মনিপুর – Kino-Eye – ৩

মনিপুর – Kino-Eye – ৩

চূড়াচাঁদপুর পেরিয়ে বিষ্ণুপুর ঢুকছি যখন দিগন্তে দিন শেষের বীতরাগ সূর্য ডুবছে। ক্ষেতের ওপারে পাহাড়ের ঢালে টিপটিপে বাতির জ্বলে ওঠা-ছায়া মাখা কুকি গির্জার ইশারা সরে যাচ্ছে পিছনে। হেঁসেলের চুলার ধোঁয়া চিমনি বেয়ে উঠে ফসলের মাঠে কুন্ডুলি পাকিয়েছে। সমাহিত মনিপুর পাহাড়ের এই ছবিতে চোখ ভরে নিলাম। জানি দূরের ছবি কাছে গেলে সমসময়ের দেয়াল লিখনে বদলে যাবে -“No Peace “!

   আমরা যারা CDRO (কোঅর্ডিনেশন অফ ডেমোক্রেটিক রাইটস অর্গানাইজেশন্স) team এর fact finding team এ ছিলাম, মনিপুর থেকে ফিরে আসার পর আবার যখন দুই তরতাজা যুবক যুবতীর প্রাণ যাওয়ার খবরে উপত্যকা উত্তপ্ত হয়েছে খবর পড়ছিলাম -সকালের কাগজ বাসি হওয়ার আগেই নিজেদের মধ্যে ফোনাফুনি শুরু করেছিলাম যে – ‘অদ্ভুত লাগছে না খবর টা পড়ে’?- দুটি ছেলেমেয়ে ভালোবাসাবাসি করতে কোথায় গেলো না ওই ‘ওয়ার জোন’-এ? এই আড়াআড়ি ‘ওরা-আমরা’-য় টুকরো হয়ে থাকা মনিপুরে -ইম্ফল উপত্যকা শেষ হলেই ‘সীমানা’ মেইতেই আর কুকিদের দখলে থাকা গ্রামের -গত দেড় দশকে যেন জম্মু থেকে মুঝফ্ফরনগর নিজের দেশের মধ্যেই বার বার এই পাঁচিল উঠতে দেখেছি আমরা -মনিপুরেও নতুন নয় -ইম্ফল উপত্যকা পার্বত্য মনিপুরে ছেড়ে ঢুকতে বেরোতে দেখছিলাম – এবারের পরিস্থিতিতে ‘বাফার জোন’-এর এপারে ‘মেইরাপাইবি’র মহিলারা লাঠি হাতে প্রত্যেকটি গাড়ি ধরে ধরে তল্লাশি চালাচ্ছেন একজনও কুকি মানুষ যেন ‘বেরিয়ে’ যেতে না পারে, – ওপারে একই ভাবে কুকি জনজাতির নজরদারি-চোখ এড়িয়ে পেরিয়ে যেতে না পারে যেন একজনও মেইতেই-মাঝে তিন থাক CRPF এর সাঁজোয়া গাড়ি পাথুরে মুখে ডিউটি করছে। ইম্ফলে নেমে নানা সূত্র ধরে যখন কাংকোপকি বা চূড়াচাঁদপুর জেলার কুকি আশ্রয় শিবিরগুলোতে যেতে চেয়ে ফোনে ধরা গেছে তাদের যারা “Zalen-gam” (স্বাধীন কুকি এলাকা) সমর্থক, বলেছে -আপনারা আসুন কিন্তু গাড়ির চালক যেন মেইতেই (হিন্দু) না হয়, না হলে আপনারা ফিরবেন কিন্তু গাড়ি আর চালক আমরা ইম্ফল ফেরত যাওয়ার নিশ্চয়তা দিতে পারবো না’। তাহলে ‘উপায়?- ‘পাঙ্গাল'(মেইতেই মুসলিম) ড্রাইভার আনুন- আপাতত ওদের এই সংঘর্ষে ‘আমরা ওরা ‘-র বাইরে রাখছি।’

