পরিবেশ ও প্রকৃতির স্বার্থে ভোট ময়দানে অংশগ্রহণ

ভোট এক অদ্ভুত ব্যাপার – জনগনের গণতান্ত্রিক অধিকার। ভোট কি আদৌ উৎসব? সত্যিই কি গণতন্ত্র, না কি গণতন্ত্রের নামে এক মুখোশ? রাজনীতি নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন মানুষের মনে প্রতিনিয়ত ঘুরপাক খাচ্ছে। অস্বচ্ছ ও ঘোলা রাজনীতির বিষয়ে আমরা কথা বলতে আসি নি, এসেছি প্রকৃতির কথা বলতে।

মানুষের কথা তো সবাই বলে, কিন্তু প্রকৃতির কথা কতজন বলে? প্রকৃতিকে বিনষ্ট করার অর্থই হল- নিজের পরিবার পরিজনকে স্বমুলে উতখাত করা। প্রকৃতিকে বিনষ্ট করা যেন এক আধুনিকতার লক্ষন। আমরা দিন দিন আধুনিকতা ও উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে চলেছি প্রকৃতিকে বলি দিয়ে। আমাদের পুর্ব পুরুষেরা সেই প্রাচীন যুগ থেকেই প্রকৃতিকে ঈশ্বর জ্ঞানে পুজো করে এসেছেন। অথর্ববেদ অনুযায়ী ‘যা কিছু স্বর্গীয় তার পার্থিব রুপ হল প্রকৃতি’। আমাদের গ্রাম্য লোকাচারের মধ্যেও লুকিয়ে রয়েছে – প্রকৃতির প্রতি ভালবাসার বন্ধন। আজকের এই বস্তবাদী উন্নয়ন ও আধুনিকতার ছোঁয়ায় প্রকৃতি বিলুপ্তির পথে। এইসবের পিছনে লুকিয়ে আছে আমাদের ভেতরের লোভ আর শুধুই লোভ – অর্থ আর অর্থ। মহাভারতে কথিত আছে, কর্নের মৃত্যুর পর তাঁর আত্মা স্বর্গে গমণ করলে, তাঁকে শুধু স্বর্ণ খাদ্য হিসাবে দেওয়া হত কারন তিনি কোনোদিন পিতৃগণের উদ্দেশ্যে খাদ্য প্রদান করেন নি – এর ভাবার্থ কি? যদি সহজ ভাবে ব্যাখ্যা করে বলি, তাহলে আমরা যে অর্থ আর অর্থ করছি সেটা কি খেতে পারবেন? পেট কি আপনার আমার অর্থ দিয়ে ভরবে? তাই, পুকুর ভরাট করে অট্টালিকা বানানোর মধ্যে কি মাহাত্ম্য লুকিয়ে আছে? জলাভূমি দিনের পর দিন নষ্ট করে চলেছি শুধু অর্থের কারনে – কবে আমাদের চৈতন্য হবে, দিনের পর দিন অবলুপ্তি ঘটে চলেছে বিভিন্ন প্রাণীর। একটি বেসরকারি সংস্থা ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ফান্ড ফর নেচারের এক হিসাব অনুযায়ী প্রতি বছর প্রায় দশ হাজারের বেশি প্রাণীর প্রজাতির ধ্বংস হচ্ছে। ভেবে দেখেছেন কি, আপনার আমার ধ্বংস লেখা আছে হয়তো আমাদের জড়বাদী উন্নয়নের শেষ লগ্নে।আমাদের উদাসীনতার কারনে আমরা আমাদেরই প্রজাতিকে হারাব – পৃথিবী কিন্তু সে নিজের জায়গাতেই থেকে যাবে এবং নিজেকে নিজের মতো করেই গড়ে তুলবে পুনরায় –পৃথিবীর প্রিয় মনুষ্য সম্প্রদায় রইল না কেন একবারও ভাববে না ধরিত্রীমাতা – কারন পৃথিবীকে আমাদের দরকার, পৃথিবীর মানুষকে দরকার নেই।

