১
“এ পর্যন্ত যা দেখেছি, তাতে আর নতুন করে চমকিত হই না, তবে সরকারের এই নতুন স্মৃতিফলক আর পার্কের সজ্জা দেখে ভারী বিষন্ন লাগে” – কথাগুলো বলছেন ৭৮ বছরের বয়স্ক চন্দ্র সিং রানা। ‘চিপকো আন্দোলনে’র অন্যতম প্রধান নেত্রী গোরা দেবীর ছেলে। আন্দোলনের নামটা প্রায় সকলের শোনা, আর বিষয়টা অনেকের জানা। আমার অনুভূতি, যেকোনো আস্তিকের দেবালয়ের সামনে দাঁড়ালে যেমন মাথা নত হয়ে আসে তেমনি। ক্যালেন্ডারে আজ ১৬ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৩। আমরা এখন উত্তরাখণ্ডের, চামোলি জেলার সেই বিখ্যাত গ্রাম, রেনি গ্রামে। এই গ্রাম সেই বীরাঙ্গনাদের গ্রাম, যাঁরা জীবনের তোয়াক্কা না করে নিজেদের জঙ্গল ও জনজাতির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য, হিমালয়ের সর্বনাশ ঠেকাতে দাঁত নখ বের করে ঝাঁপিয়ে পড়া কর্পোরেটর সামনে বুক চিতিয়ে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। প্রমাণ করে দিয়েছিল মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির নিবিড় সম্পর্ক।
১৯৭৩ সালে এই আন্দোলনের সূচনা হয়। চিপকো আন্দোলন কে কৃষকদের আন্দোলন বা মহিলাদের আন্দোলন যা হিসাবেই অনুমান করা হোক না কেন সর্বপরি এটি ছিল স্বাধীন ভারতের প্রথম সংগঠিত পরিবেশ আন্দোলন। চিপকো আন্দোলনের শিকড় অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে এই আন্দোলনের মূলে রয়েছে স্বাধীনতার পূর্বে ১৭৩০ সালে ঘটে যাওয়া রাজস্থানের যোধপুর জেলার খেজারালী গ্রামের, বিষ্ণোই সম্প্রদায়ের মানুষদের দ্বারা খেজরি গাছ কে রক্ষার জন্য ‘বিষ্ণোই আন্দোলন’ বা ‘খেজারি আন্দোলন’। পরিবেশ আন্দোলনের ইতিহাসে এটি ছিল সেই আন্দোলন যা তাদের সুরক্ষার জন্য গাছকে আলিঙ্গন করার কৌশল ব্যবহার করেছিল।
১৯৭৩ সালে স্থানীয় মানুষদের কৃষি সরঞ্জাম তৈরির জন্য বন দপ্তরের কাছে ১০ টি করে ছাই বৃক্ষ প্রদানের অনুরোধ করেছিলেন, কিন্তু বনদপ্তর তা দিতে অগ্রাহ্য করেন। অথচ বিদেশী সাইমন্ড কোম্পানীকে ৩০০ টি ছাই বৃক্ষ কাটার অনুমতি প্রদান করেন। যা স্থানীয় মানুষদের মধ্যে অসন্তোষের উদ্ভব ঘটায়। কোম্পানী তাদের সরকারি বরাদ্দ ৩০০ গাছ কাটতে এলে স্থানীয় মানুষ জন ড্রাম বাজিয়ে, লোকগীত গেয়ে তাদের বিরোধীতা করেন। লাগাতার আন্দোলনের পরিনতিতে বনদপ্তর সাইমন্ড কোম্পানীর গাছ কাটার অনুমতি বাতিল করতে বাধ্য হয়। চিপকো আন্দোলন এরপর তৎকালীন উত্তরপ্রদেশের (বর্তমানে উত্তরাখন্ড রাজ্য) অন্যান্য পার্বত্য এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে, যেমন – রেনি, প্যাং, সুভাই, তেহরি, কুমায়ন, বৈদ্যগড়। এইসময় সরকার এই অঞ্চলের অরণ্যের একটি বড়ো অংশ নিলামে বিক্রি করে দিলে কেবলমাত্র রেনির ‘পাঙ্গারানী’ জঙ্গলে ২০০০ মতো গাছ কাটা পড়ার সম্ভাবনা দেখা যায়। যেখানে এই আন্দোলন একটি গুরুত্বপূর্ন মোড়ে পৌঁছায়। এলাকার গ্রামীন মহিলারা গোরা দেবীর নেতৃত্বে গাছগুলোকে জড়িয়ে কাটার থেকে রক্ষা করেন।
