যোশীমঠ সহ উত্তরাখণ্ডের এক বড় অংশ অতল গহ্বরে তলিয়ে যেতে বসেছে: এই ভয়াবহ বিপর্যয়ের দায় কার?

Image Not Found

দেদার বাজি ফাটিয়ে, তারস্বরে ডিজে বাজিয়ে মহা ধুমধামে সারা দেশে ইংরেজি নববর্ষ পালনের পরে পরেই যোশীমঠ এর বিভিন্ন এলাকায় বাড়িঘর, হোটেল, রাস্তা ও জমিতে ভয়ঙ্কর ফাটলের ছবি ও খবর আসতে থাকে সোশ্যাল মিডিয়া ও সংবাদপত্রের পাতায়। এখনও পর্যন্ত যোশীমঠের নয়টি ওয়ার্ডের ৭২৩টি বাড়িতে ফাটল ধরেছে, ফাটল ক্রমেই চওড়া হচ্ছে। ফাটলের হাত থেকে রেহাই পায়নি যোশীমঠের সামরিক বাহিনীর বেসক্যাম্প। ফাটল ধরেছে যোশীমঠের প্রাচীন শংকরাচার্য মঠের দেওয়ালেও। উত্তরাখণ্ডের এই বিপর্যয় খতিয়ে দেখতে কেন্দ্রের তরফে একটি বিশেষ দল (Expert Panel) তৈরি করা হয়েছে। সেই দল এলাকা পরিদর্শন করে রাজ্যকে যে রিপোর্ট দিয়েছে তার ভিত্তিতে রাজ্য সরকার পুরো এলাকাকেই ‘সিঙ্কিং জোন’ অর্থাৎ ক্রমশঃ ধসে যাওয়া অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করেছে। ‘বসবাসের অযোগ্য’ বলে ঘোষণা করা যোশীমঠ থেকে সব বাসিন্দাদের অবিলম্বে বাড়ি খালি করার নোটিশ ধরানো হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্থ বাড়িগুলো ভেঙে ফেলার কাজ সরকার আপাতত বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছে বিপদগ্রস্ত মানুষদের প্রবল বিক্ষোভের মুখে। ১৩ তারিখে উত্তরাখণ্ড সরকার জানিয়েছে –৬৭৮ টি বাড়ি বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছে, হাজার চারেক মানুষকে ত্রাণ শিবিরে সরানো হয়েছে। হেলে পড়া দুই হোটেল: পাঁচতলা ‘মালারি ইন’ এবং সাততলা ‘মাউন্ট ভিউ’ ভাঙার কাজ শুরু হয়েছে। অন্যদিকে ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ISRO- র উপগ্রহ চিত্র থেকে জন্য গেছে মাত্র বারো দিনের (২৭ ডিসেম্বর-৮ জানুয়ারি) মধ্যেই ৫.৪ সেন্টিমিটার বসে গেছে যোশীমঠ। মাটির নিচে যোশীমঠের এই হারে বসে যাওয়া আগের সব রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে। অর্থাৎ দেবভূমির এই ছোট শহরটির অস্তিত্বই এখন প্রশ্নচিহ্নের মুখে দাঁড়িয়ে গেল। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে যোশীমঠের সর্বত্র। যোশীমঠের প্রায় ৩০ শতাংশ এলাকা এই ধসের কবলে পড়েছে। অন্যদিকে যোশী মঠ থেকে ৯০ কিলোমিটার দূরে কর্ণপ্রয়াগ ও তেহরি গাড়ওয়ালেও ফাটল দেখা দিয়েছে। রাস্তায়, বাড়িতে ফাটল দেখে মনে হচ্ছে –পাহাড়ের গা থেকে শহরটি আলগা হয়ে যাওয়া এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।

যোশীমঠ সহ উত্তরাখণ্ডের এই বিপর্যয়ের কারণ কী:

প্রথমেই দেখা যাক, কীভাবে এই শহরটি গড়ে উঠেছিল। কোনো এক সময়ে প্রবল ভূমিকম্পের ফলে পাহাড় থেকে মাটির যে ধস নেমে আসে,  জমাট না বাঁধা সেই ঝুরো মাটির ভগ্নাবশেষের ওপর সমুদ্রতল থেকে ৬১৫০ ফুট উপরে পাহাড়ের ঢালে উত্তরাখণ্ডের চামোলি জেলায় গড়ে তোলা হয় যোশীমঠ শহরটিকে। নৈনিতাল, উত্তরকাশী, চম্পাবত –উত্তরাখণ্ডের এই শহরগুলোও গড়ে উঠেছে ভূমিধসের ফলে জমা হওয়া আলগা মাটির ওপর। ফলতঃ প্রকৃতির নিয়ম মেনেই শহরের নিচে এখনো রয়ে গেছে প্রচুর পরিমাণে আলগা বালি, পাথর, দুর্বল শিলা এবং মোরেন’ র (হিমবাহ গলে যাওয়ার পর যা অবশিষ্ট থাকে) স্তূপ। আর এই কারণেই ভূমিকম্পন প্রবন এই অঞ্চলে ভারী নির্মাণকাজ কোনভাবেই বিজ্ঞাসম্মত নয়। কিন্তু জনবসতি গড়ে ওঠা এবং দেবভুমির তিনটি স্থান –বদ্রীনাথ, হেমকুন্ড সাহিব এবং শঙ্করাচার্য মন্দির অঞ্চলে ধার্মিক ও পর্যটকদের নানান সুখ সুবিধে দেওয়া ও আরও আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য প্রকৃতির নিয়মকে তোয়াক্কা না করে অপরিকল্পিতভাবে বড় মাপের পরিকাঠামো গড়ে তোলার কাজে হাত দেওয়া হয়। এর সাথে তাল মিলিয়ে পর্যটন শিল্পের রমরমাও বাড়তে থাকে।

অন্যদিকে যোশীমঠে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রে টানেল তৈরির জন্য পাহাড় ফাটাতে বিস্ফোরণ করা হয়। স্থানীয়দের অভিযোগ, ওই বিস্ফোরণে বারবার কেঁপে উঠত গোটা শহর। গত ডিসেম্বর থেকেই যোশীমঠে একাধিক বাড়িতে ফাটল ধরতে শুরু করে। স্থানীয়দের অভিযোগ, এর আগে একাধিক বার এই নিয়ে সরকার ও প্রশাসনের কাছে অভিযোগ জানানোর পরেও কোনও লাভ হয়নি।

উত্তরাখণ্ডের যত্রতত্র ভুইঁফোড়ের মতো গজিয়ে ওঠা জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের সাথে যুক্ত হয়েছে পাহাড় ও গাছপালা কেটে বড় বড় রাস্তা তৈরি, যত্রতত্র হোটেল, রেস্টুরেন্ট ও বাড়ি তৈরী, অলকানন্দার দুপারে নুড়ি পাথর ও মাটি তুলে নেওয়া, নদীর স্বাভাবিক গতিপথ রুদ্ধ করে নদীর পাড় বরাবর রাস্তা নির্মাণ, ইত্যাদি। মাটি পাথর বালির বদলে কোনরকম পরিকল্পনা ছাড়াই পুরো শহরটাকে কংক্রিটের জঙ্গলে ঢেকে দেওয়ার ফলে জল নিকাশি ব্যাবস্থাও পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে। পুবে ধাকনালা, পশ্চিমে করমনাশা, উত্তরে অলকানন্দা, দক্ষিণে ধৌলিগঙ্গা –এই চারটি প্রাকৃতিক জলনির্গমন প্রণালী উন্নয়ন ও নগরায়নের চাপে অবরুদ্ধ। ফলে পাহাড় থেকে আসা জল বা বৃষ্টির জল মাটির ভিতর প্রবেশ করতে না পারায় তা ভূভাগের উপরিস্তরে ও মাটির নিচে বাড়তি চাপ তৈরি করছে।

