কুন্দেশ-সন্ধান

অটোরিক্সাটা আমাদের নামিয়ে দিল। জঙ্গল আর মালভূমির এক অন্তহীন রাস্তা তবুও উত্তাল সামুদ্রিক ঢেউয়ের মাথায়, উঠছিলাম আর নামছিলাম।
সবার আগে ক্যাপ্টেন; চব্বিশ ঘন্টা মাথায় আটকে থাকা ক্যাপের ভাইজার ঠিক করতে করতে ভেতর থেকে বেরিয়ে এল। সে ছিল ড্রাইভারের পাশে । অরুণবাবু আর বিশুও গোটা কয়েক ব্যাগ নিয়ে মাঝের বসার জায়গা থেকে বেরিয়ে এল। পেছনের বুট কাম সিটিং থেকে ভূমিষ্ঠ হলাম আমি আর প্রভাতদা । নীচু করে রাখা মাথা-ঘাড় আর বাঁকিয়ে রাখা পিঠ-কোমর আস্তে আস্তে সোজা হচ্ছিল । বন্ধ করে রাখা চোখ দুটো দিনের আলোর গেটপাস মিলিয়ে নিচ্ছিল। লালমাটির কাদারঙা অটোটা এতটুকুও সময় নষ্ট করল না। সামনের পাহাড়ি আমগাছটাকে একপাক ঘুরে উলটো দিকের উৎড়াইয়ে ফুড়ুৎ হয়ে গেল। তবুও তার সম্মোহনী ইঞ্জিনের গ্যাঁ…গররর হারিয়ে গিয়েও হারাচ্ছিল না।

ভরা শ্রাবন। জোলো হাওয়া। ছকবাঁধা চোখে মাপা যায় না…বিপুল আকাশে ছাইছাই মেঘের ঢাকনা। একটু একটু করে কালো হচ্ছে! কাঁকুড়ে ঘাসের নীচের জল স্যান্ডেল পেরিয়ে পায়ের পাতা স্পর্শ করছে। ন বৃষ্টি হয়ে গেছে একটু আগে। মেঘ-সবুজ ঘাসে ঢাকা একটা ঢালু সমতল আমাদের সামনে। কিছুটা গিয়ে হঠাৎ করেই সেই ডাঙা শেষ হয়ে গেছে। তার পরেই আবার মেঘমলাটের আকাশ। ক্যাপ্টেন হাত তুলে সেই দিকটা দেখাল;
‘এবার শুরু করতে হবে ! এই জল, বৃষ্টি এটাই চাইছিলাম আমরা। এটাই সুযোগ । চলুন , …’
আমার গায়ে জ্বর! দুই চোখ টকটকে লালজবা। অগুনতি মহাজাগতিক পোকা যেন কুটকুট করে কামড়াচ্ছে পেশী…যন্ত্রণা! গলায় ঝোলানো গামছা দিয়ে, কষে একটা পাগড়ি বেঁধে নিয়েছি মাথায়। মাথাব্যাথা যদি একটু কমে।

আমি আর ক্যাপ্টেন এগিয়ে এসেছি। ঢালু ডাঙাটা এইখানে আচমকা ঝাঁপ দিয়েছে। ফুট দশেক নীচে বুনো ঝোপঝাড়ের মাথা। ক্যাপ্টেন কোন সরেজমিন তদন্তে গেল না;
‘ষাট-সত্তর ফিট। নামতে হবে আমাদের!’
পায়ের নীচে বন-জঙ্গলের ডালপালা ধরে ধরে নামার মত লম্বালম্বি একটা শুঁড়িপথের আভাস। ক্যাপ্টেন মাটিতে বসে পড়ে পা ঝুলিয়ে দিল ঐ খাদের পথটা বরাবর। তারপর নিজেকে ভাসিয়ে দিল সেই শুড়িপথ লক্ষ্য করে। এক লহমায় সে আমার দিকে মুখ করে নামতে শুরু করল;
‘ নেমে পড় সুখেন। বৃষ্টিটা জোরদার আসার আগেই এই খাদ পেরিয়ে সামনের জলাভূমিতে চলে যেতে হবে?’
গাছপালার মাথাগুলো বেশ দুলছে। ঝপঝপ আওয়াজ হচ্ছে;
‘মাথাটা তুলে একবার সামনে তাকিয়ে দেখ। জল-সবুজের এমন রূপ আগে দেখেছ?’
সামনে তাকালাম। সত্যি সামনে একশো আশি ডিগ্রি ধরে চোখ ঘোরালে জলে আর সবুজে মেশামেশি । যার কোন শেষ নেই। শহুরে শ্যাওলা জমা চোখে মেঘরঙা এই অপার্থিব ভূমিরূপের অস্তিত্বে বিশ্বাস হতে চায় না।
‘কী হল, নামছ না কেন?’
শুড়িপথের ফাঁক দিয়ে ক্যাপ্টেনকে আর দেখা যাচ্ছে না! অনেক… অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে তার কন্ঠস্বর। দুচোখ বুজে সেই অচেনা সবুজ-রাস্তায় ঝাঁপ দিলাম ব্যাগ, পাগড়ি আর প্লাস্টিক-স্যান্ডেল ছিল বলে পিঠ, মাথা আর পায়ের নীচের চামড়া বেঁচে গেল। বাকি পোষাক ও শরীরে অদেখা এই রাস্তার প্রচুর চিহ্ন থেকে গেল;
‘আপনারাও নেমে আসুন এক এক করে। আমি আর সুখেন একটু এগিয়ে দেখছি…’
ক্যাপ্টেন ডানদিক বরাবর এগোতে শুরু করেছে। বেশ জোরেই হাঁটছি, নাহলে ক্যাপ্টেনের সাথে তাল মেলানো যাবে না।

