সমর বাগচী স্মরণে – জীবন ও পৃথিবীকে ভালবাসতে শিখিয়েছিলেন সমর দা

লিখছেন অভিষেক রায়

সমর সমর বাগচী স্মরণে লিখতে গিয়ে আবেগ তাড়িত হয়ে পড়াটা আমার কাছে খুব স্বাভাবিক। বিগত কয়েক বছর তাঁর খুব নিকট সান্নিধ্য লাভের এক পরম সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। টেলিফোনের ওপারে সমর দা যেন ২৪ ঘণ্টাই উপস্থিত থাকতেন। শুধু নম্বরে একটা রিং করলেই হল। সেটা এ বছরের মে মাস থেকে হঠাৎ যেন স্তব্ধ হয়ে গেল। ওই সময়েই তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী হলেন। সমর দাকে যারা জানেন, চেনেন তারা জানেন এই স্তব্ধতা ও শূন্যতা কতটা দুঃসহ। আমরা যারা আশীর দশকে বড় হয়েছি, তারা সমর বাগচী নামটির সাথে পরিচিত দূরদর্শনে বিজ্ঞান বিষয়ক অনুষ্ঠান ‘কোয়েস্ট’ এর জন্যে। কিন্তু আমার সাথে তাঁর যোগাযোগ হয়েছিল কয়েক বছর আগে এবং প্রথম আলাপ থেকেই এক প্রগাঢ় আত্মিক সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিল।

সমর দা’র পরিচয় তাই আমার কাছে একটু একমাত্র বিজ্ঞান প্রচারকের নয়। আমি এই কয়েক বছরে এক পরিপূর্ন ব্যক্তিত্বের সাথে পরিচিত হয়েছিলাম। যাঁর দিন শুরু হত ভোর চারটেতে। বাড়িতে থাকলে দুপুরের আহারের পরে কিছুক্ষণের বিশ্রাম ছাড়া, বাকীটা সময় নিজেকে ব্যস্ত রাখতেন বিভিন্ন কাজে। তাঁর সাথে নিয়মিত দেখা করতে আসতেন বিবিধ জগতের সব মানুষ। যারা শুধুই বিজ্ঞান নিয়ে চর্চা করেন, তারা নিজেদের জগতে ডুবে থাকেন,  তাঁরা গুরুত্ব সহকারে অন্য অনেক কিছুতে মনোনিবেশ করেন না। সমর দা যুক্ত ছিলেন এক বহুমুখী জগতের সাথে এবং তাঁর কাছে প্রত্যেকটা জগৎ ছিল গুরুত্বপূর্ন। বিজ্ঞানকে দেশের ছাত্র ছাত্রীদের কাছে সহজতর করার সাথে সাথে তিনি মানবাধিকার এবং পরিবেশ রক্ষার দিকটির প্রতিও ছিলেন সমান ভাবে সচেতন। বিজ্ঞান, পরিবেশ রক্ষা এবং মানবাধিকার তাঁর কাছে ছিল এক সূত্রে বাঁধা এবং নিরলস ভাবে এই তিনটেকে এক সাথে মিলিয়ে গেছেন।

 বিড়লা সায়েন্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল মিউজিয়ামের অধিকর্তা ছিলেন তিনি দীর্ঘকাল। নিজের হাতে গড়েছিলেন মিউজিয়ামটি। Encyclopedia Britannica তে ভারতের বা সম্ভবত এশিয়ার ওই একটিই বিজ্ঞান মিউজিয়াম তালিকাভুক্ত হয়েছে। এই প্রসঙ্গে একটি কথা বলি। তিনি যখন অধিকর্তা, সেই সময় তাঁর নির্দেশ ছিল, তাঁর সাথে যারা দেখা করতে আসবে, তাদের জন্যে নির্দিষ্ট করা ঘরে সবাইকে বসতে দিতে হবে। সে আমলা থেকে প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষ যাদের গায়ের জামা, কাপড় হয়ত মলিন এবং পা ধুলায় আবৃত তাদের ও।

বিজ্ঞান বিষয়ক বিভিন্ন ফোরামের তিনি যেমন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন, তেমনি মেধা পাটকর প্রতিষ্ঠিত National Alliance for People’s Movement বা NAPM এর ও প্রাণপুরুষ। আবার মৈত্রেয়ী দেবী প্রতিষ্ঠিত ‘খেলাঘর’ র তিনি চেয়ারপারসন। একদম আদি পর্ব থেকে যুক্ত ছিলেন ওই প্রতিষ্ঠানের সাথে। আমায় গল্প করেছিলেন, মৈত্রেয়ী দেবীকে নিয়ে তিনি গাড়ি ড্রাইভ করে মধ্যমগ্রামের কাছে বাদুতে জমি খুঁজতে গিয়েছিলেন।

