প্রশাসন, আধাত্ম্যচিন্তা ও জলঙ্গীর নাভিশ্বাস

এই বছরের তাপপ্রবাহটি স্মরণাতীত কালের মধ্যে দীর্ঘতম ও শুষ্ক। বাংলার নদী-জলাশয়-নয়ানজুলি শুকিয়ে যাওয়ার কতটা অবদান তা অবশ্যই গবেষণাসাপেক্ষ। তবে গত বছর বৃষ্টিপাত তুলনামূলকভাবে কম হওয়ার কারণে কৃষ্ণনগরের পুকুরগুলিতে পুজোর পর থেকেই প্রায় জল ছিল না। গরমে শহরের পুকুরগুলি এতটাই শুকিয়ে গেছে যে বেশ কয়েকটি আপাতত খেলার মাঠ হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। এই নীচু মাঠগুলি সবুজ বলে, ঘাস-ওঠা মাঠের চেয়ে জনপ্রিয়। সেটা আপাতদৃষ্টিতে নির্দোষ মনে হলেও অতীতের অভিজ্ঞতা ভয়াবহ। আজকাল পুকুরে জল আর ফেরে না, পরে এই খেলার মাঠগুলি একটু করে উঁচু হয়ে যায়। তারপরও পুকুরগুলি বেঁচে থাকে, তবে বাস বা অটোস্ট্যান্ডের নামের অংশ হিসেবে।

Image Not Found

শহরের উপকন্ঠে স্বরূপগজ্ঞ গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্বর্তী হুলোর ঘাটের আগেই ফকিরতলা পেট্রোলপাম্পের কাছে জলঙ্গীর শীর্ণতা আরও প্রকট। হালে তৈরি রেলসেতু ও নির্মীয়মান জাতীয় সড়কের সেতু এ বছর জলঙ্গীর গলা টিপে ধরেছে।

প্রশাসন আধাত্ম্যচিন্তা ও জলঙ্গীর নাভিশ্বাস

গ্রামের মৎসজীবিরা মাছ যে প্রায় পাচ্ছেন না তা বলাই বাহুল্য। ফকিরতলা গ্রাম হলেও নদীর উল্টোদিকে মায়াপুরের সুবাদে পর্যটক প্রচুর। মুঠোফোন বলছে তাপমাত্রা বিয়াল্লিশ। এদিকে ডাবের দামও আগুন। যেগুলো এখানে পঞ্চাশ টাকা, কলকাতায় সেগুলো পঁয়ত্রিশ। ওপারেও পঞ্চায়েত এলাকা কিন্তু জমি বা ফ্ল্যাটের দামও কলকাতার সমান। সবই উঁচু মাঝে নদীই যা একটু বিপদে আর কি। তাই পেশা বদলে জেলেরা কখন যেন চুপ করে ডাব বিক্রেতা বা নির্মাণ শ্রমিক হয়ে গেছেন। নদীতে জল তলানিতে এবং দু’পাশ জুড়ে জমা করা হয়েছে কচুরিপানার জঙ্গল। স্থানীয় মৎসজীবিরা একে বলেন “কোমড়”। তারই পাশে নদীর মধ্যেই কংক্রিট দিয়ে বাঁধিয়ে তৈরি হয়েছে “শ্রী শ্রী গৌর নিতাই মন্দির“।

