দুই পৃথিবী

চারিদিকে যা অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে, মণিপুরের মেয়ে রাজধানীর জন্তর-মন্তরে দাঁড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলছে যে এই ইতিহাস বহির্ভূত অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে, বলছে আমরা ভারতীয় এই প্রমাণ আমাদের দেশেই বার বার দিতে হবে কেন? অত্যাচার বন্ধ করতে প্রাণে বাঁচতে প্রয়োজনে আমরা অস্ত্র তুলে নেব তখন আমাদের দায়ী করবেন না। মুক ও বধির সরকার নির্বিচারে বন বনাঞ্চল পাহাড় খনিজ ও প্রকৃতি ধ্বংসের পরোয়ানা জারি করে দিল।

এরই মাঝে নদী বাঁচানোর লড়াইয়ে সামিল আমরা বলার সাথে লিখতে বসেছি যে তার নাম ” দুই পৃথিবী “

আশ্চর্যজনকভাবে মুক্ত (বাজার) অর্থনীতির যুগ এদেশে, বিশ্বের এই বৃহত্তম গণতন্ত্রে খুব সফলভাবে এক বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগ্রামের পরিসর তৈরি করেছে যা এ দেশের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়।

সৃষ্টি করেছে এক উচ্চবিত্ত এবং উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণির যারা (অন্তত মননে) বাস করেন অনেক উচ্চতায়, হয়তো বা ঐ আকাশে, হয়তো বা স্ট্রাটোস্ফিয়ার এরও ওপরে। যেখানে তারা বাকি বিশ্বের অনুরূপ উচ্চ শ্রেণীর সাথে নিজেদের অবস্থানকে উপলব্ধি করে আত্মতৃপ্তি লাভ করে থাকেন। সে এক অবাক পৃথিবী। সেখানে অর্থ এবং ক্রয় ক্ষমতাই একমাত্র মাপকাঠি। সে সাম্রাজ্যে তারা, এই  ‘সব পাওয়া ‘ বিশ্ব নাগরিকগন, বাকি পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এক নিশ্ছিদ্র বেষ্টনীতে অবস্থান করাকে সাফল্য মনে করেন। সে জগতে তাদের জন্য আছে সিনেমা, টেলিভিশন সহ নানান বিনোদন সামগ্রী। আছে তাদের জন্য সংবাদমাধ্যম, পরিবহন, শপিং মল ও বুদ্ধিজীবীগণ, যারা বিভিন্ন চা চক্রে ব্যস্ত থাকেন উন্নয়নের পরিভাষা বোঝাতে। যদি তাদের প্রকৃতি ধংসের কথা, নদীর গুরুত্বের কথা বলা হয়, উত্তরে এক অবজ্ঞা ভরা নির্বাক দৃষ্টি পাওয়া যায়। যদি বনভূমি ও তার আদিবাসীদের অধিকারের কথা বলা হয়, বলা হয় প্রাকৃতিক সম্পদ লুট ও প্রকৃতির মাঝে বসবাসকারী আদি ভারত নাগরিকদের অন্যায় উচ্ছেদের কথা, উত্তর মেলে, ” তাহলে আপনি কি উন্নয়ন চান না? ওটা উন্নয়নের Co- lateral damage”। যদি বলা হয় আকাশ ছোঁয়া দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও মানুষের অনাহারে মৃত্যুর কথা, মৃদু আঁচে উত্তর মেলে “প্রাইস ইনডেক্সের ওঠা নামা তো বাজার অর্থনীতির নিয়ম। “

আকাশ নাগরিকদের তবু বিরাম নেই আরও চাওয়ায়। এতো পাওয়ার মাঝেও তাদের আছে এক বিশেষ সমস্যা। যে সমস্যা প্রতিটি সাম্রাজ্যের বৈশিষ্ট্য। চাই তাদের রাজত্ব, রাজস্ব,  সম্পদ সৃষ্টির উৎস এবং কৃতদাস।  হাস্যস্করভাবে এই আকাশবাসী গন তাদের রাজত্ব খুঁজে পান তাদেরই ছেড়ে যাওয়া পুরনো পৃথিবীতে।

