গরম পানীয় পান করার ক্ষেত্রে সময় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। উনুন থেকে নামানোর পরের অবস্থাটি জিহ্বা নিতে পারে না, আবার দীর্ঘ সময় ধৈর্য ধরলে তা বিস্বাদ হয়। প্রতিবাদের ক্ষেত্রেও সম্ভবত ধৈর্য কতক্ষণ ধরতে হবে তা জানা খুব জরুরি। নইলে বহমান সময় প্রাসঙ্গিকতা ধুয়ে নিয়ে চলে যায়। স্বর পরিবর্তন না করলে পারিপার্শ্বিক পৃথিবী ধৈর্যকে দুর্বলতা বলে বিশ্বাস করতে শুরু করে।
আমাদের ‘জলঙ্গী নদী সমাজ’ সংগঠনটি জলঙ্গী নদী নিয়ে কাজ করার সঙ্গেই প্রথম থেকে সমকালীন রাজনীতিতেও পরিবেশকে প্রাসঙ্গিক করতে চেষ্টা করে যাচ্ছে প্রায় তিন বছর। আমাদের কাজের এটাই মৌলিকতা। ভারত যেহেতু গণতান্ত্রিক দেশ এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক মত আমাদের দেশে রয়েছে, তাই বিভিন্ন রাজনৈতিক মঞ্চগুলিকে সরাসরি লিখে বা চিঠিপত্র দিয়ে পরিবেশ নিয়ে ভাবতে আমরা অনুরোধ করি। গড়ে ওঠার সময়ে কোন একটি নিশেষ রাজনৈতিক মত বর্জন করার নীতি থাকলেও, দেওয়াল-লিখন না পড়ার মতন কোন চিন্তার দাসত্বও জলঙ্গী নদী সমাজ করেনি। অসংখ্য সরকারি অফিস, চিঠিপত্র, ই-মেইল, সচেতনতা কর্মসূচি এবং নেতার কাছে দরবারের পর একদিন আমরা দেখলাম নদীর ভোটাধিকার না থাকাটাই সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। এরপর ইচ্ছা-অনিচ্ছা বাদ দিয়ে ভোটে অংশগ্রহণ না করা ছাড়া আর উপায় ছিল না। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমর্থক ও রাজনীতি সচেতন মানুষ যেহেতু আমাদের সদস্য, তাই প্রয়োজন পড়লেও আমরা ভোটে যাব না এমন কোন ছুঁৎমার্গও ছিলনা। বাধা পেলে বাঁক নিয়ে পুরোন নদীখাত ছেড়ে আসা নদীর সহজাত গতি, প্রকৃতি বা পরিবেশই সঠিক সময়ে সে নির্দেশ দেয়। হয়ত ছেড়ে আসা জলঙ্গীর অশ্বখুরাকৃতি হ্রদগুলিই আমাদের স্থবিরতা বর্জন করে স্বর বদলে নেওয়ার শিক্ষা দিয়েছিল।
আমাদের কারুর কোন পদ নেই, সকলেই শুধুমাত্র সদস্য। যে কোন মানুষ জলঙ্গীর শুভার্থী হলেই তিনি এর সদস্য হতে পারেন। যেহেতু সদস্যরা রাজনীতি সচেতন তাই আমরা ভোটে নিজেদের প্রার্থী দেব ভাবামাত্রই প্রার্থী দিতে পেরেছি এমন না। অনেকে মত দিলেন ভোটে না যেতে, যাঁদের মধ্যে শুরুর দিনের সদস্যরাও আছেন। তবে আমাদের মূলধন হল বিশ্বাস। সকলেই জানেন, যে যা করছে সে নদীর স্বার্থ রক্ষা করার তাগিদেই করছে। তাই বাধা দেওয়া বা রাগ করে চলে যাওয়ার মতন কিছুও করেন নি এবং সস্নেহে গোটা বিষয়টার ওপর অভিভাবকসুলভ নজর রাখছিলেন। ভোটের কার্যকলাপ মিটে যাওয়ার পর বেশ কিছুটা সময় পেরিয়ে আমরা আশা করি, কাজের ভুলত্রুটি বিশ্লেষণ করে গঠনমূলক আলোচনার একটি পরিসর তৈরি হবে।