১৯৭০ ও ১৯৭৮ সালে ভাগীরথী ও অলকানন্দার প্রবল বন্যা, ১৯৮৩ সালের কেদারনাথ কাণ্ড, ২০১৩ সালে চামোলি গ্রাম সংলগ্ন অঞ্চলে ব্যাপক বিপর্যয় ও প্রাণহানি এবং ২০২১’র হিমবাহ গলে গিয়ে ব্যাপক বিপর্যয়ের ধারাবাহিকতায় এবারের যোশীমঠে প্রকৃতির প্রলয় নাচন বোধহয় শেষবারের মতো অশনি সংকেত। ভূমিকম্প প্রবণ, বয়সে নবীন ও ভঙ্গুর হিমালয় সংলগ্ন এলাকায় এইসব বিভীষিকাময় দুর্যোগগুলো কিছুটা স্বাভাবিক হলেও এর মূলে মনুষ্যসৃষ্ট কারণগুলোই সবচেয়ে বেশি করে দায়ি। হিমালয়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সবুজে মোড়া সুউচ্চ বনানী, নদীর স্বাভাবিক গতিপথ সহ তামাম জীব-বৈচিত্র্য অটুট থাকলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিভীষিকা ও ক্ষতিসাধন ক্ষমতা অনেকটা কম হয়। কিন্তু বাস্তবে কী হলো? নদীর পাড় বরাবর রাস্তা নির্মাণ, নদীর প্রাকৃতিক গতিপথ রুদ্ধ করে যেখানে সেখানে বাঁধ ও জলবিদ্যুৎ প্রকল্প এবং তার জন্য মাটি ফাটিয়ে সুড়ঙ্গ তৈরি, নদী ও জমি চুরি করে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠল হোটেল-রিসর্ট। নদীর বুকে ও পাহাড়ের কোলে জমা হতে থাকল যতসব অপরিকল্পিত, অবৈজ্ঞানিক নির্মাণের কঠিন বর্জ্য, হলো চারধামে যাওয়ার চার লেনের রাস্তা –রুদ্ধ হলো নদীর স্বাভাবিক গতিপথ। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে – বিগত কয়েক বছরে উত্তরাখণ্ডের কয়েক হাজার প্রাকৃতিক ঝর্না স্রেফ উধাও হয়ে গেছে। এসবই হলো সরকারের প্রত্যক্ষ মদতে ও অদূরদর্শিতার কারণে। অথচ ঋষিগঙ্গা জলবিদ্যুৎ প্রকল্প যে পরিবেশ সহ স্থানীয় মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপনে ব্যাপক ক্ষতিসাধন করবে, তা বুঝতে পেরেই গ্রামবাসীরা এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রতিবাদে মুখরিত হয়েছেন প্রথম থেকেই। তাঁরা আদালতে গেলে আদালতের স্পষ্ট রায় ছিল–”হিমালয়ের একেবারে ভিতরে নদীকে অনেকটা পথ ঘুরিয়ে নিয়ে গিয়ে বিদ্যুৎ-কেন্দ্র স্থাপন করলে তা হিমালয়ের সামগ্রিক পরিবেশ ধ্বংস করে বিপর্যয় ডেকে আনবে”। এই রায়কে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে নানান পন্থা-পদ্ধতি অবলম্বন করে নির্মাণ কাজ চলছেই, উন্নয়নের ঢক্কা-নিনাদ বেজেই চলেছে। আসলে কর্পোরেট ও তাদের সেবাদাস সরকারগুলোর একটাই বাণী–যে কোন মূল্যে ছুটিয়ে নিয়ে চলো সব গিলে খাওয়া উন্নয়নের রথ আর পুঁজির মুনাফা বৃদ্ধির হার।  অপরিকল্পিত, অবৈজ্ঞানিক উন্নয়ন ও নগরায়নের মহাযজ্ঞ প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম ও ভারসাম্যের বিপরীতে কাজ করছে, ফলে এইসব পরিবর্তনগুলোকে প্রত্যাবর্তনীয় চক্রের মধ্যে নিয়ে গিয়ে আগের অবস্থায় কোনভাবেই আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। তাই হিমালয়ের বিপর্যয়ের সাথে সাথে জীববৈচিত্র্য সহ প্রকৃতির ভারসাম্য সম্পূর্ণ রূপে ধ্বংস হওয়ার দিকে নিশ্চিত পায়ে এগিয়ে চলেছে।

উত্তরাখণ্ডের বারংবার বিপর্যয় সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের অভিমত:

