‘নদীজীবীর নোটবুক’ বইটি ২০২৩ সালে ‘নমিতা চট্টোপাধ্যায় সাহিত্য সম্মান’ পেতে চলেছে।
বুদ্ধিজীবী থেকে ‘নদীজীবী’-একটি উৎক্রমণ ? আলোচ্য বইটির নাম বলে খুঁজলে এখনও কলেজস্ট্রীট পাড়ার বইদোকান আর এক প্রয়াত প্রথিতযশা কৃষ্ণনাগরিকের বইটিই এগিয়ে দিচ্ছে – ‘বুদ্ধিজীবী-র নোটবই”। কিন্তু এ বইটির নাম ‘নদীজীবীর নোটবুক’- লেখক ‘সুপ্রতিম কর্মকার। সর্বজন শ্রদ্ধেয় সুধীর চক্রবর্তী সারাজীবন কলেজে পড়িয়ে ও বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যের বহুমুখী গন্তব্যে ঐশ্বর্য্য রেখে মেধা জীবীতায় স্বনামে ভাস্বর হয়ে রয়ে গেছেন। ‘নদীজীবীর নোটবুক”-এর ব্লার্ব-এ গেলে বোঝা যায় লেখক সুপ্রতীমও কলমজীবী এবং বুদ্ধিজীবী। সঙ্গে একটা সঙ্গত প্রশ্ন তিনি কি নদীজীবীও ? নদীর বুকে বা নদীর পাড়ে তার চাষ বা বাস ? নাকি হারানো নদী, মুমূর্ষু নদী, দখল হয়ে যাওয়া নদী আর সেসব নদী নির্ভর জীবনই তার মেধা চর্চায় নাব্যতা আনে ? মননে চর্চায় নদীলগ্নতার আত্মপরিচয় তিনি অর্জন করেছেন নিঃসন্দেহে। দেড় দশকের বেশি সময় ধরে বাংলায় অগ্রগণ্য প্রকাশন সংস্থাগুলির নানা দৈনিক, পত্ৰ – পত্রিকায় পরিবেশ ও সারা দেশের নদী, জলাভূমি নিয়ে তিনি লিখে চলেছেন। নদী বিশেষজ্ঞ হিসেবে নদীয়া জেলার সরকারী দপ্তর আর নানা নদীপ্রেমী স্বেচ্ছাসেবী উদ্যোগেরও অংশ তিনি । ‘নদী বাঁচাও জীবন বাঁচাও’আন্দোলনের সাথী-বন্ধুদের সঙ্গী হয়ে ছুটে গিয়েছেন গঙ্গা বাঁচানোর আন্দোলনের ভরকেন্দ্র হরিদ্বারের কংখলের কাছে মাতৃসদন আশ্রমে বা কখনো পৌঁছেছেন নর্মদা বাঁচাও আন্দোলন এর সভায় মধ্যপ্রদেশের ভূপালেও ।
এর আগে তার লেখা একটি বই আমার পড়া –‘নদীয়ার নদী ও জলাভূমি কথা’। আর ‘জলঙ্গী নদী সমাজ‘ নামে একটি নদী বাঁচানোর চেষ্টায় তার সাথে আমার পূর্বে আলাপ। সাম্প্রতিকতম বইতে তার নদী জরিপের বিস্তৃতি ধরা পড়লেও এটিও তার নিজের ক্ষেত্র সমীক্ষা থেকে উঠে আসা ‘নোট বুক’,নাকি তিনি প্রস্তাব রাখছেন নদীপ্রেমী পাঠক ‘নোটবুক’ হিসেবে এই বই সঙ্গে রাখতে পারেন – এটা নিয়ে একটু সংশয়ে থাকলাম । বইটির অধ্যায় পর্যায়ক্রম নিয়েও যেমন প্রশ্ন জাগছিল তিনি কি সংকোশ থেকে বুড়িগঙ্গা পথে