সৃষ্টির পর জলঙ্গী যেমন ভাবেনি সে একদিন পণ্য হবে বা জলঙ্গী নদী সমাজও ভাবেনি তারা ভোট অবধি আসতে বাধ্য হবে, তেমনই জলঙ্গী নদী সমাজের ভোটপ্রার্থী তারক ঘোষও ভাবেন নি তিনি কোনদিন নদীয়ার ২৪ নং জেলা পরিষদের আসনে দাঁড়াবেন। তারকবাবু একজন পরিবেশ উদ্বাস্তু। তাঁর সঙ্গে আমাদের আলাপ হয় ‘নদীর পাঠশালা’ কর্মসূচীতে। পরিযায়ী শ্রমিক শব্দটির আশ্রয় নিলে বর্তমান সময়ের একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাওয়া যায়, পরিবেশ উদ্বাস্তুদের কথা। আসলে পরিযায়ী শ্রমিক যাঁদের বলা হয় তাঁরা সকলেই পরিবেশ উদ্বাস্তু। নদী নিয়ে কাজ শুরু করার মজা হল শুরুর পরেই নদীপাড়ের মানুষেরা নদীর কাজের সিলেবাসে এসেই যান। এই প্রসঙ্গে মনে করে নেওয়া যাক, নদীয়ার তিন সনাতন পেশা হল কৃষক, মৎস্যজীবি ও তন্তুশিল্পী। নদীতে জল কমলে এই তিন পেশায় যুক্ত মানুষজনকেই পেশান্তরে বাধ্য হতে হয়। পেশা বদলে মফস্বল, তারপর বড় শহর, তারপর ভিন রাজ্যে যেতে বাধ্য হন মজুরির জন্য এঁরা। নির্বাচনে প্রার্থী তথা নদীবন্ধু শ্রী তারক ঘোষকে আমরা চিনি ‘নদীর পাঠশালা’ -র ছাত্র হিসেবে। আগে নিজেদের সামান্য জমিতে চাষ করতেন। দু’ হাজার সালের পর নদীয়ায় আর বন্যা হয় নি, নদীতে জল কমছিল, জমি অনুর্বর হয়ে পড়ছিক, চাষের খরচ বাড়ছিল। একদিন তারকবাবু দেখলেন চাষের চেয়ে নির্মাণকর্মী হয়ে সহজে জীবিকা নির্বাহ করা সম্ভব হচ্ছে। জলঙ্গী নদী সমাজের নদীবন্ধুরা পঞ্চায়েত ভোটে এমন কোন পরিবেশ উদ্বাস্তুকেই খুঁজছিলেন। তারকবাবু রাজি হওয়ার পর নদীবন্ধুরা সরাসরি জেলা পরিষদে লড়েন। কারণ, এতে কোন একটি গ্রাম পঞ্চায়েতের চেয়ে বেশি মানুষের কাছে আমাদের আলোচনাগুলি নিয়ে যাওয়ার সুযোগ ছিল। অবশেষে ১৪ই জুন, ২০২৩ তারিখে তারকবাবু তাঁর কাগজপত্র ও নগদ ১০০০/- জমা দিয়ে পঞ্চায়েত ভোটে জেলা পরিষদের ২৪ নং আসনে জলঙ্গী নদী সমাজ সমর্থিত নির্দল প্রার্থী হন।
নির্বাচনের প্রথম শিক্ষা – পরিবেশের জন্য ভোটে প্রতীকি লড়াই বলে কিছু হয়না। নির্দলকে দেখলাম নির্বাচন কমিশন নিজের পছন্দের প্রতীকই শুধুমাত্র বাড়িয়ে দেয়। যার মধ্যে গাদাগাদা পরিবেশের স্বার্থবিরোধী প্রতীকও থাকে। জলঙ্গী নদী সমাজের নদীবন্ধুরা প্রতীক হিসেবে চেয়েছিলেন নদী বা নৌকা। বাস্তবে দেখা গেল ভোটে নির্দলদের জন্য ‘নদী’ প্রতীক নেই। নৌকা চিহ্ন আছে তবে তা পঞ্চায়েত নির্বাচনের জন্য। জেলা পরিষদ আসনের জন্য যে প্রতীকগুলি ছিল তা হল টেলিফোন, স্কুল, স্বাস্থ্য কেন্দ্র, পাখা, ক্রিকেট, দামামা, পিচ রাস্তা, বন্যপ্রাণী, বাগান, মোটর গাড়ি, বাস, পোস্টাল ভ্যান, লঞ্চ, ট্র্যাক্টর ও আরও দুটি চিহ্ন। অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্যি, সেই চিহ্নদুটি ছিল নদীর ওপর ব্রিজ এবং নদীর ওপর নির্মিত জলাধার বা ব্যারেজ। যার থেকে বোঝা যায় রাষ্ট্র দেশের উন্নতির পথটা কীভাবে সাজাচ্ছে। প্রতীকগুলি দেখে ও প্রাথমিক ধাক্কা সামলে ১৯শে জুন সদস্যরা নিজেদের মধ্যে ভোটাভুটির মাধ্যমে মাদল চিহ্ন বেছে নেন।
