জাহ্নবী যাত্রা মার্গশীর্ষ ১৪২৯

উত্তরপ্রদেশের রামরাজ। রাস্তা বাঁচানোর জন্য জাতীয় সড়ক ছেড়ে জঙ্গলে শুঁড়িপথে কমবেশি কুড়ি কিলোমিটার চালিয়ে ধুলো আর রোদ্দুরে জেরবার হয়ে পৌঁছেছি মেরঠগামী পথের উপর এই অখ্যাত জনপদে। আর কি আশ্চর্য! যেন আমরা চারজন সাইকেল যাত্রীর জন্যই এই তেপান্তরে ধু ধু ফাঁকা মাঠের মাঝখানে মাটি ফুঁড়ে গজিয়ে উঠেছে একটা পোড়োবাড়ি। তার দেওয়ালে আঁকাবাঁকা হরফে কাঠ কয়লা দিয়ে লেখা ‘ঠান্ডি বিয়ার কি দুকান’। দৈববাণী কিংবা ইস্তেহারের মতোই! চোখে চোখে সম্মতি আদায়ের পর ঘোড়াগুলো আস্তাবলে ঠেলে দিয়ে যে যার আসন নেওয়া গেল। ভরদুপুর। মেরঠ এখনো কমবেশি চল্লিশ কিলোমিটার পথ। ধীরে সুস্থে সাইকেল চালালেও চার ঘন্টার বেশি লাগা উচিত নয়। সুতরাং তাড়া নেই। অবিশ্যি কবেই বা ছিল?

একতলা বাড়িটার গড়ন কোন পরিত্যক্ত সরকারি প্রাথমিক স্কুল কিংবা প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মত।এখন আখচাষের ভরা মরশুম। আসা-যাওয়া করা বেশিরভাগ মানুষ স্থানীয় আখ ক্ষেতের শ্রমিক অথবা রিক্সা বা ভ্যানচালক। এমন জায়গায় যা হয়। টুকরো আলাপচারিতায় ওরা বুঝে নিতে চাইছে আমাদের পরিচয়, সাইকেলের সামনে লাগানো ইংরেজি আর বিশুদ্ধ হিন্দি দাবিগুলোর মর্মার্থ। আমরাও মন দিয়ে দেখছি গায়ের মেটে রং, মাথার গামছা, ভাষার অচেনা শব্দ। এই আদেখলেপনা স্বাভাবিক। আধার কার্ডটুকু বাদ দিলে, আমাদের আর একই দেশে বাস করা হলো কবে?

ঘন্টাখানেক পরে প্রফুল্লচিত্তে আবার চাকা গড়ালো। কিন্তু সামান্য এগোতেই পিছুডাক শুনে থামলাম। মাঝবয়সি দোহারা চেহারার একজন সাইকেল আরোহী পিছন থেকে ইশারায় আমাদের থামতে বললেন। মনে হল একটু আগের আসরের পিছন দিকে একেও দেখেছি। কাছে এসে খানিকটা ইতস্তত করে বললেন, এই পথে আরও বেশ কিছু বীয়ারের দোকান আছে। আমরা যদি সে সব জায়গায় ঢুকি, তবে যেন দয়া করে টি-শার্টগুলো খুলে ব্যাগে ভরে নিই আর সাইকেলগুলো একটু দূরে রাখি। আমরা সমস্বরে জানালাম, আমরা মাতাল নই। আর তাছাড়া গঙ্গা সংরক্ষণের সাথে বীয়ারের সম্পর্কটা কি?

মানুষটার রাগলেন না। কেমন একটা করুণ মুখ করে বললেন, ‘গঙ্গা মাই কি রক্ষা কে লিয়ে আওয়াজ উঠা রহে হো না? প্রভাব পড়তা হ্যায়।’

আমি এঁড়ে তক্কো করতে পারতাম। এইসব ধর্মান্ধরাই দেশটাকে মধ্যযুগে ঠেলে দিচ্ছে। কিন্তু আমার যাবতীয় নাস্তিকতার তত্ত্ব লোকটার স্নেহ আর বিশ্বাসের সামনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। ভরদুপুরে বীয়ারেরই ঘোর হবে, মনে হল মানুষটা আমার নিজেরই দাদা। সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দিয়ে আবার বুঝতে পারলাম এই দেশটার আমি কিচ্ছু চিনি না।

ভারতের স্বাধীনতার প্রথম পর্ব থেকেই এদেশের বড় নদীগুলোর উপর বাঁধনির্মাণ এবং জলবিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরীর একটা হিড়িক ওঠে। আর একুশ শতকে পৌঁছে সেই হিড়িক উন্নয়নের হিস্টিরিয়ায় পরিণত হয়েছে। সভ্যতার বিকাশের এই ভয়াবহ পরিণাম নিয়ে বিভিন্ন পরিসরে বহুবার চর্চা হয়েছে, এমনকি থার্ড প্ল্যানেটের  বিভিন্ন কর্মসূচিতেও এ বিষয়ে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করা হয়েছে। তাই আখ্যানকে অকারণ ভারাক্রান্ত না করে শুধু এইটুকু বলতে পারি যে, বিপুল সরকারি অর্থব্যয়ী এইসব প্রকল্পগুলো থেকে বৃহৎ নির্মাণশিল্পকারী গোষ্ঠীগুলো ছাড়া এ দেশের আর কারো কোনো উপকার হয়নি।  বরং নদীগুলির বাস্তুতন্ত্রের এবং  নদীনির্ভর প্রান্তিক মানুষের জীবন জীবিকার সর্বনাশ হয়েছে। গঙ্গার উচ্চ অববাহিকায় ২০০৬ সালে নির্মিত তেহরি বাঁধ প্রকল্প তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ।