‘দেখবেন দেশি দূরে যাবেন না। আপনাকে ছাড়া পুরো রাস্তার খণ্ডগুলো জোড়া দেওয়া যাবে কী করে?’
‘ক্যাপ্টেন সব সামলে নেব। একটা ছোট বেস ক্যাম্পের জায়গা ঠিক করে নাও।’
প্রভাতদা তারপরে বিশুর গলা। পুবদিক থেকে বয়ে আসা হাওয়ার তেজ বাড়ছে সাথে জলের গুড়ো । মেঘের মলাট আর ছাইরঙা নেই। কালোর পরত ঘন হচ্ছে। পায়ের নীচে এখনও হালকা কাদা মাটি। স্যান্ডেল বারবার পিছলে যাচ্ছে। ক্যাপ্টেন দিব্যি এগিয়ে যাচ্ছে। বাধ্য হয়ে ডাকলাম;
‘ক্যাপ্টেন প্লিজ একটু দাঁড়ান!’
‘দাঁড়ানোর জন্য তো বেরোইনি সুখেন।’
বলতে বলতেই সে উবু হয়ে বসে পড়ল। ভ্রু কুচকে জলে ভেজা ঘাস জমির দিকে তাকিয়ে থাকল।ত যতটা সম্ভব পায়ের জোরে এগিয়ে এলাম তার কাছে। সে আবার উঠে দাঁড়াল। দূরের ঝোপ-জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসছে বাকি তিনজন। ক্যাপ্টেন উত্তর –পশ্চিম কোনে ঘুরল;
‘ঐ যে দেখছ, ঐ যে ঢিপিটা ঐ খানেই বেস-ক্যাম্প।’
‘কী দেখছিলে নীচু হয়ে ক্যাপ্টেন?’
‘ স্রোতের কালচে রঙ’
‘কালচে…’
‘ হুঁ…বালি, পাথরের গুড়ো মিশে থাকে তো!’
(২)
পুব দিকের একেবারে শেষপ্রান্তে ওরা তিনজনজন। আমি আর প্রভাতদা ঢিপিটার মাঝখানে ব্যাগপত্রগুলো ভালভাবে সঙ্গে আনা প্ল্যাস্টিক দিয়ে ঢেকে রাখছি। বাইরে আছে শুধু নিজেদের জলের বোতল, বিস্কুটের প্যাকেট। প্রভাতদার ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিল না; এই খোলা জায়গায় এভাবে ব্যাগগুলো যার মধ্যে নিজেদের মোবাইল, মানিব্যাগ সব আছে ,সেইসব রাখা যায়! দূর থেকেই সেকেন্ডের ভগ্নাংশে ক্যাপ্টেন জিজ্ঞাসু চোখে তার দিকে তাকাল। তারপর চোখ সরিয়ে নিল পশ্চিমদিকের বিস্তীর্ণ জল-ডাঙার অনন্তে।

‘ক্যাপ্টেন, এগুলো ঠিক ঢিপি না। এর নীচে যেতে পারলে নিশ্চই ছোটখাট কোন বিহারের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যাবে।’
হাওয়ার তোড়ে কথাগুলো বড্ড কাঁপছে ? জলের ছাট আরও বাড়ছে। জমাট মেঘের বুক কাঁপানো মিশমিশে তুলিতে চারপাশের রঙ ঢেকে যাচ্ছে। অরুণবাবুর হলদে বাটিক প্রিন্টের ফতুয়াই শুধু চোখে পড়ছে। বাকি তিনজন কালিরঙা স্কেচ।
‘ দেশের পুরোনো দিনের কথা, কতটা আমরা আর জানতে পারলাম? একেবারেই অদ্ভূত না! নদীর তীরেই তো সভ্যতা গড়ে ওঠে!’
‘ কিন্তু অরুণদা, এখানে তো নদীর শুরু আর এটা তো বর্ষাজলের পাহাড়ি নদী। তিন-চারশো কিলোমটার যাওয়ার পরে তবে নৌকা যেতে পারে!’
বিশুর প্রশ্ন, অরুণবাবু উত্তর দিচ্ছে না। আমাদের কাজও শেষ! প্রভাতদা বাঁদিকে মাথা ঝঁকিয়ে ইশারা করল আমাকে;
‘ আরে এভাবে একমাত্রিক ইতিহাস জানা যায় নাকি! জিওগ্রাফি, জিওলজি, ফোক-অ্যান্থ্রো-আর্কিও থিয়োরিগুলো আগে জানতে হবে। তারপর দেখতে হবে প্রুফ কী কী আছে! তারপর একটা মত দেওয়া যায়, কী বল?’
উত্তর দেওয়ার কোন দায় নেই আমার। না দিলেও অভদ্রতা দেখায়! তাই হ্যাঁ-না এর মাঝমাঝি মুচকি হাসলাম একটু। প্রভাতদা আমার দিকে তাকায়নি। আমারও হাসিতে কোন আওয়াজ ছিল না। প্রভাতদা চুপ। দশ দিক জুড়ে দেখতে চাইছি। দক্ষিণ-পুবে বেশ কিছুটা দূরে সেই ঢাল যেখান থেকে আমরা নেমে এসেছিলাম। তার পিছনে মালভূমির রেঞ্জ। বাকিটা ঘোলা জল আর সবুজের নকশা। কোন জ্যামিতিক আকারেই তাকে ধরা যাবে না। নতুন লাগানো ধানের চারা, কোথাও ঘাস আবার কোথাও বা জলজ আগাছা! পাঁচ-ছটা একসাথে বা দু-একটা তালগাছ কোথাও কোথাও জল-সবুজ ভেদ করে উঠে এসেছে।

‘এবার তাহলে আমরা শুরু করব। আমরা এখান থেকে উত্তর-পশ্চিম দিকে যাব। কুন্দেশ্বর এখানে কুন্দেশ বলে সবাই…এখান থেকেই শুরু তার।’
ক্যাপ্টেন টুপির ভাইজারে আবার হাত দেয়। তারপর এগোতে থাকে। আমরা সবাই তার পেছন পেছন। ক্যাপ্টেন ঢিপির ঢাল বরাবর নামতে থাকে। প্রভাতদার মুখ থেকে আর একবার বেরিয়ে আসে;
‘ব্যাগ সাথে থাকলে ক্ষতি কী হত?’
ক্যাপ্টেন জলে এমনভাবে হাটছে যেন কোন পাতিহাঁস তার দুটো পায়ের পাতা ধার দিয়েছে তাকে। ঠিক তার পিছনে বিশুও যেনহাঁসের ছানা;
‘প্রভাতদা এখানে একটা চোরা-কাদার দলদল আছে। পড়লে আপনি গেলেন, মোবাইলটাও যাবে। লোকেশান আর ট্র্যাক করতে পারবে না কেউ!’
‘মাই গুডনেস! চোরাকাদা? গুগলে তো দেখায়নি! ইস, ঐ জঙ্গল থেকে একটা করে লাঠি ভেঙে আনলে ভাল হত! ঠুকে ঠুকে বোঝা যেত কোথায় বিপদ’
‘এটা পাহাড়ি রাস্তা না প্রভাতদা! পাথর, লাঠিকে ঠেলবে না। ক্যাপ্টেনই এখানে গুগুল ম্যাপ-গুগল আর্থ । সে জানে কোথায় কী আছে! চিন্তা নেই কমরেড! ’
বিশুর থুতনির নীচে হালকা ছাগলদাঁড়ি। চে-র মুখ আঁকা ময়লা জলপাই টি-শার্টে আর দুস্টুমি ভরা খুদে চোখদুটোতে আচমকা প্লাবন সমভূমির মোহনা জেগে উঠল। গান ধরল সে;
‘আমি আশায় আশায় বসে রইলাম মাঝি…’