২০২১ সালের ভূমিধ্বস ও হড়পা বানে ঋষিগঙ্গা ও তপোবন জলবিদ্যুৎ প্রকল্প দুটি সম্পূর্ণ ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। কর্মরত শ্রমিকরা টানেলে আটকে পড়ে সবাই মারা গেছেন। এর আগে ২০১৩ সালে একইভাবে ১১,০০০ মানুষ বিপর্যস্ত হন, জলের তলায় তলিয়ে যায় বেশ কয়েকটি গ্রাম ও হেক্টরের পর হেক্টর চাষের জমি। এই বিপর্যয়ের কারণ খুঁজতে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে গঠিত পরিবেশ ও বনমন্ত্রকের বিশেষ কমিটির রিপোর্টে আঙ্গুল তোলা হয়েছিল পার্বত্য রাজ্যটিতে অপরিকল্পিত জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বাড়বাড়ন্তের দিকেই। দেরাদুনের ‘পিপলস সায়েন্স ইনস্টিটিউট’ র অধিকর্তা রবি চোপড়ার নেতৃত্বে কমিটি যে রিপোর্ট সুপ্রিমকোর্টে ২০১৪ সালে জমা দেয় তাতে স্পষ্ট সুপারিশ ছিল– অলকানন্দা ও ভাগীরথী নদীর অববাহিকায় অন্তত ২৬ টি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প অবিলম্বে বাতিল করতে হবে। কারণ এই নির্মাণের ফলে নদীর জলস্তর এবং গতিপথ, ধস আটকানোর বনভূমি, মাটি-পাথরের স্থিতিশীলতা– ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সবকিছুই। রিপোর্ট জমা পড়ার পর কেটে গেছে আট-আটটি বছর, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বরং অসংখ্য জলবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র গড়ে তোলার যে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল তার মধ্যে ১২০ টির কাজ ইতিমধ্যেই শেষ। নদী-বিশেষজ্ঞ কল্যান রুদ্র মনে করছেন –’রান অফ দ্য রিভার মডেলে’ জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মিত হলে তা নদীর বাস্তুতন্ত্রকে অনেক সময়ই ক্ষতিগ্রস্ত করে। বিখ্যাত পর্বতারোহী বসন্ত সিংহ রায়ের মতে –”নদীবাঁধ ও জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের পাশাপাশি বনভূমি ধ্বংসও এই বিপর্যয়ের অন্যতম কারন”। পরিবেশ আন্দোলনের সংগঠক ও হিমালয় বিশারদ প্রয়াত সুন্দরলাল বহুগুণার নেতৃত্বে উত্তরাখণ্ডের মন্ডল গ্রামে প্রথম শুরু হয়েছিল রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে চিপকো আন্দোলন ১৯৭৩ সালে। বস্তুত, ১৯৩০ সালেই সুইজারল্যান্ডের কিছু ভূ-বিজ্ঞানী যোশীমঠে যেকোন ধরনের বড় নির্মাণ বন্ধ করার কথা বলেছিলেন। পাহাড়কে বাঁচাতে বড় আন্দোলনে নামেন জি ডি আগরওয়াল, যাঁর আন্দোলনের ফলে ২০১০ সালে ইউপিএ সরকারের পরিবেশ মন্ত্রী ৬০০ মেগাওয়াটের প্রস্তাবিত বিদ্যুৎ প্রকল্প বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছিল। ২০১৮-এ ভাগীরথী নদীর উপর বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে ধর্ণা ও অনশনের সময় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং তারপরই খুব খারাপ পরিস্থিতিতে ওনার মৃত্যু হয়। এরপর, পরিবেশ বিজ্ঞানী রবি চোপড়া, যিনি চারধাম রেল প্রকল্পের মনিটরিং কমিটির একজন বিশেষজ্ঞ ছিলেন, ওই কমিটি থেকে ইস্তফা দেন পরিবেশ রক্ষা প্রসঙ্গে তার পরামর্শ সরকার মানছে না বলে। চিপকো আন্দোলনের অন্যতম নেতা, যিনি প্রকৃতিকে নিজের প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসেন, পাহাড়ের প্রতিটি গ্রাম, প্রতিটি নদীকে হাতের তালুর মতো চেনেন সেই চন্ডীপ্রসাদ  ভট্ট তাঁর দীর্ঘ প্রবন্ধে হিমালয়ের বুক বিদীর্ণ করে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রবল বিরোধিতা করেন। অন্যদিকে ‘পহর’ পত্রিকার সম্পাদক, বিশিষ্ট পরিবেশবিদ ও ‘হিস্ট্রি অফ চিপকো মুভমেন্ট’ গ্রন্থের প্রণেতা শেখর পাঠকও সরকারকে একই উপদেশ শুনিয়েছেন বারেবারে। কাকস্য পরিবেদন! উত্তরাখণ্ড ও দেশের রাজনীতিবিদরা এসব চেতাবনি কানে তুললে বারবার ভয়াবহ বিপর্যয়ের সাক্ষী হতে হত না ভারতবাসীকে।

আর বর্তমান বিপর্যয় সম্পর্কে পঞ্চম শ্রেণী থেকে পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনে যুক্ত অধুনা একাদশ শ্রেণীর ছাত্রী হরিদ্বারের রিদ্ধিমা পাণ্ডের বিস্ফোরক মন্তব্য –”শুধু যোশী মঠ বা উত্তরাখণ্ড নয়, সমগ্র দুনিয়াকে ধোঁকা দিচ্ছে এই সরকার। টাকা আর ক্ষমতায় থাকা ছাড়া এরা অন্য কিছু বোঝে না। আন্তর্জাতিক মঞ্চে দাঁড়িয়ে ‘গ্রিন এনার্জি’ নিয়ে বড় বড় কথা বলে, অথচ উন্নয়নের নামে এরাই রোজ ধ্বংস করছে পরিবেশ-প্রকৃতিকে। পরিবেশে নজর না-দিয়ে সরকার শুধু ভোটের জন্য উন্নয়ন-উন্নয়ন করে লাফালে, এটাই হবে। মানুষ মরবে, পশুপাখি মরবে। গাছপালা সব শেষ হয়ে যাবে। শুধু যোশীমঠ কেন, গোটা রাজ্যটাই রসাতলে যাবে”। সাব্বাশ রিদ্ধিমা। দুর্ভাগ্য এটাই, তোমাদের মতো ছোটরা ভয়ঙ্কর ভবিষ্যতের পদধ্বনি শুনতে পেলেও, আমরা বড়রা প্রাজ্ঞরা এখনো নানান দোলচালে দ্বিধান্বিত, বহুধা বিভক্ত।

হিমালয়ের বুকে বৃহৎ জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বনাম হিমালয়বাসীর স্বার্থ:

প্রথমেই স্পষ্ট করে নেওয়া যাক যে, কয়লা পুড়িয়ে তাপবিদ্যুৎ কারখানা থেকে নির্গত কালো বিষাক্ত গ্যাস ও কয়লার গুঁড়ো বায়ুদূষণ, জলের দূষণ বৃদ্ধির পাশাপাশি বাতাসে গ্রীনহাউজ গ্যাসের পরিমাণ বাড়িয়ে দিচ্ছে প্রভূত পরিমাণে এবং এর হাত ধরে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রাও বাড়ছে চড়চড় করে। খুব সঙ্গত কারণেই জীবাশ্ম জ্বালানির বিরুদ্ধে বিশ্ব জুড়ে পরিবেশবিদ, বিজ্ঞানী ও পরিবেশ মেরামতির দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রী ও কিশোর-যুবা বাহিনীর বিক্ষোভ প্রতিবাদ জোরদার হচ্ছে। বিশ্বজোড়া পরিবেশ আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ভারত সহ বেশ কিছু দেশ জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর ভরসা কমিয়ে নতুন করে কয়লা উত্তোলন বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বিগত আন্তর্জাতিক জলবায়ু সম্মেলনগুলিতে। এই লক্ষ্যে কিছু দেশ সদর্থক পরিকল্পনা নিলেও বিশ্বজুড়ে তা রূপায়িত করা এখনও বিশ বাঁও জলে।