আর এর ঠিক বিপরীতে এক উজ্জ্বল আলোর রেখা হরিদ্বারের মাতৃসদন আশ্রমের সন্ন্যাসীদের ধারাবাহিক আন্দোলন, যা শুরু হয়েছিল আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে। ১৯৯৮ সালের সেই মার্চ মাসে স্বামী গোকুলানন্দ সরস্বতী এবং  স্বামী নিগমানন্দ সরস্বতীর অনশন সত্যাগ্রহ থেকে তাঁদের সংকল্পের সূচনা। সেদিন থেকে আজ অবধি গঙ্গা নদী এবং হিমালয়ের প্রকৃতি রক্ষায় আইন প্রণয়নের দাবিতে এই আশ্রমের বিভিন্ন সন্ন্যাসী সাতষট্টি বার অনশন করেছেন। বিভিন্ন পর্যায়ে প্রাণ হারিয়েছেন পাঁচজন সন্ন্যাসী। আজও তাদের সেই সংকল্প এগিয়ে নিয়ে চলেছেন স্বামী আত্মবোধানন্দজীর মত সন্ন্যাসীরা।স্বাভাবিকভাবেই তাদের এই ধারাবাহিক আন্দোলন রাষ্ট্রের সাথে একটা বৃহত্তর সংঘাতের রূপ নিয়েছে।

আমরা ‘থার্ড প্ল্যানেটে’র সদস্যরা বেশ কিছুদিন ধরেই এই আন্দোলনের সহমর্মিতায় সক্রিয় অংশগ্রহণের পরিকল্পনা করছিলাম। সমবেত সিদ্ধান্ত হলো, এই আন্দোলনের জনমুখী প্রচার করতে অনিমেষ, বিশ্বজিৎ, মাজিদুল এবং আমি এই চারজন মাতৃসদন আশ্রম থেকে সাইকেল চালিয়ে নতুন দিল্লির নদী ও জলসম্পদ মন্ত্রক পর্যন্ত যাব এবং একটি স্বাক্ষরিত আবেদনপত্র পেশ করব। চলার পথে যে সমস্ত জনপদ পড়বে সেই সব জায়গার মানুষকে আমরা এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানাবো এবং তাদের মতামতও জানবো। ২৩০ কিলোমিটার সাইকেলের যাত্রাপথের জন্য আমরা সময় ধার্য করলাম তিন দিন। এবং কলকাতা থেকে রওনা দেওয়ার দিন স্থির হলো ২রা ডিসেম্বর।

২রা ডিসেম্বর দিনটিকে আমরা বেছেছিলাম সচেতন ভাবেই। আজ  গোটা দেশজুড়ে নদী পাহাড় জঙ্গলের উপরে যে কর্পোরেট লুঠতরাজ চলছে, এই দেশ প্রথমবার তার ভয়াবহ পরিনাম দেখেছিল ১৯৮৪ সালের ২রা ডিসেম্বর মধ্যরাতে ভূপাল গ্যাস দুর্ঘটনায়। ইউনিয়ন কার্বাইড ইন্ডিয়া লিমিটেডের সেই দুর্ঘটনায় সরকারি হিসেবেই মারা গিয়েছিলেন পনেরো হাজারেরও বেশি মানুষ। বেসরকারি মতে সংখ্যাটা আরো অনেক বেশি। আজ প্রায় চার দশক পেরিয়েও মৃত পরিবারগুলির উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ নিয়ে টালবাহানা এখনো চলছে উচ্চতম আদালতে। আমরা আর কিছু যদি নাও করতে পারি, এদেশের মানুষখেকো কর্পোরেট শিল্পের সেই খুনী রাতটাকে অন্তত মনে করিয়ে দিতে চাই বারবার।

আমাদের অন্য যে কোনো সাইকেল যাত্রার তুলনায় এবারের প্রস্তুতিটা অন্যরকম ছিল। একে তো পশ্চিমবঙ্গের বাইরে, তার উপরে উত্তরাখন্ড, উত্তরপ্রদেশ এবং দিল্লি তিনটি আলাদা আলাদা রাজ্যের ভেতর দিয়ে সাইকেল যাত্রা এবং  ‘বিকাশ’ বিরোধী প্রচার চালানোয় প্রশাসনিক জটিলতার আশঙ্কা করছিলাম আমরা। সেই মতো চিঠিপত্র দিয়ে আইনি সুরক্ষা তৈরির চেষ্টাও করছিলাম আমরা। কিন্তু যেকোনো কারণেই হোক, সর্বশক্তিমান ভারত রাষ্ট্র আমাদের মতো চারটি নগণ্য পোলাপানকে অকারণ গুরুত্ব দিয়ে নিজেদের সময় নষ্ট না করায় আমরা বেঁচে গেলাম। জাতীয় স্তরে সুপরিচিত নদী কর্মী তাপস দাস দায়িত্ব নিয়ে সর্বভারতীয় স্তরে যে সমস্ত পরিবেশ এবং নদীকর্মীরা দীর্ঘ আন্দোলন গড়ে তুলেছেন, তাদের কয়েকজনের সাথে আমাদের  যোগাযোগ  করালেন। মূলত তাপসদার উদ্যোগে ‘নদী বাঁচাও জীবন বাঁচাও আন্দোলন’ আমাদের এই কর্মসূচিতে সক্রিয়ভাবে শামিল হলো। একথা স্বীকার করতেই হবে যে, অনেক মানুষের সক্রিয় সহযোগিতা ছাড়া  মাত্র আমাদের চারজনের পক্ষে এত বড় একটা কর্মসূচী রূপায়ণ করা শুধু কঠিন নয়, অসম্ভবই ছিল।