দেখেন উড়িষ্যার আদিবাসীরা বক্সাইট পাহাড়ের উপর বসে আছে। তারা বসে আছে ঝাড়খন্ড ও ছত্রিশগড়ের খনি সমৃদ্ধ অঞ্চলের উপর। তারা উপর থেকে দেখেন, সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামের প্রধান উর্বর জমির উপর মুসলিম ও দলিতেরা বসে আছে। যে জমি তাদের  ‘কেমিক্যাল হাব ‘ হওয়ার উপযুক্ত। তারা দেখেন মধ্যপ্রদেশের বনাঞ্চলে তাদের অধিকারের হীরে অযথা পড়ে আছে। এভাবে একে একে তাদের নজর পড়ে ভারতবর্ষের অত্যন্ত প্রাকৃতিক সমৃদ্ধ ও প্রাচুর্যপূর্ণ উপত্যকা গুলির ওপর। অসাধারণ সব নদীগুলি দেখে মনে করেন, এগুলিকে প্রয়োজন তাদের জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য। এই আকাশ নাগরিকেরা নদীকে দেখেন শুধুমাত্র জল ও বালি এবং জলপথ হিসাবে । বনাঞ্চলের সাথে তাদের পরিচয় কেবল বৃক্ষের কাঠের মাধ্যমে। এমনই ভাবে তারা মনে করেন, মাটির উপর ও নিচের সকল সম্পদে শুধু তাদেরই অধিকার এবং এটাই যে উন্নয়নের একমাত্র পথ, সেই মত প্রতিষ্ঠা করাই আধুনিক শিক্ষা। তারা আক্রোশের সাথে প্রশ্ন করেন যে তাদের বক্সাইট, কয়লা, খনিজ, পেট্রোল, হিরে, পাহাড়, উপত্যকা’ ও নদীর উপর এ অনাহুতরা কি করছে? এসবে তো কেবল তাদের অধিকার। ওরা কারা?  জেনে নেওয়া যাক তাদের আসল পরিচয়। তারা কোন দেশের, কোন পৃথিবীর মানুষ? এদেশের তো নয় নিশ্চয়! আর ” বাবু যতবলে পারিষদ দলে বলে তার শতগুণ ” প্রচার মাধ্যমগুলো বুদ্ধিজীবীদের সমন্বয়ে যোগ্য সঙ্গত দেয়।

 কিন্তু আমরা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি যদি পাল্টাই, যদি একটু অন্যভাবে ভাবি এবং ভারতবর্ষের মানচিত্রের দিকে নিঃস্বার্থ ভাবে তাকাই, তাহলে দেখবো যে প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ অঞ্চলগুলির ওপর দেশের আদিবাসী অর্থাৎ আসল ভারতবাসী বলা হয় বা একসময় বলা হতো যাদের, যুগ যুগ ধরে তারা শুধু বসবাস করে আসছে না, প্রকৃতির মাঝে প্রকৃতির সাথে থেকে তাকে রক্ষা করে আসছে। যদি দেশের শুধু কয়লা এবং খনিজ সম্পদের অর্থনৈতিক মূল্যায়ন করা হয় তাহলে সেটা হবে কমপক্ষে পাঁচ হাজার লক্ষ কোটি টাকা এবং প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম দেশ ভারতবর্ষের সকল প্রাকৃতিক সম্পদের যদি আর্থিক মূল্যায়ন করা হয় তাহলে সেটা দাঁড়াবে পঞ্চাশ হাজার লক্ষ কোটি টাকা। বলা হয় বা কোন এক সময় বলা হতো যে, যাদের জমির নিচে সম্পদ, সেই সম্পদে অধিকার তাদের। তাহলে এটাই কি ঠিক নয় যে যাদের আমরা গরীব ও প্রান্তিক বলি তারাই আসলে সম্পদশালী?

কিন্তু না, এ সম্পদে কেবল রাষ্ট্রের অধিকার। এই সম্পদ যথাযথ ব্যবহৃত না হয়ে অযথা পরে আছে। বিশ্বায়ন ও আধুনিক উন্নয়নের যুগে এ সম্পদকে দীর্ঘদিন ধরে যথাযথ ব্যবহার না করে ফেলে রেখে যে অন্যায় উন্নয়নের প্রতি করা হয়েছে স্বাধীনতার পর থেকে, তা শোধরানোর সময় এসেছে। অর্থনীতি ভুল পথে চলেছে এতদিন। দেশকে সম্পূর্ণভাবে উম্মুক্ত বা বলা চলে উলংগ করে বাজারে নিলাম করা হয়নি।