ক্যাপ্টেন অনেকটা এগিয়ে গেছে। বিশু তাল মেলাতে না পেরে অরুণবাবুর সাথে হাটছিল। এখন আমি সবার পেছনে। জ্বরের ক্লান্তি আচমকাই কামড়ে ধরেছে। অরুনদা পাকা লম্বা দাঁড়িতে হাত বুলিয়ে বলল;
‘ সামগান, বৌদ্ধ মন্ত্র এসবের সুর আমাদের পরম ঐতিহ্য! সেই সুর থেকেই সব সুর, সব গানের সৃষ্টি!’
প্রভাতদা একটুএগিয়ে হাটছিল। দাঁড়িয়ে পড়ল;
‘ফোক থেকেই কোর্ট মানে রাজসভার কালচার। এটা সবাই মানে এখন অরুণদা।’’
‘তাহলে প্রাচীন ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থা যেখানে অরণ্যে গুরুগৃহে জীবনের একটা সময় কাটাতেই হত সেটা রাজসভার সংস্কৃতি? পশ্চিম যা বলবে সেটাই মানতে হবে, এ কেমন কথা?’
‘ তা কেন, ফুকোরা যা বলছেন…নতুন জ্ঞানের আলোয় পুরোনোকে গড়ে নিন তাহলেই সব জানা যাবে?’
‘তাহলে পুরোনো জ্ঞাণ অভ্রান্ত নয়?’
বিশু দুজনের মাঝখানে ছিল দাঁড়িয়ে পড়ল;
‘দাদারা, এখন নদী খুঁজছি। সে তো নতুন-পুরোনো সবকিছু ছাড়িয়ে বইছে!’
দুজনেই চুপ করে গেল। মোটা মোটা ফোঁটায় বৃষ্টি নামল। আমার জ্বর আরও বাড়ছে। পাগড়ির শক্ত বাঁধন, মাথার যন্ত্রণাকে বেঁধে রাখতে পারছে না। শীত করছে খুব। তবুও থামব না। হাটু সমান জল-ধানগাছ-জংলি ঘাসের এই মহামিলনে গভীর একটা ডুব দএতে ইচ্ছা করছে।
(৩)
ঘোলাটে জলরাশির মধ্যে এক কালচে স্রোতধারা । উত্তর-পশ্চিম থেকে দক্ষিণ-পুবে বয়ে চলছে। তিন-চারশো কিলোমটার দূরে চার-পাঁচশো ফিটের বিস্তার যে কুন্দেশ্বরের সে এখানে কুন্দেশ। কোথাও একফুট, দেড়ফুট কোথাও ছয়ইঞ্চি কোথাও আরও সরু। কখনও ধানজমির আলের পাশ দিয়ে কখনও এই ঘোলাটে জলঘাসের মধ্যে স্রোতের চিহ্ন রেখে রেখে। তার স্রোত বরাবর বিপরীত দিকে আমরা এগোচ্ছিলাম। কিন্তু ঠিক এখন, এই যে এখানে দাঁড়িয়ে আছি আর তার কোন খোঁজ নেই! সামনে এবার শুধুই বর্ষার জলে ভাসা প্রান্তর। কোন সবুজের চিহ্ন নেই। ক্যাপ্টেন চশমাটা ঠিক করে নিয়ে ঝুঁকে দেখছে;
‘বুঝলেন অরুণদা এর কাছাকাছি স্পটটা; যেটাকে ধরা হয়। কিন্তু এটা ঠিক না। আরও আরও কিছুটা দূর থেকে আসছে কুন্দেশ। এখানে বালি কোথায়? কাদা আর কাঁকড়।’
‘ যেখানে জল সেখানেই সপ্তসিন্ধবঃ!… তাহলে আশার পূরণ হল না ক্যাপ্টেন?’
‘ তার মানে, সে কি হয় নাকি! ক্যাপ্টেন বলছিল! ভরা বর্ষাতেই আসল রিভার সোর্স খুঁজে পাওয়া যাবে। আর এটা একটা… সিম্পল আরও কয়েক ঘন্টা জলকাদায় হাটলেই নিশ্চই খুঁজে পাওয়া যাবে। তার জন্যেই তো আসা! একটা নতুন কিছু কন্সট্রাকশানের, পুরো বিশ্বকে নতুন তথ্য জানানোর সুযোগ চলে যাবে ?’
প্রভাতদার রাগ কার ওপরে অরুণদা নাকি ক্যাপ্টেন? অরুণদা নিজের ডানগালে ছোট্ট একটা চাপড় মেরে বলল;
‘এই জলেও এত মশা! এই দিনের বেলায়?’
‘এ আমাদের চুলকে ফুলকি তোলা মশা নয় দাদা! একেবারে জাত মশা এডিস-ডেঙ্গু, চিকনগুনিয়া…’
বিশুর গলায় মজার ছোঁয়া;
‘ কী বল?’
প্রভাতদা ভাল করে হাতের পাতাদুটো লক্ষ্য করতে থাকে;
‘ বিশু , সত্যিটা লুকোচ্ছিস কেন? নোনা জলাভূমিতে এডিসের উৎপাত বেশি। আর এ হচ্ছে বর্ষার চারমাসের জল। কমবেশি মুভ করছে। এখানে ভয় পাওয়ার কিছুই নেই!’
ক্যাপ্টেন কখন ঘুরে দাঁড়িয়েছে লক্ষ্যই করিনি। অরুণদা এবার জলের দিকে তাকিয়ে কী যেন খুঁজছে;
‘ কুন্দেশ তাহলে এই পর্যন্তই! ক্যাপ্টেন… ধৈর্য একান্তভাবে ভারতীয় ঐতিহ্য আর সাধনার বিষয়। ঋষিরা হাজার হাজার বছর তপস্যা করতেন এক লক্ষ্য অর্জন করতে! আর আমরা? কেউ রাশিয়া, কেউ চীন, কেউ আমেরিকার শিষ্য! সামান্য কয়েক মিনিট ধৈর্য রাখতে পারছি না। খোঁজ…অনুসন্ধান এসব কি কয়েক মিনিটের ব্যাপার? সারাজীবন লেগে যায়!’
আমি কেন প্রভাতদার দিকে তাকালাম জানি না। সে চুপ করেই থাকল কিন্তু বিশুর চোখদুটো শক্ত;
‘অরুণদা, এরকম জলাভূমি পেরোত মাও-এর লংমার্চ, রাতে জলের মধ্যেই ঘুমোত তারা। নলখাগড়া দিয়ে একজন আরেকজনকে শক্ত করে বেঁধে গোল করে দাঁড়িয়ে ঘুমোতে হত… যাতে কেউ না জলের মধ্যে পড়ে যায়।’
‘কেন ডাঙা দিয়ে কি বিপ্লব হয় না?’
‘ স্থলপথে চিয়াং কাই শেকের মেশিনগান রেজিমেন্ট। আর এদের কাছে গাদা বন্দুক, পুরোনো রাইফেল । তবুও আট-দশ হাজার মাইল পেরোতে হয়েছিল … চিন, ভারত, বেড়াগুলো তো আমরাই বানিয়েছি, তাই না! যে পাখিটা উড়ে আসে সাইবেরিয়া থেকে তার কাছে এটাও নিজের দেশ। ধৈর্য থাকে দাদা…কিন্তু কেন ধৈর্য সেটাই আসল…’

ক্যাপ্টেন আবার বেশ কিছুটা এগিয়ে। বিশুও এখন তার পাশে। ক্যাপ্টেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে আমাদের। ছপাৎ ছপাৎ করে দৌড়ের ভঙ্গি করেই যতটা আগে পারি গেলাম। আকাশছোঁয়া বর্ষার ঘোলাটে স্থির জলের মধ্যে সেই কালচে জলের ধারা আবার দৃশ্যমান। তবে বড্ড …বড্ড সরু । কোথাও কোথাও একেবারে সরু সুতোই যেন। সোজা না, আঁকাবাঁকা। মাঝেই মাঝেই ভেঙে যাচ্ছে তারপর আবার জুড়ছে। বিশু চিৎকার করে উঠল;
‘কুন্দেশ হে…’

(৪)