পরিকল্পনা অনুসারে, মূলপর্বের চার দিন আগে  ২৮ তারিখ রওনা দিয়ে ২৯ শে নভেম্বর আমি হরিদ্বারে মাতৃসদন আশ্রমে পৌঁছলাম। সেই প্রথম মুখোমুখি সাক্ষাৎ হলো স্বামী আত্মবোধানন্দজীর সঙ্গে। এত শান্ত এবং শীর্ণকায় একটি তরুণ সমগ্র অসাধু আমলা এবং নদী খাদান মাফিয়া লবির আঁতাতকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে ভেবে বেশ অবাকই হলাম। আশ্রম শব্দটা শুনলেই আমাদের মাথার ভেতরে যে ছবি ভেসে ওঠে, তার সাথে মাতৃসদনের কিছু চরিত্রগত ফারাক আছে। এখানকার আবাসিকরা যতটা সন্ন্যাসী তার চেয়ে অনেক বেশি আশ্রমিক বলে মনে হতে পারে। আমার দেখা আর পাঁচজন সন্ন্যাসীর মতো দিনের বেশিরভাগটা নিষ্ক্রিয় উপাসনা আর পূজার্চনায় এখানে দিন কাটে না। বরং  চাষবাস থেকে পশুপালন এবং লেখাপড়া থেকে চিকিৎসা — অত্যন্ত সক্রিয় এবং স্বনির্ভর যে জীবনযাত্রা এখানে চলে, নগর জীবনে বসে তাকে আন্দাজ করাও কঠিন।

হরিদ্বারের দিনগুলো নিয়ে নাহয় অন্যত্র কথা বলা যাবে, কারণ এই যাত্রা পথের অন্যান্য সাইকেল আরোহীরা ইতিমধ্যে কলকাতা থেকে সাইকেলগুলো ট্রেনে চাপিয়ে ৩রা ডিসেম্বর হাজির হয়েছে মাতৃসদন আশ্রমে। আগের দিন অর্থাৎ ২রা ডিসেম্বর এই যাত্রার আনুষ্ঠানিক সূচনায় তারা মহেশতলা থেকে হাওড়া স্টেশন পর্যন্ত কলকাতা শহরের ভিতরেই একটি ছোটখাটো সাইকেল পরিক্রমা সেরে নিয়েছেন। এই পর্বে তাদের সঙ্গ দিয়েছেন দুর্বার কলম পত্রিকার সম্পাদক অমর নস্কর ও সরোজ মন্ডলের মতো মানবাধিকার কর্মীরা।

৪ঠা ডিসেম্বর রবিবার সকালে সমস্ত আশ্রমিকদের আশীর্বাদ এবং শুভেচ্ছা নিয়ে আমরা পথে নামলাম। পথ চলতি মানুষকে আমাদের এই সাইকেল র‍্যালির উদ্দেশ্য জানাতে আমরা হাজার খানেক লিফলেট তৈরি করেছিলাম। একদিকে হিন্দি, অপর দিকে ইংরেজি বয়ান। আমাদের প্রচার শুরু হল হরিদ্বার শহর থেকেই। এইসব সময়ে বিচিত্র জনসমাবেশ আর বহুবর্ণ মতামত শুনতে শুনতে আমার বারবার মনে হয় ‘পথের ভিখারী’ একটা অত্যন্ত অর্থহীন শব্দবন্ধ। একমাত্র পথই আমাকে কখনো ভিখারী হতে দেয় না। আমার প্রাচুর্য পথেই।

ঘন্টা দুয়েকে নুরপুর পঞ্জাহ্নেদি, জিয়াপোতা পেরিয়ে ফেরুপুরে এসে একগ্লাস চায়ে গলা ভেজানো গেল। উত্তর পশ্চিম ভারতে এখন আখ চাষের ভরা মরশুম। ফসল কাটা, ঝাড়াই বাছাই চলছে পথের দু’ধারে সর্বত্র। রাস্তায় আখ বোঝাই ট্রাক্টরের সারি আর ট্রাক্টরের এফএম এ ফরমায়েশি পাঞ্জাবি গান– কারুর কোন তাড়া নেই। আশপাশ থেকে ভেসে আসা গুড় জ্বাল দেওয়ার ধোঁয়ার সাথে রাস্তার গাড়ির চাকায় থেঁতলে গিয়ে গেঁজিয়ে ওঠা আখের রসের গন্ধ বাতাসে মিশে আমাদের বিপাক হার বাড়িয়ে তুলেছে। আমরা আরো জোরে জোরে প্যাডেল করছি।