আধুনিক বিশ্বায়নের অর্থই হলো বাজারে নিজের দেশের সকল শিক্ষা, শিল্প, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, প্রকৃতি, সকল  সম্পদকে বেচার জন্য বিশ্বের সামনে পরিবেশণ করা। উন্মুক্ত করে দেওয়া উচিত সকল পর্দা, তা নারীর হোক বা ধরণীর। আমরা দেখেছি যা ধীরে ধীরে শুরু হয়েছে বিংশ শতাব্দীর শেষ দশক থেকে। এ দেশে বেচার জন্য বা এ দেশকে বেচার জন্য ঐ সময়কাল থেকেই শুরু হয়ে গেছে  এদেশের নারীর সৌন্দর্যের পসার। ১৯৯৪ সাল, মিস ইউনিভার্স এবং মিস ওয়ার্ল্ড হলেন দুই ভারতীয় নারী। ভারতের সম্পদের, ঐতিহ্যের ও সম্ভ্রমের দরজা খুলতে লাগল। ২০০০ সালে আরও অগ্রগতি। এ বছরে মিস ইউনিভার্স, মিস ওয়ার্ল্ড এবং মিস এশিয়া পেসিফিক হলেন তিন ভারতীয় নারী। পরিকল্পিত আঘাত হানা হোলো ভারতীয় আত্মসম্ভ্রমের মেরুদণ্ডে। প্রচারের কৃত্রিম আলো অন্য কথা বলল। আমরা পুলকিত বোধ করলাম। কসমেটিকস পণ্যে ভরে গেল দেশ ও দেশবাসীর মন। তারপর, না জানি আরও কত সুন্দরী শুধুমাত্র দৈহিক প্রদর্শনীতে বিশ্বজয় করে ধন্য করলেন আমাদের। সিলভার সুন্দরিগণ সিলভার স্ক্রীনকেই প্রদর্শনীর মাধ্যম হিসাবে ধরে নিলেন। রাষ্ট্র মুচকি হাসলো ও হাসতে থাকলো। আত্মিক সৌন্দর্য্য হারতে শুরু করল দৈহিক সৌন্দর্যের কাছে। নারী পুরুষ নির্বিশেষে চারিদিকে প্রচারের হাতছানি। ফর্সা হওয়াই, সুন্দর হওয়াই, একমাত্র সাফল্যের চাবিকাঠি। চিন্তার গোড়ায় লাগলো কুঠারাঘাত। আমির খান তার সিনেমা লাগান এ স্বপ্ন দেখালেন যে আমাদের দেশ নিজস্ব দক্ষতা ও সম্পদ নিয়েই বাজারে প্রতিযোগিতায় নামবে এবং জিতবে। যে খেলা দেশবাসী কখনও খেলেনি, সেই খেলা শিখতে হবে। কারণ ওটাই একমাত্র  খেলা যা না শিখলে আমরা হেরে যাব। নিঃস্ব হয়ে উচ্ছেদ হয়ে যাব সমূলে। আসলে ছবির মাধ্যমে বলা হয়েছে যে, হয় তুমি আমাদের শিক্ষায় শিক্ষিত হও, না হলে তোমার কোনো অস্তিত্ব নেই। কারণ এটাই সময়ের দাবী আর সময়ের সাথে না বদলালে বিলুপ্তি। ‘ আকাশ নাগরিকগণ সন্তুষ্ট হলেন, সাথে সন্তুষ্ট হোলো করপোরেট ও রাষ্ট্র। ‘ লাগান ‘ সিনেমার ধন্য ধন্য পরে গেল চারিদিকে। কানের পাশ দিয়ে অস্কার হাত ছাড়া হলো। আর যদি এই আন্তর্জাতিক পুরস্কার আমির জিতত,  আমাদের দেশ জিতত কি? জিতলেও কারা জিতত, বা কারা জিতে চলেছে, ১৪০ কোটির সম্পদ মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের হস্তগত করাই কি তাহলে বিশ্বায়ন? আর সেকাজে বাধা মানেই অগ্রগতির  পায় শিকল?

