লিঙ্গারাজ আজাদ’জীর বক্ত্যবের ভাবানুবাদ

২৬শে জুন কলকাতার রামমোহন লাইব্রেরী হলে বক্তব্য রাখলেন লিঙ্গারাজ আজাদ ‘নিয়মগিরি সুরক্ষা সমিতি’-র অন্যতম সংগঠক।  ‘উন্নয়নের নামে উচ্ছেদ ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিরোধ ‘- শীর্ষক APDR আয়োজিত এই আলোচনা সভায় লিঙ্গারাজ আজাদ’জী বলেন:

‘ভারতবর্ষের জঙ্গল নির্ভর আদিবাসীদের বুকে ধর্ম না ‘ ধম্ম ‘ আছে – যে অর্থে বাবা সাহেব আম্বেদকর বলেছিলেন। ধর্মের ঠিকাদাররা এদের ভয় দেখিয়ে বহু বছর ধরে ধর্মান্তরিত করেছে। একসময় খ্রিস্টানরাও করেছে, আজ হিন্দুরাও করছে। এদের ঐতিহ্যপূর্ণ আচরণ, বেশভূষা, সংস্কৃতিকে জঙ্গলের বাইরের লোকেরা ‘অসভ্যতা’ বলে দাগিয়ে এসেছে। ব্রিটিশদের গোলামি করে যে দাসত্বের সংস্কৃতি, ভাষা এই  দালালরা রপ্ত করেছে তাই আদিবাসীদের মধ্যে সে সেঁধিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে চলেছে। নিয়মগিরির এক জনজাতি প্রধান লদরো সিকোতাকে একবার বলতে শুনেছিলাম – “আমাদের কাছে, আমাদের বেশভূষা, ভাষা মহান। নিয়মগিরির ডো‌ংরিয়া কোঁধ পুরুষদের লম্বা চুল কাটিয়ে ‘সভ্য’ বানানোর আগে ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রীর চুল কাটাও।”

‘সভ্য’ ভারতবর্ষ সংবিধান পড়ে সম্প্রীতি, বন্ধুতা এসব শিখছে আর  ডো‌ংরিয়া কোঁধরা হাজার বছর ধরে তাদের জীবন আচরণে সহজাতভাবেই এগুলি পালন করে এসেছেন। ডো‌ংরিয়া কোঁধদের জঙ্গলের ঝুপড়িতে কখনো তালা চাবি লাগাতে হয় নি। কারণ তারা কখনো চুরি করতে শেখে নি, তাই তাদের গ্রামে চুরি হয় না। তারা চিরকাল ভাগ করেই খেতে শিখেছে। আর আজকে তোমরা তাদেরকে শেখাবে কোন ভাষা ভালো আর কোন সংস্কৃতি পিছিয়ে পরা?- এগুলো কোনো মামুলি কথা বলছি না। তাৎপর্য বুঝতে হবে।

যেমন বৈবাহিক সম্পর্কের শিকলের মধ্যে আদিবাসীরা তাদের নারীকে বেঁধে রাখে না। নারীকে সম্মান দেওয়ার বিষয়টি আদিবাসীদের থেকে শিখে যাও।

জল জঙ্গল জমিনকে আদিবাসীরা ধন -দৌলত মনে করে না, প্রকৃতি তাদের ভগবান, তাদের জীবন। নিয়মগিরি পাহাড়ে ডো‌ংরিয়া কোঁধরা যে লড়াইয়ের সূচনা করেছিলো তা শুধু অর্থনৈতিক দাবীর লড়াই নয়,-  তা তাদের প্রকৃতি নির্ভর জীবন আর সংস্কৃতির বাঁচানোর লড়াই।

আজকের ‘ ক্রুনি’ পুঁজিবাদ উন্নয়নের নামে আদিবাসীর থেকে জল জঙ্গল জমিন ছিনিয়ে নিচ্ছে। এই লুঠের নামই নয়া উপনিবেশবাদ, নয়া উদারনীতি।

