সমর বাগচী স্মরণে – সামাজিক আন্দোলনের এক অন্যতম নক্ষত্র   

লিখছেন কল্যাণ সেনগুপ্ত

সমর বাগচী ছিলেন আমার মত আরও অনেক তাঁর স্নেহাস্পদদের কাছে পরম আত্মীয়ের চেয়েও অনেক বেশি কিছু। তাঁর বিয়োগ ব্যাথার সম্পূর্ন নিরাময় হতে কিছু সময় জরুরি। কারণ সময়ের সাথে সাথে দুনিয়াও চলবে তার নিয়ম মেনেই। বিশাল এই দুনিয়ায় হয়তো অনেকেরই এই বিদায়ে বিশেষ কিছু যায় আসে না, কিন্তু আমাদের মতো বেশ কিছু মানুষের, যারা তাঁর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য লাভ করেছি, তাদের অনেকেই বিষণ্ণতা বোধের এক গভীর অনুভূতিতে আচ্ছন্ন হয়ে থাকবেন বেশ কিছুদিন। বিশাল এক বটচ্ছায়ায় বাসে অভ্যস্ত মানুষেরা হটাৎ যদি দেখেন সেই বটগাছটি আর নেই, তখন তাদের অসহায়তা সহজেই অনুমেয়।

সমর দা নেতা ছিলেন না, ছিলেন এক সহৃদয়  অগ্রজ সহকর্মী। কিন্তু তাঁর নেতৃত্বেই বিড়লা মিউজিয়াম পৌঁছেছিল খ্যতির শীর্ষে। তিনি আজীবন আগামী প্রজন্ম বিশেষত শিশুদের মধ্যে বিজ্ঞান শিক্ষার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টিতে ছিলেন একাই প্রায় এক ব্রিগেড। অসংখ্য কর্মশালার মাধ্যমে তিনি এই অভিযান চালিয়েছেন বাংলার প্রায় প্রতিটি প্রান্তে এমনকি বহির্বাংলাতেও। সমাজের প্রতি তাঁর এই দায়বদ্ধতার কোন তুলনা হয়না। অন্তত এই একটি ক্ষেত্রে তিনি অনেকের থেকেই কয়েক যোজন এগিয়ে।

সমর দার সুনামের সঙ্গে বহুদিন আগে থেকেই পরিচিত হলেও সম্মুখ পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা ঘটে সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময়কাল থেকেই। ক্রমশ তা আরও গভীর হয় এন এ পি এম -এর আন্দোলনে যুক্ত হয়ে। তারপর নানা ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে সংগঠনকে এগিয়ে নিয়ে যাবার প্রশ্নে প্রথমাবধি আমার ও সমর দার মতামত ছিল সম্পূর্ন অভিন্ন। বরাবর বহুবিষয়েই পারস্পরিক আলোচনার মধ্য দিয়ে সহমতের ভিত্তিতে তথা সমর দার সমর্থনে সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সমর দার মতো একজন ফাদার ফিগারের অনুপস্থিতিতে আমিও যেন আজ তাই উৎসাহহীন।

সমর দা ঘনিষ্ট সবার সাথে মিশতেন অকপট আন্তরিকতার সাথে। কোন প্রকার অনাবশ্যক গাম্ভীর্য ছিল না এত বড় মাপের মানুষ হয়েও। তাঁর নিবিড় সান্নিধ্য আমাদের ধন্য ও গর্বিত করেছে। তাঁর চিন্তা ও চেতনায় ছিল সমাজের প্রতি ঋণ শোধের এক সীমাহীন ঝোঁক বা ক্ষুধা। কারণ, প্রখ্যাত চিন্তাবিদ অম্লান দত্তের মতোই তিনিও ভাবতেন, সমাজের থেকে আমরা নিয়েছি অনেক এবং তা ফিরিয়ে দেবার দায়ও আমাদেরই নিতে হবে। সমাজ, বিশেষত আগামী প্রজন্মের জন্য তাঁর ব্যাকুলতা ছিল অনুকরণীয়। সমাজ ও সংস্কৃতি জগতের প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাঁর আগ্রহ ছিল অপরিসীম। তাঁর ঘনিষ্ট প্রায় প্রত্যেকেই তাঁর মুখ থেকে অরুণ মিত্রের কবিতা শুনেছেন। গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথ ছিল তাঁর উদ্দীপক মননশীলতার আশ্রয়স্থল। আর মার্কসীয় সাম্যের ভাবনার প্রতি ছিল গভীর অনুরাগ। তবে কালের ঘাত প্রতিঘাতে সেই বিশ্বাস বা ভাবনায় হয়তোবা চির খেলেও, সে বিষয়ে কাউকে বুঝতে দিতে চাইতেন না।

 শেষ কয়েকটা বছর আমি ও অভিষেক(রায়) প্রায়শই যেতাম সমর দার বাড়ি এবং সেখানে জমে উঠতো আমাদের আলোচনা বা আড্ডা নানা সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়ে। রাজনৈতিক বিষয়ের মধ্যে মোদীর শাসন মুক্তির সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা ছিল অন্যতম মুখ্য বিষয়। এই আড্ডার আকর্ষণ ছিল অমোঘ। সমর দা নিজে বলতেন কম শুনতেন বেশি। ব্যক্তিরূপে সজ্জনতার প্রায় সর্বোচ্চ স্তরে  ছিল সমর দার অবস্থান। গান্ধীজির সঙ্গে তুলনার ধৃষ্টতা না দেখালেও তিনিও হয়তোবা বলতে পারতেন যে, আমার কাজই আমার বাণী।

সমর দার জীবনাসানে সমাজ, সামাজিক আন্দোলন ও আমাদের মত তাঁর ঘনিষ্ঠ অনুরাগীদের ক্ষতি অপূরণীয়। তবু কালের নিয়মে সবই ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে যায়। তাঁর স্মৃতিও ক্রমশ  ফিকে হয়ে যাবে সবার মনে, তবে সমর দার জন্য সেই সময়কাল হয়তো অনেকটাই বেশি লাগবে, তাঁর সদা হাস্যময় মুখচ্ছবিটা মনের মণিকোঠায় অমলিন থাকবে বহুদিন।

আরও পড়ুন – সমর বাগচী স্মরণে – জীবন ও পৃথিবীকে ভালবাসতে শিখিয়েছিলেন সমর দা