বিকল্প শক্তির উৎস হিসেবে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প সেই অর্থে কোন আপাত দূষণ ঘটায় না। কিন্তু যেটা আমাদের বুঝতে ও আলোচনার বৃত্তে আনতে হবে সেটা হলো –কাদের স্বার্থে এবং কিসের বিনিময়ে হিমালয়ের কোলে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের এত ঘনঘটা। ভারতের একচেটিয়া পুঁজির মালিকরা চায় প্রাকৃতিক সম্পদ ও সস্তা শ্রম ব্যবহার করে সরকারের সক্রিয় সমর্থন ও সাহায্যে দেশের প্রয়োজনের অতিরিক্ত বিদ্যুৎ তৈরি করে প্রতিবেশী নেপাল, ভুটান ও বাংলাদেশে উচ্চ দামে বিক্রি করে পকেটে মুনাফার টাকা গুছিয়ে নিতে। তাই বিজ্ঞানী ও পরিবেশবিদদের সমস্ত হুঁশিয়ারি ও সতর্কবার্তা স্বত্বেও পাহাড় ফাটিয়ে, টানেল তৈরি করে এবং নদীর গতিপথ ঘুরিয়ে যেকোন স্থানে বড় বড় জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরির প্রকল্প চলছে মহা সমারোহে। ব্যাংক-পুঁজি ও রাষ্ট্রের সহযোগিতায় ফুলেফেঁপে ওঠা ফিকটিশাশ ক্যাপিটালকে বাস্তবের মাটিতে বিনিয়োগ করে রিয়েল করা ও মুনাফার হার বাড়িয়ে নেওয়ার অন্ধ তাগিদে স্বয়ং হিমালয়ের প্রকৃতি এবং হিমালয়বাসী সহ সমগ্র ভারতবাসীর জীবনে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসছে, সেই বিষয়ে রূপকারদের কোন হেলদোল নেই। অথচ হিমালয়ের স্থানীয় মানুষের যেটুকু বিদ্যুতের প্রয়োজন, তা তৈরি করা সম্ভব ছিল প্রকৃতির কোনো ক্ষতি না করেই পাহাড় থেকে নেমে আসা অজস্র ঝোরা বা জলপ্রপাতের নিচে ছোট ছোট টার্বাইন বসিয়ে জলবিদ্যুৎ তৈরি বা সৌর শক্তিকে ব্যবহার করার  মধ্য দিয়ে। পাহাড়ের ওপর বাতাসের গতিকে কাজে লাগিয়ে ছোট ছোট হাওয়া-কল বা উইন্ড মিল বসিয়েও এই চাহিদা মেটানো সম্ভব ছিল। এতে করে নৈসর্গিক হিমালয়ের ভারসাম্য বজায় থাকত, রক্ষা পেত তামাম জীববৈচিত্র্য, স্থানীয় মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাও সচল থাকত। অর্থাৎ, প্রাকৃতিক সম্পদ ও মানুষের শ্রমশক্তি কাজে লাগিয়ে মানুষের নূন্যতম প্রয়োজনের ভিত্তিতে শুধুমাত্র ব্যবহার মূল্য তৈরি করলে প্রকৃতির সংহার করতে হয় না। অথচ ব্যবহার মূল্য তৈরি না করে পুঁজির সঞ্চয়নের স্বার্থে বিনিময় মূল্যের (এক্সচেঞ্জ ভ্যালু) জন্য পন্য উৎপাদন করলে পুঁজির অন্ধগতি বজায় থাকে ঠিকই, কিন্তু এটা করতে গিয়ে প্রকৃতির লুণ্ঠন ও নিষ্পেষণ বাড়িয়েই চলতে হয়, যার হাত ধরে সাধারণ মানুষের জীবন জীবিকাও ব্যাহত হয় চক্রাবর্ত হারে। এবং এই প্রক্রিয়ায় প্রকৃতি বান্ধব উৎপাদনের পরিবর্তে পাহাড়ের সাথে সমতলের এবং গ্রাম থেকে শহরের মধ্যে বিপাকীয় ফাটলের (মেটাবলিক রিফ্ট) রেখা দীর্ঘতর হচ্ছে। কিন্তু এসব ভেবে পুঁজির মালিকদের কোনো লাভ নেই। প্রাণ-প্রকৃতি- পরিবেশ রক্ষার কথা কর্পোরেটরা আর কবে ভেবেছে? ওদের চায় নতুন নতুন বিনিয়োগ ও সেই অর্থ (money) সুদে-আসলে ফেরত নিয়ে আসা। তাতে করে প্রকৃতি-পরিবেশ-মানুষ গোল্লায় গেলেও ভ্রুক্ষেপ না থাকাটাই পুঁজির স্বাভাবিক নিয়ম। তাই ‘জনগণের স্বার্থে উন্নয়ন’ –সরকার ও কর্পোরেটের এই ধারাভাষ্যের পিছনে আসল রহস্যটা স্পষ্ট করে বুঝে নেওয়ার দরকার। এটাও আজ জলের মতো স্পষ্ট যে, একচেটিয়া পুঁজিপতিদের স্বার্থ দেখতে গিয়ে হিন্দু ধর্মের ব্যাপারীরা তাদের স্বপ্নের পীঠস্থান যোশীমঠকেও জলাঞ্জলি দিচ্ছে।

যোশীমঠ কীভাবে হিন্দু ধর্মের পীঠস্থান হয়ে উঠল:

এই বিষয়টিকে বুঝতে হলে আদি শঙ্করাচার্যের উত্থানকে বুঝতে হবে। ভারতীয় সমাজে বস্তুবাদী দর্শনের এক সুদীর্ঘ ঐতিহ্য ছিল, পরবর্তী ক্ষেত্রে যা বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের মধ্যে প্রসারিত হয়।  শাসকশ্রেণীর স্বার্থে ও অন্যান্য কারণে মৃতপ্রায় এই যুক্তিবাদের কবরে শেষ পেরেকটি পুঁতে   দিলেন শঙ্করাচার্য (৭৮৮-৮২০)। এহেন ধর্মীয় গুরুর নির্মোহ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে সমাজ- গবেষক আশীষ লাহিড়ী কী বলছেন তা সংক্ষেপে শুনে নেওয়া যাক –”শঙ্করাচার্যের মতে একমাত্র ব্রহ্মই সত্য। ব্রহ্ম নির্গুণ, অব্যক্ত। তাঁর কোনো উৎপত্তি নেই, তাঁর কোনো পরিবর্তনও নেই। সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন ওঠে: তাহলে চারপাশে যা কিছু ঘটছে, এত যে পরিবর্তন, এতকিছুর যে উৎপত্তি ও বিনাশ হচ্ছে, সেগুলি কি ব্রহ্ম থেকে আলাদা? শঙ্করাচার্যের উত্তর: একমাত্র ব্রহ্মই সত্য, সেই ব্রহ্মকে বিদ্যাবুদ্ধি দ্বারা বোঝার জো নেই, এমনকি জ্ঞানের দ্বারাও নয়। কেবল গুরুর দেখানো পথে সাধনা করতে করতে যদি কখনো সেই উপলব্ধি জাগে, তবেই হবে ব্রহ্মাস্বাদন। যতক্ষণ না সেটা হচ্ছে ততক্ষণ চারপাশের এই ঘটনা-পরম্পরাকে, এই পরিবর্তনমালাকে মায়ার খেলা বলে মানতে হবে। বাস্তবকে বোঝার চেষ্টা করার বদলে, বাস্তবকে অ-বাস্তব বলে প্রমাণ করার যুক্তি জোগালেন শঙ্কর। বিজ্ঞানের বিকাশের দিক থেকেই এটাই হয়ে দাঁড়ালো সর্বনাশা। ভারতীয় ব্রাহ্মণরা ক্রমাগত বাস্তবতার থেকে দূরে সরে গেলেন। সত্য কি, তা বোঝার জন্য, কিংবা তাকে যাচাই করার জন্য, বাস্তবের কাছে ফিরে যাওয়ার কোন প্রয়োজন তাঁরা বোধ করলেন না –কেননা বাস্তবতা তো আসলে নেই-ই। সেটাই তো শঙ্করের শিক্ষা” (অন্য কোন সাধনার ফল: পৃষ্ঠা -৯৩)। অর্থাৎ ব্রাহ্মণরা জ্ঞানচর্চার জগৎ থেকে বিযুক্ত হয়ে, অবাস্তব হিং-টিং-ছট মন্ত্র উচ্চারণের মধ্যেই আবদ্ধ হয়ে রইলেন। আর উল্টোদিকে শ্রমজীবী মানুষ, যারা প্রকৃতির উপর জ্ঞান প্রয়োগ করে জ্ঞানকে বিকশিত করে উৎপাদনের বিকাশ ঘটায়, তারাই বঞ্চিত রইল জ্ঞানের জগত থেকে। ফলে শংকরাচার্যের উত্থানের মধ্যে দিয়ে গড়ে ওঠা ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতি মানুষের মননে থাকা কার্য-কারণ সম্পর্ককে উপড়ে ফেলে দিল। বিশাল বিপুলা প্রকৃতিকে গভীরে জানা বোঝার ফলশ্রুতিতে প্রকৃতি-বান্ধব ভারতীয় সমাজে নিজেকেও আরো ভালোভাবে জানার প্রক্রিয়া চালু ছিল। প্রকৃতির সন্তান মানুষের চেতনায় ধরা পড়ছিল প্রকৃতির সৌন্দর্য, রূপ, রস, গন্ধ। মানুষের এই প্রাকৃতিক চেতনাকেই উল্টে দিল ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতি।

