গাছপালা কাটা না কাটা নিয়ে চিন্তিত হন তিন ধরণের লোক। এক, যাদের গাছপালা মাটি জলের উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকতে হয় – যেমন প্রাথমিক উৎপাদকরা। দুই, যাঁরা ঘরের খেয়ে না খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোকেই জীবনের ব্রত করেছেন। তিন, যাদের ভাত-কাপড়-ছাদের নিশ্চিত যোগান আছে, পড়াশোনা আছে, কিঞ্চিৎ আলোকপ্রাপ্ত এবং পরিবেশ নিয়ে ভাবনা চিন্তার সময় আছে। এক থেকে তিনের মাঝামাঝি নানা ভগ্নাংশেও কেউ কেউ থাকতে পারেন। এর বাইরে যে বিপুল সাধারণ মানুষ – যাদের প্রতিদিনের ভাতের গ্রাস উপার্জন করার পরিশ্রম এমন সর্বগ্রাসী হয়ে উঠেছে যে পরিবেশ চিন্তা তাদের কাছে বিলাসিতা ছাড়া আর কিছুই নয়। উন্নতির এমন সব সংজ্ঞা আমাদের শেখানো হয়েছে, সেই সংজ্ঞার এমন বিশ্বায়ন হয়েছে যে আমরা মেনে নিয়েছি ব্যাংকক থেকে ব্যাংচাতরা, ম্যাঞ্চেস্টার থেকে মদনপুর – উন্নত জীবনের মান ও মানে একই। তার সঙ্গে তাল রাখতে গিয়ে ভাতের গ্রাসের বাইরেও অনেক কিছু ভোগ্য লাগে – যা পয়সা দিয়ে কিনতে হয়। এমনকি উন্নতির সংজ্ঞায় সম্মতি জানাতে এমন কিছু সার্ভিস, যা কিনা জনতার ভোটে নির্বাচিত সরকারের কাছ থেকে এমনিই পাওয়ার কথা ছিল – তাও কিনতে হয় নগদ কড়ি ফেলে – যেমন শিক্ষা, যেমন স্বাস্থ্য। প্রাইভেটে ‘ফেলো কড়ি মাখো সার্ভিস’ পদ্ধতিকেও তাই স্বাভাবিক উন্নতি বলে মেনে নিয়েছি। ফলে নিছক ভাত-কাপড়-ছাদ নয়, চাহিদা এখন উন্নতির সেই বুর্জ খলিফা। সারা বিশ্ব জুড়েই উন্নতির ঠুলি পড়িয়ে মানুষকে আসন্ন ডুম্স ডে বা দুম ফটাস দিনের দিকে চোখ ফেরাতে দেওয়া হচ্ছে না। ফলে গাছ ফাছ চিন্তার বিষয় হয়ে ওঠার সুযোগ পায়নি। জীবন যুদ্ধে ব্যতিব্যস্ত থাকো, ভোগ্যপণ্যকে আরাধ্য করে তোলো – তবেই তো মুনাফা। এই স্ক্রিপ্টে যশোর রোডের গাছের জায়গা কোথায়?
যশোর রোডের মঞ্চে কী সেই স্ক্রিপ্ট? প্রধান যা শোনা যাচ্ছে তা হল – আশপাশের গাছ কেটে জাতীয় সড়ক ১১২কে চওড়া করতে হবে, কারণ বাংলাদেশের সঙ্গে ব্যবসা বাড়ছে না। কারণ বনগাঁ থেকে রুগী নিয়ে কলকাতা যেতে অনেক সময় লাগে। কারণ অনেক গাছ অনেক পুরোনো, তার ডালপালা ভেঙ্গে লোকের মৃত্যু হচ্ছে।
১৮৪০ থেকে ১৮৪৪ সালের মধ্যে যশোরের জমিদার কালী পোদ্দার ১০৮ কিমি লম্বা রাস্তা তৈরি করেন এবং রাস্তার ধারে ধারে অসংখ্য শিরীষ গাছও লাগান। তার পরেও অনেক গাছ লাগানো হয়েছে – ভারতের দিকের ৭০ কিমি রাস্তায় প্রায় চার হাজার গাছ আছে বলে মনে করা হচ্ছে – যার কেউ কেউ প্রায় ১৮০ বছরের পুরোনো। এই সব সাফ করে চার লেনের রাস্তা তৈরির দাবী অনেকদিনের, এবং তার প্রতিরোধও ততটাই প্রাচীন। হাইকোর্ট হয়ে সুপ্রিম কোর্ট অবধি মামলা গড়িয়েছে। শেষ পর্যন্ত ২০১৮ সালের হাইকোর্টের রায় মেনে নিয়ে এই ফেব্রুয়ারির ৮ তারিখে সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছেন – গাছ কাটা অত্যন্ত দুঃখের ব্যাপার, কিন্তু এভাবে তো উন্নয়ন আটকে রাখা যাবে না! ফলে অন্তত ৩৫৬টা গাছ কেটে ফেলে রেল লাইনের উপর দিয়ে পাঁচটা ফ্লাইওভার না করলেই নয়! বরং একটা গাছ কেটে তার বদলে পাঁচটা গাছ লাগালেই হল!
