ইম্ফলের কেন্দ্রে ইমা কেইথেল বাজারে গিয়ে চুপ করে একপাশে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে ছিলাম। অবাক হয়ে তাকিয়ে। কাংলা দুর্গের পশ্চিমে, বীর টিকেন্দ্রজিৎ রোডে (উল্লেখ করে রাখলাম কারণ পরে শিখেছি কাঙলা দুর্গ বা টিকেন্দ্রজিৎ কে বাদ দিয়ে মনিপুর এর আত্মপরিচয়ের লড়াইকে জানা শুরুই হয়না)। খাওয়াইরামবান্দ ইমা কেইথেল – অন্য নাম নুপি কাইথেল বাজার- গুগল করলে জায়গায় দাঁড়িয়ে জেনে নেওয়া যাবে- এটাই বোধহয় দুনিয়ার একমাত্র পুরোপুরি ভাবে মেয়েদের চালানো বাজার। জায়গাটায় গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম -বাজার মাদার্স মার্কেট (এ নামেও ডাকতো ব্রিটিশরা )-এর একটা নয় তিন তিনটে – বাজার ছাপিয়ে সংলগ্ন ফুটপাথেও – গড়ে ৫ হাজার মহিলা নাকি রোজ বসেন।
যেমন ৫০০বছরের পুরোনো এই বাজার কে জানতে ব্রিটিশ বিরোধী নুপি বিদ্রোহের কথা জানতে হবে তেমনি বাজারে ঘুরতে ঘুরতে ইমা শব্দের মানে খুঁজতে আমাকে মেইতেই পুরাণের ইমোইনু দেবীর গল্পে টেনে নিয়ে যান এক পদ্মের বীজ নিয়ে বসা প্রবীণা।
এখান থেকেই বা শুরু করবো না কেন তাহলে?
শুঁটকি মাছ, তাঁতে বোনা কাপড়, গয়না, পুতুল, বেত আর কাঠের কত কিছু- ছাপিয়ে আমার চোখ যাচ্ছিলো পাহাড়ি মধু আর ছোট মাটির হাঁড়ির দই,পদ্ম বীজের বাদাম হাতে তুলে ভাঙতে ভাঙতে থুপ করে রাখা বাঁশের কোঁড়া/ছাতু (ব্যাম্বু শুট) আর অত বড় বড় গুঁড়ো মুড়ির মোয়া গুলোর দিকে। গরম ভাজা হচ্ছিলো :মোবাই নকুপি’ (বেসনে ডুবিয়ে পাহাড়ি নানা শাক)-কলা পাতার এক চ্যাঙ্গারি শেষ করে একটা কালো তিলের খাজা মুখে ভেঙে শুনতে থাকছিলাম ‘নুপি লান’ বিদ্রোহের কথা। ‘ইন্ডিজেনাস’ নিয়ে আদিখ্যেতা বেচার ‘এক্সটিক ইন্ডিয়া’ পায়ে পায়ে হোঁচট খাবে যখন জানা হবে ‘লাল্লুপ কাবা’ (প্রাচীন ভূমি দাস প্রথা – যাতে পুরুষদের বাধ্যতা মূলক জমিতে শ্রম দিতে ঘর ছেড়ে দূরে চলে যেতে হতো )-র কারণে মেয়েরাই একদিন চাষ আর কৃষিজাত বিক্রির দায়িত্ব তুলে নিয়ে বসিয়েছিলেন এই কেইথেল বাজার।
মনিপুর কে জানতে বুঝতে এই মাতৃসূত্রিক সমাজ কাঠামোকে না বুঝতে চেয়ে শুরু করবো কি করে?
সম্প্রতি মেয়েদের জন্য ৩৩% আসন সংরক্ষণ বিল সংসদে পাশ হয়েছে। আদতেই নারী ক্ষমতায়ন না ভোটের খেলা এই বিতর্ক উসকে দিয়েই। উত্তর পূর্ব ভারতে দাঁড়িয়ে তাই প্রাসঙ্গিক ভাবেই মনে পড়ে যাচ্ছে – ২০১৭-য় নাগাল্যান্ডে নগরপালিকাগুলোয় এক তৃতীয়াংশ মহিলা সংরক্ষন চালু করতে গিয়ে প্রতিবাদের আগুন জ্বলে উঠেছিলো। মণিপুরে ইম্ফল ভ্যালিতে অসুবিধা হয়নি কিন্তু পার্বত্য জনজাতি প্রধান ৬টি অটোনোমাস ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিল জানিয়ে দিয়েছে মহিলাদের এক তৃতীয়াংশ সংরক্ষণ তাদের উপর চাপিয়ে দিলে তারা মানতে বাধ্য নয় -এ তাদের জনজাতি স্বাতন্ত্র বোধের উপর আঘাত। ইমা বাজারে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিলো, সত্যিই সময়ের আর শাসকের বদলে সমাজ চালানোর ক্ষমতা সত্যিই আজও মেয়েদের হাতেই কিনা এই প্রশ্নের উত্তর অন্যভাবে খোঁজা দরকার, খুঁজবো আজকের অগ্নিগর্ভ মনিপুরে জনজাতি সংঘর্ষে মেয়েদের শরীর যখন ‘যুদ্ধ ক্ষেত্র’ হয়ে ওঠে আর নগ্ন নির্যাতিতাকে যুদ্ধ বন্দীর মতো হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়ার ভিডিও ভাইরাল হয়- সেই প্রেক্ষিতেই। মনে সবারই পড়বে দেড় দশক আগে কাংলা দুর্গের সামনে সেই দুর্জয় মহিলাদের ছবি- সেদিন ও ভাইরাল হয়েছিলো নগ্নতার ছবি, নিজেরাই তারা নগ্নতাকে করেছিলেন প্রতিরোধের ভাষা। আসাম রাইফেলস এর সদর দপ্তরের ফটক ঝাঁকিয়ে কল্লোল তুলেছিলেন হাজারে হাজারে- বুকের জড়িয়ে নেওয়া ব্যানারে লিখে এনেছিলেন ‘ইন্ডিয়ান আর্মি এসো, ধর্ষণ করো আমাদের ‘! মনোরমার ধর্ষণ, মণিপুরে আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ার এক্ট(আফস্পা )’ চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে ইরম শর্মিলা চানুর ১৬বছরের অনশন।তবে আজ মেইতেই কুকি সংঘর্ষে ‘মেইরা পেইবি’ মহিলা সংগঠনের ভূমিকা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে কেন? ইম্ফল উপত্যকা পেরিয়ে পাহাড়ে ওঠার মুখে গাড়ি আটকে তল্লাশি চালালেন লাঠি হাতে ‘মেইরা পেইবি’মহিলারা, এগিয়ে দিলেন ঘর ছাড়া মেইতেই পরিবারগুলির জন্য চালানো আশ্রয় শিবিরের জন্য তোলা চাঁদার রসিদ।এরাই বসেন ইমা কেইথেল বাজারে, পোলো গ্রাউন্ডের জমায়েত মিছিলে হাঁটেন এরাই , এরাই হরতালে অচল করে দিয়েছেন মনিপুর -ইতিহাসে বার বার।আর এবারের দাঙ্গায় কুকি মহিলাদের ঘর থেকে টেনে বের করে এরাই ঠেলে দিচ্ছিলেন মেইতেই পুরুষদের উদ্যত লালসার দিকে?-ইতিহাসের এই পিছনে হাঁটার প্রহসনে ‘রাত কত হলো – উত্তর মেলেনা’!