উত্তর থেকে বঙ্গের সমুদ্রপোকূলে এসেছেন নাকি অন্য কোন যুক্তিতে সাজিয়েছেন, তা অস্পষ্ট। যেমন ভৌমজল সংরক্ষণ, বিপন্ন পুকুর-জলাশয় ও খরসুল্লা;ছটকা;চিংড়ির মতো লুপ্তপ্রায় মৎস বৈচিত্র্য,(নদীবাঁধ ও বাঁধ পাড়ের জীবন ও রাজনীতি হয়তো সহজাতভাবেই এসে পড়ে )ভাঙন ও চর রাজনীতি বা প্লাবন সেচের ঐতিহ্য, পাতকুড়ে; পাছাল;পানকাই;পাটনাই ধান প্রজাতিগুলির হারিয়ে যাওয়া – এগুলি নিয়ে তার গুরুত্বপূর্ণ অনুধাবনগুলি তার পরবর্তী প্রকাশিতব্যের জন্য সরিয়ে রাখলে এ বইটি হয়তো কলেবরে কৃশ হলেও সুগ্রন্থিত হতো। তদুপরি নদীজীবী বঙ্গদেশে দেশভাগ উত্তর সিরিয়াস নদীবিজ্ঞান চর্চায় শ্রদ্ধেয় কপিল ভট্টাচার্য থেকে কল্যাণ রুদ্র যে ঐতিহ্য তৈরী করেছেন সুপ্রতিম নিঃসন্দেহে তার হকদার এবং অনুসারী-এ বইও তার স্বাক্ষর। তার লেখার যে চলন সবচেয়ে টানে তা তার সহজিয়া টান । নদী পাড়ের গীতি গাথা কাব্য কাঁথার ফোঁড়ে সে বুনতে বুনতে এগোয় । আধুনিক সমাজবিজ্ঞান চর্চায় যা ‘এথনোগ্রাফিক ইনসাইডার্স অ্যাপ্রোচ। তথ্যের ভার কখনও কখনও ছন্দ ভাঙলে রসভঙ্গও হয় । আশা রাখা যায় তার চলার ছন্দে সে স্থিত হবে। মেধাজীবী থেকে নদী জীবী হয়ে ওঠার এই পথই সে খুঁজে নিচ্ছে। এ বইয়ের শেষ লেখাটি ‘নদী মরা ও বাঁচানো’পড়তে পড়তে মনে হলো বাংলার নদী চর্চায় আরেকটি ধারা জীবনভর লড়াইয়ে থেকে জয়া মিত্ররা তৈরী করেছেন তা নদী আন্দোলনের কথা তুলে ধরার । সুপ্রতিম এর কাছে সে পথে সামিল হওয়ার প্রত্যাশা সে নিজেই তৈরী করছে।
শেষে বলি, প্রসঙ্গান্তর নয়,আলোচ্য বইটি খুঁজতে গিয়ে কলেজ স্ট্রীট পাড়ার একটি দোকানে অন্য আরেকটি বই হাতে উঠে আসে – এক স্মরণীয় উত্তর ঔপনিবেশিক তাত্ত্বিক এডওয়ার্ড সাঈদ এর ‘বুদ্ধিজীবীর দায়’(রিপ্রেসেন্টেশন অফ দ্য ইন্টেলেকচুয়াল গ্রন্থটির অনুবাদ, ১৯৯৪ ),যেখানে ‘ইউরো সেন্ট্রিজম”-এর জ্ঞানীয় ‘অপর’নির্মাণের প্রতাপের প্রশ্ন তুলে তিনি সামনে রাখেন ‘বুদ্ধিজীবী কি কখনও রাজনৈতিক হতে পারে ? – এখানেই পাঠক সুপ্রতিম কর্মকারের “নদী জীবীর নোট বুক”হাতে নিয়ে পড়তে পড়তে ভাববেন নদীকে মারা আর বাঁচানোর কথা বলার দায় নিয়েই কি আজকের সময়ের নদী জীবী হয়ে ওঠেন?