এই পর্যায় মিটে যাওয়ার পর দেখলাম আমাদের প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলগুলির অনেকেই তারকবাবুকে ‘অমুক পার্টির গোঁজ প্রার্থী’ বলে দাগিয়ে দিচ্ছেন। বস্তুত দুই-একটি দলই যেন দেশে আছে, বাকিরা সবাই গোঁজ প্রার্থী। বলা বাহুল্য, এই শব্দবন্ধের সঙ্গে আমাদের প্রথম থেকে শেষদিন অবধি লড়তে হয়েছে। কটু ভাষা বুকে সয়ে বেছ পরিধান/বিবিধের মাঝে গোঁজা-মিলই মহান – এমনটাই ছিল নির্বাচনের দ্বিতীয় শিক্ষা।
নির্বাচনের তৃতীয় শিক্ষা ছিল মনোনয়নপত্র ও মনোনয়ন পেশের পদ্ধতি। আমাদের কাজ ত্রুটিমুক্ত ছিল, কথাটি বিশেষ করে বললাম কারণ অনেক ক্ষেত্রেই এটি হয়না। অনেক পুরোন রাজনৈতিক দলের প্রার্থীদেরও নমিনেশন বাতিল হয়েছিল এবার। এসবের নিরিখে যে সদস্যরা এই কাজটি করেছিলেন ও তাঁদের সাধুবাদ প্রাপ্য। আমাদের সদস্যরা একেবারেই প্রশাসনের সুনজরে নেই। মাত্র কয়েকদিন আগেই সাংসদ কোটার টাকায় নদীর পাড়ে সৌন্দর্যায়নের জন্য একটি বিনোদন পার্ক আটকে দিয়েছিলাম আমরা অন্য এক মঞ্চের সহযোগিতায়। ভোটের কাজকর্মে নদীয়ার প্রশাসনিক ভবনে যেতেই কর্মচারীরা ভেবে বসেন, আমরা আবার সেই নিয়ে দরবার করতে এসেছি। সে কাজে যে আবার আসা হয়নি এবং নদীর জন্য ভোটে অংশগ্রহণ করতেই এবার শুধুমাত্র আসা হয়েছে এই জেনে তাঁরা সবিশেষ বিস্মিত হন।
প্রচারের জন্য আমরা প্রথমেই ঠিক করেছিলাম কিছু স্বকীয়তা অবলম্বন করব। যেমন – কিছুতেই প্লাস্টিকের ফ্লেক্স বা ব্যানার ব্যবহার করব না এবং মাইক্রোফোন ব্যবহারে সরকারি নিয়মাবলী মেনে চলব। আমরা প্রচারে প্রত্যেক দিন যেতে পারিনি কিন্তু যে কয়েকদিন গেছি, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রচার চলেছে মাইক্রোফোন ছাড়া ও সংলাপ নির্ভর। এবং ধোঁয়া বেরোয় এমন কোন যানবাহন ব্যবহার করব না। আমরা প্রতিদিন অক্ষরে অক্ষরে এগুলি পালনও করেছিলাম। এ বছর কঞ্চিতে লাগানো ছোট পতাকাগুলির দাম যেখানে এগারো টাকা সেখানে অবশ্য এর বেশি আমাদের সামর্থ্যও ছিল না। ভোটে অংশগ্রহণের পরেই চলে আসে বাজেটের কথা। আমরা প্রথমেই ঠিক করে রেখেছিলাম যেহেতু অর্থ সংগ্রহ করেই নির্বাচনের ব্যয় বহন করা হবে, তাই বিশ হাজার টাকার ওপর আমরা কিছুতেই খরচ উঠতে দেব না। এলাকায় যেহেতু ছিল শতাধিক গ্রাম, তাতে আমরা সীমাবদ্ধ থাকতে পারিনি। ইচ্ছে ছিল মানুষজনের কাছে পাঁচ বা দশটাকার কুপনেই পুরো খরচটা জোগাড় করব। আমাদের প্রত্যাশা অনুযাইয়ী সে পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করে উঠতে পারিনি। সব মিলে ছাব্বিশ হাজার টাকা খরচ পড়ে। তবে ভোটের প্রচার যে পরিবেশ-বান্ধবও হয় এটা নির্বাচনের শেষে, ইচ্ছে থাকলে যে উপায় হয়, আমরা নিজেরাই নিজেদের করে দেখালাম। বাজেট অনুযায়ী খরচে সংযত হতে না পেরেও অনেক কিছু শিখলাম, এ ছিল নির্বাচনের চতুর্থ শিক্ষা।