নাসিরপুর কালান পেরিয়ে সামান্যই এগিয়েছি। পরের গ্রাম দরগাহপুর তখনো প্রায় আট দশ কিলোমিটার দূরে। অনিমেষ আর বিশ্বজিৎ চুম্বকের টানে লোহার মত রাস্তার বাঁদিকে একটা গুড়জ্বাল দেওয়ার কারখানায় সাইকেলগুলো ঢুকিয়ে দিল। অগত্যা আমি আর মাজিদুলও পিছু নিলাম। গুড় জ্বাল দেওয়ার বিজ্ঞান নিয়ে আমাদের অসম্ভব কৌতূহল দেখে এবং ‘সাইকেল পে দিল্লি’ যাচ্ছি শুনে বয়স্ক কারিগরটি খানিকটা দয়া পরবশ হয়েই কেজিখানেক গুড় দিয়ে দিলেন। সেটা বাকি পথে আমাদের বহুবার কাজে লেগেছে। ওই যে বললাম, পথেই আমাদের প্রাচুর্য।

রায়সি মোড় থেকে ডান দিক নিয়ে রঘুনাথপুর উর্ফ বালাওয়ালি পৌঁছতে প্রায় তিনটে বেজে গেল।এতক্ষণে প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে এসেছি। পেটে আগুন জ্বলছে।  শহর নয়, ছোটখাটো জনবসতি। মুদিখানা বা অন্যান্য ছোটখাট দোকানপাট থাকলেও ভরদুপুরে খাবার মতো হোটেল প্রায় নেই বললেই চলে। তারই মধ্যে পথের ধারে ছোটো একটা ধাবার মতো খাবার দোকান দেখে চারজনে আছড়ে পড়লাম। রুটি, ভাত, রাজমা ডাল আর ফুলকপির তরকারি জুটে গেল। আলাদা করে দোকানে কোন কর্মচারী নেই, এই দোকানেরই লাগোয়া ঝুপড়িতে বসবাসকারী দম্পতি এবং তাদের মেয়েটি হাতে হাতে কাজ চালিয়ে নেয়। এই দুপুরে তেমন কোনও গ্রাহক নেই, আর সেটাই স্বাভাবিক। ভারতের গ্রামাঞ্চলে দুপুরে-রাতে পয়সা খরচ করে হোটেলে খাবার রেওয়াজ নেই,  ইন্ডিয়ান কসমোপলিটন সিটিগুলোর মতো। আমাদের আচমকা উপস্থিতিতে তাদের অলস দুপুর কিছুটা ত্রস্ত হয়ে উঠল বটে, তবে সেটুকু তারা সহজেই হাসিমুখে সামলে নিল।

কিন্তু এত গুরুত্বপূর্ণ একটা আন্তরাজ্য সড়কে সেই ভাবে মালবাহী বা যাত্রীবাহী গাড়ি নেই কেন? যদিও আমরা হরিদ্বার থেকেই মির্জাপুর হয়ে বিজনৌরগামী মূল রাস্তাটির বদলে গঙ্গার পশ্চিম তীর বরাবর বিকল্প রাস্তাটি নিয়েছি, তবুও এটাতো আন্তরাজ্য সড়ক। কথাবার্তায় জানা গেল সামনে রাস্তার অবস্থা বেহাল।

এখনো অনেকটা পথ বাকি, সুতরাং প্যান্ডেলে চাপ পড়ল দ্রুত। মাত্র কয়েক কিলোমিটার এগোতেই বিস্তৃত গঙ্গার উপর পুল। এপারটা উত্তরাখণ্ড, গঙ্গার অপর তীরে উত্তর প্রদেশ। বিকেলের পড়ন্ত আলোয় পুলের উপরে বেশ কিছু ছবি তোলা হলো।

তারপর নদী পেরিয়ে বোঝা গেল বেহাল রাস্তা কাকে বলে! এদেশের বেশিরভাগ রাজ্যের সীমানাতেই সড়ক গুলির অবস্থা কমবেশি খারাপ, কিন্তু এখানে রাস্তা প্রায় নেই বললেই চলে। কোথাও চালিয়ে, কোথাও হাঁটিয়ে কোথাও বা সাইকেল ঘাড়ে করে অনেকটা এগোনোর পর একটা চলনসই রাস্তা পাওয়া গেল। দৌলতপুর মোড়ে এসে যখন আমরা মূল রাস্তায় পড়লাম ততক্ষণে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। তখনো প্রায় পঁচিশ কিলোমিটার পথ বাকি। অন্ধকার নির্জন রাস্তায় মান্ডওয়াড়, সরাই মুবারক, জামালপুর পাঠানী পেরিয়ে যখন বিজনৌরে পা দিলাম শহরে তখন রাত নেমেছে। এখানে আয়োজকরা আমাদের রাতের মাথা গোঁজার ব্যবস্থা করেছিলেন ‘রজত রেসিডেন্সি’ হোটেলে। এত অভিজাত পরিবেশে থাকার অভ্যাস আমাদের নেই। কিন্তু প্রচণ্ড ক্লান্তিতে সেই অস্বস্তিটুকুও মুছে যাচ্ছিল।