বিশু ছবি তুলছে। একেবারে আধুনিক ক্যামেরা। এর সাথে নাকি সরাসরি ইন্টারনেট, উপগ্রহ সংযোগ সব করা যায়। অনেক কষ্টে ক্যাপ্টেনকে বুঝিয়ে সঙ্গে আনতে পেরেছে। কুন্দেশের একেবারে সোর্স পয়েন্টে পৌছে গিয়েই এর মাধ্যমে ল্যাটিচিউড, লঙ্গচিউড ঠিক করে গোটা বিশ্বকে জানিয়ে দেওয়া যাবে। তার সাথে ছবিও পৌছে যাবে। বিশুকে বললাম;
‘হ্যাঁ রে, এখানে এত ছবি তুলছিস কেন? যদি ব্যাটারি কমে যায়?’
বিশু তখন ক্যাপ্টেন আর আদিবাসী বৃদ্ধা রাখালিনীকে ফোকাস করছে। বৃদ্ধা আর ক্যাপ্টেন দুজনেই মাটিতে উবু হয়ে বসে। তাদের পেছনে বৃদ্ধার সঙ্গী জনা চারেক মাঝবয়সি আদিবাসী;
‘সুখেনদা এই যে নদীকে খুঁজছি সেই পথেই তো এদের সাথে মোলাকাত! এই সব কিছুই থাকবে ছবিতে। ভাব তো, ঘন্টা চার-পাঁচ ধরে পাগলের মতন জল ভাঙছি আমরা। যারা এর আগে খুঁজে পেয়েছিল তাদের দেওয়া লোকেশান ফেলে এগোচ্ছি তো এগোচ্ছি। এই একবার দেখতে পাই তো আবার লুকোচ্ছে কুন্দেশ! জল শেষ, বিস্কুট শেষ। ঠিক সেইসময় এরা ডাকল। জল দিল,খেতে দিল কুড়িয়ে পাওয়া পাকা তাল…ঐ দেখ?’
প্রভাতদাকে আঙুল তুলে দেখাল বিশু। প্রভাতদা এখনও যে পাকা তালটা খেতে শুরু করেছিল সেটাই শেষ করতে পারেনি। প্রবলভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছে!

সত্যি সত্যি জলে তখন যেন আর আমার শরীরের কোন শক্তি ছিল না। যেকোন সময় জলের মধ্যেই বসে পড়ব। ভাবছিলাম, জ্বরের জন্যই শুধু এমন হচ্ছে আমার। কিছুক্ষণ পর আমি না অরুণবাবু বসে পড়ল জলের মধ্যে। দুচোখ বন্ধ। কী করা যায়; তখনই পশ্চিম দিক থেকে কিছু গলার স্বর ভেসে এল। অনেকটাই দূরে উচু ডাঙায় কিছু মানুষ আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে। অরুনবাবুকে প্রায় চ্যাঙদোলা করে আনা হল। দক্ষিণ পশ্চিম থেকে বেশ কিছুটা পশ্চিমে সরে এসেছি। যে ডাঙা থেকে আমরা নেমেছিলাম, তারই অন্য দিক।
‘সুখেনদা কুন্দেশের শুরুটা আজ যেভাবেই হোক পাব! এটাও তো লড়াই…সেই লড়াই-এর পথেই দেখ, এই আদিম সমাজের মানুষগুলো মানে যাদের আমরাই আদিম বানিয়ে রেখেছি নাকি তারা অভিমানে এখনও ঐ পর্যায়ে রয়ে গেছে জানি না; যাদের দুপুরের খাবার এই জঙ্গল থেকে কুড়িয়ে পাওয়া পাকা তাল! কী আশ্চর্য তাই না! আর আমরাও তাদের দেওয়া সেই পাকা তাল খেয়েই বেশ পেট ভরালাম, গায়েও জোর পাচ্ছি! বাড়ি ফিরলে মনে হবে …অদ্ভূত!…ইয়েস এই অদ্ভূত মানুষদের এই যে লড়ুয়ে জীবন দেখতে পেলাম! সেটাও থাকবে, কুন্দেশের সৃষ্টিপথের অ্যালবামে! বিপ্লব কী হবে জানি না… কিন্তু ছবিতে লড়াইয়ের কথা বলব বলেই তো এলাম!’
বিশু ক্যামেরা বন্ধ করে প্রভাতদার পাশ থেকে একটা পাকা তাল তুলে নেয়।

আমি ক্যাপ্টেনের কাছে যাই। সে সেই বৃদ্ধার সাথে তখনও কথা বলছে। শরীরের সর্বত্র কুচকুচে বলিরেখাই যার একমাত্র পরিচয়;
‘টুকচা বস্যে যান বাবুরা! বড্ড কাহিল যে আপনার লোকগুলান! ঐ যে ইখন জল! পানি লামার আগে… ই সব কাঁকড়ে ভরা জমিন। এক কুড়ি, দু কুড়ি কত মাইল হবে কে জানে? শুখা, এক ফোটা পানি লাই কুত্থাও। তার কুথায় যে কুন্দেশ ভগমান পোরকোট হয়্যেছে তার কি ঠিক আছে? …টুকচা বস্যুন।’
‘ আপনি তাহলে বলতে পারবেন না, ঠিক কোথায়…’
যেদিক থেকে আমরা এসেছি সেই দিকে আঙুল তুলে দেখায় বৃদ্ধা;
‘ উই …উই দিকে! জমিন টুকচা লরম আছ্যে। সিয়ার লিগ্যা পানি পড়লে উদিকে ধান উগায়। আবার ঘাঁসও আছ্যে। ভইসগুলা উদিকে চল্যে গেলে মাহাতগুলার ক্ষেতি হব্যে। তাই উদিকে আমরা যাই না। ইখান থিক্যে পানি খাওয়াই! দেখলম,আপুনারা জল ঠেঙ্গাইয়ে যাইচ্ছ! তো সবাই বুলল বাবুদের সাথে একটু কুথা বল্যি…কুথায় যাচ্ছ্যে…’
প্রভাতদা এসে গেছে। সে বৃদ্ধাকে থামিয়ে দিয়ে বলল;
‘ তোমরা ঠিক জান…একবার বল না।’
মোটা পাচন দিয়ে একটা বুড়ো মোষের পিঠ চুলকে দিচ্ছিল জোয়ান ছেলেটা । সে বলল;
‘ কুন্দেশ, মোদের বাপ বল, মা বল। বাপ, মা কুথা থেকে জন্মায়, কেউ দিখায়?…চল হে! সাঁঝ এস্যে পড়ল বলে! মাহাত রাগ করবে। জঙ্গলে চিতে আছ্যে…’