নির্বাচনে পঞ্চম শিক্ষা ও প্রাপ্তি ছিল পঞ্চায়েত নির্বাচন ২০২৩কে সামনে রেখে নিম্নলিখিত বিশ দফার নদী ইস্তেহার প্রস্তুত করা।
১) জলঙ্গী-চূর্ণি-অঞ্জনার বিস্তীর্ণ দখল হওয়া অংশ দখলমুক্ত করতে সেচ দপ্তরকে বাধ্য করা। বিপন্ন জলঙ্গীকে কেন্দ্র করে মন্দির, মসজিদ, ক্লাব, ধনীদের ব্যবসা ও জমি দখল বন্ধ করা।
২) নদী মাফিয়াদের দ্বারা নির্মিত নদীর ওপর আড়াআড়িভাবে বাঁশ ও চটজাল সম্বলিত কু-পরিকল্পিত ‘বাঁধাল’-এর অপসারণ (প্রসঙ্গত উল্লেখ্য শুধু জলঙ্গী নয়, নদীয়ার সব নদীই এর শিকার। এমন অসংখ্য বাঁধ নির্মাণ করে ও নদীর মাছ তুলে ফেলে নদী মাফিয়ারা। তারপর অভিশাপ নেমে আসে প্রান্তিক মৎস্যজীবিদের জীবনে)।
৩) বহু মাছ বিলুপ্তপ্রায় অথবা লুপ্ত। মীন দপ্তরের জরুরী কার্যক্রমের আওতায় সেগুলির সংরক্ষণের বিষয়টি আসুক। নতুবা জীবিকা চলে গিয়ে মৎস্যজীবিরা এরপর অনাহারকেই ভবিতব্য বলে মেনে নেবেন।
৪) ইতিপূর্বে জলঙ্গীকে জল দিত অঞ্জনা সহ অন্যান্য এমন নদী ও জলাশয়গুলিকে পুনরুজ্জীবিত করা।
৫) ‘নদী দখল হেল্পলাইন’ চালু করা। প্রয়োজনে সেচ ও ভূমি দপ্তরের যুগ্ম টাস্কফোর্স তৈরি করতে হবে। নদীর জন্য আরক্ষা(পুলিশ) বিভাগে ও প্রশাসনের একজন করে আধিকারিককেও চিহ্নিত করা যাঁরা অন্য কারুর সঙ্গে যোগাযোগ না করতে না বলে নিজেরাই অভিযোগের দ্রুত নিষ্পত্তি করবেন। এই সংক্রান্ত অভিযোগ সঠিক ব্যক্তির কাছে যাওয়ার আগেই দীর্ঘ সময় পেরিয়ে প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলে। এভাবে অঞ্জনা দখল হচ্ছে। বর্তমানে কোন আধিকারিক সদুত্তর দেন না। যথা – সেচ দপ্তর , মীন দপ্তর ও জেলাশাসকের অফিস। প্রতিটি নদী দখলকারীকে চিহ্নিত করা ও ওয়েবসাইটে সেই নামের তালিকা প্রকাশ করতে হবে।
৬) জলঙ্গী নদীকে প্রবাহমান রাখতে নদী দখল মুক্ত করতে গ্রামসভা গঠন ও নজরদারি।
৭) জলদূষণের অন্যতম বড় কারণ হয়ে উঠেছে – নদীতে প্রতিমা নিরঞ্জন, প্লাস্টিক দূষণ এবং আষাঢ়/শ্রাবণ মাসে আসা দূষিত-কালো জল। এই কালো জল যেখানে বয় জলঙ্গী দিয়ে ও নদীর মাছগুলি মরে ভেসে ওঠে। বন্ধ করতে জন্য সেচ দপ্তর ও প্রশাসন উভয়কেই যুগ্ম-পদক্ষেপ নিতে হবে।
৮) নদীতে নির্মিত সেতুগুলির জন্য যে পাথর-মাটি জমা করে নদীকে ছোট করা হয়েছে, তার অপসারণ। পরিবেশের যা ক্ষতি হয়েছে(EIA – Economoic impact assessment) তার আর্থিক মূল্য হিসেব করে সমান অর্থ নদীপাড়ের বাসিন্দাদের স্বাস্থ্য বা শিক্ষার মানোন্নয়নে বিনিয়োগ করা।
