গাছ, পের, tree ও সাধু ভাষায় যাকে বলে বৃক্ষ, এদের রোপণের কথা, তার গুরুত্ব বহুদিন ধরে বহু মানুষ বলে এসেছেন, অনেকে হাতেনাতে করে দেখিয়েছেন। কিন্তু মানুষ যত প্রযুক্তি নির্ভর হয়েছে, কুচক্রিরা যত অলীক উন্নয়নের মরীচিকা সৃষ্টি করেছেন আমরা প্রকৃতির এই রক্ষককে, মানুষের এমন পরম বন্ধুকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টেছি। আজ আমাদের চোখে গাছের মূল্যায়ন শুধুমাত্র তার কাঠে। অনেকে অবশ্য অক্সিজেনের কথা বলেন। ব্যাস শুধু ঐ পর্যন্ত। শুধু রাষ্ট্র ও ব্যবসায়ী গোষ্ঠী নয়, সাধারণ মানুষের কাছেও গাছের গুরুত্ব ক্রমশ কমে যাচ্ছে। তাই কারনে অকারণে গাছ কাটার বিরূদ্ধে কথা বলা তো দূর, নিজেরাই কেটে ফেলতে দ্বিধা করে না। গতবছর এবং এ বছর আম্ফান ও ইয়াসের কারণে গাছ পরে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় যত ক্ষোভ প্রকাশ গাছের ওপর পড়তে দেখা গেছে। অনেকে তো পাতা পড়ে নোংরা হয় বলে গাছ কেটে ফেলে। গাছের মূল্যায়ন জানার আগ্রহ কারও ভাবনায় আর স্থান পায় না। তাই ভাবলাম একটু গাছ নিয়ে ভাবা যাক।
আমরা সাধারণভাবে জানি যে পৃথিবীর তিন ভাগ জল আর এক ভাগ স্থল। আর এই স্থলের গাছ নিয়েই মূলত আমার আলোচনা। আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হল মানুষের বসবাস শুধুমাত্র স্থলেই। শুধু মানুষের উল্লেখ কেন? অন্য প্রাণীরা কেন নয়? কারণ বৃক্ষ নিধন একমাত্র মানুষই করে থাকে।
পণ্ডিতেরা বলেন স্বাভাবিকভাবে পৃথিবীর ভারসাম্য বজায় রাখতে সকল জীব এবং প্রাণীর স্বাভাবিকভাবে জীবন ধারণ করতে স্থলভাগের অন্তত তিন ভাগের এক ভাগ সবুজায়নের প্রয়োজন অর্থাৎ বৃক্ষে র প্রয়োজন। পরিসংখ্যান বলে বর্তমানে আনুমানিক ৩.৫ ট্রিলিয়ন গাছ এ ধরায় আছে। এখানে গাছ বলতে পরিপূর্ন বৃক্ষ কে ধরা হয়েছে। যা আজ মোটামুটি ৩০ শতাংশেরও কম এবং ক্রমাগত কমছে। পরিসংখ্যান আরো বলে যে বছরে ১৫ বিলিয়ন গাছ কেটে ফেলা হয় এবং ৫ বিলিয়ন রোপণ করা হয়। তাও সমগোত্রীয় কিনা বলা মুস্কিল। আমি ধরে নিচ্ছি যে সমগোত্রীয়। সুতরাং উন্নয়নের কুঠার এভাবে চলতে থাকলে আনুমানিক আর দুশো বছরে পৃথিবী বৃক্ষ শূন্য হয়ে পড়বে। অনেকে হয়তো বলবেন, তাতে কি? গাছ তো শুধু প্রয়োজনের ২০ থেকে ২২ শতাংশ অক্সিজেন সরবরাহ করে তার শালোক সংশ্লেষ এর মাধ্যমে। বাকি সিংহভাগই তো আমরা পাই সমুদ্র থেকে। ঠিক কথা, প্রায় ৮০ ভাগ অক্সিজেন তৈরী হয় সমুদ্রের প্রবালে থাকা phytoplankton নামক এক ধরনের ছত্রাক থেকে। তাহলে যেটা দাঁড়াল, আমরা ঐ ৮০ শতাংশে অভ্যস্ত হয়ে নেব। তাছাড়া করপোরেট ল্যাবরেটরি তো আছে। গাছ না থাকলেও অসুবিধা হবে না।
সত্যিই কি তাই?
