রুটেন্ড ও রবসনের বৃদ্ধ নদীর বিস্তীর্ণ দুই পাড়

বইয়ের পাতার নথিবদ্ধ ইতিহাস শুধু জানার পরিসরটা বাড়ায়, প্রতিদিনের প্রতিটা মানুষের জীবন কিভাবে তার বর্তমান সমাজ ও পরিবেশের সাথে জড়িয়ে থাকছে- তার ভাঙা গড়ার সাথে মিশে যাচ্ছে তার উপলবদ্ধি করতে শেখায় না।তাই চার দেওয়াল থেকে বেরিয়ে পথে নেমে পড়তে হয়, নির্ধারিত সঃজ্ঞা গুলিকে সরিয়ে দেখলে আরও নানা পথ খুঁজে পাওয়া যায়।
নির্ধারিত ইজমের পথ ছেড়ে পরিবেশ ও জন জাতি সমাজ নিয়ে ভাবতে শেখায় ডি গ্রোথ ও নদী বাঁচাও জীবন বাঁচাও আনন্দোলনের স্বর- আর বয়ে যাওয়ার জন্য দুটি মাধ্যম তো আছেই, একটি সময় অন্যটি নদী। কিন্তু সময় তো নিজে কথা বলে আর নদী যেমন নিজের কথা বলে তেমনি তার কাছে এলে সে কথা জানতেও চাইবে।
এমনই একটি নদী এই মাটি পৃথিবীর প্রান্তভাগ থেকে বয়ে এলো এদেশে। সে নদীর নাম রুটেন্ড এঙ্গারা— পল রবসন তার Ol’ man River এর কাছে তার দুঃখ দুর্দশার কথা জানাতে গিয়ে সে যেমন কালের প্রবাহে নিজেই এক নদী হয়ে উঠলেন, তেমনি রুটেন্ড আদিম সুরটিকে বয়ে নিয়ে ফিরছে দেশে দেশান্তরে।
মানুষ ও পরিবেশের ভারসাম্য মূলক সহাবস্থানের ঐতিহ্যবাহী ধারণাকে সঙ্গে নিয়ে সে বেরিয়ে পড়েছে পৃথিবীর পথে। আমরা ক্রম উন্নতির পথে হাঁটছি, সে হাঁটছে এই পৃথিবীর প্রকৃত ক্রম মুক্তির পথে। উন্মত্ত চাহিদার ফলে সৃষ্ট শোষণনীতির বিপরীতে সে আমাদের কাছে নিয়ে এলো সু-চেতনা।
এই চেতনা প্রবাহের কাছে এসে জানা গেল তাদের টোটেম রীতির প্রাসঙ্গিকতা, কখনো সে শোনালো ঔপোনিবেশিক শোষণ যন্ত্রণার কথা, কখনো উঠে এলো রাজনৈতিক স্বার্থরক্ষায় মানুষের মধ্যে বিভেদের জাল ছড়িয়ে দেওয়ার চক্রান্ত। যে জাল কাঁটাতার হয়ে ভাগ করে দিয়েছে এ বঙ্গভূমির মাটিকে, আক্ষেপে রটেন্ডকে এ কথা জানিয়েছিল তাপস দা ও সৌরভ।