৯) রাজ্য নদী রক্ষা কমিশন গঠন।
১০) পরিবেশ উদ্বাস্তু, যাঁরা পেশান্তরে বাধ্য হয়েছেন ও যাঁদের “পরিযায়ী শ্রমিক” বলা হয়, তাঁদের সংখ্যা নির্ধারণ করা। এঁদের জীবন-জীবিকার জন্য নিখরচায় ন্যূনতম চিকিৎসা ও আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
১১) হাঁসাডাঙা বিল, গুড়গুড়ে খাল জাতীয় জলাশয়গুলির সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ।
১২) সমবায় সমিতিগুলির পুনর্গঠনের মাধ্যমে ও আর্থিক হাল ফেরানোর মাধ্যমে মীনজীবিদের ও কৃষকদের ঋণ পাওয়ার পথ সুগম করা।
১৩) নদীয়া পর্যটনের মানচিত্রে গুরুত্ব পাচ্ছে, পরিবেশ ও নদীর ক্ষতি না করে পরিবেশবান্ধব পর্যটন শিল্পকেই শুধু সহায়তা করা।
১৪) নদীয়ার বন-জঙ্গলগুলির রক্ষণাবেক্ষণ ও বৃক্ষরোপণ সংস্কৃতি গড়ে তোলা। লাগানো গাছগুলির যেন অকালে মারা না যায়।
১৫) এলাকায় পানীয় জলের সমস্যা দূরীকরণ। গ্রামেগঞ্জে অনেক বাড়িতেই কলের লাইন পৌঁছে গেছে, কিন্তু তাতে কোনদিন জল আসেনি।
১৬) প্লাস্টিকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ ও নদীগুলিতে প্লাস্টিক-থার্মোকল নিক্ষেপ বন্ধ করা। নদীর অববাহিকার সমস্ত বর্জ্যই নদীতে নিষ্কাশিত হয়। এগুলি বন্ধ করতে উদ্যোগ নেওয়া।
১৭) একশ’ দিনের কাজে নদীগুলি ও জলাভূমি সংস্কার এর কাজে যুক্ত করা।
১৮) বিস্তীর্ণ সময় নদী কচুরিপানায় ঢাকা থাকে। মিষ্টি জলে সবুজ উদ্ভিদের আধিক্য মাছেদের পক্ষে অস্বাস্থ্যকর। কচুরিপানা সংক্রান্ত আইন অনুযায়ী সরকারী কাজ চালু করা।
১৯) যাঁরা মাছ ধরেন তাঁরা যে চার ব্যবহার করেন তাতে নদীর জলে দূষণ হয় ও জল দুর্গন্ধময় হয়ে ওঠে। এগুলি বন্ধ করা।
২০) চটজাল, মশারির মাধ্যমে অবৈজ্ঞানিক মৎস্যচাষ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করা।
নির্বাচনে ষষ্ঠ শিক্ষা – জনসংযোগ। প্রচারে গিয়ে ভোটপ্রার্থী তারকবাবু প্রথমে প্রায় চুপই থাকতেন। ভদ্রলোক মুখর লাজুক, তাই পথে টোটোগাড়ির ছাদে বাজত আমাদের গান ও রেকর্ডেড বক্তব্য। হাটে-বাজারে-গ্রামে আমরা পরিবেশ বা নদী বিষয়ক একাধিক পথনাটিকাও পরিবেশনও চলতে থাকে। গান বা বক্তব্য চলতে চলতেই আমরা প্রথমে হ্যান্ডবিলগুলি সাধারণ মানুষের মধ্যে বিলি করে নিতাম। মানুষজন সেগুলি পড়া শুরু করার পর কোন সদস্য রেকর্ডেড বক্তব্য থামিয়ে, হাতে মাইক্রোফোন নিয়ে আমাদের কথাগুলি মাইকে বলতে শুরু করতেন। আমাদেরই কয়েকজন আবার ভোটপ্রার্থী তারকবাবুকে নিয়ে যতদূর সম্ভব প্রতিটি মানুষের কাছে যেতেন। তাঁর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতেন, নদী ইস্তেহারের বক্তব্যগুলি জানাতেন। একশ’ গ্রাম নিয়ে জ্ঞান আমাদের ছিল না, অনেকে সেই দুর্বলতা দেখতে পেয়ে আবার সস্নেহে ভুলত্রুটি ধরিয়েও দিয়েছেন।
