বন অধিকারের কথা থেকে সুবর্ণরেখার পাড়

জঙ্গলকন্যা সেতু থেকে ২৮ নভেম্বর তোলা ছবি

নভেম্বর ২৬, মোটর গাড়ি করে যখন জঙ্গলকন্যা সেতুর উপর থেকে সুবর্ণরেখা পেরোচ্ছি। রাত তখন পোনে নটা, পূর্ণিমার আলোয় সেতু থেকে সোনালী জলের বদলে দেখলাম হাইটেনশনের বিদ্যুৎ টাওয়ার। ৯টা ১৫ নাগাদ পৌঁছলাম নয়াগ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত কুড়চিবনী গ্রামে। গাঁয়ের মোড়ল, মুরুব্বিরা সুকুমার দলাই(স্থানীয় বাসিন্দা) এর উঠোনে আমাদের জন্য বেশ খানিকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছেন বোঝা গেলো। মিটমিটে এলইডি লাইটের আলোয় আমাদের বসিয়ে প্রাথমিক আলাপ সারতে সারতে বললো এ অঞ্চলের মূল সমস্যা পাট্টার। এত বছর ধরে বনভূমি আগলে বেঁচে থাকা মানুষগুলির এই জমিতে থাকার রাষ্ট্র ব্যবস্থায় কোনো লিখিত অধিকার নেই। কাগজ নেই।

নভেম্বর ২৭, থেকে দুদিনব্যাপী অখিল ভারতীয় বন জন শ্রমজীবী ইউনিয়ন(A.I.U.F.W.P.) এর পশ্চিম মেদিনীপুর ও ঝাড়গ্রাম জেলার কর্মী সম্মেলন। সকালে অশোক চৌধুরী (মহাসচিব, A.I.U.F.W.P.), অভিজিৎ চ্যাটার্জী (কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, A.I.U.F.W.P.), প্রতাপ ঘোষ (স্থানীয় প্রৌঢ়) সহ আমি সৌরভ (নদীকর্মী, NBJBA) চাক্ষুস করতে গিয়েছিলাম অঞ্চলের পরিস্থিতি।

কলমাপুকুরিয়া গ্রামের স্থানীয়দের কথা থেকে উঠে এলো জঙ্গল নির্ভর জীবিকার কথা। মূল জীবিকা শাল পাতা বিক্রি। দুটি করে শালপাতা কাঠি গুঁজে মোট হাজারটি এরকম জোড়া পাতার দাম পাওয়া যায় ৫০ টাকা। প্লেট বানিয়ে বিক্রি করার সংখ্যা কম। জঙ্গলের ছাতু, বনের আলু, তালগাছের ধুনা, বিভিন্ন গাছের শিকড় এই মোটামুটি বন নির্ভর জীবিকা। কথা বলতে বলতে জানা গেল শিকড়ের ন্যায্য দাম ওনারা পান না। গ্রামে বাইরে থেকে আসা ফড়েরা এসব কিনে নিয়ে যায়। গ্রামের কেউ কেউ অন্যত্র গিয়ে বিক্রি করে এসে বেশী দাম পেয়েছে। ন্যায্য দাম না পাওয়ার সন্দেহের পোক্ত ভিত্তি এটিই।

বন দপ্তরের ভেঙে দেওয়া ঘর

বাগডোবা গ্রামে কয়েকদিন আগেই বনবিভাগ দরমা বেড়ার নির্মিয়মান বাড়ি ভেঙে দিয়ে গেছে। এরকম ঘটনা এই অঞ্চলে প্রচুর। কোনো নোটিশ নেই, বন দপ্তর সঙ্গে পুলিশ এনে আদি বাসিন্দাদের বলছে জঙ্গলে বাড়ি করা যাবে না আর, গুঁড়িয়ে দিচ্ছে ঘরবাড়ি। বাগডোবা তে যে ঘরটি ভাঙা হয়েছে, তাদের পুরানো বেড়ার ঘরটির প্রায় ভগ্ন দশা, তার সামনেই আরেকটি নতুন বেড়ার ঘর বাঁধছিলেন ওই পরিবারটি। তা ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। দেখা মেলেনি পরিবারের সদস্যদের। ধান কাটার সময় এটি। ভোরে বেরিয়ে পড়েন তারা অন্যের জমির ধান কাটতে।

লোধা, শবর, মাহাতো, সাঁওতাল আদিম অধিবাসীদের পাশাপাশি হিন্দুরাও রয়েছে। ঘর ভেঙে দেওয়া, স্বাধীনতার এত বছর পরও পাট্টা না দেওয়া এই সব স্বৈরাচারের সঙ্গে রয়েছে প্রতিদিনের জীবনে অত্যাচার। কামালপুকুরিয়া গাঁয়ের রামকৃষ্ণ সোরেন বললো, ‘চোখের সামনে থেকে লরি বোঝাই কাঠ চলে যায় জঙ্গল থেকে, কিন্তু আমরা জ্বালানির কাঠ কুড়িয়ে আনতে গেলেই বন দপ্তর অত্যাচার করে”।

