ফিলিস্তিনে দৈনন্দিন ঘটে চলেছে এক নির্মম, জঘন্য হত্যালীলা। আমেরিকার মদতপুষ্ট ইজরায়েলি সরকার এবং তাদের বোমারু বিমান প্রতিনিয়ত প্রাণ নিচ্ছে হাজারো শিশু, বৃদ্ধ এবং প্রাপ্ত বয়স্ক নারী পুরুষের। বিগত বেশ কিছু দশক ধরে হয়ে চলা এই মৃত্যুমিছিল হঠাৎ আন্তর্জাতিক মিডিয়ার নজর কাড়ে ৭ই অক্টোবর, যেদিন ইজরায়েলের উপর একদিন আচমকা আক্রমণ করে হামাস। কিন্তু এই আক্রমণ একেবারেই আচমকা ছিল না। বরং এর নেপথ্যে আছে বিগত কয়েক দশক ধরে ঘটে চলা এক সাম্রাজ্যবাদী অত্যাচারের ইতিহাস। এবং এই পুরোটার পিছনে ইন্ধন জুগিয়ে গেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং গুটিকয়েক পুঁজিবাদী মাথা।
এই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদী মুকুটের এক অন্যতম প্রধান পালক হল “স্টারবাকস্” (Starbucks) নামক এক বহুজাতিক সংস্থা। স্টারবাকস্- এর লেবার ইউনিয়ন “স্টারবাকস্ ওয়ার্কার্স ইউনাইটেড” (Starbucks Workers United) অক্টোবরের ৯ তারিখে তাদের এক্স (আগে যা টুইটার বলে পরিচিত ছিল) অ্যাকাউন্টে ফিলিস্তিনের সংহতিতে একটি পোস্ট করে। স্টারবাকস্ কতৃপক্ষ মনে করে এরকম পোস্ট তাদের কোম্পানির “রেপুটেশন” খারাপ করে দিতে পারে, কারণ স্টারবাকস্ সমস্ত ধরনের “সন্ত্রাসবাদ” এবং হিংসাকে সমান ভাবে ধিক্কার জানায়। তাই তারা চাপ দিয়ে সেই পোস্ট সরিয়ে নিতে বাধ্য করে। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। ঘটনার জল গড়ায় কোর্ট পর্যন্ত। স্টারবাকস্ অক্টোবরের ১৩ তারিখে ইউ এস ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট ফর সাদার্ন ডিস্ট্রিক্ট অফ আইওয়াতে মামলা করে তাদের শ্রমিক ইউনিয়নের নামে। কতৃপক্ষের দাবি ইউনিয়ন যেন স্টারবাকস্-এর নাম এবং লোগো ব্যবহার করা বন্ধ করে। ইউনিয়নের তরফে অক্টোবর ২০ তারিখে পেনসিলভেনিয়া ফেডারেল কোর্টে পাল্টা মামলা দায়ের করা হয় স্টারবাকস্ কতৃপক্ষের বিরুদ্ধে। ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট লিন ফক্সের বলেন যে কর্তৃপক্ষ এই যুদ্ধের সুযোগ নিয়ে আসলে শ্রমিক ইউনিয়ন বিরোধী প্রচার চালাচ্ছে। ইউনিয়ন তার নিজস্ব মতামত বহন করার নৈতিক অধিকার রাখে এবং তারা সেটাই করেছে। এই ঘটনায় পৃথিবীর নানান প্রান্তে দানা পাকিয়ে উঠতে থাকে “বয়কট স্টারবাকস্ মুভমেন্ট”। কলেজ পড়ুয়া এবং নানান লেবার ইউনিয়ন ফিলিস্তিনের সংহতিতে পাশে দাঁড়ায় স্টারবাকস্ ইউনিয়নের। সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে ছড়িয়ে পড়তে থাকে ফাঁকা স্টারবাকস্ স্টোরের ছবি। নানান মানুষ নানান রকম ভাবে পাশে এসে দাঁড়ানো আরম্ভ করে এই মুভমেন্টের। (https://x.com/ShaykhSulaiman/status/1722531975662080447?t=8waXP3nMee2Xy4V34qzBrg&s=09 , https://twitter.com/destructionella/status/1720994542646628707?t=cXgNyrP8FQBUw7wbY1Iq0g&s=19 , https://twitter.com/aria_ahrary/status/1723526690897588352?t=Z_-GyxUo71TRUHktttMreA&s=19 , https://twitter.com/hacha799/status/1722341140593045721?t=AMCV80GFCSl9dUCGioQUzQ&s=19 , https://twitter.com/SDGMasterglass/status/1721128213324136760?t=5BoReEQ1_Q3Ye0Xi5aGJZw&s=19)