ট্রেনের হকারদের কায়দায় মানুষের জমায়েত দেখলেই তাঁদের মনোযোগ আকর্ষণ করতাম। প্রথমে নদীর জন্য ভোটে প্রার্থী দিতে বাধ্য হয়েছি তা ব্যাখ্যা করতাম, তারপর তারকবাবুর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতাম। মতামত জানতে চাইতাম, এতে আলাপ দ্বিপাক্ষিক হত। একটা জিনিস না বললেই নয়, তা হল আমরা হাটে-বাজারে, ফেরিঘাটে, সব্জির আড়তে, সেলুনে, চাঁদসী চিকিৎসালয়ে, হোমিওপ্যাথি ডাক্তারের কাছে, মিষ্টির দোকানে ও অন্যান্য দোকানে যেখানেই যাই না কেন মানুষজন সাগ্রহে আমাদের কথাগুলি শুনছিলেন। বেশিরভাগ মানুষই বক্তব্যের সঙ্গে সহমত হচ্ছিলেন। এমনকি বিরোধী প্রার্থীর বাড়ি ভুল করে চলে যাওয়ার পর তাঁরাও। প্রথমে অবশ্য তাঁরা ‘রে-রে’ করে তেড়ে এসেছিলেন। সংলাপ যখন শেষ হল তখন আমরা উভয়পক্ষই ভোটের পর একসঙ্গে পরিবেশের কাজে অন্তত পরষ্পরকে সঙ্গ দেওয়ার অঙ্গীকার করেছি।
এসব আলাপ-আলোচনায় প্রথমদিকে তারকবাবু প্রায় দর্শকের ভূমিকায় থাকলেও দিন দুয়েক পর চিত্রটা বদলাল। ততদিনে অনেক সাংবাদিকও তারকবাবুর সঙ্গে কথা বলেছেন, যার মধ্যে প্রথম শ্রেণীর সংবাদ মাধ্যমগুলিও আছে। মানুষের সঙ্গে কথা বলার মজাটা পেতে শুরু করলেন ভদ্রলোক। ওঁর জীবন, অভিজ্ঞতা আর জলঙ্গী নদী ওঁকে দিয়ে একটা স্লোগান তৈরি করিয়ে নিয়েছে – নদী না বাঁচলে কোন গাছ বাঁচবে না, গাছ না বাঁচলে মানুষও বাঁচবে না।
নির্বাচনে সপ্তম শিক্ষা – ‘নদী পেল আটান্ন ভোট’। পরিবেশ বা নদীর গুরুত্ব একটু-আধটু বুঝতে শুরু করার পর থেকে আমাদের অগ্রজ পরিবেশকর্মীদের কাছে শেখা উন্নয়নের অন্য সংজ্ঞাটা বোঝানোর চেষ্টা করতাম। যাকে বর্তমান সময়ে অনুন্নয়ন বলেও কেউ কেউ ভাবতে পারেন। উন্নয়ন বলতে আমরা কিছু রাস্তা সারানো, রেললাইন পাতা, জলবিদ্যুৎ বা বাড়ি বানানোই শুধু যে বুঝি তা নয়। আমাদের কাছে উন্নয়নের সংজ্ঞা দীর্ঘকালীন সময়ে পৃথিবীর বড় ক্ষতি কমানোর জন্য বর্তমান সময়ে প্রাকৃতিক সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণ ও অনাড়ম্বর জীবনযাপনে নিজেদের অভ্যস্ত করা। আমাদের মনে হয় অনেকাংশেই প্রচলিত ‘উন্নয়ন’-এর পথে হাঁটলে এবং অতিরিক্ত বিলাসিতায় প্রাকৃতিক সম্পদের অপচয় তো হয়ই, দূষণও বাড়ে। বর্তমানে আমাদের রাজ্যের রাজনৈতিক আবহ যেমন, তাতে কোন কিছু ‘পাইয়ে দেওয়ার’ প্রতিশ্রুতি না দিয়েও আটান্নটি মানুষের ভোটও পাব এমন আমরা একেবারেই ভাবিনি। একশ’ গ্রামে আটান্নজন যে পরিবেশ বা নদীর কথা ভাবেন, এ বড় কম প্রাপ্তি নয়! এঁদের খুঁজে নিয়ে নিজেদের সঙ্গে জুড়ে নেওয়ার দায়িত্ব এবার আমাদেরই।
