নাজিম দফাদার স্মরণে – উঠোনের গাছে ও নাটকে

বাঘারে নাটকে নাজিম
বাঘারে নাটকে নাজিম

২৫ বর্ষীয় যুবক নাজিম দফাদার মারা গেছে ১০ আগস্ট, ২০২৩ সকাল ৯টা ১৫ মিনিটে রাণাঘাট হাসপাতালে। ওর ডেঙ্গি ধরা পড়ে ৭ তারিখ। ৮ তারিখ দুপুরে অবস্থা খারাপ হলে ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এমার্জেন্সি টু আইসিইউ টু ভেন্টিলেশন। রাণাঘাটে ইতিমধ্যে ডেঙ্গি মহামারীর রূপ নিয়েছে। বিশেষ করে নাজিমদের মতো বস্তি-অংশগুলিতে। সেখানে সরকারি ব্যবস্থাপনা হিসেবে রাণাঘাট হাসপাতাল যথেষ্ট স্বস্তিজনক পরিষেবা দিতে চেষ্টা করে চলেছে। অন্তত নাজিমের চিকিৎসায় ডাক্তারদের তৎপরতা এবং পরিজনের সঙ্গে সহযোগিতার যে নজির স্থাপিত হল তা আশাব্যঞ্জক। কিন্তু থ্যালাসেমিক নাজিমের পক্ষে ডেঙ্গির সঙ্গে লড়াইটা অসম হয়ে পড়ল। ওর লিভার কাজ করা বন্ধ করে দিল দ্রুত। অ্যামোনিয়া ও পটাশিয়ামের মাত্রা বেড়ে গেল। ডাক্তাররা নানা চেষ্টা করেও কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট রুখতে পারলেন না।

কিন্তু এরকম কত নাজিমের মৃত্যু ঘটে যায় একোণে সেকোণে! লিখতে বসি না তো! খবরই পাই না। পেলেও একবার ভুরু কুঁচকে দুবার দাঁতে জিভে শব্দ করে ভুলে যাই। নাজিম দফাদারের হঠাৎ হারিয়ে যাওয়ার বিপরীতে তাকে স্মৃতিমুখর করে রাখার চেষ্টার করেছে ডিগ্রোথ পোর্টাল। আমার ব্যক্তিগত শ্রদ্ধা ও অভিনন্দন জানাই। এই ছোট্ট বয়সে মরে যেতে পারে, নাজিম জানত না তা না, কিন্তু মরোমরো বেঁচে থাকার মানুষ সে ছিল না। বেঁচে থাকার কাঙালপনা ওকে বাঁচিয়ে রাখার তাড়নায় ছুটিয়েছিল। নাহলে এত শীঘ্র কেন লিখে দেবে নাজিম তার মরণোত্তর চোখদুটি?  প্রতিবেদনে যত্নের সঙ্গে লেখা হয়েছে এ বিষয়ে। লেখা হয়েছে নেচার ফার্স্ট সংস্থার সঙ্গে ওর বৃক্ষরোপণকর্মী হিসাবে কাজের কথাও। তাই আমারও ইচ্ছে হল আরো কিছু লিখে ফেলতে, নাজিমকে নিয়ে।

প্রাণপ্রকৃতির প্রতি সংবেদনশীল যোদ্ধা হিসাবে নাজিম শুধু গাছই লাগায়নি, সে ছিল এই মূহুর্তে বাংলা নাটকের সেরা শিল্পীদের একজন। যে দলটির মধ্যে নাজিম বাস করত নাম তার চেনা আধুলি। রজত দাস (বাপি), গৌরি দাস (পুট) ছিল তার নিজের চেয়েও আপন, সব ভালবাসা মান অভিমান আনন্দ বেদনার আশ্রয়।