Image Not Found

গত ১৩ই মার্চ কলকাতার প্রান্তে বসে এক আলোচনায় আমি রুটেন্ডকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম আমাদের এখানে নদীকে যেরকম স্ত্রী লিঙ্গ বিশেষে অভিহিত করা হয়, তেমন কি কোনো ধারণা আছে তাদের দেশে।
এর উত্তর দেওয়ার সময় রুটেন্ড জানালো লিম্পোপো নদীর কথা- যা দক্ষিণ আফ্রিকা ও জিম্বাবাওয়ের মধ্যে সীমান্ত রচনা করে ভারত মহাসাগরে মিশেছে। সেও আক্ষেপের সুরে জানায়- সে উন্নয়ণের ক্ষমতার জোরে সে নদীতে আর প্রাকৃতিক ভাবে জলের ধারা বয়ে যায় না বরং তা নিয়ন্ত্রিত হয় রাষ্ট্র ব্যবস্থার জাঁতাকলে।
একের পর এক বাঁধ নির্মাণ করে লিম্পোপো নদীর জল দক্ষিণ আফ্রিকার নগরকেন্দ্রিক জায়গা গুলিতে সরবরাহ করা হচ্ছে, ফলে লিম্পোপোর বেশ কিছু উপনদী শুকিয়ে গিয়েছে এবং রটেন্ডর মাতৃভূমি জিম্বাবাওয়েতে খরার প্রকোপ বাড়ছে।
কর্পোরেটের স্বার্থে উন্নয়নের এই সর্বগ্রাসী রূপ দেশ কালের পারে সর্বত্র একই থাকে – সুদূর আফ্রিকা থেকে এদেশের বঙ্গভূমির নদ নদী ও তাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা জন জীবন সেই একই সমস্যায় জর্জরিত।
একদিকে শিল্পপতিদের উদ্যোগগুলি পরিবেশ নীতিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে জল দূষণ করে নদীকে অবলুপ্তির পথে ঠেলে দিচ্ছে, অন্যদিকে রাষ্ট্র ব্যবস্থা কূটনৈতিক প্রক্রিয়ায় উপমহাদেশে নিজের ক্ষমতা বজায় রাখার জন্য দুই দেশের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলা নদী গুলির উপর বাঁধ নির্মাণ করেছে। এই কূটনৈতিক প্রভাব বিস্তার করতে গিয়ে দেশের অভ্যন্তরে অনান্য নদীগুলিতে জলের বন্টন একেবারে নিঃশেষ হয়ে গেছে।
ফারাক্কা বাঁধ থেকে মাত্র শ-তিনেক কিলোমিটারের মধ্যে ভারতের ভূ-ভাগে গঙ্গার যেসব উপনদী গুলি আছে সেগুলির অবস্থা ঠিক কেমন! একবার জানা যাক –
পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার বেশ কিছু নদী ভাগীরথী গঙ্গার পশ্চিম ভাগে এসে মিলিত হয়, যার বেশিরভাগটাই বৃষ্টির জলের দ্বারা সমৃদ্ধ হয়ে থাকে।
বীরভূমের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে গঙ্গায় গিয়ে মিশেছে মূয়রাক্ষি ও অজয়। এর মধ্যে মূয়রাক্ষির জল সরবরাহ করে আরও বেশ কিছু স্থানীয় নদী মূয়রাক্ষির সাথে মিশেছে- যেমন বক্রেশ্বর, বীরভূমের একটি গুরুত্বপূর্ণ নদী মূয়রাক্ষির সাথে মিশে তাকে জলের যোগান দেয়। কিন্তু এবারে শান্তিনিকেতন ঢোকার মুখে হাতিকরা ব্রিজের তলায় বক্রেশ্বরের হতশ্রী অবস্থা দেখে শোকাহত হলাম – এই দৃশ্য রুটেন্ডও দেখেছিল।

রুটেন্ড

এই বক্রেশ্বরে আবার জল বয়ে এনে মিলিত হয়েছে কোপাই নদী, হাঁসুলি বাঁকের কাছে। এই কোপাই এর উৎপত্তি, পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত পেরিয়ে ঝাড়খন্ডের ভিতরে, সেখানে আদিবাসিদের কাছে পরিচিত শাল নদী হিসাবে।
শান্তিনিকেতন আমার কুটিরে এসে রুটেন্ড কোপাইকেও শীর্ন অবস্থায় দেখেছিল আর আদিবাসী গ্রামে নিরুপায় মানুষের আকুতি শুনেছিল এই নদীর পর্যাপ্ত জলের অভাবে তাদের চাষ আবাদ বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে।
১৪ ই মার্চ রুটেন্ড তাপস দাস সহ ডি গ্রোথের অনান্য কর্মীদের সাথে রাজনগর কুশকর্ণী আশ্রমে যায়। কুশকর্ণী নদীও মূয়রাক্ষীর উপনদী – এই নদীর কথা পরে জানাচ্ছি, আগে শাল নদী পাড়ের দুঃখ বৃতান্ত বলে নিই।
রাজনগর থেকে ১০- ১২ কিমি দূরে ঝাড়খণ্ডের ভীতরে জোকপাহাড়ী গ্রামের কাছেই শালজোড় নদী, এখানে এই নদী আরও কয়েকটি নিকটবর্তী জলধারার সাথে মিলিত হয়ে সৃষ্টি করেছে কোপাই নদী।
এই জোকপাহাড়ী গ্রামে মূলত আদিবাসী জন গোষ্ঠী মানুষের বসবাস। কুশকুর্ণী আশ্রমকে নিজেদের পরিচর্যায় যারা ভরে রাখেন নরেন মূর্ম ও কেনারাম মূর্ম র কারাম গুরুর বাড়ি জোকপাহাড়ী গ্রামে, সেখানেই আমাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। কারাম গুরু নরেশ মারান্ডী এখন বৃদ্ধ হয়েছেন, বহুকাল যাবৎ তিনি এই কারাম সংস্কৃতির চর্চা ও প্রচার চালিয়ে আসছেন, কারাম গান এই লোকসংস্কৃতির একটি অঙ্গ। কারাম গুরুর বর্তমান উত্তরসূরিরা আমাদের সামনে সেই গান পরিবেশনা করলে, রুটেন্ডও যোগ দেয় তাতে। সংস্কৃতি দর্পণে এক হয়ে গেল সাঁওতাল গ্রাম আর আফ্রিকার বন প্রান্তরের সুর ও স্বর।

