নদী ইস্তেহার

নদী বাঁচাও জীবন বাঁচাও এর আহ্বানে

জল যেমন জীবন’ তেমন ‘জলই মরণ’ – এই মৃত্যু বন্যার জলে ডুবে নয়। বিজ্ঞানীদের ধারণা এবার পানীয় জলের জন্য যুদ্ধে কোটি কোটি মানুষ মারা যাবে। তার সঙ্গে আছে জলদূষণ যা পৃথিবীর সমস্ত জীব জগতের জন্য সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত। পৃথিবীর তিন ভাগ জল হলেও বিশুদ্ধ জল সংকটে ভুগছেন ৮০টি দেশের ১১০ কোটি মানুষ। মনে রাখতে হবে পৃথিবীর জলরাশির ৯৭.২ শতাংশ সমুদ্রের লবণাক্ত জল। বাকি জলের২.১৫ শতাংশ বরফের আকারে জমাটবদ্ধ। বাকি ০.৬৫ শতাংশ জল পানযোগ্য বা ব্যবহারযোগ্য। এর ০.৩৫ শতাংশ জল রয়েছে ভূগর্ভে বাকি জল আছে নদী, খাল, বিল ইত্যাদিতে। এই প্রাকৃতিক সম্পদ রাজনৈতিক সীমা নিরপেক্ষ ও গতিশীল।

ভারতবর্ষে স্বাধীনতার আগে থেকে একের পর এক নদী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে, যা আপাত দৃষ্টিতে সাময়িক সমস্যা মেটালেও সুস্থায়ী উন্নয়নের অঙ্গ হয়ে উঠতে পারে নি। স্বাধীনতার পর চার লক্ষ কোটি টাকা খরচ করে বিভিন্ন বড় ও মাঝারি জল সেচ প্রকল্পের মাধ্যমে ১১৩ এম, এইচ, এ, জমিকে জল সেচের আওতায় আনলেও তার মধ্যে মাত্র ৮৯ এম,এইচ, এ, জমিকে ব্যবহার করা সম্ভব হয়েছে। তবুও ভারতবর্ষের ৮৪ শতাংশ চাষ জমি ভূগর্ভস্থ জলের উপর নির্ভরশীল। প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বড় বাঁধ ব্যারেজ সারা দেশ জুড়ে গড়ে তোলা হলেও দেশের খরা পীড়িত অঞ্চল বেড়েই চলেছে। আজ দক্ষিণ ভারতের বেশিরভাগ নদীতে বর্ষার কিছু সময় ব্যতীত ভীষণভাবে জলপ্রবাহ ব্যাহত হচ্ছে। অথচ এখনও সরকার নদী সংযুক্তির নামে ৩৬টি বড়ো ও অসংখ্য ছোট বাঁধ এবং প্রায় ১২৯০০ কিমি ক্যানাল তৈরি করে জলসেচের ভ্রান্ত বিকাশের কথা প্রচার করছে।

এর সঙ্গে আছে ভয়াবহ দূষণ। ভারতের প্রায় প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ নদীর কোন না কোন অংশে দূষণমাত্রা দুর্বিষহ। স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পরেও দূষণ নিয়ন্ত্রণের যথাযথ ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। ভারতের ৩২ টি বড় শহরের ২২টি তীব্র জল সংকটের সম্মুখীন। দেখা গেছে, বছরের যে কোনো সময়ে পৃথিবীর প্রায় সমস্ত হাসপাতলে ৫০ শতাংশ রোগী জল বাহিত রোগে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হন। শহরবাসী, শ্রমজীবী মানুষ, কৃষকসহ দেশের বিপুল সংখ্যক মৎস্যজীবী মানুষের

জীবন-জীবিকা ভয়ঙ্কর বিপদের দিকে এগিয়ে চলেছে। অসংখ্য মৎস্যজীবী তাদের জীবিকা পরিবর্তন করতে বাধ্য হচ্ছেন। এই সংকট এত বিপুল আকারে দেখা দিত না, যদি নদীর স্বাভাবিক প্রবাহকে বজায় রেখে উন্নয়নের পরিকল্পনা নেওয়া হতো। দূষণমুক্ত নিরাপদ জল সংবিধানের ২১ নং ধারা অনুযায়ী প্রতি দেশবাসীর মৌলিক অধিকার। এই অধিকার রক্ষা করতে দেশজুড়ে নদীকে ব্যবহারের প্রচলিত পদ্ধতি ও ধারণা বদলের দাবিতে জনমত গড়ে তোলা প্রয়োজন। সেই লক্ষ্যে মুজাফ্ফরপুর, মৌরিগ্রাম, পুটকি, বালুরঘাট, কোলকাতা, ব্যারাকপুর, ধানবাদ সহ বিভিন্ন কনভেনশন ও বিভিন্ন স্তরে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে দেশের প্রখ্যাত ভূতত্ত্ববিদ, নদী বিজ্ঞানী, ইঞ্জিনিয়ার, জীববৈচিত্র্য বিশেষজ্ঞ, দেশের বিভিন্ন রাজ্যের পরিবেশ আন্দোলনের কর্মীসহ বহু মানুষ সহমত হয়েছেন যে জীবন বাঁচানোর তাগিদে নদী বাঁচাও জীবন বাঁচাও আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করতে হবে। সঙ্গে নিম্নোক্ত বিষয়গুলিতে দেশব্যাপী বিভিন্ন স্তরের মানুষদের মতামত গ্রহণ করে ‘নদী ইস্তেহার’ তৈরি করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