২০১১ সাল থেকে নাজিম চেনা আধুলির সঙ্গে যুক্ত হয়। দলের প্রথম নাটক বাদল সরকারের ভুল রাস্তায় কাঠুরিয়ার ভূমিকায় তার যাত্রা শুরু। ২০১৪ সালের ৩ রা আগস্ট থেকে বাংলার অঙ্গননাট্যজগতে নাজিম একটা নাম হয়ে ওঠে চেনা আধুলি প্রযোজিত ‘বাঘা রে’ নাটকের সুবাদে। সিরিয়ান ছোটগল্পকার জাকেরিয়া তামেরের গল্প অবলম্বনে তৈরি নাটকে দেখানো হয় সুপরিকল্পিত সুসংগঠিত হাড়হিম করা ক্ষমতার প্রয়োগ কীভাবে বন্দী করা জংলি বাঘকে শেষমেশ খড় খেতে বাধ্য করে। তারপর তাকে খাঁচা খুলে ছেড়ে দেয়। সে জনতায় মিশে যায়। ততক্ষণে সে বেভুল পথের পথিক, এলোমেলো অথর্ব চিন্তারহিত আর পাঁচটা নাগরিকের মতই। তার হিংস্রতার স্মৃতি নেই। স্বাধীনতার আকুতি নেই। প্রতিশোধের স্পৃহা নেই। দেখতে দেখতে মনে হয়, যে যেখানে খনি বাঁধসহ নিষ্কাশনবাদের বিরুদ্ধে দাঁতচেপে লড়ে যাচ্ছে এই বাঘ তাদেরই একজন। একে গরু বানিয়ে দিয়ে আরো বর্গমাইল প্রকৃতি গিলে ফেলল রাষ্ট্র। নাটকটা এবছরের জুন মাসের পঁচিশ তারিখ শেষ শো হয়েছে চাকদায়। প্রায় দশ বছরে দেড়শো শো হয়েছে বাংলার বিভিন্ন কোণে। নাটকে বাঘ ছাড়াও তিনজন ট্রেনার দেখা যায়। প্রথম ট্রেনারের ভূমিকায় অভিনয় করত নাজিম। মজার কথা হল, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ট্রেনারের চরিত্রাভিনেতা বারবার বদলে গেলেও বদলায়নি বাঘ (পুট) ও প্রথম ট্রেনার (নাজিম)।

পালাকুন্তলায় বাঁশিবাদক
পালাকুন্তলায় বাঁশিবাদক

পালাকুন্তলা (প্রথম অভিনয় ৩১ মার্চ, ২০১৯, নালিকুল) চেনা আধুলির আরেকটি মাইলস্টোন প্রযোজনা যে নাটকের প্রয়োজনে বাঁশি শেখে নাজিম। থ্যালাসেমিয়ার রোগী একটা রোগাপাতলা দুবলা ছেলের কতটা প্রাণশক্তি ছিল তার প্রমাণ ও নিজে। হতদরিদ্র বস্তিবাসী পরিবারে জন্মেও সারা জীবন সে জাপটে থেকেছে অঙ্গন নাট্য, যে নাটকের শেষে পাতন পাতা হয়, উপস্থিত দর্শকদের যার যা ইচ্ছে দেন। তা দিয়ে দলের খরচই ওঠে না। নাজিম নেচার ফার্স্টের আগে কাজ করত সোনার দোকানে, দীর্ঘদিন। সম্ভবত গড়িতের কাজ। সমস্ত লাঞ্ছনা সয়ে জীবনধারণের উপায়টিকে বজায় রেখেছিল যাতে তার বড় বড় চোখগুলি আকাশের দিকে খোলা থাকে, খোলা থাকে ধরিত্রীর দিকে।

পালাকুন্তলা একটি মেয়ের গল্প বলে যে প্রকৃতির সঙ্গে কথা কইতে পারে। তার ছোট্টবেলার বন্ধু বিশুর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় শিখদাঙ্গায়। বিশু রয়ে যায় সে দেশে তার বাপ-মায়ের সাথে। কুন্তলাকে নিয়ে বাংলায় ফিরে আসে তার বাপমা। আজীবন বিশুকে মনে রেখে সে কথা কয়ে চলে গাছের সাথে, পোকার সাথে, গরুছাগলকুকুরের সাথে, নদীর সাথে। কুন্তলা চেয়ে থাকে নদীর দিকে। নির্নিমেষ। বন্ধুরা জিগেশ করে তুই অমন নদীর দিকে চেয়ে আছিস কেন? কুন্তলা জবাব দেয় আমি না, নদীর দিকে চেয়ে থাকে মানুষ।

নদী আর মানুষের নাড়ীর যোগাযোগ বলতে বলতে কুন্তলা লুটিয়ে পড়ে দেখে মানুষ চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছে নদী থেকে, নদীর ঢেউয়ে শব্দ নেই, ছিপ ফেলে মাছ ধরে না ছেলের দল, চুম্বক বেঁধে তুলে আনে প্রণামীর পয়সা, জালে পলিথিন ওঠে। সোয়া একঘন্টার পালায় বিশুর চরিত্রে ঘুরে ফিরে অভিনয় করেন তিনজন। নাজিম তাদের একজন। এই নাটকও ছাপিয়ে গিয়েছে ৫০ এর বেশি অভিনয়।