আসুন আমরা এক tree free world এর কল্পনা করি। অবশ্য তার সাথে এটা ধরে নিতে হবে যে সমূদ্র আর দুষিত হবে না আর মানুষের সংখ্যা আর বৃদ্ধি পাবে না। তাহলেও গাছ ছাড়া আমাদের বাঁচা অসম্ভব হবে। কেন? কারণ অক্সিজেন আর ছায়া ছাড়াও গাছ অনেকভাবে আমাদের রক্ষা করে।
১. Smog:- অনেকে বলেন smog কথাটির উৎপত্তি smoke আর fog এর সন্ধি থেকে। আমার মনে হয় ঠিক কথা। কারন বিভিন্ন দূষণের সন্ধির ফলই হচ্ছে এই দম বন্ধ করে দেয়া smog । আধুনিক প্রযুক্তির সৃষ্টি ঝাপসা এই প্রাণঘাতী দূষণ। পরিসংখ্যান বলে শুধু বায়ুদূষণের কারণেই বিশ্বে প্রতি বছর ৪০ লক্ষ মৃত্যু হয়। শীতকালে এর প্রকোপ অত্যাধিক। কার্বন, সালফার, নাইট্রোজেন ও বিভিন্ন ধাতুর অক্সাইড, ধূলিকণা আর জলকনার মিশ্রণ এই smog।
গাছ এই সকল দূষিত পদার্থকে তার পাতার জালিকা দ্বারা শুষে নিয়ে এবং অক্সিজেন সরবরাহের সাহায্যে বায়ুদূষণের মাত্রাকে কমায়। যেখানে সবুজ বেশি সেখানে দূষণ কম। কিন্তু গাছ না থাকলে? কে নিয়ন্ত্রণ করবে? গাছ না থাকলে এই smog এর উত্তরোত্তর বৃদ্ধির ফলে আমরা বাঁচব না।
২. Hot air:- গাছ যেমন বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণ করে তেমনই গ্রীন হাউস গ্যাস জনিত কারনে বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতাকেও নিয়ন্ত্রণ করে। সাথে নিয়ন্ত্রণ করে বৃষ্টি। তাই গাছ না থাকলে শুধু অক্সিজেনের অভাবে নয় , উষ্ণায়নের জন্যও আমাদের বাঁচা মুস্কিল।
৩. Rain check:- আমরা সকলেই জানি যে গাছের শিকড় মাটির অনেক নিচে অবধি বিস্তৃত। শিকড় দিয়ে গাছ ভূ – জল টানে। অতিরিক্ত জল গাছ তার বিভিন্ন কোষ ও পত্ররন্ধ্রের মাধ্যমে বায়ুমণ্ডলে ছেড়ে দেয়। একে আমরা বাষ্পমোচন বলে থাকি। ভোরের দিকে একটু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে গাছের ঠিক ওপরেই এক বাষ্পীয় মেঘ। সেই বাষ্প মেঘের সাথে মিশে বৃষ্টি আকারে আবার ঝরে পড়ে।
গাছ না থাকলে বৃষ্টির অভাবে মিষ্টি জলের অভাব আরও বেড়ে আমাদের বেঁচে থাকা অসম্ভব করে তুলবে।
৪. ছায়ার অভাব:- একটি পরিপূর্ণ পাতায় ভরা গাছ তার ছায়ার মাধ্যমে ছায়ার মাধ্যমে শীতল করে চারিদিক। অভাবে উষ্ণায়ন আরও বাড়বে এবং প্রাণ ওষ্ঠাগত করে ছাড়বে।