আন্দোলনের অন্যতম তরুণী কর্মী জুটি দেবী জানান গোড়ায় এই আন্দোলনের নাম ‘ছিনো’ বা ‘ঝাপটো’ ছিলো পরবর্তীতে ‘চিপকো’ নাম হয়। জুটি দেবি তখন চন্দ্র সিং এর সাথে সদ্য বিয়ে হয়ে এসেছেন। শাশুড়িমা গোরা দেবীর হাত ধরেই তার সংসার সামলানোর শিক্ষা শুরু হয়। তিনি শিখে গেছিলেন সংসার বলতে রোজ এক হাঁড়িতে রান্না খাবার কতজনকে পরিবেশন করতে হয় শুধু তা নয়, এই খাবার তৈরীর রসদের উৎস তার সংসারেরই অংশ। আমাদের সাথে আলাপচারিতায় তিনি একটি গানের কিছু লাইন তাঁদের জনজাতির ভাষায় শোনাচ্ছিলেন, যার সারমর্ম, তাঁদের জীবনের যে কোন রকম অনুভূতি সুখ-দুঃখ, আপদ-বিপদ, রাগ-অভিমান সবটাই তারা জঙ্গল, বন, গাছের সাথে বিনিময় করে নেন। ঠিক যেমন মেয়েরা বিয়ের পর এই অনুভূতিগুলি তাদের ‘মাইকে’ বা বাপের বাড়ির সাথে আদান-প্রদান করে, এঁরাও জঙ্গলকে তাদের আরেকটা বাপের বাড়ি মনে করে।
মানুষ যে পরিবেশেরই অংশ এই ধারণা আদিম কাল থেকেই চেতনায়, ও নিত্য অভ্যাসে গাঁথা ছিল। তথাকথিত সভ্যতা ও উন্নয়ন সেই শিকড় ছিঁড়ে আমাদের এতটা উপরে নিয়ে চলে এসেছে যে পর্যাপ্ত জীবন শক্তির অভাবে এই মহীরূহ ধীরে ধীরে শুকিয়ে যাচ্ছে। জুটি দেবীর গান শুনতে শুনতে আজ সেই শিকড়ের টান বড্ড অনুভব করছি, কিন্তু তা এতটাই অতলে যে এক নিঃশ্বাসে ডুব দিয়ে পাঁক পর্যন্ত ছুঁতে পারছি না।
রেনি গ্রামে প্রবেশের মুখে একটি খিলান। তাতে চিপকো আন্দোলনের কর্মীদের নাম খোদাই করা আছে। এইখানে একটি স্মৃতিফলকও ছিল, যা ২০২১ এর বিপর্যয় নষ্ট হয়ে যায়। বর্তমানে সরকার গ্রামের একটু উপরের অংশে একটি পার্ক তৈরি করেন যেখানে ওই স্মৃতিফলক আবার নতুন করে বসানো হয়। সাথে একটি গাছকে ঘিরে ধরে কিছু মেয়েরা গোল করে দাঁড়িয়ে আছে আর দুজন কুঠার হাতে গাছ কাটার উদ্যোগী এমন মূর্তি বসানো হয়। এই পার্কে চন্দ্র সিং জির সাথে আমাদের কথা হচ্ছিল। তিনি ভারী বিষন্ন চিত্তে জানান, আজ এই মূর্তি দেখে কোন বোঝার অবকাশই নেই যে এই আন্দোলন একসময় ভুটিয়া জনজাতিরাই করেছিল, মূর্তি গুলির পোশাক একদম ‘পন্ডিত’ দের (তথাকথিত উচ্চবর্ণের) মত। ভুটিয়া জনজাতিরা কখনোই এই ধরনের পোশাক পরে না। আগামী বেশ কিছু বছর পরে হয়তো এই আন্দোলনের কোন ছাপেই তাদের আর চিহ্ন থাকবে না। তিনি আরো জানান, এই আন্দোলনের কথা উঠলেই যাদের নাম প্রথম সারিতেই এসে পড়ে চন্ডীপ্রসাদ ভট্ট, সুন্দরলাল বহুগুনা এরা ছিলেন ওই সময়ে জঙ্গলের ছাই গাছের ঠিকেদার। গোড়ার দিকে সরকার যখন গাছ কাটার অনুমোদনের প্রস্তাব আনেন তখন এরা সরকারের পক্ষেই ছিলেন শুধু নয়, এই আন্দোলনের বিরোধীও ছিলেন। পরে যখন বোঝেন যে সরকারের এই পরিকল্পনা আসলে বিদেশী কর্পোরেটদের বেশি মুনাফার জন্য, আর তাদের ঠিকেদারীও প্রায় বন্ধের জোগাড় হবে তখন তাঁরাও এই আন্দোলনের সঙ্গী হন ও আন্দোলনের প্রমুখ হয়ে ওঠেন।
গ্রাম সভার উঠানে এসে আমরা বসি। এখানে আজও সেই অর্থে চিকিৎসা ব্যবস্থা বা ওষুধ পত্রের দোকান নেই। মাঝেমধ্যে সরকার থেকে বা বিভিন্ন এনজিওর তরফ থেকে মেডিকেল ক্যাম্প হলে সেখানে তারা কঠিন রোগের চিকিৎসা পান, নাহলে নিচে সদর হাসপাতালে তাদের চিকিৎসার জন্য আসতে হয়। বাকি অন্যান্য যেকোনো শারীরিক ছোটখাটো সমস্যার জন্য জঙ্গলই তাদের ভরসা। তারা আজও বিশ্বাস করেন শুধু বিশ্বাস নয় অভ্যাস করেন, তাদের নিত্য জীবন যাত্রার ধরনে রোগের কোন ঠাঁই নেই। আর তেমন বয়সে রোগ হলে তাতে মানুষ মারা যাবে, এতে বিস্ময়ের কিছু নেই। বিশ্বজুড়ে মহামারীর ঢপের চপ তারা খাননি। রসিক মানুষ, খুব মজার সাথে জানান তারা এমনিতেও তেলে ভাজা কম খান। নিচে আজ এক এনজিও জল রাখার বড় ট্যাঙ্ক দিচ্ছে, সাথে প্রয়োজনীয় কিছু পাইপ উপকরণ। জুটি দেবী এক প্রতিবেশীর সেই উপকরণ আনতে সাহায্যের জন্য নিচে গেছেন। এই গ্রামের মানুষের প্রধান জীবিকা চাষ, জঙ্গলের কাঠপাতা সংগ্রহ, চাটাই বোনা ও আড়ু ফল সংগ্রহ করে তার থেকে আড়ুর তেল বানানো এসবই। জোশিমঠের আসন্ন বিপদ নিয়ে বললেন যে পাহাড়ের মানুষের পাহাড় জঙ্গল নদী নিয়েই সুখ দুঃখ মিলিয়ে থাকাই শ্রেয়, আর এর বেশি যদি সমতলের শহুরে কায়দা আকর্ষণীয় হয় তাহলে পাহাড় ছেড়ে শহরে গিয়েই তা ভোগ করা উচিত। প্রতিকারের কথায় বলেন সাধারণ সচেতন মানুষের পথে নেমে এই অপ্রয়োজনীয় উন্নয়নের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করে বৃহত্তর এমন আন্দোলন গড়া, যাতে সরকার তথা পুঁজিপতিরা বাড়তি সুবিধার লোভ পর্যন্ত না দেখাতে পারে।
জোশিমঠ থেকে লব রানার গাড়িতে ২১ কিলোমিটার দূরে রেনি গ্রামের উদ্দেশ্যে আমরা বেরিয়ে ছিলাম। লব ভাইয়ের কাছ থেকে গাড়িতে যেতে যেতে আমরা শুনি ঋষি গঙ্গায় ২০২১-এর সেই ভয়ানক বিপর্যয়ের অভিজ্ঞতার কথা যা ২০১৩ সালের কেদারনাথের ভয়ের স্মৃতিকে উস্কে দিয়েছিল । লব ভাইয়ের বয়স ৩২ বছর, পেশায় ভাড়ার গাড়ি চালক। এছাড়া ট্রেক গাইডের কাজ করে থাকেন ও চাষবাস করেন। ২০১৩ সালে তিনি কলেজ পাশ করেছেন। ওই বিপর্যয়ের একদিন আগে তিনি একটি দল নিয়ে পাঙ্গারচুলা শৃঙ্গের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে ছিলেন। পরের দিন বিপর্যয়ের আভাসে তিনি তড়িঘড়ি সদল বলে নেমে আসেন এবং এসে দেখেন সেই বিশাল জলরাশি দু’পার ধ্বংস করতে করতে এগিয়ে আসছে। যে স্থান থেকে তিনি দৃশ্য দেখেছেন আমাদেরও সেখানেই দাঁড় করালেন কিছুক্ষণ। এই দৃশ্যের ভয়াবহ অনুভূতি ভাষায় বর্ণনা করে উঠতে পারছেন না। তপোবন হাইড্রো ইলেকট্রিক পাওয়ার প্রজেক্টের ধ্বংসলীলা তিনি নিজের চোখে দেখেছেন। নদীর ওই পারে মোরান্ডা নামে একটি ছোট গ্রাম আছে যার এই পারে শহরের সাথে যোগাযোগের একটি সেতু ছিল যা ওই বিপর্যয়ে ভেঙে যায়। সম্পূর্ণ গ্রামটা মূল জনজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। বছর ঘোরেনি তপোবন প্রজেক্টের মেরামতির কাজ করে তাকে গুছিয়ে নেওয়া হয়েছে এদিকে ওই গ্রামটি আজও প্রায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। তিনি আমাদের ঝষিগঙ্গা হাইড্রোইলেক্ট্রি পাওয়ার প্রজেক্টের ধ্বংসাবশেষ দেখালেন। বললেন কি ভাবে তারা ধ্বংসের পর মানুষের মৃত দেহ উদ্ধার করেছেন। কিভাবে মৃতদেহের স্তুপ ঘেঁটে রোজ কেউ না কেউ তাদের পরিচিত মানুষের দেহ সনাক্ত করছে। কিভাবে দূরের এলাকার মজুরের একাধিক দেহ তার ভাড়ার গাড়িতে বোঝাই করে গোটা দিন ধরে পৌঁছে দিয়েছেন। পাহাড়ের গায়ে বড় বড় সুরঙ্গ গুলির দিকে আঙুল তুলে বললেন, এইভাবে পাহাড় জঙ্গল ধ্বংস করে নগরায়ন তার আর প্রয়োজন নেই। এই মৃত্যু খেলা অবিলম্বে বন্ধ হোক। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে স্টেয়ারিং এ পুনরায় হাত রাখলেন।
২
তারিখটা ৩রা জানুয়ারি ২০২৩। ইংরেজি নববর্ষের বর্ষবরণ উৎসবের রেস চোখমুখ থেকে যায়নি। সকালে খবরে কাগজের হেডলাইনে উত্তরাখণ্ডের জোশিমঠে বিভিন্ন গ্রামের ঘর বাড়িতে আকস্মিক ফাটল। জোশিমঠ এমনি ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা। তার ওপর ২০০৬ সালের শেষ থেকে ধৌলিগঙ্গা নদীর ওপর শুরু হয়েছে এন. টি. পি. সি. -এর ‘তপবন বিষ্ণুগড় পাওয়ার প্রজেক্ট’। সাথে ২০১৭ সাল থেকে শুরু হয়েছে পুরো গাড়োয়াল হিমালয় জুড়ে পাহাড়ের মধ্যে বড় বড় সুড়ঙ্গ করে, চারধাম সংযোগ রেল পরিকল্পনার কাজ। খবরটা পড়েই গা হাত কাঁটা দিয়ে উঠলো। হিমালয়ের আরও একটা গ্রাম, আরও একটা সভ্যতা এভাবেই শেষ হয়ে যাবে! পরদিনই ‘নদী বাঁচাও জীবন বাঁচাও আন্দোলন’ জোশিমঠের সংহতিতে একটা প্রদর্শনীর ডাক দেয় ১৯শে জানুয়ারী কলকাতার ‘রানুছায়া’ মঞ্চে। এখানেই জানা গেল আগামী ১২, ১৩ ও ১৪ ফেব্রুয়ারি হরিদ্বার মাতৃসদন আশ্রম এই জোশিমঠের ওপর আগত এই আকস্মিক বিপদ নিয়ে জাতীয় স্তরে একটি আলোচনা সভার আয়োজন করেছেন। ‘নদী বাঁচাও জীবন বাঁচাও আন্দোলন’, ‘জলঙ্গি নদী সমাজ’, ‘কুশকর্ণি নদী সমাজ’ ও ‘থার্ড প্ল্যানেট’-এর পক্ষ থেকে আমাদের ছ’জনের একটা দল গত ১০ই ফেব্রুয়ারি কলকাতা থেকে রওনা দিয়ে ১২ তারিখ সকালে মাতৃসদন আশ্রমে পৌঁছাই।