‘গঙ্গা বাঁচাও সাইকেল র‍্যালি ২০২২’ নামে আমাদের এই সাইকেল যাত্রার ঘোষিত উদ্দেশ্য গঙ্গার সংরক্ষণ এবং উচ্চ অববাহিকায় জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের বিরোধিতা। কিন্তু এ কথা আমরা নির্দ্বিধায় স্বীকার করি যে, জঙ্গল নিধন থেকে খনি মাফিয়া আর বড় বাঁধ প্রকল্প থেকে রাসায়নিক শিল্পের দূষণ — সবকটি আসলে পরস্পর অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। এবং এর প্রধান কারণ দুটি-

১) কর্পোরেট আগ্রাসন এবং ২)ভোগবাদী নগরায়ন। যা আদতে একই  মুদ্রার দুই পিঠ। তাই এদেশে যারাই এসবের বিরোধিতা করছেন অথবা আন্দোলনগুলির দিকে ন্যূনতম সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন তাদের কাজের ধরন সম্পর্কে প্রাথমিক পরিচিতিটুকু আমাদের কাছে একান্ত জরুরী।

বিজনৌরে সাইকেল যাত্রীদের দেখভাল এবং পরামর্শের দায়িত্ব নিয়েছিলেন ডক্টর রণসিং আরিয়া এবং মহারাজ সিং। এরা বিজনৌরে ‘জীবন বিদ্যা পরিচয়’ নামে একটি সংগঠন চালান। তাদের সংস্থা অসংখ্য অবসাদগ্রস্ত বয়স্ক মানুষ এবং শিশুদের মানসিক ও সামাজিক সহায়তা দিয়ে থাকে। পরদিন সকালে চায়ের আলাপচারিতায় মহারাজ সিং যথার্থই বলছিলেন, নদী বা পরিবেশ দূষণ আসলে ভোগবাদী এবং ব্যক্তিকেন্দ্রিক নাগরিক দূষণেরই পরিণাম।

আজ আমাদের যেতে হবে মেরঠ বা মীরাট, কমবেশি পঁচাত্তর কিলোমিটার পথ পেরিয়ে। তাই সকাল সকাল শুরু করতে হবে। স্থানীয় বন্ধুদের সাথে নিয়ে শহরের বাসস্ট্যান্ড চত্বরেই বেশ কিছুক্ষণ প্রচারপত্র বিলি করা হলো। তারপর চাকা গড়ালো মেরঠের পথে। একটা অসাধারণ বিষয়ে এখানে উল্লেখ না করলেই নয়। এতো ছোটো একটা শহরে বেশ কয়েক জায়গায় জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য কয়েকটি করে বাইসাইকেল রাখা আছে। প্রয়োজন মতো ব্যবহার করে আবার নির্দিষ্ট স্ট্যান্ডে ফিরিয়ে দিলেই হল। সাইকেল ব্যবহারের সচেতনতা বাড়ানোর জন্য এতো ছোটো শহরে এতো ভাল উদ্যোগ আমরা অন্তত আগে দেখিনি। সুতরাং আহ্লাদে বেশ কিছু ছবি তোলা হলো সাইকেল আর নিজেদেরও।

শহর ছেড়ে ঘন্টাখানেক এগোতেই দেখা মিললো গঙ্গার উপর বিশাল ব্যারেজ। ভারতের পঞ্চম প্রধানমন্ত্রী চৌধুরী চরণ সিং-এর নামাঙ্কিত।

গঙ্গা পেরিয়ে কসমপুর খোলার কাছে আমরা ৭০৯নং জাতীয় সড়ক ছেড়ে দিয়ে গঙ্গার ক্যানেল বরাবর জঙ্গলের রাস্তায় ঢুকে পড়লাম। পিছনে পড়ে রইল মিরণপুর হয়ে মেরঠ যাওয়ার ব্যস্ত জাতীয় সড়ক। জঙ্গলের শুঁড়িপথে দশ মিনিট চালাতেই বুঝতে পারলাম নৈঃশব্দ্য কোনো অলৌকিক বস্তু নয়, তার পার্থিব অস্তিত্ব আছে। একান্ত নির্জন, পাণ্ডববর্জিত এই জঙ্গুলে শুঁড়িপথটুকুর ছবি আজীবন স্মৃতিতে থাকবে। এ পথের শেষ প্রান্তের জনপদ রামরাজ, যেখানকার কথা দিয়ে এই লেখা শুরু হয়েছে।

বেসুমা, ঝুনঝুনি পেরিয়ে মওয়ানা খুর্দ পৌঁছতে বিকেল হয়ে গেল। সারাদিনে পঞ্চাশ কিলোমিটারের বেশি পথ পেরিয়ে এসেছি। এখনো আরো প্রায় দু’ঘণ্টার পথ বাকি। শীতের বেলা,  তাড়াতাড়ি অন্ধকার নেমে আসবে। কিন্তু ঘোড়া ছোটানোর উপায় নেই। আর কিছু নয়, প্রতিদিনই এই সময়টাতে আমাদের ভয়ানক খিদে পায়। মেলট্রেনের লেভেল ক্রসিং পেরিয়ে রাস্তার পাশের একটা ধাবা থেকে খান তিনেক রুটি সবজি ঠেসে নিয়ে আবার পথচলা শুরু। প্রসঙ্গত,  উত্তর ভারতের গ্রামেগঞ্জে বাংলার মতো এতো সহজে আমিষ খাবার পাওয়া যায় না। অবিশ্যি তা নিয়ে আমাদের বিশেষ কোনো হেলদোলও নেই। মসুরি থেকে মুজফ্ফরনগর সৈনী হয়ে মেরঠ শহরে ঢুকতে ঢুকতে ঝুপ করে সন্ধ্যে নেমে গেল।