আমরা নিয়মগিরি সুরক্ষা সমিতি শুধু ইন্ডাস্ট্রির বিরোধীতা করছি না , আমরা প্রযুক্তিরও বিরোধীতা করছি। ইন্ডাস্ট্রির বিরোধীতা করবো আর প্রযুক্তিকে কাছে টানবো এটা কখনো হতে পারে না। প্রযুক্তির জন্য চাই যে ব্যবস্থাটা সেটাই ইন্ডাস্ট্রি – তার জন্য কাঁচামাল চাই, কাঁচামাল পাওয়া যায় খনি খুঁড়ে। তাই  লুঠ হচ্ছে ধাতু। এই খনিগুলো চালানোর জন্য প্রয়োজন  জল, জঙ্গল, জমিন । গরীব , দলিত আদিবাসীর শ্রম লুঠ না করলেও আবার ইন্ডাস্ট্রি চলবে না। এটাই সবাইকে বলতে চাই, ভাবুন কিসের জন্য জঙ্গলের বুকে খনি খোঁড়া হচ্ছে, নদীর বুকে ড্যাম করে বিদ্যুৎ তৈরী করা হচ্ছে? একদিকে আদিবাসীর পায়ের তলার জমি আর জঙ্গল কেড়ে নিচ্ছে আর অন্যদিকে শিল্পের জন্য নদী নষ্ট করে বিদুৎ উৎপাদন বাড়িয়েই চলেছে। আমরা তাই এর সবকটারই বিরোধীতা করছি। কি কাজে লাগবে এত বিদ্যুৎ আমাদের ?  কি দরকার আমাদের এত বড় বড় রাস্তার ? -এসবের কোনও দরকার নেই। রাস্তা তৈরী জন্য জমি জঙ্গল থেকে উচ্ছেদ হচ্ছে আদিবাসী, আর রাস্তা তৈরী হচ্ছে ইন্ডাস্ট্রির জন্য। এরপর হচ্ছে বড় বড় গোডাউন, বিক্রির জন্য বাজার বসছে, ইন্ডাস্ট্রির জন্য তৈরি হচ্ছে নতুন কলোনী, আর মালিকদের জন্য ফাইভস্টার হোটেল হচ্ছে, মজা মজলিশের জন্য সুইমিংপুল হচ্ছে- এতে করে আদবাসীদের জীবনে  নেমে আসছে ঘোর সংকট।

আমাদের প্রশ্ন হলো –

তাহলে এই লুঠের নামই উন্নয়ন ? এসব কথা কেউ বলছে না। একমাত্র জঙ্গলের সন্তান আদিবাসীরাই নিজেদের জীবন দিয়ে এর বিরোধিতা করছে।

আমাদের বেঁচে থাকার জন্য চাষ, চাষের জমি, জমির জন্য জল, জলের জন্য জঙ্গল, জঙ্গল টিকিয়ে রাখার জন্য  প্রকৃতিমুখী মানসিকতা আর মানবিকতা চাই। আমরা বুঝে গেছি খনি শিল্প হয়ে চললে এগুলির কোনোটাই বাঁচবে না। তাই নিয়মগিরির লড়াই শুধু খনির বিরুদ্ধে নয় – জল, জঙ্গল, জমি সম্পর্কে মানুষের লুঠে নেওয়ার মানসিকতা বদলের লড়াই।

এই লুঠের জন্যই বিশ্ব উষ্ণায়ন, পাহাড়ে ধ্বস, ভুমিকম্প বাড়ছে। প্রকৃতি আর মানুষের দ্বন্দ্ব বাড়ছে। যাদের জীবন AC -র মধ্যে কাটে, তারা AC বন্ধ হলে ব্রয়লার মুরগির মতো মরবে, কিন্তু এই কথাগুলির অর্থ বুঝবে না। বৈজ্ঞানিকরা বলছেন, আকাশের নীচে রোদ্দুরে পিঠ পুড়িয়ে যারা গতরে খেটে বাঁচে তারাই শেষ পর্যন্ত বাঁচবে।