দোবরু পান্না আরেকটি নাটক যেখানে রাষ্ট্রের পোঁয়ের ভূমিকায় অভিনয় করে নাজিম। একজন নিরপরাধ মানুষকে দীর্ঘদিন বিনা বিচারে আটক রাখার পর তার বিচার শুরু হয় এবং কোনো অপরাধই প্রমাণ হয় না। কিন্তু দেখা যায় তার ফেরার সব রাস্তাই বন্ধ। এই মানুষটিও অদ্ভুত৷ আইডিয়ালিস্ট। প্রকৃতিপথিক। কোনো অভিযোগ নেই কারুর প্রতি। তাই, যেহেতু মুক্তির পর তার ফেরৎ যাবার কোনো জায়গা নেই, বিচারের নামে এই সার্কাসে বিচারক রায় দেন, ইনি বেকসুর মুক্ত এবং দেশে তার থাকার জায়গা না থাকায় দেশ ছেড়ে যেতে হবে। কিন্তু তার দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলি যেহেতু দেশের সম্পত্তি তাই সেগুলো খুলে নেওয়া হবে। দুহাত বাঁধা এক কয়েদির শরীর থেকে বৃক্ক, যকৃৎ, হৃৎপিণ্ড খুলে নেওয়ার অভিনয়টি করত নাজিম। ও কতবড় মাপের অভিনেতা ছিল ওই একটি দৃশ্য তার প্রমাণ। একাধিকবার নাটকটি দেখার অভিজ্ঞতায় লক্ষ্য করেছি এই দৃশ্যে দর্শক নিজের শরীর থেকে অঙ্গ ছিঁড়ে নেবার তীব্র চকিত ব্যথা অনুভব করে।

চেনা আধুলির সঙ্গে নাজিমের শেষ কাজ অমল আব্রাসা। গত পঁচিশে বৈশাখ চাকদহ অবক্ষয় নামক একটি সংস্থার আয়োজনে প্রথম অভিনীত হয়। আমি সেই কাজ দেখিনি তাই বলতে পারব না।

নাজিম দফাদার

এছাড়াও ২০১৫ সালে নবারুণ ভট্টাচার্যের উপন্যাস অবলম্বনে রজত দাস রচিত খেলনানগর নাটকে বামনের চরিত্রে চোখ টেনে নেয় নাজিম। এই নাটক ও বামন চরিত্রটি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার ইচ্ছে থাকল।

চেনা আধুলি ছাড়া দৃশ্যান্তর কলকাতা, রাণাঘাট সৃজক, চাকদহ অবক্ষয় ইত্যাদি দলে নাটক করেছে নাজি। সর্বত্র প্রশংসিত হয়েছে। হুগলির নালিকুলে পালাপাব্বন আসরের অন্যতম উদ্যোক্তা হিসেবে কচিকাঁচাদের ‘হইচই’ দলকে সাথে নিয়ে ২০২২ সালে নাজিম আর চেনা আধুলির আরেক অভিনেতা শমীক মিলে বানিয়েছিল অনবদ্য একটা নাটক— মোরগের ডাক। যেখানে দেখতে পাই, একজন ট্রাফিক পুলিশ অফিসার জানজটে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে এবং গ্রামের বাড়িতে অবসাদ কাটাতে যায়। সেখানে ভোর বেলায় এক মোরগ ডাকে। অফিসারের ঘুম ভেঙে যায়। রোজই এই অবস্থা। একদিন অফিসার মোরগের নামে কেস করে। অফিসার জেতা মানে মোরগের মৃত্যুদণ্ড। কারণ না ডেকে তো মোরগ বাঁচে না। এমতাবস্থায় খবর কাগজে সোস্যাল মিডিয়ায় হইচই ওঠে৷ মোরগের পক্ষে মিছিল বের হয়। জনমতের চাপে আদালত মোরগকে ডাকার অধিকার দেয় ও অভিযোগকারী অফিসারকে নিরবিচ্ছিন্ন ঘুমের জন্য অন্যত্র জায়গা খুঁজে নিতে বলে। নাজিমের মধ্যে চিরজাগরুক শিশুটিকে খুঁজে পাই এখানে।

মোরগের ডাক নাটকের কুশীলবদের সঙ্গে নাজিম ও শমীক
মোরগের ডাক নাটকের কুশীলবদের সঙ্গে নাজিম ও শমীক

আর একটা কথা, যেকটি দলে বা উদ্যোগে নাজিম নাটকের কাজে বেঁচে আছে সবকটি উঠোনে নাটক করে, নাটক করে দর্শকের সমতলে, দর্শকের সঙ্গে দূরত্ব কমিয়ে এনে, অন্তত তিনদিক দর্শকবেষ্টিত হয়ে। এত বড় মাপের অভিনেতা হয়েও প্রসেনিয়ামে জনপ্রিয় হওয়ার মোহ ওকে ছুঁতে পারেনি। এটা একটা স্পষ্ট অবস্থান। ক্ষমতার চোখে চোখ রাখা জেদ।

লিখেছেন – ইমন