যুগলের খুনের ঘটনা ঘটনা নাকি সেই উত্তপ্ত সময়ে ৬ই জুলাইয়ের। আর রাজ্যে ইন্টারনেট আগল খুলতে খুনের ভিডিও ‘ভাইরাল’ হয়ে নতুন করে আগুন জ্বালালো ২৫শে সেপ্টেম্বর। ২৯তারিখ ছাত্ররা পথে নামলো আর আবারও পরিস্থিতি ‘নিয়ন্ত্রণে’আনতে শট গান চালালো সেনা।তিন বছর আগে কাশ্মীরে পেলেট গান এর ব্যবহার নিয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের আন্তর্জাতিক অভিযোগের মুখে প্রতিরক্ষা মন্ত্রক কে বিবৃতি দিতে হয়েছিলো – উত্তেজিত জনতার উপর ব্যবহারে পেলেট গান আর ছররা ‘নন লেথাল'(প্রাণঘাতী নয় এমন ) বলে বিবেচিত হবে না।’আবারও মনিপুরে ছাত্রের মৃত দেহে ‘পেলেট গান’-এর ছররা গুলির অসংখ্য ক্ষত  – কাশ্মীরের সেনাবাহিনীর বর্বরতার স্মৃতি দিয়ে মিলিয়ে দিলো কাশ্মীর আর মনিপুরকে।

মনিপুর – Kino-Eye – ৩

 তো পরিস্থিতি যখন এই -তখন ‘প্ৰিয়, ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য ‘এ কথা বলতে একে অপরকে তারা যুগলে ওই রণ রক্তের মধ্যে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলো ?- সেলফি তুললো এবং ‘কুকি বাঙ্কারে গিয়ে গাঁজা চাইলো’ তারপরেই নাকি কুকি ‘জঙ্গিরা’ তাদের তুলে নিয়ে গিয়ে খুন করলো? পরে পাওয়া গেলো তাদের ‘ঘনিষ্ট হওয়ার আপত্তিকর’ ভিডিও ও। সুধীর মিশ্রর সিনেমার স্ক্রিপ্ট এর কাছাকাছি প্রায়। যদিও তারপর কেন্দ্রের ইন্টেলিজেন্স টিম তদন্তে নেমে নাকি এই ঘটনায় জড়িত ৭ জনকে গ্রেফতারও করেছে। মেইতেই মুখ্যমন্ত্রীরই কেন্দ্র থোউবলে মেইতেইরাও মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিং এর কুশপুতুল পুড়িয়েছে ও ইম্ফলে বিজেপি পার্টি অফিস পুড়িয়েছে। মনিপুর পুড়ছে।

Zomi (কুকি) ছাত্র সংগঠনের মোর্চা অফিসের বাইরে এসে এক ঝকঝকে সদ্য তরুণ জবাব দিয়েছিলো -‘আমি দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের এম ফিল। ছাত্রাবস্থায় দিল্লীতে থাকতে থাকতে বুঝেছি কি চোখে তাকান আপনারা কেন্দ্র থেকে প্রান্তের দিকে, আমাদের দিকে! উত্তর পূর্ব ভারতের সব ভিন্নতার মানুষ আপনাদের চোখে একই রকম। নর্থ ইস্টের মেয়েদের দিল্লীতে ডাকা হয় ‘চিঙ্কি’-কি তাইতো? যেমন কাশ্মীরি ছাত্রদের দেখলে ক্যাম্পাসে ডাক চালু হয়েছে দেখতাম ‘টুকরে টুকরে ‘- আমরা সবাই ‘সেপারেটিস্ট’ আপনাদের নর্থ ইন্ডিয়ার চোখে। কখনো তথ্য নিয়েছেন উত্তর পূর্ব ভারতের ছাত্ররা কিভাবে নিগ্রহের শিকার হয়ে চলে দিল্লী হরিয়ানায়? দিল্লীর কিরোরীমল কলেজে পড়তো আমার বোন, লকডাউনের সময় ফোনে কাঁদতে কাঁদতে বলতো কলেজে হোস্টেলে ওদের ‘করোনা -চীনা ভাইরাস’ বলে ‘নেম কলিং’করতো মেইনল্যান্ড ইন্ডিয়ান স্থানীয়রা! ইন্ডিয়া আমাদের যে চোখে দেখে আমরাও তাকে সে চোখেই দেখি।’