রুটেন্ড

এই সংস্কৃতির মেল বন্ধনের পাশাপাশি, আমরা সেখানকার স্থানীয় মানুষদে্র কাছে তাদের জীবন জীবিকা ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশের ব্যাপারে জানতে চাই – এই প্রসঙ্গেই তারা বলে স্থানীয় শালজোড় নদী একসময় সেচের জন্য জল যোগান দিত, এখন বছরের বেশিরভাগ সময়ে জল হাঁটুর কাছাকাছি। সেচের অভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে কৃষিকাজ, আক্ষেপ করে জানালো স্থানীয় মানুষেরা, জীবিকা নির্বাহের জন্য বেশিরভাগই এখানে মজুর খাটে, মহিলারা আশে পাশের বন জঙ্গল থেকে ডাল পাতা কুঁড়িয়ে জ্বালানি সংগ্রহ করে। এই গ্রামের কয়েক প্রজন্ম ধরে মানুষ গ্রামের বাইরে জীবিকার সন্ধানে পাড়ি দেয় নি, তাদেরই বর্তমান প্রজন্ম এখন উপার্জনের তাগিদে পাড়ি দিচ্ছে কলকাতা, চেন্নাই, বোম্বাই।
রুটেন্ড তার মাতৃভূমির ইতিহাস জানাতে গিয়ে বলেছিল উপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদিরা কিভাবে তাদের দেশের সম্পদকে লুঠ করেছিল, আদিম সংস্কৃতি ও পরিবেশের বাস্তুতন্ত্রকে ছিন্ন বিছিন্ন করেছিল নিজেদের আদব কায়দায়- বর্তমানে উন্নয়নের ধ্বজাধারিরা শুধু এটাই করে না তার সঙ্গে সঙ্গে সকলের অজ্ঞাতসারে মানুষকে ভিটে মাটি ছাড়া করে, মানুষের জীবন জীবিকার উপর প্রভাব বিস্তার তাকে চালিত করে এক অনিশ্চয়তার দিকে, এবং ওই চেন্নাই মুম্বাইয়ের মতো শহর গুলিতে পাড়ি দেওয়া পরিযায়ী শ্রমিকদের গায়ে হিউম্যান রিসোর্সের এক কদর্য ছাপ বসিয়ে দেয়।
কুশকর্ণীর অবস্থাও ক্রমশ শোচনীয় হয়ে উঠেছে— গত দু বছর ধরে নদী বাঁচাও জীবন বাঁচাও আন্দোলনের কর্মীরা স্হানীয় মানুষ জনের সাথে যুক্ত হয়ে কুশকর্ণী নদী সমাজ গড়ে তুলে মানুষের মধ্যে সচেতনতার প্রসার ঘটাচ্ছে। রাজনগরে রাণিগ্রামের কাছে কুশকর্ণী নদীর পাড়ে গড়া হয়েছে কুশকর্ণী নদী সমাজ আশ্রম। নদীর একদিকের পাড়ে ইট ভাটার চিমনি গুলি যেমন মাথা তুলে প্রগতির ধ্বংস ধ্বজার নিশান উড়াচ্ছে তেমনি নদীর এপাড়ে এই আশ্রমে জীবন ধারণের জন্য নূন্যতম চাহিদাটুকুর সংস্থান করার মাধ্যমে পরিবেশকে রক্ষা করার দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে এই আশ্রমের কিছু মানুষ। পিনাকী আচার্য, সৌগত চৌধুরী, তপন সিনহা্র মতো মানুষেরা কুশকর্ণী নদী পরিবেশের সাথে একাত্ম হয়ে আছেন। এই লক্ষ্যেই গত বছর ডিসেম্বরে তারা কুশকর্ণীকে কেন্দ্র করে আশে পাশের গ্রাম গুলিতে সচেতনতা মূলক পদযাত্রার আয়োজন করে।