নদী ইস্তেহার

১) আমরা সকলে অবহিত যে ভারতের জলবায়ু, প্রকৃতি-পরিবেশ ও জীবন প্রবাহ হিমালয়ের দান। সেই হিমালয়কে ধ্বংস করে নদীকে বাঁচানো সম্ভব নয়। নদীর উৎস মূলত হিমালয়ের হিমবাহ আর হিমালয়ের বনাঞ্চল। কিন্তু ভ্রান্ত বিকাশ নীতির শিকার হিমালয় আর হিমালয়ের উৎপন্ন অসংখ্য নদী-নালা-ঝোরা। সস্থায়ী উন্নয়নের জন্য হিমালয় নীতি গ্রহণ করা হোক। হিমালয়ের প্রাকৃতিক পরিবেশ বজায় থাকুক।

২) নদীর অবিরল ধারা সরকারের ঘোষিত নীতি, অথচ হিমালয় সহ সারা দেশ জুড়ে বড়ো বাঁধ ব্যারেজ ভট্টবন্ধন-এর মত নদী বিনাশকারী পরিকল্পনা চলছে। নদীর অবিরল ধারা ব্যাহতকারী সমস্ত পরিকল্পনা বন্ধ হোক এবং প্রতিটি নদীর বয়ে চলার অধিকার নিশ্চিত হোক। বিগত দিনের পরিকল্পনাগুলির সামাজিক, পরিবেশগত এবং অর্থনৈতিক প্রভাবের পুনঃবিচার হোক এবং নদীপ্রবাহের সাথে যারা অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত সেই সমস্ত গোষ্ঠীর অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক হোক। ব্যর্থ বিবেচিত বরবাদ গুলি ভেঙে ফেলার কাজ শুরু হোক অবিলম্বে ।

৩) নদী-খাল শুধু বয়ে চলা জলের ধারা নয়, জীববৈচিত্র্য সহ এ এক সম্পূর্ণ বাস্তুতন্ত্র, যা সমস্ত পৃথিবীর জীববৈচিত্র্যের ধারক বাহক ও বটে। নদী মানুষের সৃষ্টি-সংস্কৃতি- সভ্যতার বিকাশের মূল আধার। নদীর নির্মল ধারার স্বার্থে সমস্ত শহর, কলকারখানার বর্জ্য জল, রাসায়নিক কীটনাশক মিশ্রিত চাষের জল নদীতে নিষ্কাশন বন্ধ করতে হবে।

৪) দেশের সমস্ত ও গ্রামকে জল স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলতে হবে।

৫) বিভিন্ন নদীতে স্যাংচুয়ারি অঞ্চল ঘোষণা করে মাছ ধরা বন্ধ করছে সরকার। অথচ হাজার হাজার বছর ধরে এই অঞ্চলে মাছ, মৎস্যজীবী এবং ডলফিন সহ অসংখ্য জলজ জীব একই সঙ্গে বসবাস করে জীবন-জীবিকা বজায় রয়েছে। দেশজুড়ে নদী জলাশয়ের ভারসাম্য রক্ষার স্বার্থে এবং মৎস্যজীবী নাগরিকদের অধিকার অক্ষুন্ন রাখতে হবে।

৬) দেশের অসংখ্য নদী-নালা কে ফিরিয়ে দিতে হবে তাদের নৈসর্গিক প্রবাহ। ভারত- বাংলাদেশের ৫৪টি যৌথ বড় নদী সহ অসংখ্য ছোট নদী, খাল, বিল, ভৌম জলের বন্টন ব্যবস্থা যৌথ নদী কমিশনের আওতায় আনতে হবে ও নদীনির্ভর সব গোষ্ঠীর অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক করতে হবে। অন্তর্দেশীয় নদী ও নদীপাড়ের মানুষের স্বার্থে জাতিসংঘের বিধি মেনে চলার জন্য প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

৭) সুন্দরবন অঞ্চল নদ-নদী ঘেরা হেঁতাল-গরানের বন আর রয়েল বেঙ্গল টাইগার দেখার জন্য শুধুমাত্র ভ্রমণ কেন্দ্র নয়। ১০২টি দ্বীপের মধ্যে ৫৪ টি দ্বীপে ১৯টি ব্লকে 50 লক্ষ মানুষ বসবাস করে। তাদের স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রেখে সমগ্র জীবন প্রবাহকে বাঁচিয়ে রাখার সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতি ও মানুষের ভারসাম্য রক্ষাকারী সুস্থায়ী উন্নয়ন নীতি গ্রহণ করতে হবে।

৮) বন্যার হাতে বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কাছে আত্মসমর্পণ নয়, কোন ত্রুটিপূর্ণ ধারণা