মনিপুর – Kino-Eye – ৩
মনিপুর – Kino-Eye – ৩

আমাদের প্রশ্ন ছিলো?- ‘তাহলে কি আর্মির বুটের তলা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে  AFSPA-র  বিরুদ্ধে ‘তানাশাহী’র বিরুদ্ধে মনিপুরের লড়াই আবার ঢেকে গেলো জনজাতি দাঙ্গার বিদ্বেষের ধোঁয়াশায়?”

নিজের শুধুমাত্র কুকি আত্মপরিচয় সরিয়ে রেখে দ্বিধাহীন উত্তর ছিলো তার  -‘যে আগুন লাগাচ্ছে ধোঁয়া সরিয়ে  তার মুখ চিনতে বেশি দেরী হবে না মনিপুরের।’

ফিরতি পথে জাতিসত্বার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার নিয়ে পুরনো ‘বাম বেসিকস’ ঝালিয়ে নিতে নিতে আমরা দেখছিলাম উত্তরপূর্ব ভারতের জানজাতির বিন্যাস জটিলতায় সব পুরনো ধারণা খাপে খাপে বসিয়ে দেওয়া যাচ্ছে না আর।

আসছে ভোট-এ ৫৬ শতাংশ মেইতেই ভোট ধরে রাখতে চাইবে ‘ডবল ইঞ্জিন ‘সরকার নাকি ফেব্রুয়ারী তে কাঙকোপকি জেলায় ‘পপি (আফিম ) চাষের মরসুম শেষ হলে থামবে দাঙ্গা – হাইপোথিসিস অনেক!

মেইতেই কুকি নাগা -সব ‘পক্ষ’ই আমাদের বলেছেন – ‘আপনারা বড় ‘ভারত’ থেকে শান্তি চাইতে এসেছেন। আপনাদের শুভকাঙ্খাকে আমরা জল সুপুরি বসার আসন দিয়ে সৌজন্য জানাচ্ছি। তবে কি জানেন যুদ্ধ লেগেছে তো – যুযুধান দুপক্ষকে শান্তি চাইতে হবে আর চাইতে হবে যে দাঙ্গা ‘লাগিয়েছে’ তাকে -সরকার কে!’

আজকের কিস্তিতে এ ছবি দুটোই দেবো। চূড়াচাঁদপুর কলেজের ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলতে যাচ্ছি – চলতি গাড়ি থেকে হঠাৎ চোখ আটকে গেলো একটি নিরীহ পথের পাশের স্টেশনারি জাতীয় দোকানে – প্রকাশ্যে দিনের আলোয় ঝুলছে সামরিক বুলেট প্রুফ জ্যাকেট। বিক্রির জন্যই। দেখিনি কখনো কোথাও, তাই ছবি তুললাম। পরে দেখলাম একাধিক দোকানে। মে মাসের ৩ তারিখের পর সরকারি অস্ত্রাগার থেকে লুঠ (মতান্তরে বিলি) হয়েছে ৪ হাজার অ্যাসল্ট সক্ষমতার রাইফেল – ঘুরছে দু তরফের হাতেই। মণিপুরে সমাজের ‘সামরিকিকীকরণ’ করা হয়েছে। বন্দুক নামিয়ে রাখতে সময় লাগবে।

মনিপুর – Kino-Eye – ৩

তাই গোটা উপত্যকা আর পাহাড় জুড়ে নানা দেওয়ালে আলকাতরার পৌঁচে লেখা  ‘No Peace’!

পড়ো সমকাল – এটাই মনিপুরের আজকের দেওয়াল লিখন।

Image Not Found

আরও পড়ুন – মনিপুর – Kino-Eye

আরও পড়ুন – মনিপুর – Kino-Eye – ২