আজকে (অর্থাৎ, ১১ই আগস্ট, ২০২৩), সকালে কিছু শোক বার্তা দেখলাম নদী বাঁচাও জীবন বাঁচাও আন্দোলনের সমাজমাধ্যমে (whatsapp groupএ)। তার কয়েকটি এখানে হুবহু তুলে দিলাম:
“নেচার ফার্স্টের সক্রিয় কর্মী নাজিম দফাদার 10/8/2023 সকালে ডেঙ্গুতে ভুগে মাত্র 25 বছর বয়সে প্রয়াত হলেন। নাজিম আমাদেরও বন্ধু সাথী ছিল। হাঁসি মুখ নিয়ে কর্মসূচিতে পৌঁছে যেতো নাজিম। ওর এই অকাল প্রয়াণে আমরা গভীর শোকাহত । শোকসন্তপ্ত পরিবারের ও সাথী-বন্ধুদের প্রতি সমবেদনা জানাই। নাজিমের ইচ্ছা অনুসারে তাঁর চোখ দুটি দান করা হয়েছে। নাজিম বেঁচে থাকবে আমাদের মনে।”
লিখেছেন নদী বাঁচাও জীবন বাঁচাও আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক, তাপস দাস
“নাজিম হাসুলিতে ৪ঠা জুন ২০২৩ গাছ লাগাতে গেছিলেন। সেই গাছগুলোর মধ্যেই উনি বেঁচে থাকবেন।”
লিখেছেন নদী বাঁচাও জীবন বাঁচাও আন্দোলন ও সরকারি কর্মচারী আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক, অনিরুদ্ধ ভট্টাচার্য
“নাজিমের আত্মার শান্তি কামনা করি”
লিখেছেন চূর্ণী মাথাভাঙ্গা নদী বাঁচাও আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক, স্বপন ভৌমিক
“অতীব দুঃখদায়ক এই খবরের মধ্যে একটাই আশার আলো যে সে তার চক্ষুদুটি দান করে গেছেন এবং তার পরিবার এটা সম্পন্ন করতে দিয়েছে। প্রাপক সেই চোখ দিয়ে নতুন পৃথিবী দেখবে এই আশা রাখি।”
লিখেছেন নদী বাঁচাও জীবন বাঁচাও আন্দোলনের সাথে যুক্ত আর একজন নাম না জানা পরিবেশ কর্মী।
এই বার্তাসমূহের মাধ্যমে আমার সাথে নাজিম দফাদারের আলাপ হলো। সাথে ছবিও ছিল। তাই গোটা মানুষটাকে কল্পনা করে নিতে বিশেষ অসুবিধা হলোনা।
৪ঠা জুন আমি হাসুলিতে যায়নি। ৫ই জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস ছিল। সেই উপলক্ষে বৃক্ষরোপন উৎসব। প্রকৃতি পাঠশালা, নেচার ফার্স্ট, বিজ্ঞান বার্তা, কুশকর্ণী নদী সমাজ, এরকম কয়েকটি সংগঠন এই উৎসবের সাথে যুক্ত। আমি এরকম আচার অনুষ্ঠানের বিরোধী। বিশেষত যেসব আচার অনুষ্ঠান এমন কোন সন্দর্ভের অংশ যার সাথে আমার বিরোধ আছে। সেই বিরোধিতার মধ্যে এখানে ঢুকছি না, কিন্তু তাই যায়নি। অর্থাৎ, আমন্ত্রণ থাকা সত্তেও যায়নি। গেলে নিশ্চই আরো আগে পরিচয় হত নাজিমের সাথে।
হ্যাঁ অনিরুদ্ধ ভট্টাচার্য ঠিকই বলেছেন। তবে ওই গাছগুলোর মধ্যে না হলেও গাছেদের মধ্যেই বেঁচে থাকবে নাজিম, কারণ সে মিশে যাবে এই পৃথিবীর মাটিতে। সেই মাটিতে একদিন গাছ হবে। সেই সব গাছেদের শেকড় বেয়ে পৃথিবীর রৌদ্র, জল, বায়ুর সাথে মিলিত হবে নাজিম। মিলিত হবে এই পৃথিবীর পশুপাখি, কীটপতঙ্গের সাথে। মিলিত হবে এই পৃথিবীর নামনাজানা বহু বহু নরনারীর সাথে।
আর হাঁ, সেই নাম না জানা পরিবেশ কর্মী যেমন বললেন, তাদের মধ্যে কেউ হয়তো নাজিমের দেওয়া চোখ দিয়েই দেখবে এই পৃথিবীর সেসব গাছেদের। তার সাথে দেখবে সেইসব পশুপাখি, কীটপতঙ্গ, রৌদ্র, জল, ছায়া।
কিন্তু এই দেখাই কি সব?