দলমা থেকে ভরা ফসলের সময়ে প্রায়ই নেমে আসে হাতির পাল। কারণ জঙ্গলগুলি পরিণত হয়েছে মুনাফা তৈরীর জঙ্গলে। হাতির পাল থেকে শুরু করে, বন শুয়োর খাদ্যের অভাবে জঙ্গল ছেড়ে গ্রামে আসে খাদ্যের খোঁজে। ঠিক যেভাবে ভাবে গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে হয় যুবককে শহরে। পাল ছুট একা হাতি তার চলনে ভেঙে ফেলে ঘর-বাড়ি। এই ক্ষেত্রে বন দপ্তরের ভূমিকায় ভাঁটা পরে। বন দপ্তরের এই উদাসীনতার প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে গ্রামের এক যুবক বর্তমানে জেলে।

এত কিছুর পরেও জঙ্গলমহল ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছে না কেনো ? স্থানীয় মানুষদের (যারা অর্থনৈতিকভাবে স্থিতিশীল জায়গায়) কথায়, রেশনের চাল ও আটা, এই খাদ্যের নিশ্চয়তা ক্ষোভ দমনে সহায় হয়েছে। বড় বিল্ডিং এ স্বাস্থ্যকেন্দ্র, যদিও সেখানে চিকিৎসা নামমাত্রই হয়। তবু দৃশ্যত মননে আশ্বাস তৈরী করে। এছাড়া অন্যান্য সামাজিক প্রকল্প তো আছেই। এসবের জন্যই কী মানুষ অত্যাচার মেনে নিচ্ছে ? এই প্রশ্নের পর, চুপ করেই থাকলো বছর ৭০ এর এক বৃদ্ধ। আরও কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেলো, চিকিৎসার জন্য এখানকার মানুষ কলকাতার থেকে কটক যেতেই আজকাল স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন আর্থিক ও মানসিক দুই জায়গা থেকেই।

কর্মী সম্মেলনে বলছেন অশোক চৌধুরী

বিকেল ৪টে নাগাদ শুরু হয় প্রথম দিনের কর্মী সম্মেলন। সুন্দরবন সহ ঝাড়গ্রাম, পশ্চিম মেদিনীপুর থেকে আগত জঙ্গল নির্ভর, নদী মানুষেরা তাদের প্রতিদিনের লড়াইয়ের কথা তুলে ধরেন। অধিকার লড়াই করে বুঝে নিতে হবে একথা বারবার উঠে আসে। অভিজিৎ চ্যাটার্জী খুব গুরুত্বপূর্ণভাবে বারবার বলেন, বন অধিকার ২০০৬ এমন একটি আইন যেখানে স্বীকার করা হচ্ছে “যে অধিকার আপনাদের থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল, তা ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে”। অশোক চৌধুরী সহজ সরলভাবে ব্যাখ্যা করেন বন অধিকার আইনের প্রস্তাবনার, আগামীতে এই আইন নিয়ে কর্মশালা করা হবে ঘোষণা করেন। নদী বাঁচাও জীবন বাঁচাও আন্দোলনের পক্ষ থেকে জানানো হয় সংহতির বার্তা। নদী অরণ্য পাহাড় নিয়ে লড়াই করে মানুষদেরকে এক জায়গায় এক সুরে সোচ্চার হতে হবে এই কথাও বলা হয়। স্থানীয় পীতাম্বর সহ ও অন্যান্য জেলা থেকে আগত সকলের বক্তব্য শেষে শুরু হয় স্থানীয়দের সাংস্কৃতিক প্রদর্শন, ধামসা মাদলের আওয়াজে গম গম করে অধিকারের এই সম্মেলন।

বন অধিকারের কথা থেকে সুবর্ণরেখার পাড়
সুবর্ণরেখা

নভেম্বর ২৮, সকালে চাষ জমির আলপথ ধরে সুবর্ণরেখা দেখতে যাওয়ার পথে চোখে পড়ে, এই গ্রামে এখনও বেশ কিছু দেশী ধান চাষের চল রয়েছে। আর দেশী বীজের চাষ মানেই, কম রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার, মাটির শক্তির দীর্ঘায়ু, চাষ জমি থেকে নদীতে যাওয়া জল দূষণমুক্ত। সুবর্ণরেখার পাড়ে গিয়ে দেখা মেলে জেসিবি দিয়ে অবৈধ বালু তোলার দৃশ্য। পাড়ে স্থির জলে ভেসে থাকা পানা। নদীর বুকে জেগে থাকা চর। নদী পাড়ের চরে জেসিবির ট্রায়ারের দাগ দেখতে দেখতে ফিরে আসা।

আরও পড়ুন – জনজীবন বিঘ্নকারী পরিবেশ ধ্বংসকারী মাইনিং প্রকল্পের বিরুদ্ধে গড়চিরৌলির জনজাতিদের লড়াইয়ের পাশে দাঁড়ান