এর আগে আমাদের ‘গঙ্গা বাঁচাও সাইকেল যাত্রা-২০২২’-এর সময় প্রথমবার এসেছিলাম। গঙ্গা তথা গঙ্গাকেন্দ্রিক জীব বৈচিত্র বাঁচিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে এই আশ্রমের সন্ন্যাসীদের নিরলস প্রচেষ্টা ও বলিদান সত্যিই উল্লেখযোগ্য। ‘পর্থিব’ পত্রিকার জল বিষুব, ১৪২৯ সংখ্যায় এঁদের গঙ্গা বাঁচানোর উদ্দেশ্যে আন্দোলন ও বলিদানের কথা বিস্তারিত তুলে ধরেছেন পরিবেশ কর্মী কল্লোল রায়।
আলোচনা সভায় ‘পিপলস সাইন্স ইনস্টিটিউট’-এর কর্ণধার ডঃ রবি চোপড়া তাঁর বক্তব্যে জোশিমঠের এই ভয়াবহ অবস্থার জন্য সরাসরি দায়ী করেন বর্তমান সরকার ও সরকারি মদতে গড়ে ওঠা কর্পোরেট আগ্রাসনকে। তিনি এও বলেন এই ঘটনায় শুধু যে জোশিমঠের বাসিন্দারা আতঙ্কে আছেন তা নয়, বর্তমান সরকার ও ভীষণ রকম ভয়ে আছেন। প্রমাণ স্বরূপ গত ৫ই জানুয়ারি, ২০২৩ এর ইসরো(ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশন) রিপোর্ট উল্লেখ করেন। যেখানে জানা যায় জোশিমঠ শহরের নিচের ভূমি স্তর ক্রমশ সরছে। মে, ২০২০ থেকে মার্চ, ২০২২ পর্যন্ত ২২ মাসে ভূমি স্তর সরেছে ৬.৬ সেন্টিমিটার। এপ্রিল ২০২২ থেকে নভেম্বর ২০২২ পর্যন্ত ২১০ দিনে ৮.৯ সেন্টিমিটার, আর ২৭শে ডিসেম্বর, ২০২৩ থেকে ৫ই জানুয়ারী, ২০২৩ অব্দি আরও ৫.৬ সেন্টিমিটার মাত্র ১২ দিনে। যা আগের পরিসংখ্যানের প্রায় ১১ গুণ। এই খবর সংবাদমাধ্যমে আসার পর এন.ডি.এম.এ(ন্যাশনাল ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অথরিটি) তৎক্ষণাৎ একটি নোটিশ জারি করে, যে আটটি কমিটি তৈরি হয়েছে এই ঘটনা পর্যবেক্ষণের জন্য তাদের রিপোর্ট আর কোনোভাবে বাইরে আসবে না, এই রিপোর্ট জমা পড়বে এম.ডি.এম. এ.-র কাছে, সেখান থেকে ভারত সরকার তারপর উত্তরাখণ্ড সরকার। তারা এই রিপোর্ট পর্যালোচনা করে তার একটা নির্যাস প্রকাশ করবেন। পরবর্তীতে ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারের সময় উনি নদী নিয়ে বলেন যে, কোন বড় নদীকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে তার সঙ্গে জুড়ে থাকা সমস্ত ছোট মাঝারি শাখা নদী উপনদী গুলি কে বাঁচিয়ে রাখা ভীষণ আবশ্যক। তা না হলে আজ জোশিমঠের পরিবেশ উদ্বাস্তু শুধু নয়, পশ্চিমবঙ্গে গঙ্গা নদী মোহনায় সুন্দরবনের বহু দ্বীপ ধীরে ধীরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। নদী নির্ভর বহু জীবন পরিবেশ উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে, মুর্শিদাবাদের মতো।