৫. মাটি/ ভূমির উপরিভাগ(top soil):- গাছ , বৃক্ষ বহু বহু বছর ধরে ভূভাগের উপর স্তরকে ধরে রাখে তার শিকড়ের সাহায্যে এ কথা আমরা জানি। গাছের অনুপস্থিতি কি ভয়ঙ্কর দুর্যোগ ডেকে আনতে পারে তার প্রমাণ আমরা বিভিন্ন সময়ে পেয়েছি। পাহাড় একসময় গাছে ঢাকা থাকত। বিগত দু তিন দশকে সেগুলি আজ নিশ্চিহ্ন। গাছ কেটে কেটে ন্যাড়া করে দেওয়া হয়েছে। তার প্রতিফল পাহাড়ের উপরিতলের মাটিকে আর ধরে রাখার কেউ নেই। তাই একটু বেশি বৃষ্টি হলেই ধস নেমে আসছে সমতলে। বৃষ্টির সাথে এই মাটি নেমে আসছে সমতলে, করছে ধ্বংস। অনিয়ন্ত্রিত বৃষ্টির ফলে হঠাৎ হঠাৎ মেঘ ভাঙ্গা বৃষ্টি হচ্ছে বিভিন্ন পার্বত অঞ্চলে তার কারণ যে উষ্ণায়ন, বৃষ্টির নিয়ন্ত্রণহীনতা, সেটাও গাছের অভাবে। পাহাড় থেকে নেমে আসা এই ক্লেদ প্রবেশ করছে বিভিন্ন নদী ও জলাশয়ে। উচ্চতা বাড়িয়ে দিচ্ছে রিভার বেডের। ফলে নদী বা জলাশয়ের আর আগের মত জল ধরে রাখার ক্ষমতা থাকছে না প্লাবন তাই তীব্রতর হচ্ছে। সুতরাং গাছ না থাকলে শুধু অক্সিজেনের অভাবে কেন? এভাবে ভেসে যাব মৃত্যুমুখে।
৬. দুষিত মাটি ও জল:- বৃষ্টির প্রথমদিকে বৃষ্টির সাথে বায়ুমণ্ডলের দূষিত পদার্থ গুলিও নেমে আসে এই মাটিতে। সেগুলি যদি নিয়ন্ত্রণ করা না যায় তাহলে সেগুলি বিভিন্ন জলাশয়ে বয়ে যাবে এবং মাটির নিচে প্রবেশ করবে। গাছ তার শিকড়ের সাথে সাহায্যে এই দূষিত পদার্থ গুলিকে বৃষ্টির জল এবং মাটির উপরিভাগের স্তরের(top soil) সাথে ধরে রাখে। তাই দূষিত পদার্থ গুলি আমাদের বিভিন্ন জলাভূমিকে ক্ষতিকারক রাসায়নিক মিশে যাওয়া থেকে রক্ষা করে। সাথে জমিকেও দূষিত রাসায়নিকের হাত থেকে রক্ষা করে উর্বর রাখতে সাহায্য করে। তাই গাছ না থাকলে শুধু অক্সিজেনের কারণে না হলেও দূষিত জলের কারনেও রোগ ও মৃত্যু আমাদের পিছু ছাড়বে না।
৭. শব্দ দূষণ:- শব্দ দূষণ, বিশেষত শিশু ও বৃদ্ধ বৃদ্ধাদের এবং যারা হৃদরোগে ভুগছেন তাদের কাছে বিভীষিকা। শুধু ওদের কথা বলি কেন যে কোন বয়সের মানুষ ও প্রাণীদের পক্ষে উচ্চ শব্দ খুব কষ্টকর। বলা হয়, যে পরিসরে শব্দ দূষণ নেই বা অনেক কম, সেখানকার ছাত্র ছাত্রীদের পড়ায় মনযোগের ক্ষমতা বেশি। দিনদিন বধিরের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে শুধুমাত্র এই মাত্রাছাড়া শব্দের কারণে। গাছ বিহীন ইঁট, কাঠ, বালি, পাথরে ভরা জনপদে শব্দ প্রতিফলিত হতে থাকে। কারণ শব্দ শুষে নিয়ে তা প্রতিফলিত হওয়া থেকে রক্ষা করে গাছ তার কাণ্ডে। আর আমরা ভাবী গাছ শুধু অক্সিজেন দেয়।
আরো বিভিন্নভাবে গাছ আমাদের সুস্থ জীবন যাপন করতে সাহায্য করে স্বার্থহীন বন্ধুর মত। অথচ আমরা সাধারণভাবে জানি যে গাছ দেয় শুধু কাঠ, অক্সিজেন আর ছায়া। তাই এটা অনেক সময় মনে হতে পারে যে অক্সিজেনের অভাব মেটাবে সমুদ্র এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ল্যাবরেটরি, ছায়া দেবে ছাতা আর কাঠের অভাব মেটাবে প্লাস্টিক। সুতরাং গাছ না থাকলে বেচেঁ থাকতে তেমন অসুবিধা হবে না। কিন্তু সত্যিই কি তাই? ভেবে দেখুন