সিপাহী বিদ্রোহের শহর মেরঠ। ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের শহর। ইতিহাস এখানে সরু আর ঝুপসি গলিতে আটকে থাকে, বটগাছের অন্ধকারে ঝুলে থাকা বাদুড়ের মতো। অবিশ্যি আজকাল একটা যারপরনাই তোড়জোড় চলছে সমস্ত পুরনো ধুলোমাখা ইতিহাস ঝেড়েমুছে চকচকে আর নতুন করে লেখার। বড় বড় ফ্লাইওভার আর ভিনগ্রহী শপিং মল বিকাশের চরম করে ছেড়েছে। তবু তারই ফাঁক দিয়ে সাইকেল চালাতে চালাতে আড়চোখে দেখে নেওয়া যায় সিপাহী বিদ্রোহের স্মৃতিস্তম্ভ থেকে পুরনো রেলস্টেশন।

আমাদের আজ রাতের আস্তানা শহরের সতীগঞ্জ রোডে কুরাণ-শেখ-উল হিন্দ-একাডেমী মাদ্রাসা।

এখানে আমাদের দায়িত্ব নিয়েছেন মাদ্রাসা পরিচালন কমিটির সদস্য নবীন কুরেশি, মওলানা জাহিদ এবং মওলানা আখলাক। অভূতপূর্ব আপ্যায়ন আর আন্তরিক আতিথেয়তায়, সত্যি বলতে কি, আমরা ঠিক বুঝতেই পারছিলাম না আমাদের কি প্রতিক্রিয়া হওয়া উচিত। পারস্পরিক প্রাথমিক আলাপ মিটতে না মিটতেই রাতের খাবার চলে এলো। প্রায় পাঁচদিন পরে আমিষ জুটেছে। সুতরাং পাখির মাংস থেকে পশুর মাংস– বাদ গেলো না কোনো কিছুই। আর তাদের স্বাদ, গন্ধ এবং রন্ধনশৈলী নিয়ে একটা আলাদা উপাখ্যান লেখাই যায়।

এখানে প্রায় তিরিশটি আবাসিক ছাত্র আছে। বয়সে বেশিরভাগই শিশু, দু’একজন কিশোর। খাওয়ার পরে তাদের সাথেই গোল হয়ে আড্ডায় বসা গেল। ছোটদের চরম কৌতূহল আমাদের নিয়ে। আমরাও ধীরেসুস্থে নিজেদের কথা বলছিলাম। এক সময় জিজ্ঞেস করলাম বড় হয়ে কে কি হতে চায়। বেশিরভাগ বাচ্চাই বললো বড় হয়ে ‘অফসর’ হবে‌। বাবা-মার কথা জিজ্ঞেস করায় জানা গেলো, অধিকাংশের পরিবারই ‘ক্ষেতি’ করে। আমি জিজ্ঞেস করলাম ক্ষেতির চেয়ে অফসরী ভালো কেন? বাবামার ইচ্ছে বেয়ে, একটু ভালো রোজগার বেয়ে, গ্রামের মজে যাওয়া পুকুর বেয়ে সেই কথা গড়ালো অনেক দূর। কথার সূত্রে এক সময় বললাম, আমাদের চারপাশের পরিবেশকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব আমাদেরই। মনে রাখা দরকার পৃথিবীটা মানুষের একার নয়,বরং বিবর্তনের রাস্তায় মানুষ সবার শেষে এসে অন্যায়ভাবে পৃথিবীর বেশিরভাগটা দখল করে নিয়েছে। হঠাৎ দেখলাম কিশোরদের চোখে কৌতুহল আর উপস্থিত শিক্ষকদের চোখেমুখে অস্বস্তি। মনে পড়লো নো এন্ট্রিতে ঢুকে পড়েছি। প্রায় সব ধর্মীয় পাঠক্রমেই বিবর্তনবাদ নিষিদ্ধ ফল। কি করে এই অস্বস্তির হাত থেকে বাঁচবো ভাবছি, এবং কিছুই করতে হলো না। খুবই দ্রুত ওনারা অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলেন, যেন আমার আগের কথাগুলো শুনতেই পাননি। স্বাভাবিক অসহিষ্ণুতার এই পৃথিবীতে সহাবস্থানের এই সৌজন্যটুকু আমাকে কৃতজ্ঞ করলো। এ যেন চলতি বাসে সামান্য সরে বসে অপরকে বসার সুযোগ করে দেওয়া। রাতে শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম, আমাদের মধ্যেকার এই দূরত্ব অনড় থাকবে। কিন্তু তাতে হাত ধরার চেষ্টাটুকু বিফলে যাবে না।

আজ আমাদের শেষ দিনের রাস্তা সবচেয়ে দীর্ঘ, আশি কিলোমিটারেরও বেশি। সকাল সকাল রওনা দেওয়া জরুরী, কিন্তু নীহারি-পায়া-কিমা কবে মানুষের তাড়া বুঝেছে? বাকি আতিথ্যটুকু পরের বারের জন্য মুলতুবী রেখে কোনো রকমে নিস্তার পাওয়া গেল।