‘জোশিমঠ বাঁচাও সংঘর্ষ সমিতি’-র বিশিষ্ট পরিবেশ আন্দোলন কর্মী অতুল সতীর কথায় জোশিমঠের আজ এই অবস্থার জন্য মূলত এন.টি.পি.সি-র প্রজেক্ট দায়ী। তিনি জানান এই প্রজেক্ট হওয়ার আগে ভীষণ আবশ্যিক ছিল জিও ফিজিক্যাল সার্ভে হওয়া এবং তার রিপোর্ট সর্বসাধারণের জন্য প্রকাশ করা। কিন্তু তাঁরা এই সমীক্ষাই করেননি, রিপোর্ট দেওয়া তো দূরের কথা। এও বলেন প্রজেক্টের শুরুতে জি. এস. আই(জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া) অনুমোদন দিয়েছিল। উত্তরাখণ্ড সরকারের ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট বিভাগের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর পীযূষ রাউতেলা ২০১০ সালে জি. এস. আই এর অনুমোদনের বিরুদ্ধে রিপোর্ট প্রকাশ করেন। এই প্রোজেক্টের প্রথম দায়িত্ব দেওয়া হয় আন্তর্জাতিক কোম্পানি এল এন্ড টি কে। তারা কাজ শুরু কিছু দিনের মধ্যেই জানান এখানের মাটিতে এই প্রজেক্ট করা কোনমতেই সম্ভব নয়, এবং কাজ ছেড়ে দিয়ে চুক্তি বাতিল করেন। এত বিপত্তি সত্ত্বেও বর্তমানে এই প্রজেক্ট রমরমিয়ে চলছে। বর্তমানে তপোবনের কাছে একটি সুড়ঙ্গ করার মেশিন সুড়ঙ্গের গভীরে আটকে পড়ে, যা এখনো বের করা সম্ভব হয়নি। সেটি বাইরে আনার জন্য তার চাইতে অনেক চওড়া জায়গা জুড়ে ব্লাস্ট করে ফাঁকা করা হচ্ছে। আর এই ফাটলের সূত্রপাত ওই ব্লাস্টের জন্যই। এই আলোচনা সভা থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শনের জন্য আমরা চারজন আমি, সৌরভ, অমিতাভদা আর ইপ্সিতাদি ১৪ তারিখ জোশিমঠ পৌঁছালাম।
৩
জোশিমঠে পৌঁছে আমাদের জ্যোতির্মঠে ঠাঁই হলো। দুটো দিন আমরা এলাকার বিভিন্ন গ্রাম, সেখানের বিভিন্ন মানুষ ও ক্ষতিগ্রস্ত জমি ঘর বাড়িগুলো ঘুরে দেখলাম। জানুয়ারির ২ তারিখে রাতে ‘হোটেল মাউন্ট ভিউ’ এর একটি অংশ বিকট আওয়াজ হয়ে ধসে পড়ে আর ওই সাথেই এলাকায় বিভিন্ন বাড়িতে জমিতে ফাটল দেখা দেয়। স্থানীয় মানুষ আতঙ্কিত হয়ে ঘর ছেড়ে দেন। পরদিন তড়িঘড়ি তাদের রাহাত শিবিরে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা হয়। মূলত চারটি গ্রাম বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ভয়প্রবণ বলে জানিয়েছে এন. ডি. এম. এ। মোনহরবাগ, সুনিল, সিংধার ও গান্ধি নগর। প্রায় তিন কিলোমিটার ব্যাসার্ধের বলয় এই ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা। ২৭৮টি পরিবার ঘরছাড়া, ৮৫৬টি ঘরে ফাটল দেখা দিয়েছে। ‘জোশিমঠ বাঁচাও সংঘর্ষ সমিতি’-র পক্ষ থেকে এখানে ৪২ দিন ধরে ধরনামঞ্চ চলছে। ধরনাতে ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ির