Image Not Found

পুরোহিতের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল তিনি বললেন “মন্দির কারা করেছে আমি জানি না”। তবে মন্দিরের মিটার তাঁরই নামে, রোজ সকালে তিনিই পুজো দেন। তাঁর বক্তব্য, তিনি এলাকার বাসিন্দা এবং শিষ্যদের অনুরোধে ও পঞ্চায়েত প্রধানের সন্মতিতে এই মন্দির তৈরি করেছেন। এমনিতে “দু’ হাজার সালের পর আর জলঙ্গীতে তো বন্যা হয় না”, তাই এতে সমস্যার খুব বেশি কিছু ওঁরা দেখেন নি। বরং এতে নাকি ‘অসামাজিক ক্রিয়াকলাপ’ নিয়ন্ত্রণে এসেছে তাই সব দলের কর্মীরাও নাকি তাঁদের সঙ্গে আছেন। এই এক মজার ব্যাপার। “সব দলের” কর্মীরা এক যখনই হয়ে কোন মহতী কর্মসূচি গ্রহণ করেন তা দেখি অবধারিতভাবে পরিবেশ বিরোধী হয়। আবার আমরা যখন ভোটের আগে রাজনৈতিক ইস্তেহার জলঙ্গী-অঞ্জনা-চালতেতলার খালকে জায়গা দিতে চিঠিপত্র দিই, তখনও বেশিরভাগ নেতা-ই “দেখছি/হবে” করে এড়িয়ে যান। ফকিরতলার মানুষের সঙ্গে কথা বলে মোদ্দা কথাটা যা উঠে এল, প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তায় ধর্ম তথা আধাত্মিক পথ ধরে মানুষ ইভটিজিং ও মাতালদের অত্যাচার থেকে মুক্তি পেলেন। তবে দাম দিল সেই সর্বংসহা জলঙ্গী নদী। সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা এই খন্ডচিত্রগুলি জুড়লে সর্বত্রই এক সত্য দেখা যাবে । দক্ষিণপন্থার উত্থানের সময় সুশাসনের অভাবে কিছু মানুষজন ধর্মকে ঢাল করে নানান বেআইনি কার্যকলাপ চালাতে বাড়তি সুবিধা পাচ্ছেন। পরিবেশের খেয়াল রাখা যে সুশাসনের সহায়ক, এই অমোঘ সত্য বুঝে কবে যে ভোটপ্রার্থীরা তাঁদের ইস্তেহারে পরিবেশ নিয়ে ভাবনা স্পষ্ট করবেন কে জানে!

প্রশাসন আধাত্ম্যচিন্তা ও জলঙ্গীর নাভিশ্বাস

সামনে পঞ্চায়েত ভোট, তাই জলঙ্গীর স্বাস্থ্য নিয়ে এসব প্রসঙ্গ তোলা অনুচিত। তবে এভাবে কৃষ্ণনগর শহরের চালতে তলার খাল হারিয়ে গেছে। বিখ্যাত নদী অঞ্জনা হয়েছে নর্দমা, বর্ধমানে বঙ্কেশ্বরী হয়েছে ‘বাঁকা নালা’, তারাপীঠের দ্বারকা নদও মৃতপ্রায়। খবরে পড়ি বাংলাদেশের বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ নদীর ওপরেও প্রায় খান পঞ্চাশেক মসজিদ মাথা তুলেছে।

কৃষ্ণনগর শহরের বুকেও অঞ্জনা নদীর নাভিশ্বাস তুলছে একাধিক সুরম্য এবং সুবৃহৎ গির্জা ও মসজিদের কংক্রিট। সম্প্রতি দেখছিলাম প্রতিবেশি এক দেশের জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন কিন্তু তাদের ওয়েবসাইটে বেশ কিছু তথ্য তুলে ধরেছে। দেশের জেলা ও উপজেলাগুলির নদী-দখলদারের নাম, দখলীকৃত সম্পত্তির বিবরণ, উচ্ছেদ না হয়ে থাকলে তার কারণ অবধি দেওয়া আছে। এই কাজটা না হলে কিন্তু পরে কোনদিন হৃত নদীগর্ভ পুনরুদ্ধার করার কথাও ভাবা যাবে না। আমাদের অঞ্জনা-জলঙ্গীর ছেঁড়া কাঁথার দিনলিপিতে এসব একলাখি স্বপ্ন বৈকি। তাই নদীকর্মীদের হয়ত সময় এসেছে অন্য দাবিগুলোর সঙ্গে প্রশাসনের কাছে এই নদীতে দখলদারদের তালিকাও দাবি করা।

ভারত এক মজার দেশ। আমাদের চন্দ্রযান পৃথিবীকে প্রথম জানাল যে চাঁদেও বরফ আছে। তাতে দেশে-বিদেশে আমাদের বুক গর্বে বুক ফুলে উঠল। আর যারা সে অর্থভার বহন করলাম, তারা সুশাসন খুঁজতে প্রশাসনের ভরসা ছেড়ে ধর্মকে আশ্রয় করি আর বিজ্ঞান ভুলে অবলীলায় নদী ধ্বংস করি। নদীর দেশ হয় না। চলার শেষও নেই। আছে শুধু দেখার অসীম ধৈর্য, সে শেষ অবধি দেখবে। তবে চুঁচুড়ার সরস্বতীর মতন জলঙ্গীও একবার অভিমান করে চলে গেলে আর ফিরবে না। হারানো পুকুরের মতন তাকেও খুঁজে নিতে হবে কোন পথ অথবা জনপদের নামে, যেভাবে কোন পুর্বপুরুষকে খুঁজে নিই আমরা তাঁর ফেলে যাওয়া চশমা অথবা ছড়ি হাতড়ে।

ফিচার ছবি – Mali