দক্ষিণ ভারতে যে ভক্তিবাদী আন্দোলনের উত্থান হয়েছিল যা তামিল ভক্তিবাদ নামে প্রচলিত, সেই ভক্তিবাদের বিরুদ্ধেই শিবের অবতার রূপে শঙ্করাচার্যের উত্থান। দক্ষিণ ভারতের ধনী সামন্ত প্রভুরা ছিলেন শিবের উপাসক, এঁরাই সাধারণ কৃষকদের কাছ থেকে প্রচুর খাজনা আদায় করতেন। শিব উপাসক সামন্ত প্রভুরা সাধারণ মানুষের স্বার্থের বিরোধী ছিলেন বলেই শিব উপাসনা ছেড়ে কৃষক সম্প্রদায় সহ সাধারণ মানুষ বিষ্ণু উপাসনার দিকে ঝুঁকলেন। বৈষ্ণব সম্প্রদায়গুলির বিরুদ্ধে শঙ্করাচার্যের তাত্ত্বিক সংগ্রাম চালানোর পেছনে কাজ করছিল এই শিব-উপাসক, ধনী জমিদারদের স্বার্থ। আর ঠিক এই কারণেই বৈষ্ণব ধর্মের সংস্কৃতির বিরুদ্ধে  ব্রাহ্মণ্যবাদের ধ্বজা ওড়াতে অষ্টম শতকের শুরুর দিকে সামন্ত শাসকরা শঙ্করাচার্যকে পাল্কিতে চাপিয়ে বর্ণাঢ্য মিছিল করে যোশীমঠে নিয়ে গিয়ে তাঁকে প্রতিষ্ঠিত করেন, গড়ে উঠে শঙ্করাচার্য মঠ, যা জ্যোতির্মঠ নামে পরিচিতি লাভ করে। অথচ হিন্দুদের অন্যতম এই পীঠস্থানও আজ পুঁজি ও লুটেরাদের করাল গ্রাসে ধূলিসাৎ হতে বসেছে। সনাতন হিন্দু ধর্মের সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত এই ধামটি তলিয়ে যাবে কিনা, সেই প্রশ্ন উঠে যাওয়ায় বিজেপি নেতৃত্ব প্রবল অস্বস্তিতে পড়েছেন। এই সংকট আরও বেড়ে গেছে জ্যোতির্মঠের বর্তমান শঙ্করাচার্য, প্রাক্তন মন্ত্রী উমা ভারতী এবং স্থানীয় মানুষ, পরিবেশবিদ সহ বিরোধী দল একযোগে কেন্দ্রীয় সরকারের দিকে আঙুল তোলায়। তাঁদের অভিযোগ –প্রধানমন্ত্রীর চারধাম জাতীয় সড়ক প্রকল্প, কেদারনাথ-বদ্রীনাথ রেল প্রকল্প (উল্লেখ্য, এই রেল প্রকল্পের প্রায় ৮৫ শতাংশ অংশই মাটির নিচে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে) এবং NTPC’ র তপোবন-বিষ্ণুগড় জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজে যথেচ্ছ বিস্ফোরণ ঘটানোর জন্যই পুরো শহরটাই তলিয়ে যেতে বসেছে। বর্তমান শঙ্করাচার্য নির্দিষ্টভাবে বলেছেন –”কেন্দ্র বা উত্তরাখণ্ড রাজ্যের সরকার জানেই না, কেন যোশীমঠের এই বিপর্যয় এবং কী করতে হবে তা-ও তাদের জনা নেই”। তাঁর মতে –”কোনো উন্নয়ন বা নির্মাণকার্যই প্রকৃতি ধ্বংস করে হতে পারে না, হলে তা যুদ্ধকালীন তৎপরতায় বন্ধ করা দরকার”। সুর চড়িয়ে উমা ভারতী বলেছেন –”বিকাশ ও বিনাশ হাত ধরাধরি করে চলতে পারে না। আসলে দিল্লিতে বসে যাঁরা নীতি বানায়, তারা একদিন ঠিক উত্তরাখণ্ড, গঙ্গা আর গোটা হিমালয়কেই গিলে খাবে”।

শুধু যোশীমঠ নয়, হিমালয়ে অবস্থিত চারধামসহ আরও অসংখ‍্য পীঠস্থান বিপন্ন এখনই। চওড়া রাস্তা আরও চওড়া করবে সেই বিপর্যয়কে, রেলপথে দ্রুত পৌঁছবে ধ্বংসের বার্তা। ‘যোশীমঠ ভাঙো, আর রামমন্দির গড়ো’ –স্বার্থান্বেষীর নোট ব্যাংক আর ভোট ব্যাংকের এই খেলা আজ দিনের আলোর মত স্পষ্ট। কর্পোরেটের স্বার্থকে নিরাপত্তা দাও, আর হিন্দুত্বকে চাগাড় দাও –এই ক্রসওয়ার্ড পাজেলে মানুষকে আটকে রাখার যে পরিকল্পনা ভোট সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে বছরের পর বছর চলছে তা বুঝতে পারছেন অনেকেই।  কিন্তু এ ব্যাপারে ভেবে দেখার জন্য আরও বেশি সময় নেওয়ার অর্থ সখাত সলিলে ডুবে মরা।  আমাদের সন্তানদের জন্য অভিভাবক হিসাবে এই কি আমাদের ভূমিকা?