আমি যখন তাঁর সান্নিধ্যে আসি, তখন তিনি প্রবীণ, শরীর সব সময় যুতসই ছিল না। কিন্তু নিরলস ছিলেন নিজের কাজে। তাঁর কর্মশক্তি যে কোনো যুবাকে লজ্জা দেবে। ভোর চারটেতে শুরু হত তাঁর দিন। সারাদিন বিভিন্ন মানুষকে ইমেল করছেন। আপডেট নিচ্ছেন বিজ্ঞানী, সমাজকর্মী, রাজনৈতিক কর্মী, পরিবেশবিদ, ইতিহাসবিদ, সাংবাদিক এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রের মানুষদের কাজের।

 কোনো বিজ্ঞান ওয়ার্কশপে যাওয়ার বিষয়ে তাঁর মধ্যে দেখতাম যেমন উদ্দীপনা, আগ্রহ, তেমনি NAPM বা খেলাঘর বিষয়ে মিটিংয়ের এজেন্ডা ঠিক করা, মিটিংয়ের আয়োজন, মেধা পাটকর এলে তাকে বিমানবন্দর থেকে আনতে যাওয়া, তাঁর থাকার ব্যবস্থা, সবকিছুর ব্যবস্থাপনা করতেন সমর দা। এই সেদিন ও ছুটে ছুটে যেতেন ‘খেলাঘর’ এ। গত বছর এপ্রিলেই পেস মেকার বসলো তাঁর। তখনও স্টিচ কাটা হয়নি। খেলাঘরের বসন্ত উৎসবে শুধু যোগ দিলেনই নয়, প্রায় সারাদিন পুরো অনুষ্ঠানে রইলেন।  

তার সাথে চলত তাঁর সাহিত্য, ইতিহাস, পরিবেশ, সমাজ, রাজনীতি, দর্শন বিষয়ে তাঁর নিরন্তর জ্ঞানান্বেষণ। সমর দা কিছু পড়লে আমায় সাথে সাথে জানাতেন। আমি কিছু পড়লে সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে। এমনিই একটি মানসিক সংযোগ ছিল তাঁর সাথে। এই কয়েক বছরে উনি জীবন এবং  পৃথিবীকে ভালবাসতে শিখিয়েছিলেন। আর ভালবাসার, চর্চা করার সব বিষয়গুলোর প্রতি এক দায়বদ্ধতা তৈরি করিয়েছিলেন কারণ ওই বিষয় গুলো নিয়েই আমাদের জীবন ও পৃথিবী। তাঁর জন্যেই আলাপ হয়েছে ব্যতিক্রমী কাজ করা কিছু মানুষের সাথে। কেউ হয়ত কয়েক লক্ষ বৃক্ষরোপণ করেছেন, কেউ নদী ও বন সংরক্ষণ বিষয়ে গবেষণা ও আন্দোলন করে চলেছেন, কেউ হিমালয়ের গহনে একা সেখানকার বন্য জন্তু জানোয়ারদের সাথে থাকেন, কেউ প্রত্যন্ত এলাকায় চালাচ্ছেন স্কুল, কেউ সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়ে চলেছেন সারাজীবন। 

কত মানুষকেই তিনি এভাবে প্রভাবিত করেছেন, তাদের পরিচিত করেছেন নূতন বিষয়ের ওপর। তবে সমর দা মানেই কিন্তু সব সময় সিরিয়াস বিষয়ের চর্চা নয়। আমুদে ও রসিক  মানুষ ছিলেন। তাই স্মৃতিতে রয়েছে মজার ঘটনাও। একদিকে তাঁর গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ ও মার্ক্স বিষয়ে অন্বেষণ। অন্যদিকে সাহিত্য, সঙ্গীত, নাটক, ভ্রমণ, খাদ্য, চলচ্চিত্র, বিশ্বের ঘটমান বর্তমানের কত বিষয়ে নিরন্তর আগ্রহ। প্রকৃত অর্থেই এক সংবেদনশীল বহুমুখী মানুষ। এবং সবকিছুর উপরে মানুষকে জানার, বোঝার। এবং এ বিষয়ে তাঁর মধ্যে কাজ করত এক শিশুর সারল্য। বাঙালির যে আড্ডা সংস্কৃতি হারিয়ে গেছে। সমর দা, যেন ছিলেন, সেই উৎকৃষ্ট আড্ডা সংস্কৃতির একজন ধারক। তাঁর বাড়িতে নিয়মিত হত আড্ডা, নানান বিষয়ে। সকলের মতামত মন দিয়ে শুনতেন। আর মানুষে মানুষে সংযোগ করাতে তাঁর জুড়ি ছিল না। কত মানুষের সাথে আলাপ করিয়ে দিতেন।