গাছ বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইড কমায় আবার অক্সিজেন ছাড়ে – ফলে ভারসাম্য বজায় থাকে – ফলে বিশ্ব উষ্ণায়ন কমতেও পারে, গাছ মাটিকে ধরে রাখে, গাছ থাকলে তাপমাত্রার বাড়াবাড়ি প্রশমিত হয়, বড় গাছের ঘনত্ব বেশি হলে বৃষ্টির সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এসব আমরা জানি। আমরা জ্ঞানপাপীরা এও জানি ‘ইকোসিস্টেম সার্ভিস’ বলে একটি ধারণা আছে, যাতে বলা যায় একটি গাছ আসলে টাকার অংকে কতখানি সার্ভিস দিচ্ছে – এবং তার বদলে মুনাফাও করছে না। সে জন্যেই তো বৃক্ষরোপণ করি – যদিও রোপণের পড়ে তা বেঁচে থাকল কিনা তা নিয়ে আমাদের চিন্তা কম – তবুও, করি তো। গানও গাই – ‘মরুবিজয়ের কেতন উড়াও…’, আবার স্লোগানও দিই – ‘একটি গাছ একটি প্রাণ’, – ফলে গাছের প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে দীর্ঘ প্রবন্ধের চেষ্টায় যাচ্ছি না। তবে একটা বিষয় একটু টুক করে জানিয়ে রাখি – অনেক বুড়ো গাছ তো, তাদের অনেক পোষ্য। প্রচুর পোকা, পাখি, শ্যাওলার প্রজাতি – এমনকি গাছকে জড়িয়ে অন্য গাছের প্রজাতিও বেড়ে উঠেছে। একটি রিপোর্ট বলছে প্রায় ৬০ রকম পাখি-পোকার বাস এক একটি গাছে। সুতরাং এখানের একটি গাছ মানে একটি আস্ত বাস্তুতন্ত্র, যা ১৮০ বছর ধরে তৈরি হয়েছে – ঝপ করে গাছ কাটছেন মানে আপনি বাস্তুতন্ত্রটাকেই হাপিশ করে দিচ্ছেন – আর সেই সঙ্গে কাটা পড়ছে সময়টাও। এই জৈববৈচিত্র নিয়ে ঘ্যান ঘ্যান করার কী দরকার – তা বরং আপনি আপনার ছেলেমেয়েদেরই জিজ্ঞাসা করুন – যদি ইস্কুলের পড়া বেমালুম ভুলে গিয়ে থাকেন।
ভারত থেকে বাংলাদেশে পণ্য পরিবহণের মূল্য বছরে ১৫৭০০ কোটি টাকা। বনগাঁ সীমান্তে ভারতের দিকে সীমানায় মালবাহী ট্রাক থাকতে পারে প্রায় ২০০০টি, সেখানে বাংলাদেশ সীমানায় ৭০০। সুতরাং সীমান্তের অবস্থা বোতলের মুখের মত – যতই রাস্তা চওড়া হোক, ভিড় করে ট্রাক জমে থাকবেই। যে কোনও দিন যে কোনও সময় ৩৫০০ ট্রাক দাঁড়িয়ে থাকে এবং গড়ে প্রায় ১৫-২০ দিন তাদের দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। দাঁড়িয়ে থাকার এত জায়গাও নেই, এবং দিন পিছু ৪০০০ টাকা ভাড়া দিয়ে নিছক দাঁড়িয়ে থাকার মত খরচ করার চাপও