জলের অপর নাম জীবন। সৃষ্টির ঊষা লগ্নে জল থেকেই উদ্ভিদ ও প্রাণের উদ্ভব হয়েছে। পৃথিবীর তিন ভাগ জল আর এক ভাগ স্থল। সমুদ্র উপকূলে দাঁড়িয়ে আমাদের মনে হয় এত জল! তবে কোনো সমস্যা নেই। যেমন খুশি ব্যবহার করো, অপচয় করো। অথচ বিজ্ঞানীরা বলছেন আগামী কয়েক দশকের মধ্যে জলের জন্য নাকি বিশ্বযুদ্ধ বেঁধে যাবে। মানুষ পানীয় জল না পেয়ে গভীর সংকটের মধ্যে পড়বে।
একটি সহজ সরল হিসাবের দ্বারা জল সমস্যাটা বোঝাবার চেষ্টা করি- ধরা যাক, একটি খেলার মাঠে একশটি বালতিতে জল ভর্তি আছে –এর মধ্যে তিন বালতি জল একপাশে সরিয়ে রাখা হল— যা কি-না ব্যবহারোপযোগী কিন্তু বাকি সাতানব্বই বালতি জল নোনা জল। নোনা জলে না যায় কাপড় কাচা, না যায় চাষের মাঠে দেওয়া, না যায় শিল্পের জন্য ব্যবহার করা, না যায় পান করা। অর্থাৎ সাতানব্বই বালতি জল আমাদের কোনো কাজে লাগল না।
এখন দেখা যাক, তিন বালতি জল কীভাবে ব্যবহৃত হয়? এর মধ্যে দু বালতি জল পানোপযোগী হওয়া সত্ত্বেও উত্তর মেরু ও দক্ষিণ মেরু এবং বিভিন্ন পর্বত শিখরে জমাট বাঁধা বরফের অবস্থায় আছে। আমরা একে ব্যবহার করতে পারি না। তাহলে হাতে রইল এক বালতি ব্যবহার করার মতো পানীয় জল। এই ফলের কিছুটা অংশ মাটির তলায় আছে বাকিটা নদী, খাল, বিল, হ্রদের মধ্যে আছে যেটা আমরা ব্যবহার করতে পারি।
রাষ্ট্রপুঞ্জের এক সমীক্ষায় প্রকাশ ১৯৯০ সালে পৃথিবীর ২৮টি দেশের প্রায় ৩৬ কোটি মানুষ জীবন যাপনের জন্য প্রয়োজনীয় জল পাননি। ২০১৫ সালে যখন পৃথিবীর জনসংখ্যা দাঁড়াবে ৭৫০ কোটি তখন ৪৬ থেকে ৫২টি দেশের প্রায় ৩০০ কোটি মানুষ বাচার জন্য প্রয়োজনীয় জল পাবেন না। পৃথিবীতে প্রায় ১২০ কোটি মানুষ বিশুদ্ধ পানীয় জল পান না। বিশুদ্ধ জলের অভাবে জলবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয় ফলে প্রচুর শ্রমদিবস নষ্ট হয়। জলবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতি বছর ভারতে প্রায় ৭ লক্ষ শিশুর মৃত্যু ঘটে। প্রায় ৪ কোটি ৪০ লক্ষ মানুষ ফ্লোরাইড, আর্সেনিক, লবণতা বা লৌহ কণিকার আধিক্যে দূষণজনিত কারণে অসুস্থ হন।
এবার দেখা যাক ব্যবহারোপযোগী জলের চালচিত্র – ব্যবহারযোগ্য জলের ৬৫-৭০% ব্যবহার হয় কৃষিতে। ২০% এর মতো ব্যবহার হয় শিল্পক্ষেত্রে। উদাহরণস্বরূপ ১ টন ইস্পাত তৈরি করতে ৩০০ টন জলের প্রয়োজন হয়। একটি মোটরগাড়ি তৈরি করতে জল লাগে ৪০০,০০০ লিটার। গৃহস্থালীর কাজে ব্যবহার করা হয় মাত্র শতকরা ১০ ভাগ।
একজন মানুষের প্রতিদিন গড়ে ৫০ লিটার জলের প্রয়োজন হয়। একজন মার্কিন নাগরিক প্রতিদিন প্রায় ৫০০ লিটার জল খরচ করে বা অপচয় যেখানে একজন আফ্রিকান প্রতিদিন মাত্র ২০ লিটার জল পান। আমরা গাঙ্গেয় অববাহিকার মানুষেরা যখন প্রচুর পরিমাণে জল অপচয় করি তখন খরা কবলিত বাঁকুড়া, পুরুলিয়ার মহিলারা দু-তিন ক্রোশ পথ হেঁটে পানীয় জল নিয়ে আসেন।
অতিরিক্ত পরিমাণ জল ব্যবহারের ফলে প্রকৃতিতে আমাদের ব্যবহারযোগ্য জলের ভাণ্ডার কমে আসছে। গত ৫০ বছরে ভূগর্ভস্থ জল তোলার ফলে জলের স্তর নেমে গেছে ৩০ মিটার। উষ্ণায়নের ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য মেরু অঞ্চলের বরফ গলে উপকূল অঞ্চলের নোনা জলের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে এবং মিষ্টি জলের পরিমাণ কমছে। আবার হিমালয়-সহ অন্যান্য পর্বত শিখরে বরফ গলে যাবার জন্য বর্তমানে কিছু নদীতে জলস্ফীতি দেখা দিচ্ছে। তবে অদূর ভবিষ্যতে নদীগুলি বরফ গলা জল না পাবার জন্য শুকিয়ে আসবে, তখন পানীয় জলের প্রয়োজনে চাষের জমিতে জল সবরবাহ কমিয়ে দেওয়া হবে ফলত দেখা দেবে দুর্ভিক্ষ। নষ্ট হবে আমাদের জীব বৈচিত্র্য।