ভালো করে যদি লক্ষ্য করেছেন, তাহলে দেখবেন কোভিডের সময়কালে -আকাশ যেন শান্তি পেয়েছিল – ফিরে পেয়েছিল তাঁর পুরানো আসল রঙ ও রুপ – নীল আকাশ, সাথে পেঁজা পেঁজা তুলোর সারি। জঙ্গলের পশু পাখিরাও নিশ্চিন্তে নির্বিঘ্নে চলাফেরা করছিল। কারন মনুষ্যজাতি তখন গৃহবন্দী ছিল।যে মানবজাতি পৃথিবীকে প্লাস্টিকে ভরে দিয়েছিল, সেই পৃথিবীই মানুষকে প্লাস্টিকে মুড়ে ফেলেছিল।

দাঁত থাকতে থাকতে দাতের মর্ম বোঝা উচিৎ -নইলে পরে পস্তাতে হবে। জেলায় জেলায় কিন্তু বহু সমজসেবী সংগঠন গড়ে উঠেছে, প্রকৃতিকে চির সবুজ করে রাখার লক্ষ্যেই। পুরানো গরিমা ফিরিয়ে দেওয়া কঠিন কিন্তু সমাজ সচেতন হলেই তো আর নেমে আসবে না প্রকৃতির ওপর নির্মম অত্যাচার। বিনা কারনে মানুষ জঙ্গলে আগুন লাগাবে না, কলকারখানা গুলিও আইন মেনেই কাজ করবে – প্রকৃতিকে বিনা কারনে কলুষিত করবে না। প্লস্টিক ব্যাবহার নিয়মে মেনেই চলবে, ইত্যাদি ইত্যাদি। আমাদের প্রয়াস জারি থাকবে- প্রকৃতিকে সুস্থ রেখে মানুষের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার লড়াই।

মানুষের অস্থিত্ব টিকে আছে শুধু প্রকৃতি ও পরিবেশের জন্য – এই চিরসত্যকে অস্বীকার করার উপায় কোনো মানুষের কি আছে? পরিবেশকে কোনো রাজনৈতিক দলই তাদের ইস্তাহারে আজ পর্যন্ত রেখেছে বলে মনে পড়ে না।যখন সমাজকে বোঝানো কঠিন হয়ে পড়ে, এই জড়বাদী রাজনৈতিক রেষারেষিতে যখন পরিবেশের কথা কেউ শুনতে পায় না, তখন একমাত্র ভরসা হল রাজনৈতিক আঙিনা। যখন নেতা মন্ত্রীরা তাদের ক্ষুদ্র স্বার্থের কাছে পরিবেশকে অবজ্ঞার চোখে দেখেন, তখন যারা সত্যিই মানুষের কথা ভাবেন, প্রকৃতির কথা ভাবেন, পরিবেশের কথা চিন্তা করেন – তাদের রাজনৈতিক ভাবেই লড়াই করা উচিত। মনে রাখতে হবে প্রকৃতিই সব, আমি আপনি তুচ্ছ প্রানী মাত্র।

গত বিধানসভা ভোটে একজন সচেতন নাগরিক হিসাবে, পরিবেশ বাঁচানোর কথাকে মাথায় রেখে ভোট ময়দানে নেমে মানুষকে এই বার্তা দিতে সক্ষম হয়েছিলাম – প্রকৃতি পরিবেশ বিনষ্ট হলে আমাদের বিনাশ নিশ্চিত, এবং খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল ৩৩০৩ জন পরিবেশ প্রেমী মানুষকে একটা বিধানসভা কেন্দ্রেই। এই সংখ্যাটি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। একটা বিধানসভায় আছে। ভোটে জেতাটাই মুল লক্ষ্য নয় – লক্ষ্য আমাদের স্থির, পরিবেশকে আর নষ্ট হতে দেওয়া যাবে না।আমারা লক্ষ্য করেছিলাম, বিধানসভা ভোটে ভারতের কেন্দ্রসরকারের নামী-দামী মন্ত্রীরাও এসে বাঁকুড়ার বুকে পরিবেশকে নিয়ে মঞ্চ থেকে বার্তা দিতে এবং আমাদের ‘প্রগতিশীল মঞ্চের’ দাবীগুলোকেই তুলে ধরেছিলেন – এর অর্থ বোঝাই গেলো, দরজায় বার বার ধাক্কা দিলে বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলিও ভাবতে বাধ্য হবেন। সাধারন মানুষ ভোট দিয়ে নীতি নির্ধারনকারী তৈরী করেন, আর আজকের নীতি নির্ধারনকারীরা যদি পরিবেশ সংক্রান্ত কোনো পলিসিই সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে না পারেন – তাহলে এই ভোট যুদ্ধের মাধ্যমেই পরিবেশের স্বার্থে বিধানসভা বা লোকসভাতে পৌছাতে হবে পরিবেশ ও মানবপ্রেমীদের।