মাহাতের মোষ, সারাদিন চড়িয়ে সন্ধ্যাবেলায় একথালা মুড়ি বা জলভাত, সাথে পেঁয়াজ আর একপেট মউল। বছরে তাই বা কদিন মেলে। আমাদের সাথে অকারণ কথা বলে সেই সুযোগ কেউ নষ্ট করতে চায়? ওরা ফিরে যাওয়ার পরে ক্যাপ্টেন এসব জানাল। যাওয়ার সময় বৃদ্ধা ক্যাপ্টেনকে বলে গেল;
‘ দিনির আলো মর‍্যে আস্যছে। সময় বড় কম। আপুনারা ঘরকে যা, কুথায় দলদল আছে কে জান্যে…’
ক্যাপ্টেন সেই প্রসঙ্গটাই আনল আমাদের কাছে;
‘ এরা ভুল বলে না। ওপরের জঙ্গলের রাস্তায় মাঝে মাঝে চিতাও দেখা যায়। আমি একটা দলদল জানি…সেটা ফেলে এসেছি। কিন্তু এই বিরাট জলকাদা, এর কোথায় যে কী আছে! আপনারা কী আর যাবেন? আপনারা বরং ফিরে যান। আমি এগোই…’
ভেবেছিলাম বিশু বলবে কিন্তু বলল প্রভাতদা;
‘ আলো তো ফেরার পথেও পাব না! সঙ্গে আপনি আছেন…আমরা আপনার সাথেই যাব!’
তারপরে বিশুর কাঁধে হাত দেয় সে;
‘ লাইব্রেরির তাকে তাকে কত গ্রন্থ কত জ্ঞান! এতদিন যা বই পড়ে জেনেছি তাকে ডাইনে, বাঁয়ে, উঁচুতে, নীচুতে নানাদিক থেকে ভেঙে গড়ে পিটে বুঝে নিতে চেয়েছি। জীবনের আর সব কোথা থেকে কীভাবে কখন চলে গেছে বুঝতে পারলাম না! কিন্তু অন্যের কথাকেই বারবার নতুন করে দেখার চেষ্টা করলাম। এই প্রথম খোলা আকাশের নীচে এসেছি। একটা ইতিহাসের গঠণ দেখতে যাচ্ছি। এই সুযোগ তো আর পাব না! যাই হোক যাব।’
‘অরুণদা?’
কোন উত্তর এল না। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখি আমাদের সবার আগে অরুণবাবু প্যান্ট গুটিয়ে জলে নেমে পড়েছেন।
(৫)
মেঘলা সন্ধ্যায় আলো প্রায় আর নেই। প্রায় ঘন্টা দুয়েক পেরিয়ে এসেছি। কুন্দেশের সাথে লুকোচুরি খেলতে খেলতে। কিন্তু সেই স্পট যেখান থেকে কুন্দেশ বেরিয়ে এসেছে, তা আর পেলাম কই! আমাদের সবারই হাতের পাতাগুলো সাদা, আঙুল চিপশে গেছে। প্রত্যেকেই কাশছে, চোখদুটো লাল সবার। মনে হচ্ছে সবারই আমার মত জ্বর এসেছে। কেউ বেশি কথা বলছে না। যেটুকু বলছে তার মাঝেই কেঁপে উঠছে। যেখানে এসে কুন্দেশকে থামলাম তার ঠিক সামনে জংলা কাঁটাঝোপের উঁচু দেয়াল। কুন্দেশের কালো সুতো খুঁজতে গেলে ঐ দেয়াল ভেদ করে যেতেই হবে! আমরা দাঁড়িয়ে পড়েছি। ক্যাপ্টেন আমাদের রেখে একেবারে কাঁটাঝোপের দেয়ালটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। কিছুটা ঝুঁকল। তারপর কোন এক গোপন পকেট থেকে একটা দেশলাই বের করল। অনেক চেষ্টায় বৃষ্টি আর হাওয়ার আক্রমণ বাঁচিয়ে একটা একটা করে কাঠি জ্বালিয়ে জলের দিকে তাকিয়ে ফের কুন্দেশকে খুঁজতে শুরু করল।

মেঘলা দিনটা একটু একটু করে রাত্রির দেহে হারিয়ে যাচ্ছে । আমরা চারজন চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি কতক্ষণ। অরুণদার গলা পেলাম;
‘গঙ্গে যমুনে সরস্বতী শতুদ্রি সতোমেঁ সচতা পরুষয়া…অসিকন্যা মরুদ্রথে বিতস্তা ইয়ার্যীকীয়ে সরুদ্যা সুষমাঃ…এরাই আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের ভারতবর্ষের প্রাণ। এই কুন্দেশ কি তার বাইরে ? কুন্দেশের খোঁজে এতদূর এসেছি। সে এখন আর দেখা দিচ্ছে না! আমাদের যাত্রাপথ এখানেই শেষ…এ যাত্রার মোক্ষলাভ হয়েছে…’
কথা বলার শক্তি প্রায় নেই। মাথার ভেজা পাগড়ি খুলে ফেলেছি অনেকক্ষণ আগে। পুরো শরীরে জল। প্রচন্ড… প্রচন্ড শীত করছে তবুও বলে ফেললাম;
‘ অরুণদা আপনি সবার আগে জলে নামলেন যে…’
‘সুখেনবাবু… ধৈর্য মানুষের বৈশিষ্ট্য। তা কখনও অসীম হতে পারে? অন্বেষণের সীমা শেষ হয়েছে আমাদের। …অগ্রে প্রকেতম সলিলং সর্বাম ইদিং…তখন শুধু জল আর জল, অন্য কিছুই ছিল না। আজও জল আর জল, আদিম জল, আকাশে মাটিতে সর্বত্র। সেই মহাজলদেহেই কুন্দেশ মিলিয়ে গেছে। তাকে আর পাব কোথায়? এবার ফিরতে হবে।’

