কয়েকদিন আগে সমাজ মাধ্যমে আমরা দেখতে পারি গড়ের মাঠের একটি গাছে ভগবানের নাম লেখা টাইলস লাগানো হয়েছে। গাছ কে ভগবান ভাবা হবে কিনা এই সব নিয়ে নানা বিতর্ক সমাজে বর্তমান। পরের দিন আমরা গেলাম কয়েকজন সেখানে দেখতে , দেখলাম মাটি সিমেন্ট মাটি সিমেন্ট দিয়ে গাছের কোঠরে টাইলস লাগানো হয়েছে এবং একটি তুলসী গাছ এর চারা পোঁতা হয়েছে। গাছটি অতি প্রাচীন একটি মেহগনি গাছ । যেদিকে টাইলস লাগানো হয়েছে তার অপরদিকে যাওয়ায় আমরা পেলাম গাছটিতে বিশাল একটা খোদল বা কোটোরের সৃষ্টি হয়েছে। এবং সেই খোদলের ভিতর গাছের গায়ে অনেক দেব দেবীদের টাইলস লাগানো। এবং গাছের নিচের অংশটা রীতিমতো বসার জায়গা তৈরি করা হয়েছে। একটা ভাঙা ফাইবার বোর্ড দিয়ে দরজা করাও হয়েছে।এর সঙ্গে আছে একটি লাঠি,লাল ধর্মীয় কাপড় ইত্যাদি। এরপর একটু খোঁজখবর করতেই পাওয়া গেল। একজন বৃদ্ধা মহিলা কে। তিনি এসে আমাদের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলেন। জানা গেল তিনি নিজের পয়সায় একটু একটু করে এই গাছের কোটরটিকে সাজিয়েছেন। এটি বছরখানেক আগেই হয়েছে। ঐদিকে যাতায়াত করা সাথী রাজা কানে কানে জানালো বেশ কয়েক বছর ধরেই এটা এরকম হয়েছে।বাইরের দিকে টাইলস টা কয়েকদিন আগে লাগানো হয়েছে। যেটার ছবি সমাজ মাধ্যমে আমরা প্রথম দেখতে পেয়েছিলাম। ওই মহিলার ব্যাখ্যায় ওইখানে মানুষ এসে গাছটিতে নোংরা করে যায়। আর যারা ওই অঞ্চলে যাতায়াত করেন তারা জানেন, ছোট্ট একটু আড়াল পেলেই কত রকম ঘটনা ওখানে ঘটতে পারে। মেহগনি গাছের ওই কোটোরটিতে ৬৪ কলা না হলেও এক দুটি কলা-কৌশল খুব সহজেই করা সম্ভব। এইসব আটকাতেই ঐ বৃদ্ধার এইরকম ভগবানের আশ্রয়। আমরা যখন তাকে জানালাম যে এই রকম করাতে আপনার গাছটি মারা যেতে পারে। ভারতবর্ষের অসংখ্য মানুষ নানা ভাবে নীতি-নৈতিকতা বজায় রাখতে নিজেদের মনের শক্তি জোগাতে এইভাবে ভগবান ধর্মকে আশ্রয় করে বেঁচে আছি মনস্তাত্ত্বিক গিরিন্দ্র শেখর বলছেন যতদিন মানুষের সমাজ থাকবে ততদিন সমাজে ধর্ম ভগবানও টিকে থাকবে। এইসবে আমাদের মত নাস্তিকের কোন লেনা দেনা নেই। দীর্ঘদিন বিজ্ঞান আন্দোলন আন্দোলন করার মধ্যে দিয়ে আমরা ধর্ম ভগবান ইত্যাদি থেকে অনেক দূরেই থেকেছি। কিন্তু বর্তমান সময়ে বারবারই নিজেদেরকে প্রশ্ন করছি। আমাদের প্রিয় ভারতকে জানার চেষ্টা করেছি । যে এই আস্থাশীল মানুষগুলো এই ধর্ম-ভগবান কি তাদের