নির্বাচনের অষ্টম শিক্ষা ছিল – নিজেদের সাধারণ জ্ঞানলাভ। আমাদের জেলার সংকটগুলি ভাল করে জানা ছিল না, যার কিছু জানাও হল। আমরা এযাবৎ কাল অবধি নদী নিয়ে কাজ করতে করতে অন্য অনেক কিছুই জানতে পারিনি। জানতাম না জলঙ্গীর অনতিদূরে ভালুকা বিলের বর্তমান সমস্যা, জানতাম না অন্যান্য গ্রামের পুকুরগুলি কিভাবে রাজনৈতিক কায়েমী স্বার্থে ভরাট হচ্ছে, জানতাম না গ্রামের পরিবেশ শহরের মতনই বিপন্ন, জানতাম না নদীয়ায় সিলিকোসিস রোগীও আছে। এটা ঠিক যে, আমাদের সীমাবদ্ধতা মেনেই আমরা পাখির চোখ হিসেবে জলঙ্গীর সমস্যাই দেখি এবং পরিসর এর চেয়ে বড় করতেও চাই না। পাশে এটাও সত্যি যে আমাদের সমস্যার প্রতিবেশী সমস্যাগুলি সম্বন্ধে আমরা চোখ বন্ধ করেও থাকতে পারি না। আরও সময় নিয়ে নিজেদের জ্ঞান বাড়ালে বা নিরলস পরিশ্রম করে সমস্যাগুলি জুড়লে যে প্রশ্নগুলির সদুত্তর মিলবে না, এমনই বা বলি কি করে?
ভোট চাইতে বা প্রচারে যাওয়ার সময় অন্য সংগঠনগুলির সঙ্গে জোট না বাঁধলে কিছুই হত না। নবম শিক্ষা ছিল- ভাষাহারা বুকে স্বপ্নের বিদ্রোহ/ মেলাবেন, তিনি মেলাবেন। এগিয়ে এসেছিলেন বেশ কিছু সমমনা সাথী-বন্ধুরা। সৃষ্টির প্রথম লগ্ন থেকেই নানান কর্মসূচীতে আমরা প্রশ্নাতীতভাবে পাশে পেয়েছি আমরা ‘নদী বাঁচাও-জীবন বাঁচাও’, ‘কৃষ্ণনগর ঐকতান’, ‘দক্ষিণবঙ্গ মৎস্যজীবি ফোরাম’ এবং ‘কিশোর বাহিনী’কে। এ ছাড়াও কৃষ্ণনগর ‘এ পি ডি আর’, ‘প্রচেষ্টা’ এবং ‘আলিঙ্গন’ ইত্যাদি সংগঠনও নানান কাজকর্মে পাশে থেকেছে। দূর থেকে সঙ্গ দিয়েছে ‘গোবরডাঙা গবেষণা পরিষৎ’। এবার নতুনদের মধ্যে সদলবলে যোগ দিয়েছিল ‘ব্যারাকপুর পরিবেশ মঞ্চ’ ও ‘শান্তিপুর মরমি’-ও। সবাই মিলে স্লোগান লিখে, গ্রামীণ কবিয়াল ও পল্লীগায়ক যাদব শীলের লেখা গান জোগাড় করে এবং পরিবেশ সংরক্ষণের দাবিতে দুইটি পথনাটিকা নিয়ে প্রচারে নেমে পড়লাম। গানের কয়েকটি লাইন ছিল –
‘কত প্রাণী বাঁচে ওই জলে
কৃষক বাঁচে ফসলে
কোন দোষে জলঙ্গী মায়ের আজও এই বেহাল
জলঙ্গী তুই মরার পথে কে বাঁচাবে প্রাণ’
কয়েকটি স্লোগান ছিল – ‘মৎস্যজীবি বাঁধল জোট/নদীর জন্য চাইছি ভোট’, ‘দামামা ওই বাজে/ দিন বদলের পালা এবার ঝোড়ো যুগের মাঝে’। সে সময় আমরা হারজিতের কথা ভাবিনি। বরং ভেবেছিলাম, যে কথাগুলি আমরা সীমিত পরিসরে জনাকয়েক মানুষের সঙ্গে আলোচনা করি সেগুলি এবার আরও বৃহত্তর মঞ্চে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ এল। নদীর জন্য জনৈক পরিবেশ উদ্বাস্তু ভোট চাইছেন বলেই হোক বা সকলের সমবেত আর্তনাদে নদীর শ্রীহীন অবস্থা প্রকট হওয়ার কারণেই হোক, আমাদের প্রচার অনেক মানুষের নজর কাড়ে। প্রশংসা আসতে থাকে কাগজে ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায়। ভাল