কোনো এক গ্রীষ্মের বিকালে এক বিশাল ঠান্ডা হলঘরে চার পাঁচ জন আধুনিকা নিজেদের পোষা puppy দের একে অপরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন। কুকুরেরাও সমগোত্রীয়দের সাথে পেয়ে পুলকিত। মেয়েগুলির একজন আমাকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করল, ‘ ম্যাম এসব কি হচ্ছে চারিদিকে? উন্নয়নের জন্য ট্রাইবদের কেন ডিসপ্লেসড করা হচ্ছে? আমার ভাইকে জিজ্ঞাসা করতে সে বিরক্ত হয়ে বলল, এরাই নাকি উন্নয়নের প্রধান বাধা। ওর যদি ক্ষমতা থাকত, তাহলে নাকি সকলকে উচ্ছেদ করে দিত। ‘ Mam, so far I know, they are very peaceful people’ । বুঝলাম, মেয়েটি আমার কোনো একটি লেখা পড়েছে। আর দেখলাম, কুকুর গুলো কিন্তু নিজেদের মধ্যে কোনো অশান্তি করছে না। ওরা হয়তো ততটা প্রগতিশীল নয়।

সন্ধ্যায় টাইমস অফ ইন্ডিয়ার এক প্রচার অনুষ্ঠানে, যার শিরোনাম, ‘স্থবির ভারত ‘ । সে অনুষ্ঠানে এই বলে সঞ্চালক সূচনা করলেন যে, এই অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য সকলকে উৎসাহ যোগানো, যাতে তারা ‘অতীতের সকল প্রতিবন্ধকতার ভূতকে ‘ অতিক্রম করতে পারে। দেখলাম অমিতাভ বচ্চন প্রধান বক্তা। তিনি তার বিখ্যাত স্বরে বলে চললেন,

 ‘ এই দেশে দুটো ভারতবর্ষ বাস করে। এক ভারত সকল শিকল ছিঁড়ে, সকল প্রতিবন্ধকতা ভেঙ্গে সেই উন্নত ভারতে যেতে চায়, যে ভারতের ওপর আজ সারা বিশ্ব প্রশংসার সকল বিশেষণের ফুল ঝড়াচ্ছে। আর এক ভারত হচ্ছে সেই শিকল ও প্রতিবন্ধকতা।

এক ভারত বলছে, আমাদের সে উন্নত দেশে প্রবেশের যোগ্যতা প্রমাণ করার সুযোগ দিন। আর এক ভারত বলছে আগে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করুন তারপর আমরা ভেবে দেখব যে সেখানে যাওয়া যায় কিনা।

এক ভারত তাদের ইতিবাচক মনে বাস করে, আর এক ভারত বাস করে সন্দেহ ভরা হৃদয়ে।

এক ভারত দাবী করে, অপর ভারত আশা করে।

এক ভারত এগিয়ে চলে, আর এক ভারত অনুসরণ করে।

প্রতিদিন এই আলোচনা চলার মাঝে অন্য ভারত প্রতিবন্ধকতার বাধা পেরিয়ে অগ্রণী ভারতের দিকে চলে আসছে। এভাবে ধীরে ধীরে ও নিঃশব্দে এক গতিশীল ও সৃষ্টিশীল ভারতের উত্থান হচ্ছে। এভাবে স্বাধীনতার ষষ্ঠ দশক পেরিয়ে আমরা সময়ের এক মহান উচ্চতার শিখরের পথে এসে পৌঁছেছি।

যেখানে এক ভারত আজ উচ্চতার শিখর থেকে অতি ক্ষীণ স্বর ও দ্বিধা নিয়ে নিচে দেখে, অপর ভারত ওপর দিকে তাকিয়ে বলে উঠছে, এবার আমাদেরও ওড়ার সময়।