হা ঈশ্বর! এই জগতের বিজ্ঞান, যুক্তি সবই তো মায়া, প্রপঞ্চ! পাহাড়ে ধস, বরফের গলন, মাটি বসে যাওয়া, যোশীমঠ সহ উত্তরাখণ্ডের বড় অংশ আগামীদিনে কালের গর্ভে তলিয়ে যাওয়া –সবই তো মায়ার খেলা, কুহেলিকা! সত্য শুধু ব্রহ্ম আর পুঁজির চলাচল। যা চলছে চলুক না! যোশীমঠকে বাঁচানোর চেষ্টা করে কী লাভ? সবই তো তাঁর ইচ্ছা! ব্রহ্ম যা করেন, তা নিশ্চয় সকলের মঙ্গলের জন্যই, ইহাই কেবল সত্য!

প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় হিমালয়ের গুরুত্ব:

জম্মু-কাশ্মীর থেকে লাদাখ, হিমাচল প্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, সিকিম ও অরুণাচল প্রদেশের একটা অংশ পর্যন্ত বিস্তৃত হিমালয় হাজার লক্ষ প্রাণ ও উদ্ভিদ প্রজাতি নিয়ে অফুরন্ত জীব-বৈচিত্র্য সমৃদ্ধ ভারতবর্ষের অন্যতম পর্বতশ্রেণী। অন্যদিকে এই হিমালয়ই আমাদের রক্ষা করে দানবীয় ঝড়-ঝঞ্জার হাত থেকে, জন্ম দেয় অসংখ্য নদীর। যার ফলে ভারত নদীমাতৃক দেশ। হিমালয় বয়ে নিয়ে আসে মৌসুমী বায়ু –দেশ হয়ে ওঠে সুজলা সুফলা। উত্তরে সুউচ্চ হিমালয় ও তিনদিকে সাগর বেষ্টিত ভারতবর্ষের প্রকৃতি ছিল ছয় ঋতুর এক সুন্দর সমাহার। অথচ দেশের পাহারাওয়ালা হিমালয় আজ বিপন্ন বহুজাতিক কোম্পানির পাহাড় প্রমাণ মুনাফা ও লোভের করাল গ্রাসে, আর নেতা-বাবু-ঠিকেদার ত্রিফলা বর্শার কোপে। প্রতিটি উন্নয়ন (!) পরিকল্পনা করা হয় কর্পোরেটের অঙ্গুলিহেলনে এই ত্রিফলা জোটের হাত ধরে। বিজ্ঞানী, হিমবাহ বিশারদ, পরিবেশবিদ, স্থানীয় মানুষের সহজাত বুদ্ধি, অভিজ্ঞতা সেখানে অপাংক্তেয়। এমনকি হিমালয়ের বিশেষ বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলোকে বুঝে নিয়ে প্রকৃতি পরিবেশের ক্ষতি না করে কতটা এবং কিভাবে নির্মাণকার্য করা সম্ভব সেই বিষয়ে কোন গবেষণা না করেই উত্তরাখণ্ডে ‘ট্যুরিজম অর্থনীতি’কে প্রধান গুরুত্ব দেওয়া হলো।

ভ্রমনার্থী বনাম ট্যুরিজম ইন্ডাস্ট্রি:

নৈসর্গিক হিমালয়ের সবুজে মোড়া সুউচ্চ পাহাড়রাজি, কুলকুল বেগে বয়ে যাওয়া খরস্রোতা নদী, জলপ্রপাতের নির্ঝর শব্দ, অসংখ্য প্রজাতির গাছপালা, পাখিদের কলতান, বন্যপ্রানের উঁকিঝুঁকি, নাম না জানা কত শত পাহাড়ি ফুল, নির্মল সুনীল আকাশ, সূর্যোদয়- সূর্যাস্তের মনোরম দৃশ্য অবলোকন ও উপলব্ধি করতে –প্রকৃতির টানে প্রকৃতি প্রেমিক একদল মানুষ নির্জন হিমালয়ের পথে প্রান্তরে পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়াতেন, মাসের পর মাস কাটিয়ে দিতেন দুর্গম প্রকৃতির কোলে। ঝর্নার বিশুদ্ধ জল এবং রাস্তার ধারে সরাইখানায় বা স্থানীয় গ্রামে যেটুকু যা পাওয়া যেত, তা দিয়েই আহার সারতেন। প্রয়োজন পড়ত না নামীদামী রেস্টুরেন্টে খাওয়া বা তারকা-খচিত হোটেলে রাত্রিবাসের। পাহাড়ের প্রতি এই প্রেম-আবেগ-ভালোলাগা-ভালোবাসা সব বদলে গেল অর্থনীতির কুটিল আবর্তে।  ভ্রমণ পিয়াসীর প্রাণের আরাম-শান্তি চাপা পড়ে গেল ট্যুরিজম ইন্ডাস্ট্রির মোহজালে। এখন ট্যুরিস্ট বাবু-বিবিদের সুগম্য পাহাড়ে চায় –ঝাঁ চকচকে মাখন-মসৃণ রাস্তা, উচ্চমানের হোটেল, ২৪ ঘণ্টা গরম জল, দেশী বিদেশী গরমাগরম খাবার, শপিং মল, মোবাইলের নেটওয়ার্ক, আরও কত কী! আর বিলাসী পর্যটক টানতে, সরকারি মদতে মুনাফা লুঠতে কর্পোরেট বাহিনী যত্রতত্র হোটেল, রিসর্টের ডালি সাজিয়ে বসল। এশিয়ার উচ্চতম ও দীর্ঘতম চারধাম প্রকল্পের চকচকে রাস্তায় পিলপিল করে উঠে আসতে লাগল ট্যুরিস্ট। উপলক্ষ হয়ে গেল ভ্রমণবিলাস। আর বিলাস থেকে ব্যসন। সখের ট্যুরিস্টদের আরামের জন্য বিস্ফোরণ ঘটিয়ে, ধস নামিয়ে, উত্তরাখণ্ডের আদিমতা ও নির্জনতাকে খন্ডবিখণ্ড করে তৈরি হয়ে গেল সব সবকিছু। নব্য ট্যুরিস্ট রুচির চাহিদা মেটাতে গভীর রাত পর্যন্ত জেগে থাকতে হয় যোশীমঠকে, চাই অপর্যাপ্ত বিদ্যুৎ। সুতরাং মাটির নিচে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে এগোতে থাকল জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। ট্যুরিজম ইন্ডাস্ট্রি গ্রাস করে নিল পাহাড়ের সব কিছু। যার হাত ধরে বিপর্যয় নেমে এল নৈসর্গিক হিমালয় ও স্থানীয় মানুষের জীবনে। সমগ্র বিপর্যয়ের এক খন্ডচিত্র মাত্র যোশীমঠ। তাই হিমালয়কে রক্ষা করতে হলে সমগ্র পাহাড়, জঙ্গল, নদীসহ হিমালয়ের ইকোলজিকে টিকিয়ে রাখতে হবে। মেনে চলতে হবে প্রকৃতির অমোঘ নিয়মকে –সব পথে, সব পথিকের অধিকার নেই। সড়ক-সুড়ঙ্গ-শহর – উন্নয়নের এই তিন করাত থেকে রেহাই দিতে হবে হিমালয়কে।

ভবিষ্যতে এই ধরণের বিপর্যয়ের সম্ভাবনা কতটা:

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আরও একটি বিষয়কে স্পষ্ট করতে হবে। উপগ্রহ চিত্রে দেখা গেছে– ২০১৩ ও ২০২১’ র হিমবাহ ধসের জেরে ঋষিগঙ্গা নদীর গতিপথে তৈরি হয়েছে বিপজ্জনক একটি হ্রদ। সেই হ্রদের দেওয়াল ভেঙে পাহাড়ি পথে ফের নেমে আসতে পারে বিশাল জলরাশি, নেমে আসবে হড়পা বান, আবারও বিপদগ্রস্ত হবেন হাজার হাজার মানুষ, বিধ্বস্ত হবে হিমালয়। এই ধরনের প্রাকৃতিক ঘটনাকে বলা হয় ‘গ্লেসিয়াল লেক আউটবার্স্ট’। আরও একটি ব্যাপার ঘটতে থাকে হিমালয়ীয় অঞ্চলে। বিশাল মাপের ভূমিধস (landslide) হলে সেই জায়গায় তৈরি হয় বিপজ্জনক হ্রদ। এই হ্রদগুলিতে নুড়ি পাথর, বালি কাদা, বরফ গলা জলের পরিমাণ বাড়তে থাকলে হ্রদের বাঁধ (মোরেন) ভেঙে পড়ে বিপুল জলরাশির হড়পা বান দেখা দিতে পারে যেকোন সময়। অন্যদিকে তীর্থযাত্রা, ট্যুরিজম ও তথাকথিত উন্নয়নের যাঁতাকলে ডিনামাইট চার্জ করে পাহাড় ফাটিয়ে রাস্তাঘাট, হোটেল-রিসর্ট তৈরি, উন্নয়নের অজুহাতে নানাবিধ নির্মাণকার্যের ফলে এইসব হ্রদগুলোর ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে ঘটতে পারে প্রাণঘাতী বিপর্যয়। চামোলি, যোশীমঠের মতো বিপর্যয় ঘটতেই থাকবে, যদি না হিমালয়কে রক্ষা করতে এক্ষুনি সঠিক বৈজ্ঞানিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। কোন্ ভয়ঙ্কর ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে চলেছি আমরা শুনুন আবহাওয়া বিজ্ঞানী সুজীব কর মহাশয়ের মুখ থেকে। দূরদর্শনের এক চ্যানেলে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করলেন স্পষ্টভাবে —”২০২১ সালে উত্তরাখণ্ডে গ্ল্যাসিয়ার বার্স্ট করার সময়ই বিজ্ঞানীরা স্পষ্ট করে জানান: গ্ল্যাসিয়ারগুলো অত্যন্ত দ্রুত গতিতে গলে যাচ্ছে, হিমালয়ের শিলাস্তর ধীরে ধীরে সংকুচিত হচ্ছে এবং এর ফলে শিলাস্তরের মধ্যে অদ্ভুত একটা টান তৈরি হয়, যার হাত ধরে এর স্থিতিস্থাপকতা নষ্ট হচ্ছে। আর যোশীমঠের নিচের দিকে কর্ণপ্রয়াগের শিলা তৈরি বেলে পাথর দিয়ে, যার ধারণক্ষমতা এমনিতেই কম। বর্তমানে যোশীমঠ অঞ্চলে মাটির তলা দিয়ে প্রচুর পরিমাণে জল প্রবাহিত হচ্ছে, নীচের দিকে মাটি সরে যাচ্ছে। ফলে উপরতলাকার মাটিও হুড়মুড় করে ধসে পড়বে এবং যোশীমঠ সহ পঞ্চপ্রয়াগের সব জনপদ, ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট নিয়ে মাটির তলায় তলিয়ে যাবে”। তিনি আরও জানান –”বয়সে নবীন ও ভঙ্গুর-প্রবন হিমালয় এখনও গড়ে ওঠার প্রক্রিয়ার। মানুষের অদূরদর্শিতার কারণে অপরিকল্পিত নির্মাণকাজের ঠেলায় হিমালয়ের প্রাকৃতিক ভারসাম্যই নষ্ট হওয়ার পথে। প্রকৃতি তার নিজস্ব নিয়মে তাকে রিকভার বা মেরামত করার চেষ্টা করলেও আমরা এর সাথে নিজেদের পরিবর্তিত করতে পারছি না”।

এই সুরে সুর মিলিয়ে আমরাও বলতে চাই –প্রকৃতির ছন্দকে বজায় রাখতে আমরা নিজেদের কাজের ধারায় প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনতে তো পারছিই না, বরং কতিপয় মানুষের লোভ লালসা ও আরও আরও মুনাফার অন্ধগতির কবলে পড়ে প্রকৃতির নিষ্পেষণ ও লুণ্ঠন ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। যার ফলে শুধু উত্তরাখণ্ডের বিস্তীর্ণ অঞ্চলই নয়, এর সাথে হিমাচল প্রদেশ, জম্মু-কাশ্মীর, উত্তরপ্রদেশের উত্তরভাগ সহ উত্তর-পূর্ব ভারতের এক বড় অংশ এবং সিকিম, দার্জিলিংয়ের বিস্তীর্ণ অঞ্চল সভ্যতার (!) সব চিহ্নকে সাথে নিয়ে অদূর ভবিষ্যতে বসে যাবে অতল গহ্বরে। হিমালয়ের বরফের চাদর সম্পূর্ণ গলে গিয়ে বঙ্গোপসাগর ও আরবসাগরের জলস্তর বাড়িয়ে দেবে কয়েক ফুট। আর এর ফলে সুন্দরবনসহ দুই ২৪ পরগনা, কলকাতা, মেদনীপুর ও হাওড়ার এক বিশাল অংশ সম্পূর্ণরূপে জলমগ্ন হবে। ঘরবাড়ি, জমিজমা হারিয়ে বানভাসি বা বাস্তুচ্যুত হবেন কয়েক লক্ষ মানুষ। সাম্প্রতিক কালে পাকিস্তানের ভয়াবহ বিপর্যয়ের কথাও আমাদের স্মরণে রাখতে হবে।

২০২২ এর আগস্টে প্রবল বৃষ্টি ও হিমবাহের অস্বাভাবিক হারে গলনের কারণে বিপর্যস্ত বিধ্বস্ত পাকিস্তানের এক বড় অংশ। জুন মাস থেকেই পাকিস্তান স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যার সম্মুখীন হয়েছে। ২২ কোটি জনসংখ্যার দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশটির প্রায় এক তৃতীয়াংশ মানুষ জলমগ্ন হয়ে পড়েছেন। বিধ্বংসী এ বন্যায় দশ লক্ষাধিক বাড়িঘর মাটিতে মিশে গেছে। তিন কোটি তিরিশ লক্ষ মানুষ বন্যাদুর্গত, হড়পা বানে ভেসে গেছে ২৪টিরও বেশি সেতু, জলের তোড়ে নিশ্চিহ্ন অন্তত ৫০টি হোটেল। রাষ্ট্রসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের মতে –পাকিস্তানের এই বন্যা জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে এখনই সঠিক পদক্ষেপ করার জন্য সারা বিশ্বের কাছে সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে বড় সতর্কবার্তা। জলবায়ু বিশেষজ্ঞদের মতে, বিশ্ব জুড়ে দূষণ এবং বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণে প্রতি বছরই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে তাপমাত্রা। আর তার জেরেই একের পর এক হিমবাহ গলে যাচ্ছে। হিমাচল প্রদেশের উত্তর দিকে অবস্থিত হিমালয়ের শিসপার হিমবাহ ভয়াবহ হারে গলে গিয়ে পাকিস্তানে বন্যা ডেকে এনেছে। গোটা বিশ্বজুড়েই ভয়াবহ তাপপ্রবাহ চলেছে গত বছর, তার কারণে হিমালয়ের একাধিক হিমবাহের সঙ্গে ইউরোপের আল্পসের বহু হিমবাহ গলে গিয়েছে। বাদ যায়নি উত্তর এবং দক্ষিণ মেরু। আগে যেমনটা মনে করা হয়েছিল তার থেকে অনেক বেশি দ্রুতগতিতে হিমালয়ের বরফের চাদর গলে যাচ্ছে বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণে। এর ফলে গোটা সিস্টেমটাই নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে, সেটা বায়ুমণ্ডল হোক বা জলচক্র, এমনকি সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র সব কিছুই প্রভাবিত হচ্ছে।