লাগতে শুরু করল যখন অন্য আরও কিছু রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরা তাঁদের প্রচারে ও ব্যানারে আনতে শুরু করলেন পরিবেশের কথা। শেষে আমাদের উদ্যোগে সাধারণ মানুষসহ বরিষ্ঠ পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্ত ও নব দত্তের আশীর্বাদও মিলেছিল। এতে জলঙ্গীতে এখনও জল বাড়েনি তা নির্মম সত্য, তবে প্রতিবাদের স্বর সবাই মিলে ‘তারা’য় (সাংগীতিকী অর্থে মস্তিষ্ক থেকে আনতে পেরেছি) তা বোঝা গেল। এতদিন উদারা(অর্থাৎ অনাহারের পর উদর থেকে বের করা মৎস্যজীবিদের প্রতিবাদ) ও মুদারায়(অর্থাৎ নদীর কথা মুখে বলে, চিঠি লিখে) হয়ত ছিল আমাদের স্বর। তারক ঘোষের আগেও ছিলেন পরিবেশকর্মী স্বদেশ মন্ডল, পরেও কেউ আসবেন।
বেশ কয়েকজন প্রার্থী ২০২৩ পঞ্চায়েত নির্বাচনে যখন পরিবেশের কথা বলছিলেন, তখনই অন্য কিছু খবরও পেতে শুরু করলাম। কথাগুলি শোনার পর সেগুলির সত্যাসত্য বিচার করার সুযোগ হয়নি। তবে শোনা গেল যাঁরা ভোটের ডিউটি এড়ানোর জন্য ভোটে দাঁড়িয়েছেন এবং অন্য জেলার কিছু নদী-দখলকারীও ভোটে দাঁড়িয়ে প্রচারে বলছেন যে তাঁরা পরিবেশ রক্ষার্থে ভোটে দাঁড়িয়েছেন। সম্ভবত অন্য কারণগুলির না বলে, ‘পরিবেশ রক্ষার্থে ভোটে দাঁড়িয়েছি’ এই বলে যদি কেউ ভোট চান তাহলে কিছু দীনতা ঢাকা পড়ে। যার ফলে পরিবেশ রক্ষার মঞ্চ বা কন্ঠস্বর, এবার দুর্বৃত্তায়নের মুখেও পড়তে পারে। জলঙ্গী নদী সমাজের সীমাবদ্ধতা আছে এবং এটি জলঙ্গী নদী ছাড়া আর কিছু নিয়েই কাজ করে না। তাই অন্য কোথাও যাতে এই মঞ্চটি বেহাত না হয়ে যায়, সেজন্য সব পরিবেশকর্মীকে নিজেদের এলাকায় সচেষ্ট হতে হবে। ভাবামাত্রই অগ্রজ পরিবেশকর্মীদের বিষয়টি নিয়ে অবগতও করা হয়েছে, তাঁরা দেশ জুড়ে মানুষকে জোড়ার কাজ করে চলেছেন এবং আশা করা যায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও নিচ্ছেন। নদীর প্রবাহের মতনই নদী আন্দোলনও সোজা পথে যায় না। নির্বাচনের দশম শিক্ষাটি ছিল – এক্ষেত্রে অন্তত ক্রিয়া যতক্ষণ স্থায়ী হয় প্রতিক্রিয়া তার পরেও চলে, এবং অনেক সময় পরমাণু বিকিরণের মতন ধারাবাহিক প্রতিক্রিয়ারও জন্ম দিতে পারে।
জলঙ্গী নদী সমাজের নেওয়া ছোট্ট পদক্ষেপ পরে ইতিহাসের ধারায় বিচ্ছিন্ন হবে না ভবিষ্যৎ পরিবেশ আন্দোলনের রূপরেখা নির্ধারণ করবে কিনা জানিনা। প্রশ্নাতীতভাবেই মানুষ খুব সুদূর ভবিষ্যত দেখতে পায়না এবং সে সীমাবদ্ধতা জেনেই কর্মপদ্ধতি স্থির করে, কিন্তু বসুন্ধরারও একটি স্বকীয় নিয়ম আছে। যা প্রথমে মানুষ অসম্ভব বা কল্পনাতীত বলে ভাবে তা কীভাবে যেন বসুন্ধরার সামান্য ইচ্ছায় অমোঘ হয়ে যায়। কবে যেন সে কল্পনাতীত পরিস্থিতি মানুষের বাঁচার পথই হয়ে যায়।