সেই চোখ কি এটা দেখবে না যে পরিবেশ কর্মী নাজিম, শেষপর্যন্ত পরিবেশ বিপর্যয়েরই শিকার হলেন।
নাজিমের মেডিকেল সার্টিফিকেট বলছে যে সে ডেঙ্গুজ্বরে মাড়া গাছে। সে কথা সত্য, তবু শেষ সত্য নয়। ডেঙ্গু একটি মশা বাহিত রোগ। আর বিশ্বউষ্ণায়নের কারণে মশার বংশবৃদ্ধির হার উর্ধমুখী। আর সেই কারণেই আমাদের মত গ্রীষ্মপ্রধান ক্রান্তীয় দেশে ডেঙ্গু, চিকেনগুনিয়া, ম্যালেরিয়ার এই বাড়বাড়ন্ত। আর তাতেই প্রতিদিন মাড়া পড়ছে বহু বহু মানুষ। তারা সবাই পরিবেশ বিপর্যয়ের বলি।
আর এখানেই প্রতিষ্ঠান ও পুঁজির রাজনীতি। তারা মেডিকেল সার্টিফিকেটে কোনো অবস্থাতেই এই মৃত্যুর কারণ হিসেবে বিশ্বউষ্ণায়নকে চিহ্নিত করবে না। বরং এই সংকটকে তারা একটি সুযোগ হিসেবেই দেখবে। মানুষের অ’সুখ’কে ঘিরে এতবড় একটা ব্যবসা। ওষুধের ব্যবসা, হাসপাতালের ব্যবসা, মশা তাড়ানোর বহু ধরনের সরঞ্জামের ব্যবসা। তাতে ব্যাংকের এত টাকার কারবার। এত মানুষের কর্মসংস্থান। ডাক্তার, নার্স, আয়া, অসুধ কারখানার শ্রমিক থেকে ওষুধের দোকানের কর্মচারী। তাই ওরা বিশ্বউষ্ণায়নের সমাধান এহেন প্রসাধনী স্তরেই সীমাবদ্ধ রাখতে চাইবে, যা কোনোভাবেই বুনিয়াদি নয়। যা নিছক ব্যবসায়িক সমাধান।
নাজিমের মৃত্যুতে আমার আকুতি একটাই। ওর চোখ দুটো যে পাবে সে যেন এসব দেখতে পায়। অর্থাৎ, সে জানি এসব প্রসাধনী সমাধানের উর্ধে উঠে, পরিবেশ সংকটের বুনিয়াদি জায়গাটিকে অনুধাবন করতে পারে। অর্থাৎ, সে জানি প্রকৃত অর্থেই দেখতে পায়। না হলে হয়তো নাজিমের পরিবেশপ্রেমী “আত্মা” শান্তি পাবেনা।
ভালো থেকো নাজিম।
আরও পড়ুন – সমর বাগচী স্মরণে – জীবন ও পৃথিবীকে ভালবাসতে শিখিয়েছিলেন সমর দা