বা ব্যবস্থাও নয়। চাই এমন এক সমাজ ব্যবস্থা যেখানে প্রান্তিক শ্রমজীবী মানুষ বন্যা বা দুর্যোগের বিরুদ্ধে লড়বার মতো ক্ষমতা রাখে। যেসব অঞ্চলে বন্যার প্রকোপ কমেছে তার কারণ বিশ্লেষণ করে সেই জ্ঞান কাজে লাগাতে হবে। ৯) বড়ো নদীসহ ছোট নদী-নালা-ঝর্ণার গুরুত্বকে যথোপযুক্ত স্বীকৃতি দিতে হবে। নদী তীরবর্তী সকল অঞ্চলের ভূমিক্ষয় ও বন ধ্বংসকরণ বন্ধ করতে হবে এবং এই সক্রিয় নীতি গ্রহণ করতে হবে।

১০) নদীর সংযোগের মতো ভয়ঙ্কর বিধ্বংসী কর্মসূচি সম্পূর্ণ বাতিল করতে হবে।

১১) ভূগর্ভস্থ জল ও তার যথাযথ ব্যবহার নিয়ে জাতীয় নীতি গ্রহণ করতে হবে।

১২) নদীর অববাহিকা অঞ্চলে বহিরাগত ভিনদেশীয় প্রজাতির উদ্ভিদের চাষ ভূমিকে বিভিন্ন প্রকার ক্ষয়ের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়। গভীর শাল জঙ্গলে এরকম ইউক্যালিপটাস, ধুপী ইত্যাদির চাষ হয়েছে যেখানে শাল গাছ প্রধান অঞ্চলের সমূহ ক্ষতি দেখা গেছে। দেশের নদী ও তার প্লাবনভূমির সঠিক আধুনিক মানচিত্র তৈরি করে সুপরিকল্পিত জমি ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে।

১৩) উন্নয়নের নামে প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্রের ক্ষয়সাধন আমাদের নদীগুলির প্রভূত ক্ষতি করছে। উপযুক্ত ব্যবস্থার অভাবে অপরিকল্পিত খোলামুখ খনির ফলে জল-নদী-বনের যে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে তা বন্ধ করা হোক।

১৪) ‘সংরক্ষিত বনাঞ্চল’ বা ‘সংরক্ষিত জলাশয়’-এর নাম করে সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর প্রাকৃতিক সম্পদের উপর অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে দেশের বিভিন্ন অংশে। এক্ষেত্রে মানুষের অধিকার রক্ষার আইন থাকলেও তা বহু ক্ষেত্রে লঙ্ঘিত হচ্ছে তাই এফ,আর,এ,(২০০৬) নিয়ম বিধি কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে।

১৫) নদী-খালের স্বাভাবিক গতি প্রকৃতি ও চরিত্রের পরিবর্তনকারী নির্মাণকাজ বন্ধ করতে হবে। নদী-খাল নির্ভরশীল মানুষ এবং জীববৈচিত্র্য সহ বাস্তুতন্ত্রের সমীক্ষা ও বিশ্লেষণ করে সুস্থায়ী উন্নয়নের পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।

১৬) বালি ও পাথর খাদানে জেসিবি সহ সমস্ত যন্ত্রের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। শ্রমনির্ভর বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বালি ও পাথর উত্তোলন করতে হবে। নিয়ম লঙ্ঘনকারীদের আইনানুগ কঠোর শাস্তি প্রদান করতে হবে।

১৭) দেশজুড়ে নদীর বালি, পাথর খাদান-এর দীর্ঘমেয়াদী পরিবেশ পরিবর্তনের প্রভাবের তথ্য বিশ্লেষণ করতে হবে।

১৮) গঙ্গাসহ রাজ্য তথা দেশের সমস্ত নদী ভাঙ্গনের কারণ সঠিক ভাবে বিশ্লেষণ করতে হবে। ভাঙ্গন কবলিত মানুষের অবিলম্বে পুনর্বাসনের জাতীয় নীতি গ্রহণ করতে হবে।

১৯) নদীমাতৃক ভারতবর্ষে নদীর জীবিত সত্তাকে স্বীকার করে নদী সংরক্ষণের যথাযথ ব্যবস্থা করতে হবে। প্লাবনভূমি সহ নদী-খাল-বিলের গতিপথের দখল নিষিদ্ধ করতে হবে।

২০) পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে বহু ছোট-বড়ো পাহাড় ও টিলা বিচ্ছিন্ন ভাবে ছড়িয়ে আছে, যা ছোট-বড়ো নদী-ঝোরার উৎস ও স্থানীয় মানুষের সংস্কৃতি তথা জীবন-জীবিকার আধার। এমনকি এই সমস্ত প্রাচীন আগ্নেয় শিলার পাহাড় পর্যটন, শৈলারোহণ ও প্রকৃতি পাঠশালার গুরুত্বপূর্ণ বাস্তুতান্ত্রিক অঞ্চল। এই অঞ্চলগুলিতে পাথর খাদান সহ স্থায়ী পরিবর্তনকারী সমস্ত কার্যকলাপ বন্ধ করতে হবে।

আরও পড়ুন – চিকো মেণ্ডেস