 তাই আজ বারবার মনে পড়ছে তার সাথে বসে তৈরি করেছি পলিটিক্যাল পিটিশন। সে ছিল হপ্তা খানেকের পরিশ্রম। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তাঁর বাড়িতে বসে করতে হত কাজ। এ ব্যাপারে কত মানুষের সাথে কথা বলতে হয়েছে তাঁকে কিন্তু এতটুকু ক্লান্তি দেখিনি। তার সাথে গিয়েছি পুরুলিয়ায় সায়েন্স ওয়ার্কশপে, মিউজিক্যাল কনসার্টে, চিত্র প্রদর্শনীতে, শহরের এখানে ওখানে। কয়েকমাস আগেই বেশ হইহই করে এলেন আমাদের গ্রামের বাড়ি চম্পাহাটীতে। খুব নিয়মিত যেতাম বলে, দেখেছি সমর দা’র সাথে আলোচনার বিষয়ের পরিমাপ ছিল বিশাল। ওর বসার ঘরের দেওয়ালে রয়েছে কিছু ইউরোপীয় পেন্টিং । সঙ্গে সঙ্গে সে বিষয়ে আলোচনা। কোভিডের সময় অবাক হয়ে দেখতাম, প্রায় প্রতিদিন নানান ওয়েবিনরে বলতেন। 

সমর দা’কে কখনো ‘না’ বলতে শুনিনি। ক্লান্তিহীন ভাবে তিনি সবার সব দাবী, আবদার সামলে চলতেন। নিজের থেকে তুলে নিতেন দায়িত্ব।  ‘একুশ শতাব্দী’ নামে একটি পত্রিকার সাথে আমি যুক্ত। সমর দা’কে বললাম, ‘আমাদের পত্রিকার জন্যে একটি লেখা লিখে দিন’। সমর দা, লিখে দিলেন ‘প্রকৃতির বিপর্যয় ও মুক্তির উপায়’ নামে একটি মূল্যবান প্রবন্ধ। প্রায় সাড়ে আট হাজার শব্দের এই প্রবন্ধটি হয়ে আছে আমাদের পত্রিকার একটি সম্পদ। এই কয়েকদিন আগেও কয়েকজনের  কাছে শুনলাম, তিনি আমাদের পত্রিকায় তাঁর লেখাটি তাদের দেখিয়ে বলেছিলেন ‘ এই দেখো, আমার একটি লেখা বেরিয়েছে।।‘

সমর দা’র মধ্যে এক ব্যতিক্রমী ঔজ্জ্বল্য এবং তারুণ্য ছিল। তিনি জীবনকে প্রাণ ঢেলে ভালবাসতেন। তাই হয়ত তার মধ্যে কখনো মৃত্যু চেতনা দেখিনি। গত এক বছর বেশ কয়েকবার অসুস্থ হয়েছিলেন। ভুগেছিলেন কিন্তু কখনো একবারের জন্যেও মৃত্যুর প্রসঙ্গ তোলেননি। এমনকি মে মাস থেকে যখন তিনি শয্যাশায়ী তখন ও নয়। একবার পুরুলিয়ায় তাঁর শরীর বিষয়ে কথা উঠতে বলে উঠেছিলেন ‘দেখো, I have over lived. So, no regrets’।

আমি চেয়েছিলাম সমর দা, শতবর্ষ থাকুন আমাদের সাথে। তাঁর উপস্থিতি ছিল সদা আনন্দময়। তিনি যে ভালবাসা আমায় উজাড় করে দিয়েছিলেন, তা আমার কাছে হয়ে থাকবে পাথেয়।

আরও পড়ুন – মহারাজ স্মরণে বার্তা- ফয়সাল আহমেদ][