কুশকর্ণী নদী ঝাড়খণ্ড লাগোয়া সীমান্ত থেকে উৎপত্তি হয়েছে, এরপর সাহাবাদ, রাজনগর, গাঙ্গমুরি হয়ে পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়ে তিলপাড়া ব্যারেজের কাছে মূয়রাক্ষীর সাথে মিলিত হয়েছে। বর্তমানে এই নদীতেও বিলুপ্তির চিহ্ন গুলি স্পষ্ট হচ্ছে। শীত থেকে গ্রীষ্ম জল শুকিয়ে কোমর সমান হয়ে পড়ে, কোনো প্রবাহ থাকে না জলে, নদী পথের বেশিরভাগ জায়গাতেই উঁচু বালি মাটির ঢিবি গঠিত হয়েছে, গজিয়ে উঠেছে ঘাস, কল্মীলতা, হোগলা। ইট ভাটা গুলিতে এই মাটি যেমন কাঁচামালের যোগান দিচ্ছে তেমনি ভাটার জ্বালানি থেকে বেরিয়ে আসা ছাই বজ্য নদীতে মিশে নদীর জলকে দূষিত করে তুলেছে। কেনারাম বলছিল এই জলদূষণের ফলে নদীর মাছের পরিমাণ কমে গেছে, আগে স্হানীয় মানুষ মাছ ধরে কিছু উপার্জন করতো এখন সেটির আর উপায় নেই।
এসব কথা শুনলে এই শীর্ণ নদীর মতো একটা গ্লানির ধারা মনের মধ্যে প্রবাহিত হয়। শুধু পরিবেশের ক্ষতি নই তার সঙ্গে সঙ্গে এই জনজাতি মানুষ গুলির জীবনযাত্রাকে পরিবর্তিত করে দেওয়ার অপরাধের দায় কে নেবে !
রুটেন্ড’র এই কুশকর্ণী ভ্রমণ পর্ব শুধুই আক্ষেপের অশ্রুতে সিক্ত ছিল তেমনটা নয়, শেষটায় বরং কিছু ভালো লাগার কথা বলি যার সাথে নদীকে অন্যরকম ভাবে খুঁজে পাওয়া যায় —
জোকপাহাড়িতে কারাম গুরুর বাড়িতে কারাম গানের সাথে রুটেন্ড তার যে নিজের মাটির সুর মিশিয়ে দিয়েছিল, তার ভাষায় সেই গানের নাম হলো মন্ডোনো। এই গানে আফ্রিকার সিংহের নদী থেকে জল খাওয়ার কথা বলা হয়েছে— জল খাওয়ার সময় সেই জলের ধারার সাথে আফ্রিকার আরও অনান্য নদীর ধারা মিশে যাওয়ায় সেই সব নদীর নামও বলা হয়েছে সেই গানে। আহা এ যেন প্রকৃতির যথাযথ একটি স্তবগাথা, জন জাতীর এই গানে ফুটে উঠছে নদীর প্রকৃত বৈচিত্র্যময় রূপটি।
নদীকে এই ভাবে বইতে দিলেই জীব জন্তু– মানুষ সকলের মঙ্গল, পাহাড় থেকে উপকূল ভাগ সবজায়গার প্রাকৃতিক ভারসাম্য সুরক্ষিত থাকবে।
রুটেন্ডর দেশের যেমন সিংহ আছে তেমনি আমাদের বাংলায় বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার, কিন্তু সে তার চরম বিপন্ন পরিবেশের মধ্যে দাঁড়িয়ে আর নিশ্চিন্তে জলপান করতে পারছে না নদী থেকে — গঙ্গায় ফারাক্কা ব্যারেজ নির্মাণ হওয়ার পর ৮০ কোটি টন পলির পরিমাণ কমে এখন ১৭ কোটি টনে এসে দাঁড়িয়েছে — নিম্নভাগে পলি সঞ্চয় হচ্ছে না, বদ্বীপ গুলির আয়তন কমছে — সুন্দরবন ধ্বংসের পথে। এরপরের বার রুটেন্ড এখানে এলে কথা হয়েছে সুন্দরবন দেখাতে নিয়ে যাবো, বাদা বনের নোনা জলের জোয়ার ভাটায় মানুষের সুখ দুঃখ ভেসে যায় তার তরঙ্গে আবার এ তরী খানি ছেড়ে দেব।