এই হচ্ছে আসল দেশকে, দেশের প্রকৃত ছবিকে ঢাকার জন্য কৃত্রিম দেশের ভ্রম সৃষ্টি করা (Counterfeit)। যেখানে বার বার বলা হচ্ছে যে, যারা ধনী তাদের কাছে কোনো বিকল্প নেই, কিন্তু গরিবদের আছে। তারা চাইলেই ধনী হতে পারে যদি না চায় তাহলে ধরে নিতে হবে যে তারা নেতিবাচক মনোভাব কেই প্রাধান্য দিচ্ছে। মানসিক ভাবে আত্মবিশ্বাসের থেকে দ্বিধাকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে। অন্যভাবে বলতে গেলে তারা গরিব হওয়াটাকেই পছন্দ করছে। এটা তাদেরই দোষ, অন্য কারো নয়, কারণ তারা দুর্বল এবং আমরা জানি যে দুর্বলদের ওপর, দুর্বল সম্বন্ধে উন্নত ভারত কি মনোভাব পোষণ করে থাকেন। ‘ বাধা সৃষ্টিকারী অতীতের ভূত ‘। গরীবের কাছে থাকে মাত্র দুটো রাস্তা খোলা। হয় প্রতিরোধ করো, নয়তো তিলে তিলে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাও। উন্নয়ন ও অগ্রগতির নামে উচ্ছেদ এবং  বাধাদানে গনহত্যা এ বিশ্বে এখন একটি স্বাভাবিক অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া ছাড়া অন্য কিছু নয়। বহু যুগের অধিকার এক পলকে ছিনিয়ে নেওয়ার নামই গতিশীল উন্নয়ন। শ্রী বচ্চন ঠিকই বলেছেন, মানুষ নিঃশব্দে সীমা অতিক্রম করছে। তবে উনি বা ওনারা যেদিকে ভাবছেন সেদিকে নয়। সশস্ত্র সংগ্রামের দিকে এবং সেখান থেকে ওপরে আকাশবাসীদের দিকে তাকিয়ে বিদ্রুপ করে বলছেন, ‘ আমাদের কাছেও আর কোন বিকল্প নেই।’

তারা বাধা দেওয়ার প্রতিফল জেনেও জীবন বাজী রেখে অস্ত্র ধরেছে সেই জীবনের জন্য, সেই আত্মনির্ভর, স্ব – শাসিত ভারতের জন্য,  যে ভারতে তাদের পূর্বপুরুষেরা যুগ যুগ ধরে ভালোবেসে বসবাস করে আসছেন। এও এক ভারতবাসীর স্বাধীনতার যুদ্ধ। দেশের প্রধানমন্ত্রী এই সকল মানুষদের দেশের আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, উন্নয়নের অগ্রগতির একমাত্র বাধা বলে চিহ্নিত করে এদের উন্নয়নের ‘ ভাইরাস ‘ বলে উল্লেখ করেছেন । ‘ ভাইরাস ‘ নাসের জন্য এক নিষ্ঠুর সশস্ত্র বাহিনী গঠনের উপদেশ দিয়েছেন। যে বাহিনী সকল প্রতিবন্ধকদের নির্মূল করবে। গঠিত হয়েছে, ‘ সালওয়া জুরুম ‘, শুরু হয়েছে অপারেশন ‘ গ্রীন হান্ট্ ‘। সময়ের সাথে দল বদলে যাচ্ছে রঙ বদলে যাচ্ছে জামা বদলে যাচ্ছে আর অত্যাচারের নামও বদলে যাচ্ছে। তখন ছিল ভাইরাস আর এখন দেশের শত্রু। প্রতিরোজ, প্রতিক্ষন, দিকে দিকে বাধছে অঘোষিত যুদ্ধ। সে যুদ্ধেও গুলি ছোটে শব্দ করে কিন্তু সভ্যতার কানে পৌঁছায় না। সে যুদ্ধে বিপক্ষের হত্যার কোনো হিসাব থাকে না। সে যুদ্ধের কথা কোনো সংবাদমাধ্যম প্রচারে আনে না। যা প্রচারে আনে তা সত্য নয় সত্যের জন্য নয়। বরং মিথ্যার জন্য, মিথ্যা দিয়ে সত্য ঢেকে দেওয়ার জন্য।

একপ্রান্তে অধিকারের জন্য যখন লড়ছে মানুষ, মরছে মানুষ, ঝরছে নিষ্পাপ রক্ত, প্রকৃতির ও আদি ভারতবাসীর। ঠিক সেই সময়ে প্রচারে আসছে দেশের অপরপ্রান্তে অন্য এক ভারতবর্ষের, কোনো এক স্টেডিয়ামের ছবি, যেখানে আকাশ নাগরিকরা উন্নয়নের আধুনিক মন্ত্র জপ করছেন, ‘ ইন্ডিয়া ইন্ডিয়া ‘, ‘ ইন্ডিয়া ইন্ডিয়া ‘।

অরুন্ধতী রায়ের ‘ Listening to grasshoppers ‘ অবলম্বনে।

আরও পড়ুন – হিমালয়ের সর্বনাশ, কর্পোরেটের পৌষমাস