জল সঙ্কটের কারণগুলি পর্যালোচনা করলে আমরা দেখি, আমাদের ব্যবহার্য জলাশয়গুলি যথা নদী, নালা আমরা নানাভাবে দূষিত করে ফেলেছি। চাষের মাঠের রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ধোয়া জল, জলাশয়গুলিকে দূষিত করছে এবং ব্যবহারের অনুপোযোগী করে তুলছে। জার্মানির ‘রাইন’ নদী এতটাই দূষিত হয়ে পড়েছে যে একে ‘Sewer of Europe’ বা ইউরোপের নর্দমা বলা হয়। অন্য দিকে গঙ্গা নদী অববাহিকা অঞ্চলের মানুষেরা ভারতবর্ষের অন্যতম প্রধান নদী গঙ্গাকে দূষিত করে ফেলেছে। এই নদীর জল পরিশোধন করেই আমরা পানীয় জল হিসাবে ব্যবহার করি— কিন্তু ক্রমাগত অতিমাত্রায় দূষণের ফলে এই জল পরিশোধন ব্যয়সাপেক্ষ এবং সময় সাপেক্ষ হয়ে পড়ছে।
পানীয় জলের সরবরাহ ঠিক রাখার জন্য নতুন নতুন জল প্রকল্পের জন্য IMF ও বিশ্ববাঙ্ক থেকে বেশি সুদে ঋণ নিতে হচ্ছে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলি বোতলবন্দী বিশুদ্ধ পানীয় জলের ব্যবসা শুরু করে দিয়েছে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে জল নিয়ে নানা সমস্যা দেখা দিচ্ছে। যেমন ভারত-বাংলাদেশ জলবণ্টন, কাবেরী নদীর জল নিয়েয় কর্ণাটক, তামিলনাড়ুর মধ্যে বিবাদ ইত্যাদি।
এখন প্রশ্ন হল, এই জল সমস্যা তথা জীবন সমস্যা থেকে পরিত্রাণের উপায় কী? প্রথমত, আমাদের জলের অপচয় সম্বন্ধে সচেতন হতে হবে। জল অপচয় রোধ করতে পারলে একদিকে যেমন ভূগর্ভস্থ জলের পরিমাণ বাড়বে আবার অন্যদিকে অর্থও বাঁচবে। আমরা জানি মাটির তলা থেকে ৪০০ লিটার জল পাম্প করে তুলতে মাসে প্রায় ২৫০ টাকা বিদ্যুৎ খরচ হয় অথচ এই জলের শতকরা ৪০
ভাগ অপচয় হয়। এই অপচয় বন্ধ করলে প্রায় ১০০ টাকা এবং দৈনিক ১৫০ লিটার জল বাঁচাতে পারি। বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে চাষের ক্ষেত্রে জলসেচ করলে প্রায় শতকরা ৫০ ভাগ জল বাঁচানো যায়। ইজরায়েল Drip irrigation ব্যবস্থার মাধ্যমে জল অপচয় রোধ করতে অনেকাংশে সমর্থ হয়েছে।
এছাড়া নদী, নালা, পুকুর সংস্কার করে বৃষ্টির জলকে ধরে রেখে চাষের কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। বর্ষার মরশুমে ছাদের বৃষ্টির জল রিজারভারের মধ্যে সঞ্চয় করে গৃহস্থালীর কাজ বাগানের জল দেওয়া চলতে পারে। বর্তমানে আইনের মাধ্যমে বহুতল বাড়িতে এই ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
ঋতু উপযোগী ফসল পর্যায়ক্রমে চাষ করে জলের ব্যবহার কমানো যায়।
এছাড়াও শহরতলীর বর্জ্য জল পরিশোধন করে, এই Brown Water-কে নিকটবর্তী খেত-খামারে শাক-সবজি ও ফল চাষে ব্যবহার করা যায়।
বাথরুমে ব্যবহৃত স্নানের জলকে সংগ্রহ করে বাগানে দেওয়া চলে বা গাড়ি ধোওয়া যায়। কাপড় কাচার জল শৌচাগারে সহজেই ব্যবহার করা যায়।
জল সংকট থেকে মুক্তি পেতে গেলে জল সরবরাহকারী সংস্থা তথা পৌরসভা, পঞ্চায়েতকে সচেতন হতে হবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় সরবরাহকারী পাইপের ত্রুটির জন্য ৪০%-৫০% জলের অপচয় হয়। মনে রাখতে হবে এক সেকেন্ডে এক ফোঁটা জলের অপচয় করা মানে ঘণ্টায় এক লিটার দিনে ২৫ লিটার এবং বছরে ৯০০০ লিটার জলের অপচয় হয়।
পৌরসভা বা পঞ্চায়েতের জল অপচয়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের বিদ্যুৎ খরচও বেড়ে যাচ্ছে যার দায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আমাদের উপরই এসে পড়বে। ফলত আমাদের ব্যয়ভার বৃদ্ধি পাবে। তাই বর্তমান ও পরবর্তী প্রজন্মের পানীয় জলের কথা চিন্তা করে
আসুন আমরা আওয়াজ তুলি-
“জল অপচয় নয়, জল সংরক্ষণ করুন নিজে বাঁচুন এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বাঁচান।”