আজকের পথে জঙ্গল আর চাষের ক্ষেত অনেক কম। আমরা ভারতের রাজধানী বলয়ে ঢুকে পড়েছি। ঘন্টা দু’য়েকে মহিউদ্দিনপুর পেরিয়ে মোদিনগরে চায়ের বিরতি। দ্রুতগামী রেল আর মসৃণ ফ্লাইওভারে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে নেওয়ার তোড়জোড় চলছে রাজধানীর আশেপাশের নগর বলয়কে। যেন কোথাও এতটুকু ফাঁক না থাকে। দশ কিলোমিটার দূরে মুরাদনগর। কাছাকাছি পৌঁছতেই গুগুল ম্যাপে ‘ছোটা হরিদ্বার’ নামে একটা আজব কিছু দেখালো। ব্যাপারটা কি? আশেপাশে তো গঙ্গার নামগন্ধ নেই, সেই বিজনৌর থেকেই গঙ্গা পূর্ববাহিনী, আর আমরা পশ্চিমে চলতে চলতে এখন প্রায় যমুনা অববাহিকা অঞ্চলে। এই গল্পে হরিদ্বারটা এলো কোথা থেকে? কাছে গিয়ে ব্যাপারটা বোঝা গেল। আপার গঙ্গা ক্যানেলের যে জলধারাটা মুরাদনগরের ভেতর দিয়ে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে , স্থানীয় মানুষ তার পাড়েই নিজেদের হরিদ্বার গড়ে নিয়েছে। অল্প কয়েক গাছা মন্দির, হাতেগোনা দোকানপাট, ভিখারী, যাযাবর বেদেদের ছাউনি আর দেহাতি মানুষের খুঁটিনাটি — এই নিয়েই ঈশ্বরের গৃহস্থলী।

শুধু দৈনন্দিনতায় নয়, এদেশের যেকোনো সংস্কারে একটি নদীর উজ্জ্বল উপস্থিতি রয়েছে। সেটাই এই প্রাচীন সভ্যতার নদীমাতৃক হয়ে ওঠার প্রধান কারণ। তাই এদেশের যেকোনো জল প্রবাহিনীই গঙ্গা। কিন্তু বিশ্বায়নের একটা নতুন আপদ এই যে, আজন্ম সরল বিশ্বাসের এই গর্ত দিয়েই আমাদের যৌথখামারে ইদানিং কর্পোরেটের শেয়াল ঢুকেছে। সুতরাং যারা মনে করেন আমরা ‘ঘরের খেয়ে বনের মোষ’ তাড়াচ্ছি, তারা আসলে আমাদের অভীষ্ট জন্তুর স্বরূপটাই চেনেন নি।

গাজিয়াবাদ পৌঁছতে দুপুর গড়িয়ে গেল। আমাদের আজ রাতের আস্তানা দিল্লির জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয় অঞ্চলে ‘সব কা ঘর’ এখনো তিরিশ কিলোমিটারের বেশি রাস্তা। জালের মত ফ্লাইওভার আর অসংখ্য ওয়ান ওয়ে ধরে এই বর্ণহীন রাস্তাটুকু পার করতে আমরা সবচেয়ে বেশি ক্লান্ত হয়েছি। সন্ধ্যে পার করে ভালোয় ভালোয় যাত্রা শেষের স্বস্তি বুকে পৌঁছালাম ‘সব কা ঘরে’।

১৯২৯ সাল নাগাদ অবিভক্ত ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে খান আব্দুল গাফফার খানের নেতৃত্বে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে পশতুন জনজাতির একটি অহিংস আন্দোলন গড়ে ওঠে। ‘খুদাই খিদমতগার’ নামক সেই সংগঠন সর্বভারতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসকে সমর্থন করতো। আট দশক পেরিয়ে এসে মেরঠের রাজনৈতিক কর্মী ফয়জল খানের নেতৃত্বে আবার সংগঠিত হয়ে উঠেছে ‘খুদাই খিদমতগার’। দিল্লিতে তাঁরাই ছিলেন আমাদের সহযোগী সংগঠন এবং ‘সব কা ঘর’ তাঁদেরই একটি মানবিক উদ্যোগ। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরিবেশকর্মী, আইন ও সমাজবিদ্যার ছাত্ররা এখানে বিনাব্যয়ে আবাসিক থাকেন এবং স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে থাকেন।

রাতে খাওয়ার সময় পরিচয় হলো তাদেরই দু’একজনের সাথে। দক্ষিণ ভারত থেকে আসা আইনের ছাত্র ভারত অথবা হরিয়ানার মানবাধিকার কর্মী কৃপাল সিং প্রত্যেকেই নিজের নিজের আদর্শে অবিচল এবং সক্রিয়। অন্ধকার শাইনিং এর দিকে দৌড়াচ্ছে যে অমানুষিক ডিজিটাল ইন্ডিয়া, এরা তার বিপরীতে এক একটা আলোর ফুলকি।

