময় ধর্মীয় নেতৃত্বের ভূমিকাও অপরিসীম। বিশেষ করে গঙ্গা নদী বাঁচাও আন্দোলনে। এই নিয়ে যদি আমাদের কথা বলতে হয়, তবে বলা দরকার ধার্মিকরা আমাদের লড়াইয়ের সাথী হতে পারেন না, এমন সীমাবদ্ধ সেক্টারিয়ান ধারণা থেকে মুক্ত হওয়া প্রয়োজন। আমরা মুক্ত চেতনার কথা বলি, সেই মুক্তি তো সব ধরনের সংকীর্ণতা থেকে ‘মুক্তি’। বাহু কে প্রসারিত করে সব ধরণের জীবের মঙ্গল কামনায় যুক্ত মানুষের সঙ্গে জুড়ে কাজ করাই তো মুক্ত চিন্তার প্রকাশ। বিশ্বজুড়ে মানুষের অধিকার আন্দোলনে দেখা গেছে ধর্ম বিশ্বাসী ধর্ম প্রচারকরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছেন। সে নিকারাগুয়ার ধর্ম যাজকরা হোন বা ভিয়েতনামের বৌদ্ধ সন্ন্যাসী। ভারতবর্ষের বিভিন্ন জনজাতি মানুষের লড়াই থেকে পরিবেশ আন্দোলনে রাষ্ট্রের চোখে চোখ রেখে কথা বলা মানুষেরা কোন না কোন ধর্মে বিশ্বাসী। “লিবারেশন থিওলজি” বা মুক্ত ধর্ম চিন্তা এমন তত্ত্বের প্রতি আজকের বহু মানুষকে আগ্রহী করে তুলেছে। বিগত কিছু বছর ধরে সে চর্চা ভারতেও শুরু হয়েছে। আবার পাশাপাশি বিগত কিছু বছর ধরে হিন্দুত্বের নামে তীব্র ‘মৌলবাদী’ চিন্তা মানুষের মনকে প্রভাবিত করে ভারতের নদী পরিবেশের ধ্বংস ও মুনাফা লোভী কিছু বহুজাতিক সংস্থার লাভ যোগাড় করতে ব্যবহৃত হচ্ছে। ইসলাম ধর্ম কে ব্যবহার করে মৌলবাদও সক্রিয়। এমতাবস্থায় ধর্ম বিশ্বাসীদের মধ্যে যে মানুষেরা প্রকৃতি লুন্ঠনের বিরুদ্ধে সক্রিয়-মুখর তাদের কথা ‘শোনা-বলা’ কে নদী বাঁচাও জীবন বাঁচাও আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ মনে করে এসেছে বরাবর। গত নভেম্বর মাসের ১৮ তারিখ কলকাতাতে ‘গঙ্গা মহাসভা’র আহবান করা হয়। কলকাতাতে এ এক ব্যাতিক্রমি প্রচেষ্টা।সভায় পশ্চিমবঙ্গের গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী, সাংবাদিক,শিল্পী, নদী কর্মী, পরিবেশ রাজনৈতিক কর্মী এমনকি নাস্তিক বিজ্ঞান আন্দোলনের কর্মীরাও উপস্থিত হন। আমরা জানি গঙ্গা নদী কে বাঁচানোর দাবীতে মুখর ভারতের অন্যতম কেন্দ্র কংখলের মাতৃসদন আশ্রম। মাতৃ সদন আশ্রমের প্রধান স্বামী শিবানন্দ সরস্বতী সহ তার শিষ্য ব্রহ্মচারী আত্মবোধানন্দজী, ব্রহ্মচারী দয়ানন্দজী ও ব্রহ্মচারী সুধানন্দ জী উপস্থিত হন। রামমোহন লাইব্রেরীর মুখ্য হলে ‘গঙ্গা মহাসভা’য়। ভারতবর্ষে জীবন প্রবাহ গঙ্গা নদীর অবদান তারা সহ উপস্থিত বিশিষ্ট মানুষেরা তুলে ধরেন। গঙ্গাকে বাঁচানোর জন্য আত্ম বলিদানের তাগিদ কেন তীব্র করা প্রয়োজন তা সন্ন্যাসীরা তুলে ধরেন। গঙ্গা নদীকে ধ্বংস করে ভারতীয় সভ্যতা সংস্কৃতি টিকে থাকতে পারেনা সেকথা বারবার গঙ্গা মহাসভায় উপস্থিত বক্তারা তুলে ধরেন। এমন অনন্য প্রচেষ্টা কলকাতাতে হয়তো এই প্রথম। সভায় উপস্থিত মানুষেরা মনযোগ সহকারে শুনলেন ভারতের প্রাচীনতম সাহিত্য বেদে উল্লেখিত জল পরিবেশ বাঁচানোর উদাহরণ গুলি। বক্তারা ভারতীয় সভ্যতার সংস্কৃতির জন্য সন্ন্যাসীদের আত্ম বলিদান কে সংহতি জানিয়ে গঙ্গা বাঁচানোর আন্দোলনকে প্রতিবাদ প্রতিরোধে পথের আন্দোলনে রূপান্তরিত করার ডাক দেন।