এই উদাহরন গুলোকে সামনে রেখেই প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় হিমালয়ের গুরুত্বকে বুঝতে হবে। হিমালয় এই হারে বিপর্যস্ত হলে শুধু যোশীমঠ কেন, সীমান্তের সব প্রাচীর ভেদ করে ভারতবর্ষের এক বড় অংশ সহ পাকিস্তান নেপাল ভুটান চীন তিব্বতের ব্যাপক অংশে ধস- ফাটল-হড়পাবান-প্রবল বন্যা, এসবই নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়াবে। কোন কোন অংশ আবার রুখা-শুখা মরুভূমিতে পরিণত হবে। আর তাই প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত না হয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোকে একযোগে হিমালয়ের প্রাকৃতিক পরিবেশকে টিকিয়ে রাখতে সঠিক বৈজ্ঞানিক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে অবিলম্বে।

উপসংহারের পরিবর্তে:

হিমালয়ের অন্য এক কোলে অরুণাচলপ্রদেশ এবং সিকিম ও আমাদের সাধের উত্তরবঙ্গে পরিবেশ ধ্বংস করে যেভাবে উন্নয়নের রথযাত্রা তুমুল বেগে ধাবমান তাতে আগামী দিনে এরকম ভয়াবহ বিপর্যয়ের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া গতি নেই। অন্যদিকে ভূউষ্ণায়ণ ও লাগামছাড়া দূষণের কারণে হিমবাহ এইভাবে অতি দ্রুতহারে  গলতে থাকলে আগামীদিনে নৈসর্গিক হিমালয় হয়ত আরবের মরুভূমিতে পরিণত হবে। যার প্রভাব শুধু ভারতবর্ষের ওপর পড়বে এমনটা নয়। তিব্বত-নেপাল-ভুটান-চীন-পাকিস্তান প্রতিটি দেশের নাগরিককে এর ফল ভোগ করতে হবে। তাই সীমান্তে যুদ্ধের রণসজ্জা অবিলম্বে বন্ধ করে হিমালয়কে মেরামত করে তার স্বাভাবিক ছন্দে ফিরিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে দক্ষিণ-এশিয়ার দেশগুলোকে। যুদ্ধ ব্যবসায়ীদের মুনাফার স্বার্থে মিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের যুদ্ধাস্ত্র কেনার টাকা মানবসভ্যতাকে টিকিয়ে রাখতে প্রকৃতি পরিবেশ মেরামতির কাজে লাগানো হোক। কর্পোরেট-সরকার-নেতা-বাবু-ঠিকাদারের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় নির্বিচারে পরিবেশ লুঠের যে খেলা চলছে তার বিরুদ্ধে প্রতিটি মানুষকে রুখে দাঁড়াতে হবে। পরিবেশ ভাবনা, পরিবেশ রক্ষার বিষয়টিকে দৈনন্দিন জীবন-যাপনের আঙিনায় নিয়ে আসতে হবে। পরিবেশ ধ্বংসের প্রকল্পগুলোকে গোড়াতেই রুখে দিতে হবে, এছাড়া টিকে থাকার ও ভবিষ্যত প্রজন্মকে টিকিয়ে রাখার অন্য কোনো পথ খোলা নেই। ছিন্নমস্তা উন্নয়নের উদ্ধত ফলাকে থামাতে না পারলে শেষের সেই দিনের জন্য প্রতীক্ষা করাটাই মানব প্রজাতির ভবিতব্য হয়ে দাঁড়াবে। আমাদের বুঝতে হবে যে, পৃথিবীটা শুধুমাত্র মানুষের একার নয়। নদী সাগর পাহাড় পর্বত অরণ্য পশু পাখি সহ তামাম জীববৈচিত্র্য এই পৃথিবীর বাসিন্দা। এইসব প্রাকৃতিক সম্পদ আছে বলেই তাদের ওপর নির্ভর করে আমাদের এই ধরাধামে টিকে থাকা। তাই হিমালয়ের উত্তুঙ্গে, নদীর কোলে, পাহাড়ের পাদদেশে, গভীর অরণ্যে –সর্বত্র মানুষের লম্বা হাত পড়লে বন্যপ্রাণ ও প্রকৃতি তো রুষ্ট হবেই। এর দায় আমাদেরই নিতে হবে।

সারা বিশ্বে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বিপর্যয় যেভাবে সমস্ত রেকর্ড ভেঙে চরম থেকে চরমতর আকার ধারণ করেছে, সেখান থেকে বাঁচতে ও পরবর্তী প্রজন্মকে বাঁচিয়ে রাখতে এখনই জোট বাঁধুন। জল বায়ু মাটির দূষণ সহ সামগ্রিক পরিবেশ দূষণ রুখতে আসুন পথে নামি এখনই। নাহলে আর ভাবার সুযোগটুকুও পাওয়া যাবে না। কারণ, মানব সভ্যতা এর মধ্যেই এক ‘অপরিবর্তনীয় জলবায়ু পরিবর্তন’ চক্রের মধ্যে পৌঁছে গেছে। মনে রাখতে হবে বুকভরা শুদ্ধ বাতাস, বিশুদ্ধ পানি, পাহাড় নদী সমুদ্র ও সবুজের অফুরন্ত নৈসর্গিক সৌন্দর্য নিয়ে বাসযোগ্য পৃথিবী রয়েছে একমাত্র একটাই। প্রকৃতি প্রেমিক সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো আমাদের বলিষ্ঠভাবে উচ্চারণ করতে হবে –”জীবনের সার্থকতা অর্থ উপার্জনে নয়, খ্যাতি প্রতিপত্তিতে নয়, লোকের মুখের সাধুবাদে নয়, ভোগে নয় –সে সার্থকতা শুধু আছে জীবনকে গভীর ভাবে উপলব্ধি করার ভেতরে, বিশ্বের রহস্যকে বুঝতে চেষ্টা করবার আনন্দের মধ্যে, শান্ত সন্ধ্যায় বসে এই অসীম সৌন্দর্য্যকে উপভোগ করায়”।

আরও পড়ুন – গাঙ্গেয় শুশুক – ভারতের নদীর অন্ধ প্রহরী