একক কায়াকিং অভিযানের কথা

ভারতবর্ষ নদী মাতৃক দেশ। সেই কোন ঐতিহাসিক কাল হতে সুবিশাল দেশটির একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে বয়ে চলেছে গঙ্গা, পদ্মা, মহানদী, গোদাবরী, কাবেরী, নর্মদা এমন হাজারো নদ নদী। আবহমান মান কালের এই প্রবাহগুলি এই সুপ্রাচীন ভূখন্ডটির প্রাণ প্রবাহ হয়ে বয়ে চলেছে। এই জলপথ ধরে ধনপতি সওদাগর এর সপ্তডিঙ্গা পাড়ি দিয়েছে। গল্পের পর গল্প জুড়ে তৈরী হয়েছে মনসামঙ্গল। কালের বিবর্তনে ওই জলপথ ধরেই আগমন ঘটেছে পর্তুগিজ, ব্রিটিশ ইত্যাদি বিদেশী শক্তির। ভারতবর্ষের অঙ্গে অঙ্গীভূত হয়েছে পরাধীনতার ইতিহাস। এই নদী গুলি সাক্ষী থেকেছে হানাদারির, পরাধীনতার, স্বাধীনতার। এই নদীপথ ধরেই বিবর্তন ঘটেছে ভারতীয় ইতিহাসের। বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডের নদী পাড়ের সহস্র মানুষের হাসি, কান্না, ভালো থাকা, মন্দ থাকা জড়িয়ে আছে এই নদী গুলির প্রবাহমানতার সাথে। নদীর জলের মতোই অবিরল ধারায় প্রবাহিত হয়েছে নদীকেন্দ্রিক সভ্যতার ভাষা, সংস্কৃতি, জীবন, জীবিকা। শত সহস্র বছরের সেই প্রবাহ যখন থমকে থমকে দাঁড়ায়, মানুষের সভ্যতা গতি হারায়। শৈবাল দাম ঘিরে ধরে স্থবির এই সভ্যতাকে। নদীবাঁকের পঙ্কিল খাঁজে খাঁজে জমা হয় ক্লেদ। দেশের কিছু পরিবেশ সচেতন মানুষ একজোট হয়ে নেমেছেন এই স্থবির নদীর গতি ফিরিয়ে দেওয়ার সংকল্প নিয়ে।

২৯ শে নভেম্বর, ২০২৩  মুর্শিদাবাদ জেলার আহীরন ঘাট থেকে ভাগীরথীর জলে ভাসলো একটি ছোট্ট জলযান। ভারত বর্ষে ব্রিটিশ শাসনের অন্যতম আগমন পথ ধরে দুলকি চালে এগিয়ে চলেছে সেই জলযান। ভাগীরথীর জোলো হওয়ায় পত পত করে উড়ে চলেছে নিশান। কোনো বিজয় নিশান নয়, একটি মৃত্যুপথযাত্রী নদী কে বাঁচানোর আকুল আহ্বান। যেন, ভাগীরথী নিজেই দুহাত তুলে আর্ত আবেদন জানাচ্ছে, “আমাকে বাঁচাও, নদীকে বাঁচাও, জীবন কে বাঁচাও।” পুব আকাশে সূর্যোদয় হলেই ভেসে চলেছে সেই নৌকো। দিনশেষে দিনমনি যখন অস্তাচলে, ভাগীরথীর জলে তখন রাঙ্গা অস্তরাগ প্রতিবিম্বিত হয়। নৌকোখানি কুলে এসে নোঙর করে। নদীপাড়ে নদীর সাথে বেঁচে থাকা মানুষ জন কোল  পেতে অপেক্ষা করে আছেন ওই শ্রান্ত মানুষ গুলিকে সাদরে বরণ করে নেবার জন্য। এ যে তাদের আপন মানুষ, তাদের নদীর, তাদের জীবনের পরম আত্মীয়। রাত্রি নামে ভাগীরথীর বুকে। আলাপ চলতে থাকে পাড়ের মানুষদের।

নদীর গান, নদীর গল্প তখন ভাগীরথীর তীরের ছলাৎ ছলাৎ শব্দের সাথে মিশে অনুরণিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে পলাশীর প্রান্তরে প্রান্তরে, শান্তিপুর, উদ্ধারনপুর, কাটোয়া হয়ে হুগলির সুপ্রাচীন ঘাটগুলির পাড়ে পাড়ে। গঙ্গাপাড়ের বৃক্ষরাজির শেকড়ের ফাঁকে ফাঁকে জমা হতে থাকে সংকল্পের দৃঢ়তা। চৌদ্দ দিনের দীর্ঘ যাত্রাপথে এরকম অনেক গল্প রচিত হয়েছে, বাকী দিন গুলিতে আরো অনেক গল্প রচনা হওয়ার অপেক্ষা। সেই সব জমে থাকা গল্প একদিন প্রলয় হয়ে আছড়ে পড়বেই। সেদিন ভাগীরথী জাগবে। দুর্দম রূপে সেদিন ভেঙে ফেলবে তার যত বাধা, যত বিপত্তি। আবার প্রাণ ফিরে পাবে ভারতের প্রাণস্বরূপা গঙ্গা। যে যাত্রা আরম্ভ হয়েছে মুর্শিদাবাদে সেই যাত্রা আগামী ১২ ডিসেম্বর, ২০২৩ শেষ হবে কলকাতার প্রিন্সেপ ঘাটে। আমরা সবাই সেদিন থাকবো নৌকোটির ছইয়ে  জমিয়ে রাখা গল্পের আহ্বানে, প্রতিশ্রুতির আহ্বানে আর আগামীর পথ চলার শক্তি আহরণের উদ্দেশ্য নিয়ে। আপনিও আসুন। এই সংকল্প যাত্রায় জুড়ে নিজেকে ইতিহাসের সাথে জুড়ে নিন।