গঙ্গা শুধুমাত্র গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে নির্গত একটি জলধারা দিয়ে এত বড় শরীর অর্জন করেনি। গাড়োয়াল-কুমায়ুনের অসংখ্য ছোট বড়ো পাহাড়ি ঝরনা, নেপাল থেকে বিহারের উপর দিয়ে বয়ে আসা বেশ কিছু সমৃদ্ধ নদ নদী, এমনকি পশ্চিম ও মধ্য ভারতের রাজস্থান বা মধ্যপ্রদেশ থেকেও আগত বেশ কিছু জলধারার সম্মিলিত সংস্কৃতি নিয়ে তৈরি হয়েছে দশ লক্ষ ছিয়াশি হাজার বর্গ কিলোমিটারের গঙ্গা বেসিন। এই বিরাট ভৌগলিক ঘটনাক্রমে সামিল হয়ে দক্ষিণবঙ্গের অগুন্তি ছোট ছোট নদ-নদী-খালও পুষ্ট করেছে আমাদের প্রতিদিনের গঙ্গাকে। এইসব খালের বাস্তুতন্ত্র একাধারে তার জলজ জীবন এবং দু পাড়ের জনবসতি নিয়ে গঠিত। এমনই একটি জীবন্ত জলধারার নাম চরিয়াল খাল, গত তিন দশকে বিশ্বায়ন আর নগরায়নের জোড়া সাঁড়াশি চাপে এখন যার নাভিশ্বাস উঠেছে।
কলকাতা এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্রুভমেন্ট প্রোগ্রাম’- (KEIIP 2) প্রকল্পে এই সার্বজনীন প্রাকৃতিক জলধারা চড়িয়াল খালকে দেখানো হচ্ছে শুধুমাত্র শহরের ময়লা বয়ে নিয়ে চলার নর্দমা হিসেবে। এই প্রকল্পে খালের কিছু অংশকে কংক্রিটের করা হয়ছে এবং পূর্ব বেহালার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে মাটির নীচে নিকাশি নালা তৈরি করা হয়েছে। কোথাও কোথাও ১২ফুট থেকে ৪৫ ফুট চওড়া এই প্রসারিত প্রাকৃতিক জলভান্ডারকে সম্পূর্ণ বুজিয়ে ৩৫ ফুট নীচ থেকে ২৪০০মিমি পাইপের মধ্য দিয়ে নর্দমার জল বয়ে নিয়ে যাওয়ার আন্ডারগ্রাউন্ড সুয়ারেজ তৈরি করা হচ্ছে। সেই বর্জ্য জলকে পাম্প করে ফেলা হবে চড়িয়াল খালে।
এতো হলো চরিয়াল খালের শহর লাগোয়া দূষণের চিত্র। অপরদিকে খালটির গঙ্গা সংলগ্ন গ্রামীণ অংশের কারখানাগুলি থেকে বিগত ৩০ বছর ধরে মাত্রাছাড়া রাসায়নিক দূষণ চরিয়াল খালের জীববৈচিত্র্যকে প্রায় ধ্বংস করে ফেলেছে। এক সময় স্থানীয় মাছের বিপুল উৎস এই চরিয়াল খালে এখন আর মাছ প্রায় পাওয়া যায় না বললেই চলে। অন্যান্য জলজ প্রাণীর অস্তিত্বও চরম সংকটের মুখে।
অথচ ‘গঙ্গা অ্যাকশন প্ল্যান’ থেকে ‘নমামি গঙ্গে’ পর্যন্ত গঙ্গা দূষণ রোধে দিনরাত কেঁদে-ককিয়ে যাচ্ছেন যে রাষ্ট্রনায়কেরা, এইসব নদী-নালা-খালগুলির রাসায়নিক দূষণ নিয়ে তারা মুখে কুলুপ এঁটে আছেন। আর পরিবেশ দিবসে সরকার পোষিত গণসংগঠনগুলির বক্তব্য শুনলে মনে হয় তাদের নির্বিকল্প সমাধি হয়েছে।
সুতরাং শেষ ভরসা যে দু’চার গাছা মানুষ এখনো সর্বনাশের মুখে বালির বাঁধ দিতে চাইছেন তাঁরাই। দক্ষিণ শহরতলীর ‘থার্ড প্ল্যানেট’ নিজেদের ন্যূনতম সামর্থ্য নিয়ে তাদের পাশে দাঁড়াতে চাইছে।
গতকাল, ৫ই জুন, বিশ্ব পরিবেশ দিবসে এই সংগঠন চরিয়াল খালকে সংস্কার এবং সংরক্ষণের দাবিতে মহেশতলা ডাকঘর থেকে মহিষগোঠ, মিঠাপুকুর হয়ে বজবজের চরিয়ালে গঙ্গার মোহনা পর্যন্ত ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি সাইকেল র্যালি সম্পন্ন করলো। যাত্রাপথে খালের দুপারে জনবসতির মানুষের মধ্যে সচেতনতা প্রসারের উদ্দেশ্যে প্রচারপত্র বিলি করা হয় খালটির সংক্ষিপ্ত বিবরণ এবং সংগঠনের দাবিগুলি জানিয়ে।
মহিষগোটের যুবক বলছিলেন, রাসায়নিক মুক্ত চরিয়াল খাল তারাও চান কিন্তু বিকল্প জীবিকার সন্ধান না পেলে জীবিকা হারানোর ঝুঁকি কেই বা নিতে চায়?
রামেশ্বরপুরের প্রৌঢ়া খাল উপচানো মাছের স্মৃতিচারণ করছিলেন, আর বলছিলেন এখনো মাঝে মাঝে সন্ধ্যের দিকে খালপাড়ে ছাঁকনি জাল ধরেন মাছের আশায়। জালে মাছ তেমন পড়ে না, তবু অভ্যাস যাবে কোথায়?
মিঠাপুকুরের বৃদ্ধ এই বলে আক্ষেপ করছিলেন যে, মাত্র তিন দশক আগেও এই খালের জল পান করা যেত। অথচ নয়ের দশকের শুরু থেকে লাগামহীন দূষণের ফলে পান করা তো দূরের কথা, এখন এর জলে স্নান করলেও চর্মরোগ হয়। যাত্রা পথে বহুবর্ণ মানুষের সাথে এই মতবিনিময়ই হয়তো পরিবেশ দিবসের সাইকেল র্যালির সর্বোচ্চ প্রাপ্তি।
‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস ২০২৩’-এ থার্ড প্ল্যানেটের দাবি: —
১)সরকারি প্রকল্প গ্রহণ করে নিয়মিত হারে চরিয়াল খালের সংস্কার করতে হবে।
২) চরিয়াল খালকে নর্দমায় পরিণত করার KEIIP 2-এর প্রকল্প বন্ধ করতে হবে।
৩) চরিয়াল খালকে রাসায়নিক দূষণ থেকে মুক্ত করতে হবে।
৪) খাল সংলগ্ন কারখানাগুলির রাসায়নিক শোধনের সরকারি উদ্যোগ নিতে হবে।