ভোট অংশগ্রহন করছি মানে আমাদের মাথায় রাখতেই হবে, আপনি বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলির ভোটে থাবা বসাচ্ছেন, এই লড়াই অসম লড়াই। কিছু আবেগপ্রবন প্রকৃতিপ্রেমিক একদিকে আর অপর দিকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ যারা তথাকথিত বীর যোদ্ধা। এই পথ কন্টকময়, কাঁটা সরিয়েই পরিবেশ , প্রকৃতি ও মানুষের জয়গান লিখে যেতে হবে। সবাইকে আরো বেঁধে বেঁধে থাকতে হবে, একত্রিতভাবে প্রচার চালিয়ে যেতে হবে – শুধু এই পৃথিবী ও তার প্রাণীকুলের স্বার্থে।

আজও পরিবেশ ইস্যুতে মানুষ একত্রিত হতে পারে নি, বা পারছে না। তার কারণ আমরা প্রত্যেকেই কম বেশি রাজনৈতিক রঙে রঙিন- সমস্ত ব্যক্তি নিজ নিজ পছন্দের রাজনৈতিক আইডিওলজি নিয়ে ব্যস্ত –রাজনৈতিক রঙের কাছে হার মানে পরিবেশ ইস্যু,  রঙের মতাদর্শের স্বার্থে দেশ বা সমাজের কথাও কিন্তু কর্ণগোচর হয় না, তারা কীভাবে গাছের কথা বলবে, কীভাবে নদীর কথা বলবে, কিভাবেই বা জল জঙ্গলের হয়ে কথা বলবে – লড়াই তো অনেক দুরের কথা। পরিবেশ নিয়ে ভোট চাইতে গেলেও সাধারন মানুষ বিস্ময় প্রকাশ করে – নদীর জল শুকিয়ে যাচ্ছে, ভূগর্ভস্থ জল দিন দিন তলানিতে ঠেকছে – তারপরেও আমরাই ঘরে পানীয় জলের সুবন্দোবস্ত চাই বলে আবদার করে, গাছ কেটে গরমের হাত থেকে বাঁচার অলীক কল্পনা করে চলেছি। বায়ুকে বিষাক্ত করেই চলেছি আর বিশুদ্ধ বায়ুর কথা বলা মানে সোনার পাথর বাটির মত।

একবার ভেবে দেখুন, ২০৫০ সালের বড় বড় রাজনৈতিক দলের ইস্তাহারে লেখা থাকবে, “ ক্ষমতায় এলেই, ঘরপিছু ৫০টি অক্সিজেন সিলিন্ডার দেওয়ার অঙ্গীকার করছি” বা রাজ্যসরকার ও কেন্দ্রসরকার যৌথ ভাবে “বৃক্ষবন্ধু” প্রকল্প চালু করছেন, যাতে করে বেকার ছেলেমেয়েরা মসিক ১৫,০০০ এর বিনিময়ে জঙ্গল দেখাশোনা করবে। আবার একইভাবে সাব মার্সিবেল ছেড়ে “জলাভূমি রক্ষক” নামে নতুন প্রকল্প যেখানে বেকার ছেলেমেয়েদেরকে মাসিক ২০,০০০ টাকা ভাতা দেওয়া হবে জলাভূমি রক্ষনাবেক্ষন ও জলাভূমি নির্মাণের জন্য। তাই আজই আপনি আপনার ভবিষ্যতটা একটিবার দেখে নিন – ভোট দেওয়ার আগে।

আপনি আপনার গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিন্তে প্রয়োগ করুন, কিন্তু প্রয়োগ করার আগে একবার আপনার উত্তরসুরীর কথা ভাববেন। সেই দিনের পরিবেশের কথা ভাববেন। উত্তরসুরীর পিঠে অক্সিজেনের সিলিন্ডারের দৃশ্য কল্পনা করবেন।

তারপরে ভাবুন, পরিবেশ জরুরি না কি আপনার নিজস্ব দলতান্ত্রিক মতামত?

“যাহার তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,

তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো।”

আরও পড়ুন – তিস্তা পাড়ের ভাঙন ও প্রশাসনের উদাসীনতা