কলকাতা থেকে বিটি রোড ধরে ব্যারাকপুরে এলে টিটাগড় ছাড়ালেই যে ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন জনপদ আপনাকে স্বাগত জানাবে তার নাম তালপুকুর। রাস্তার পূর্ব পারে কৃষ্ণনাথ মিউনিসিপ্যাল স্কুল আর খানিক এগোলেই রাস্তার পশ্চিম পারে দাঁড়িয়ে আছে ব্যারাকপুর গভর্নমেন্ট স্কুল যার প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৮৩৭ সনে। পানীয় জলের সমস্যার সমাধান করার জন্য স্থানীয় সাধারণ মানুষদের আবেদনে সাড়া দিয়ে কমবেশী ২০০ বছর আগে রানী রাসমনি’র স্বামী রাজচন্দ্র দাস মহাশয় বি. টি. রোড এবং কে. এন. মুখার্জী রোডের সংযোগস্থলে তত্কালীন পঞ্চাননতলার বিশাল পঞ্চবটীর ঠিক পিছনে দেড় থেকে দুই বিঘা পরিমাণ একটি বিরাট পুকুর কাটিয়ে তার চারিপাশে তাল গাছের সারি লাগিয়ে দেন। সেই থেকে এই ঐতিহ্যবাহী পুকুটির নাম হয়েছিল তালপুকুর যার ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম। বর্তমানে তালপুকুর টি কাঙ্খিত সংস্কারের অভাবে কচুরিপানা বা অন্যান্য জলজ উদ্ভিদে কিছুটা ঢাকা পড়ে আছে। কিন্তু জলাশয়ের চরিত্র নিয়ে কোনো সংশয়ের অবকাশ নেই। স্বাভাবিক ভাবেই এলাকার মানুষের ভাবাবেগ জড়িত আছে এই জলাশয়ের সাথে।
অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক হলেও একথা সত্যি যে দীর্ঘদিন ধরে মাঝে মাঝেই জমি মাফিয়াদের নজরে পড়ে বিপন্ন হয়ে উঠেছে এই জলাশয়ের ভবিষ্যৎ। ব্যারাকপুর পৌর সভার ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের অন্তর্ভুক্ত এই তালপুকুর টি চানক মৌজার ২৫০১ দাগ নম্বরে অবস্থিত আছে। এই পুকুরে যে দীর্ঘদিন ধরে মাছের চাষ করা হয়েছে, তার স্বপক্ষে অনেক তথ্য রয়েছে। এমতাবস্থায় এলাকাবাসীর এবং পুকুরের মালিকানার শরিকদের অজ্ঞাতসারে, একদল লোক এসে পুকুরের সীমানা বরাবর টিনের বেড়া লাগিয়ে দিয়ে আক্ষরিক অর্থেই রাতের অন্ধকারে পুকুর ভরাটের কাজ শুরু করে দেয়। তাদের দাবি হল যে তারা জমিটির (পড়ুন পুকুরটির) আংশিক মালিকানা পেয়েছেন কোনো এক শরিকের কাছ থেকে। যদিও পুকুরের মূল মালিকদের বক্তব্য অনুযায়ী গোটা বিষয়টাই একটা জুয়াচুরির সামিল। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে মালিকানার প্রকৃত শরিক বা এলাকার অন্যান্য মানুষজন কিঞ্চিৎ ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে রয়েছেন।
বন্ধুরা, আপনারা অনেকেই অবহিত আছেন, যে, দেশের আইন অনুযায়ী জলাশয়ের চরিত্রবদল করা বা ভরাট করা মালিকদেরও ক্ষমতার বাইরে এবং জামিন অযোগ্য অপরাধ বলে বিবেচিত। Indian Inland Fisheries Act, 1984 এর Section 17A (as amended by Indian Inland Fisheries Amendment Act 2013) এর বিধান অনুসারে যে কোনো জলাশয়, তা যে মাপেরই হোক না কেন, তাকে বুজিয়ে দেওয়া যাবে না। এই বিষয়টি দেখার জন্য মিউনিসিপালিটির অন্তর্ভুক্ত জলাভূমির ক্ষেত্রে মিউনিসিপালিটির একজিক্যুটিভ অফিসার আর বাকি প্রায় সমস্ত জলাশয়ের জন্য সংশ্লিষ্ট জেলার জেলা শাসককে উপযুক্ত ক্ষমতা সম্পন্ন ব্যক্তি হিসেবে ঘোষণা করা আছে সরকারি গেজেটে। আমরা, নিম্নে উল্লিখিত সংস্থাগুলি, আমাদের মত করে গোটা বিষয়টা খতিয়ে দেখে, সমস্ত কর্তৃপক্ষকে আবেদন জানিয়েছি লিখিত আকারে বিভিন্ন সময়ে। কিন্তু আশানুরূপ ব্যবস্থা এখনো পর্যন্ত কিছু হয়েছে বলে জানা নেই। তবে এই বিশাল পুকুর/জলাশয়টি প্লট করে বিক্রি করার জন্য দুষ্কৃতকারীদের লাগানো একটা সাইন বোর্ড তারা সরিয়ে দিয়েছে। মত্স্য দপ্তর এবং ভূমি রাজস্ব দপ্তরের একজন আধিকারিক এসে বিষয়টি অনুসন্ধান করে তাঁর ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে কিছু রিপোর্ট দিয়েছেন বলে বিশ্বস্ত সূত্রে খবর পাওয়া গেছে।
জলাভূমি বা জলাশয়, জীববৈচিত্র্যকে সংরক্ষণের পাশাপাশি আমাদের পারিপার্শ্বিক প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রেও বিরাট ভূমিকা পালন করে থাকে। তাই সবাই এগিয়ে আসুন। রক্ষা করুন এই জলাশয়গুলি। রক্ষা করুন মানব সমাজ, রক্ষা করুন এই অপরূপ নীল গ্রহটি, যার নাম পৃথিবী।
আরও পড়ুন – যশোর রোডের গাছ ও পাগলা ঘোড়া