পরদিন ৭ই ডিসেম্বর জাতীয় পরিবেশ দপ্তর এবং জল সম্পদ মন্ত্রকে আমাদের ডেপুটেশনের পর, রাজীব গান্ধী ফাউন্ডেশন এই সাইকেল যাত্রার প্রচার ও সমর্থন জ্ঞাপনে আয়োজন করেছিল একটি আলোচনা চক্রের। আয়োজকরা ছাড়াও এই সভায় উপস্থিত ছিলেন খুদাই খিদমতগারের সদস্যরা, বেশ কিছু মানবাধিকার এবং পরিবেশ কর্মী। অভিজ্ঞতা এবং মতবিনিময়ের সময় আমরা স্পষ্ট করে জানালাম, মানব সভ্যতার আদিপর্ব থেকে প্রকৃতিকে সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করাই আজকের পরিবেশ সংকটের মূল কারণ। এদেশে পাহাড়-নদী-জঙ্গলকে কর্পোরেটের হাতে বেচে দেওয়ার রেওয়াজ চরমে উঠেছে বিশ্বায়নের পর থেকেই। তাই আজ জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিক পুঁজি দেশটাকে নিজেদের মুনাফার খনি বানাতে মরিয়া হয়ে উঠলে, অবাক হওয়াটা আমাদের ভন্ডামি হবে। সুতরাং শুধু সরকার বদল নয়, ভাবনার বদলই আমাদের বাঁচাতে পারে।

সেমিনারের পর সাইকেলগুলো নিয়ে দিল্লি শহর চষতে বেরোলাম চারজনে। একটা কথা এই প্রসঙ্গে না বললেই নয়। দিল্লির রাজপথে সাইকেল চালানো আমাদের কাছে এক অনন্য সাধারণ অভিজ্ঞতা। সংসদ মার্গ থেকে লোধি রোড হোক, কিংবা  রাজীব চক থেকে আকাশবাণী– কোথাও সাইকেলের উপর কোন নিষেধাজ্ঞা নেই। পথচারী বা গাড়ির চালকরাও দেখলাম সাইকেল আরোহীদের হাসিমুখেই মেনে নিয়েছেন এবং তাতে বিশেষ যানজটও হচ্ছে না কোথাও। ভারতের রাজধানী শহরটি এতখানি সাইকেল বান্ধব হবে আন্দাজ করিনি। আর ২০২৩ সালের ‘চারিদিকে উন্নয়ন’শীল কলকাতায় বসে এমনটা তো আমরা ভাবতেও পারি না।

সন্ধ্যা নাগাদ ক্লান্ত চাকায় এসে পড়লাম হযরত নিজামুদ্দিনের দরগায়। ইতিউতি কাওয়ালী আর গুলালের ঘোর আমাদের আক্ষরিক অর্থেই দু’দণ্ড শান্তি দিয়েছিল। মাঝরাতে ফিরে এলাম ঘুমানোর আস্তানায়। পরদিন সাইকেলগুলো পূর্বা এক্সপ্রেসের ভেন্ডারে চাপিয়ে একছুটে কলকাতা।

তবুও শেষের পরে কিছু থেকে যায়।

এই লেখার সারা শরীরে আমি অসংখ্য অখ্যাত ছোট জনপদের নাম উল্লেখ করেছি। সেটা শুধু এই লেখাটির আয়তন বৃদ্ধি করা বা লেখাটিকে প্রামাণ্য করে তোলার জন্য নয়। ইরানের কিংবদন্তি চলচ্চিত্র পরিচালক আব্বাস কিয়েরোস্তামি তার কালজয়ী  সিনেমা ‘হোয়ার ইজ মাই ফ্রেন্ডস হাউস'(১৯৮৭) এ একটি শিশুর পাশের গ্রামে বন্ধুর বাড়ি থেকে হোমটাস্কের খাতা ফেরত আনতে যাওয়ার অবিস্মরণীয় যাত্রাপথ দেখিয়েছিলেন। সেই বিরাট ল্যান্ডস্কেপ আর ক্যামেরার পথ চলা আমাকে সম্মোহিত আর বিশ্বাসী করে তুলেছিল। ১৯৯০ সালের ইরানের ভূমিকম্পে কোকার শহর, যেখানে এই সিনেমা চলচ্চিত্রায়িত হয়েছিল, সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়ে যায়। হারিয়ে যাওয়া জনপদ আর শিশুদের খোঁজে এরপর ফেলে আসা পথে এক মরমী চলচ্চিত্রকারের বিপরীত যাত্রা শুরু হয়। ‘অ্যান্ড লাইফ গোস অন‘(জিন্দেগী ভা দিগর হিচ) নামে ১৯৯২ সালের সেই সিনেমা আমার কাছে আসলে ঘরে ফেরার গল্প।

আজ যখন দেশজুড়ে ঝাঁ চকচকে নতুন ইতিহাস লেখার হিড়িক, আজ যখন নিজেদের গা থেকে ‘ফৈজাবাদ’ আর ‘এলাহাবাদে’র ধুলো ঝেড়ে মাথা তুলছে অযোধ্যা আর প্রয়াগরাজ, ‘মুঘলসরাই’  তলিয়ে যাচ্ছে দীনদয়ালে, তখন এই একগুঁয়ে স্বদেশ আমার কাছে ক্রমেই অচেনা ঠেকছে।

উন্নয়ন আর প্রগতির  মহামারী শেষ হলে একদিন যখন আমাকে ঘরে ফিরতে হবে, হারিয়ে যাওয়া অখ্যাত নামগুলো জুড়ে জুড়েই আমাকে স্বদেশের মানচিত্র তৈরি করতে হবে।

আরও পড়ুন – কুন্দেশ-সন্ধান