প্রভাতদা আর বিশু দুজনেই চুপ করে রয়েছে। আন্দাজে পরস্পরের মুখ আমরা পড়ে নিচ্ছি। ওরাও কি ফিরে যাবে? বৃষ্টিও হঠাৎ করেই থেমে গেল। নিজেদের দিকে না তাকিয়ে এবার আমরা ক্যাপটেনের দিকে তাকালাম। একটা জ্বলন্ত মোটা মোমবাতি হাতে আমাদের দিকে পিছন ফিরে সে দাঁড়িয়ে আছে। খুব মনোযোগ দিয়ে কাঁটাঝোপের দেয়ালটা দেখছে। মোমবাতিটাকে ক্যাপ্টেন কোথায় লুকিয়ে রেখেছিল সে প্রশ্ন তখন আর কারও মাথায় ছিল না। অবশ শরীর আর মন তখন মেনে নিয়েছে ফিরে যেতে হবে। তখনই ক্যাপ্টেন ফের একবার চমকে দিল । মোমবাতিটা বিশুর হাতে দিয়ে বলল;
‘ পেছোনোর উপায় নেই, এই পথেই যেতে হবে।’
তারপর দুহাত দিয়ে কাঁটাঝোপ সরিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে পড়ল সেই ঝোপজলের মধ্যে। মুহূর্তের মধ্যেই শুনতে পেলাম তার গলা;
‘এক এক করে সবাই চলে আসুন। বিশু আগে থাকুক।’
প্রবল সম্মোহনে আমরাও হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে পড়লাম সেই সদ্য সদ্য তৈরি হতে থাকা কাঁটাঝোপের সুড়ঙ্গে। আমি সবার শেষে। মোমবাতির আলো তেমন পাচ্ছিলাম না কিন্তু বুঝতে পারছিলাম কোথাও একটা মৃদু স্রোতধ্বারা বইছে। আমাদের হাত-পায়ের আওয়াজ, নিশ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ পেরিয়ে সেই জলধারা ক্ষীণ কুলুকুলু শব্দ শোনা যাচ্ছে। সামান্য ঢাল বেয়ে আমরা উপরের দিকে যাচ্ছি। মাটিতে জলের পরিমাণ কমছে, কাঁকড়ের পরিমাণ বাড়ছে। আমরা এগোচ্ছি হামাগুড়ি দিয়ে। কাঁটাঝোপের খোঁচা, রক্তপাতের কোন অনুভূতি আর নেই।
(৬)
সেই অ্যামবুশ কতক্ষণ চলল মনে নেই। বিশুর কানফাটানো চিৎকারে থামলাম;
‘মিল গায়া, মিল গায়া কমরেড…খুন কি ঝান্ডা মিল গায়া’
ঝোপ শেষ । মাথার ওপর খোলা আকাশ। একটা হাত দেড়েক ব্যাসার্ধের গোলাকার কালচে জলভরা গর্ত। আমাদের উল্টোদিকে গর্তের ধারে ক্যাপ্টেন বসে আছে। তার দুহাতে কালচে-হলুদ বালি;
‘এমন বালি এখানে এই গভীরতায় আর কোত্থাও নেই…’
আমরা ক্যাপ্টেনের কাছে গিয়ে ভাল করে দেখতে থাকি। তাই তো…তার মানে! বিশু গর্তে হাত ঢুকিয়ে ঐ বালি তুলে আনে। আবার চেঁচিয়ে ওঠে;
‘পেরেছি। কুন্দেশের মূল সোর্স পেয়ে গেছি। এখান থেকেই শুরু। হুররা…’
কিছুক্ষন সবাই হতবাক! বিশ্বাস হতে চায় না! এই ভয়ঙ্কর দুর্যোগের দিনে কয়েক বর্গকিলোমিটারের বিশাল বানভাসা রুক্ষ প্রান্তরে যাকে হারিয়ে ফেলেছি। তাকে একেবারে তার উৎসস্থলেই খুঁজে পেলাম! প্রায় শেষ হতে বসা মোমের আলোয় প্রভাতদা পুরো জায়গাটা ভাল করে দুচোখ দিয়ে জরিপ করতে শুরু করলেন। অরুণবাবুর দুই চোখে জল;
‘ভগীরথ গঙ্গাকে মর্ত্যে এনেছে। আজ এই পঞ্চ ভগীরথ, গঙ্গার আরেক পুত্র কুন্দেশের উৎস আবিস্কার করল। বিশু তোমার ক্যামেরা দিয়ে ছবি তোলো আমাদের । তারপর জানিয়ে দাও সারা বিশ্বকে। অবশেষে চল ফিরে যাই। এখনও নির্জন অথচ পবিত্র অরণ্য কন্দরে ভারতের পরমাত্মার প্রকাশ এইভাবে!…আহা!’
বিশুর ছবি তোলা আর থামছে না;
‘ সুখেনদা সারাদিনের এই লড়াই-সংগ্রাম আজীবন মনে থাকবে!’
প্রভাতদা বিশুকে ডাকছে;
‘ বিশু আমার একটা ছবি তোলো ভাই।’
অরুণবাবুও ছবি তোলার জন্য বিশুকে ডাকছে।