ছেলেরা, মেয়েরা, ও জোশিমঠ নিয়ে চিন্তিত মানুষের পালা করে হাজির হচ্ছেন। রাস্তাঘাট, দোকানের দেওয়াল জুড়ে ধিক্কার ও প্রতিবাদের পোস্টার। এন. টি. পি. সি. গো ব্যাক। এখানে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার মধ্যে অন্যতম সিংধার। এই গ্রামের সদ্য স্কুল শেষ করা মেয়ে মনিকা, রবি গ্রামের মেয়ে নিধি ও তাদের আরো কয়েকজন বান্ধবী মিলে রেড ক্রসের পক্ষ থেকে কাজ করছে। কাজ বলতে সকালে ক্ষেতি করে কলেজ যায়, কলেজ থেকে ফেরার পথে কখনো মনোহর বাগ, সুনীল বিভিন্ন ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামগুলোতে ঘুরে ঘুরে খবর নিয়ে বেড়াচ্ছে। কোন বাড়ির কতটা ফাটল বাড়লো, শরণার্থীরা ঠিক মতো রেশন পাচ্ছে কিনা, বাচ্চা বুড়ো-বুজুর্গদের শরীর স্বাস্থ্য সঠিক চলছে কিনা। তারা দুজন আমাদের সঙ্গে করে সবটা দেখায়। মনোহর বাগের এক বাসিন্দা মানসিং সাতোলিয়া ও কমলা দেবীর কাছে তাদের নিদারুণ বেদনার কথা শুনলাম। থাকার মধ্যে ওনাদের একটি জমি ছিল, তাও এত অল্প যে চাষ করে পোষাবে না। তাই তারা ঠিক করেন এখানে ভাড়া দেওয়ার মতো ঘরের ব্যবস্থা করবেন। যা থেকে তাদের পেট চলবে। বিভিন্ন জায়গায় দিনমজুরি করে, পাথর বয়ে এনে তাকে ভেঙে আকার দিয়ে, নিজেরাই গেঁথে ঘর তৈরি করেছেন। সেই ঘরই ছিল তাদের সন্তানের মত। তাদের দেখভাল করতো পেট চালাত। আজ নিয়তির পরিহাসে তাদের সেই ঘরে ফাটল দেখা দিয়েছে। গ্রামের অন্যান্য বিপদ সংকুল বাড়ির মত তাদের বাড়িতেও লাল স্টিকার মেরে দিয়ে গেছে। লাল স্টিকার চরম বিপদের চিহ্ন, অর্থাৎ এই বাড়িতে থাকা সম্ভব নয়। এছাড়া কিছু বাড়িতে হলুদ স্টিকার লাগানো। যার অর্থ বাস করা যেতে পারে কিন্তু সতর্কতা ও পর্যবেক্ষণের সঙ্গে। তাদের এই ঘর ছেড়ে আর কোথাও যাওয়ার নেই। ভরসা বদ্রী বিশাল। এই বর্ণনা বলতে গিয়ে। আমায় জড়িয়ে কেঁদেই ফেললেন কমলা দেবি।
মনিকা নিধির মতো এরাও টের পাচ্ছে, জেনে যাচ্ছে, মেনেও নিচ্ছে এটাই শেষ পর্যন্ত জোশিমঠের পরিণতি। সরে যেতে হবে, ছেড়ে চলে যেতে হবে। ফাটলে ফুটে ওঠা দেওয়াল লিখন এটাই। কোথায় যাবে?-এর উত্তর বদ্রীনারায়ন আর দিতে পারছেন না। দেবে হয়তো এন. টি. পি. সি!
কলকাতায় ফিরে এসে জানলাম, ১৬ ই ফেব্রুয়ারি যেখানে এই লেখার গোড়াপত্তন হয়েছিল গাছ বাঁচানোর আন্দোলনের ইতিহাস ছুঁয়ে, ঐ দিনই উচ্চতম আদালতে রায় বেরিয়েছে যশোর রোডের সমস্ত গাছ কেটে ফেলা যাবে। ঐ দিনই খবরের কাগজের প্রথম পাতা জুড়ে বিজ্ঞাপন বেরিয়েছে মহেশতলার গঙ্গার পার ঘিরে দিয়ে ‘দা রয়েল গ্যাঞ্জেস – শহরের দীর্ঘতম নদী পাড়ের জনবসতি গঙ্গামুখি বাংলো, ভিলামেন্ট আর টাওয়ার…’