এক জনৈক স্টারবাকস্ কর্মচারী স্টারবাকস্-এর সমস্ত পানীয় বানানোর রেসিপি আপলোড করেন তার টিকটক অ্যাকাউন্টে। তিনি মানুষকে স্টারবাকস্ বর্জন করার ডাক দেন এবং প্রয়োজনে নিজের পানীয় নিজেই বানিয়ে নেওয়ার আবেদন জানান।
(https://twitter.com/whoisitbad/status/1723340257440006214?t=jt-syomNyDIiIUQKX3IWdQ&s=19)
এমতাবস্থায় গত ১০ই নভেম্বর বিপ্লবী শিক্ষার্থী ঐক্য (আই এস ইউ) ডাক দেয় “বয়কট স্টারবাকস্” শীর্ষক জমায়েতের। পার্ক স্ট্রীট স্টারবাকস্ স্টোরের সামনে এসে জমা হয় জনা তিরিশ পড়ুয়া এবং নাগরিক। স্লোগান এবং বক্তব্যে বারংবার উঠে আশে ফিলিস্তিন, কাশ্মীর, মনিপুর সহ আরো নানান জায়গার কথা। মিলিটারি শাসনের কবলে জর্জরিত পাশের রাজ্য মনিপুর থেকে আরম্ভ করে কাশ্মীর, বার বার উঠে আসে পৃথিবীর সমস্ত মুক্তিকামী জনগোষ্ঠীর স্বাধীনতার ডাক। আই এস ইউ-র পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখেন সাথী দেবায়ুধ। দেবায়ুধের বক্তব্যে পরিষ্কার উঠে আসে যে স্টারবাকস্ আসলে আর কিছুই না, “মহান আমেরিকান ডেমোক্রেসির” পুঁজিবাদী ভাঁওতাবাজির আর এক রূপ। ফিলিস্তিনের মানুষের সংহতির পাশে দেবায়ুধ আর একবার মনে করিয়ে দেন কিভাবে এই স্টারবাকস্- এর নামের সাথেই অতীতে যুক্ত হয়েছে শ্রমিক নির্যাতনের ঘটনা।
সাথী সুম্নিমার বক্তব্যে উঠে আসে ইজরায়েল ফিলিস্তিন দ্বৈরথের আসল চিত্র। এই যুদ্ধ আসলে ইহুদি এবং মুসলমানদের ধর্মযুদ্ধ নয়, এটা আসলে অস্ত্রব্যবসা এবং যুদ্ধব্যবসার আসল রূপ। এই রূপ ফিরে আসে নানান আকারে ও প্রকারে। আমাদের নিজের দেশে আমরা এর নমুনা দেখতে পাই আফস্পা (Armed Forces Special Powers Act), টাডা (Terrorist and Disruptive Activities Prevention Act), পোডা (Prevention of Terrorism Act) – র মত জনবিরোধী আইনের মধ্যে।
সাথী রিমঝিম তার বক্তব্যে পরিষ্কার করে দেন যে এই জমায়েতের উদ্দেশ্য একেবারেই কোনো স্টারবাকস্ কর্মচারীর বিরুদ্ধে নয়, বরং বার বার এটায় জোর দেন যে কিভাবে বাকি ইউনিয়নগুলোর মত এই আন্দোলন তাদেরও আন্দোলন।
এসেছিলেন অ্যাডামসের প্রাক্তন ছাত্রী নায়রা। একটা বড় সচিত্র পোস্টারে বিগত কিছুদিন ধরে ঘটে চলা ধ্বংস এবং মানুষের উপর ইজরায়েলি বোমার প্রভাব নিয়ে নায়রা দীর্ঘক্ষণ বলেন। সেই মর্মান্তিক ছবির কোলাজ গায়ে কাঁটা দেওয়াতে বাধ্য করে।
নদী বাঁচাও জীবন বাঁচাও আন্দোলনের পক্ষ থেকে যোগ দিয়েছিলেন সাথী সৌরভ। সৌরভ পাশের রাজ্য মণিপুরের সাথে তুলনা টেনে বার বার দেখান, যে ফিলিস্তিন আসলে কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এমন ঘটনা দিনের পর দিন ঘটে চলেছে আমাদেরই দেশে, আমাদের চোখের সামনে। ফিলিস্তিনের পাশে দাঁড়ানো মানে আসলে আমাদের দায় বর্তায় মনিপুর থেকে কাশ্মীর, সবার পাশে দাঁড়ানোর। জমায়েত চলাকালীন বহু পথচলতি মানুষ যোগ দেন এই জমায়েতে। গান, স্লোগান এবং প্রতিবাদের সাথে উঠে আসে আগামীর ডাক। শুধু স্টারবাকস্ নয়, সমস্ত পুঁজিবাদী কোম্পানি যারা ইজরায়েলি সরকারের এই ঘৃণ্য কাজে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সমর্থন জানিয়েছে, একে একে প্রতিবাদ নেমে আসবে তাদের সবার উপর। পরবর্তী টার্গেট, ম্যাকডোনাল্ডস্।
আরও পড়ুন – মনিপুর – Kino-Eye