কিন্তু ক্যাপ্টেন কোথায় গেল? ক্যাপ্টেন যে নেই! যেদিক দিয়ে এসেছিলাম তার ঠিক উল্টোদিকে খাড়া পাথরের দেয়াল। ক্যাপ্টেনকে খুঁজতে খুঁজতে সেই দেয়ালের একেবারে সামনে চলে এসেছি। এত দূরে মোমের আলো পৌছোচ্ছে না! ভরসা টুকরো আকাশ থেকে আসা তারার আবছা আলো। আর তাতেই দেখলাম দেয়াল বরাবর সরু জলের একটা ধারা নেমে আসছে তারপর গিয়ে মিশছে ঐ গর্তে। ক্যাপ্টেন তাহলে…। জ্বরে তপ্ত, জলে ভেজা , কাটার খোঁচা খাওয়া অসাড় রক্তাক্ত হাত, পা আঁকড়ে ঐ দেয়াল বেয়ে উঠতে শুরু করলাম।

(৭)

ভেজা ঘাসেঢাকা ঢালু কাকুড়ে সমতল। সম্ভবত যে ঢালে নেমেছিলাম সকালে তারই অন্য কোনো দিক। অনেক দূরে দেখা যাচ্ছে চলমান ক্যাপ্টেনের আকৃতি। আমি সর্বস্বখোয়া ফকির…শ্বাস টানতে টানতে দৌড়ে ধরে ফেললাম তাকে;
‘কোথায় যাচ্ছ ক্যাপ্টেন? যা খুঁজছিলাম তা তো পেয়ে গেছি। তাহলে?… কোথায় যাচ্ছ?’
‘পেয়ে গেছ…বেশ! কী খুঁজতে বেরিয়েছিলে সুখেন?’
‘ মানে? প্রভাতদা, অরুণবাবু, বিশু…এরা সবাই মানে আমরা সবাই কুন্দেশের উৎপত্তি…’
‘না সুখেন তোমার কথা বল। ওদের কতটা কী জান?’
‘আসলে…সারাদিন জ্বরে পুড়ে মরতাম। একদিন কোথা থেকে একটা দমকা হাওয়ায় আমার দরজা, জানালা সব খুলে গেল। দেখলাম আমাদের গেঁয়ো নদীটার পাশের রাস্তা দিয়ে তুমি চলেছ। তোমার পিছুপিছু অরুণবাবু, প্রভাতদা, বিশু। সেই হাওয়া উড়িয়ে এনে ফেলল তোমাদের দলে। সেই থেকে তোমার পেছনেই আমি। চলতে চলতে ওদের কথায় কথায় জানলাম…’
‘বেশ, আমি কি তোমায় কখনও বলেছি কিছু?’
‘না তো!’
‘ এখন তুমি বাড়ি ফিরে যাবে সুখেন?’
‘কেন? তুমি তো সেদিকে যাচ্ছ না…’
‘বেশ, চল…’
‘কিন্তু কোথায়?’
‘কোথায়? আচ্ছা মাটিতে দেখ…কী দেখছ?’
‘সরু সেই কালচে জলের ধারা।’
কে যেন হ্যাচকা টানে আমায় থামিয়ে দিল। পাথরের দেয়াল থকে জলের ধারা নেমে মিশছিল সেই গর্তে…আর এখানেও কালচে জলে ধারা! তবে কী কুন্দেশ?…
‘ ক্যাপ্টেন এই ধারা কোথা থেকে আসছে?’
‘এই ঢাল পেরিয়ে । ঐ রেঞ্জ পেরিয়ে।’
‘ কিন্তু ওখান থেকে তো বরাকর?’
‘হ্যাঁ…এই ধারা বেয়ে চলে যাব বরাকর। তার স্রোত ধরে দামোদর। তার বুক ছুঁয়ে গঙ্গা, তারপর সিন্ধু। তারপর একে একে টাইগ্রিস, হোয়াংহো, দানিয়ুব, টেমস, অ্যামাজন…এইভাবে চলতে থাকব। চলতে হবে…চলতে চলতে আবার একদিন কুন্দেশ্বর, কুন্দেশ!’
‘যদি এই ধারাগুলো কেটে রাখে কেউ, বেঁধে রাখে কেউ…’
‘তাহলে?…এই দেখ সুখেন।’
এক বিশাল দৈত্যাকার হাতুড়ি কখন যেন নিজের ডান হাতে ধরে ডান কাঁধে তুলে নিয়েছে ক্যাপ্টেন। এতবড় হাতুড়ি!…এটাকেই বা কীভাবে লুকিয়ে রেখেছিল সে?
‘ এই হাতুড়ি দিয়ে সব বাঁধ ভেঙে দেব না!…আর সময় নেই। এবার আমি চলি।’

ক্যাপ্টেন জোর পায়ে এগিয়ে যায়। কাঁধে হাতুড়ি। নির্মেঘ কৃষ্ণপক্ষের আকাশের তারার আলোয় তাকে মায়াবী মনে হয়। কিন্তু আমি…আমাকে তো যেতেই হবে তার সাথে। উপায় নেই। আমি দৌড়ে তার নাগাল পেতে যাই। আমার জ্বর অনেকক্ষণ নেমে গেছে।

আরও পড়ুন – কুরোসাওয়া এঁর দুঃস্বপ্ন ও স্বপ্ন থেকে সত্যজিতের আগন্তুকের শেষ