কাছে? ‘তাদের’ অর্থাৎ শ্রমজীবী মানুষ, প্রান্তিক মানুষ যারা রাষ্ট্রক্ষমতা, অর্থনৈতিক ক্ষমতা থেকে বহু দূরে বিরাজ করেন। তাদের এই আস্থাশীলতাকে তাদের প্রকৃতির উপর অধিকার বোধকে আমরা কিভাবে ব্যাখ্যা করব? বৃদ্ধা বললেন “হিন্দু মুসুলমানের ব্যাপার আমি চাই নি” “গাছ আর ভগবান কে আমি প্রচন্ড ভালোবাসি”। এই মহিলার মধ্যেও কোনরকম ষড়যন্ত্র বা বিশ্ব প্রকৃতির জীব জড়ো কারোর প্রতি কোন বিনষ্টকারী মনোভাব আছে বলে মনে হল না। তাই সেদিন আমাদের সঙ্গে হাতুড়ি শাবল থাকা সত্ত্বেও গাছ মন্দির ভেঙে শুধু গাছ উদ্ধারে গেলাম না। শুধু ওই বৃদ্ধা মায়ের সঙ্গে আরেকটু আলাপচারিতার চেষ্টা করলাম। তার সঙ্গে একটা শ্রদ্ধার-বিশ্বাসের-মানবতার সম্পর্ক তৈরীর চেষ্টা করলাম। আর বন্ধুদের কাছে আবেদন রাখলাম এনার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে। এই মহিলা দেবতার নাম লেখা টাইলসের আড়ালে গাছ এবং গাছের কোটরটিকে পরিচ্ছন্ন রাখার চেষ্টাই শুধুমাত্র করছিলেন। কয়েকদিন পরেই সৌরভ রায় আমি বৃদ্ধা নিজে গাছের বাইরের দিকে তুলসী গাছ লাগানো টাইলস ভেঙে ফেলে গাছকে মুক্তি করছেন সেই ঘটনার সাক্ষী থাকলাম। এবং কোটোরের ভিতর থাকা টাইলসগুলোকেও খুলে নেবেন জানালেন। ইতিমধ্যে একটি সংগঠন এইরকম গাছে হঠাৎ করে মূর্তি বসানোর বিরোধিতা করে প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়ে থানায় অভিযোগ জমা করেছে। প্রথম দিনের ওই বৃদ্ধার সঙ্গে আমাদের আলাপচারিতা একটি ছোট্ট তথ্য তথ্যচিত্রের মাধ্যমে সমাজ মাধ্যমেও ছড়িয়ে ফেলা গেল দ্য ডি গ্রোথ পোর্টালের সহযোগিতায়। এরপর গত 11 তারিখ সকালে সেনাবাহিনীর পক্ষে থেকে এসে গাছটির সমস্ত দূষণ মুক্ত করিয়েছেখবর পেলাম। গড়ের মাঠের মালিক সেনাবাহিনী। মালিক তার গাছের পরিচর্যা দায়িত্ব গুরুত্ব সহকারে সঠিকভাবেই পালন করেছে। এর জন্য অবশ্যই সেনাবাহিনীর সাধুবাদ জানা উচিত। এইরকমই রাজ্যের প্রশাসনও নিশ্চয়ই গাছের ক্ষতি করে যেখানেই সিমেন্ট-পাথরের পরিকাঠামো গড়ে উঠবে তার বিরুদ্ধে যথার্থ ভূমিকা পালন করবে। গণতান্ত্রিক দেশে যা স্বাভাবিক হওয়া উচিত। প্রাকৃতিক সার্বজনীন অঞ্চল গুলি ধর্ম স্থান না হয়ে উঠুক।
তাপস দাস
নদী কর্মী হিসেবে পরিচিত, বাংলা তথা ভারতের নদী আন্দোলনগুলির সঙ্গে যুক্ত থেকে দীর্ঘদিন কাজ করছেন তাপস দাস। বর্তমানে 'নদী বাঁচাও জীবন বাঁচাও আন্দোলন' সংগঠনের আহ্বায়ক।