আমি আপনাদের বলি , সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষায় দেখাচ্ছে এখন উড়িষ্যায় বক্সাইট উত্তোলন এত বেড়ে গেছে যে, নিয়মগিরির একলক্ষ বিলিয়ন টন বক্সাইট আর কয়েক বছরের মধ্যে ফুরিয়ে যাবে। পুরো উড়িষ্যার যত বক্সাইট আছে ১৫ থেকে ২০ বছরের মধ্যে ফুরিয়ে যাবে।

তাহলে আমরা যদি প্রয়োজনের তুলনায় মাটির তলা থেকে বেশী তুলে নিই তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এই ধরিত্রীর আশীর্বাদ থেকে বঞ্চিত করা হবে। প্রকৃতিকে এইভাবে লুঠ করার অধিকার কী আমাদের আছে ?

আমাদের উড়িষ্যায় galco কোম্পানি লাগামছাড়া খনি খুঁড়ে চলেছে আর এলুমিনিয়াম, বক্সাইট উত্তোলন করে চলেছে। ভারতের যা প্রয়োজন তা মিটিয়েও রপ্তানীর জন্যই এই উত্তোলন। আসল কথাটা বলি, আজকের বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনা হলো এক দেশের সম্পদ শূন্য করে দাও, আর নিজের দেশেরটা গচ্ছিত রেখে অন্য দেশকে অসহায়, নির্ভরশীল করে তোলো। তাই আমরা লড়ছি, নিয়মগিরির আদিবাসী বিশ্ব পুঁজিবাদের থাবার মুখে দাঁড়িয়ে আওয়াজ তুলছে ‘জিনা হ্যায় তো মরনা শিখো, কদম কদম পে লড়না শিখো’। তাই আমি ছাত্রদের বলছি, তোমরা পড়ো, পড়তে শেখার সঙ্গে লড়তেও শেখো।নাহলে পড়া লেখা করে কী হবে ? কালেক্টরের ছেলে কালেক্টর হয়, ডাক্তারের ছেলে ডাক্তার, আই এ এস এর ছেলে আই এ এস হয়। কিন্তু পড়ে লিখে বড় হয়ে তারা এই জনতাকে, দেশকে লোটার ব্যবস্থাটাই চালিয়ে নিয়ে যায়। আদিবাসীর পড়া লেখার পয়সা নেই কিন্তু সে জীবনভর মেহনত করে জল-জঙ্গল-জমিন বাঁচাতে চায়। তাহলে তোমাদের ওই পড়া লেখার দাম কী ?

আমাদের বিশ্বাস, যেমন দিল্লিতে কৃষকরা আন্দোলনে লড়তে লড়তে এক সময়ে মোদীর মাথানত করে ছেড়েছে তেমনই একদিন নিয়মগিরিও জিতবে। খনি খোঁড়ার কোম্পানীগুলোও কিন্তু হাত গুটিয়ে বসে নেই – তারাও নেতা-মন্ত্রীর পেছনে টাকা ঢালছে। চাইছে এই লুণ্ঠনের বন্দোবস্তটা টিকিয়ে রাখতে।একদিন সবাই বুঝতে পারবে, আজকের নিয়মগিরির লড়াই শুধু ডো‌ংরিয়া কোঁধদের লড়াই নয়- সাম্রাজ্যবাদী লুটেরাদের হাত থেকে ভবিষ্যতে দেশকে, দেশের মানুষকে,জল-জঙ্গল-জমিকে বাঁচানোর লড়াই।’

ঐ দিন ‘দ্য ডি গ্রোথ’ – এর পক্ষে সৌরভ ও অমিতাভ উপস্থিত ছিলো।

‘দ্য ডি গ্রোথ’ কে দেওয়া বক্তব্য শুনতে ক্লিক করুন

https://youtu.be/w728uWEzHlk

আরও পড়ুন – এ কথাগুলো শুধু আমার নয়, এবং বলে চলতেই হবে