প্রবল। এপাড়ে রাস্তা চওড়া করে তার সমাধান হবে কি? আর তিরিশ ফুট চওড়া রাস্তার উপরে ১২০ ফুট চওড়া ফ্লাইওভারই বা করতে হবে কেন? তার মানে – আসলে রাস্তা আরও চওড়া হবে ভবিষ্যতে – এবং ৩৫৬ (যার প্রায় ৫০টি নাকি গত পাঁচ বছরে মারা গেছে) নয়, ৪০০০ গাছই কাটা পড়বে ধীরে ধীরে। তার মধ্যেই পরিপূর্ণভাবে চালু হয়ে যাবে অশোকনগর তেলের খনি – তার জন্য রাস্তা, পানীয় জলের দূষণ, আগুন লাগা – বিস্ফোরণের সম্ভাবনা – এই সবই ক্রমশঃ প্রকাশ্য। পিকচার আভি বাকি হ্যায়।
এই রাস্তায় মানুষ কলকাতা যাতায়াত করে থাকেন নিত্য। ট্রেন এক জনপ্রিয় পরিবহণ হওয়া স্বত্বেও শিয়ালদা থেকে বনগাঁ যাওয়ার ২৫টি ট্রেন, গড়ে একঘন্টার গ্যাপে। বনগাঁ থেকেও তাই – সময় লাগে মোটামুটি ২ ঘন্টার একটু বেশি। ট্রেন লাইন, ট্রেন আরও বাড়ানো যায় না? কাজের সুযোগ কেন প্রতি পঞ্চায়েতেই তৈরি হবে না? কেন নাকে মুখে গুঁজে সকলকে মহানগরের দিকেই ঊর্ধশ্বাসে ছুটতে হবে? বনগাঁ, অশোকনগর, হাবড়া, মছলন্দপুর – এখানের সরকারি হাসপাতালগুলির অবস্থাই বা কেমন? তা নিয়ে বিস্তারে যাচ্ছি না, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের সব রুগীকে কলকাতায় নিয়ে আসতে হবেই বা কেন? এই মূল প্রশ্নগুলি কবে উঠবে? মানুষকে সুস্থ রাখলে আসলে মুনাফা নেই – অসুস্থ হলে তবেই মুনাফা। সুতরাং গাছ রাখার থেকে কেটে ফেলায় মুনাফা বেশি – তা শুধু সরাসরি সাদা পাঞ্জাবি-পাজামার আড়ালে মাফিয়াদের গাছ বিক্রির টাকাতেই নয় – মুনাফা আসে নানা রাস্তায়।
রাস্তার ধারে গাছের রক্ষণাবেক্ষণ কে করেন? কোনও সরকারি আরবোরিস্ট আছেন কি? কী গাছ লাগানো হবে তা কে ঠিক করেন? উঁচু বড় গাছের ডাল কিভাবে কাটলে গাছের দাঁড়িয়ে থাকার ভারসাম্যে কোনও ঝামেলা হবে না – এটা কে ঠিক করেন? যেমন তেমন ভাবে গাছ কাটলে – গাছ দূর্বল হবেই এবং তার ডাল ভেঙ্গে পড়াও অস্বাভাবিক নয়। এই রাস্তায় আছে শিরীষ, বট, অশ্বত্থ, মেহগনি, গুলমোহর, আম, অর্জুন ইত্যাদি গাছ। মাঝারি গাছের মধ্যে দেখেছি জারুল, সুবাবুল, জ্যাকারান্ডা, সোঁদাল। বসন্তের দিনে গেছিলামা – তাই কচিপাতায় ঝলমলে অশ্বত্থের কথা ভুলিনি। কিন্তু তা নিয়ে মায়াময় গদ্য লেখার দিকেও ঝুঁকে পড়ছি না। কেজো কথা কেঠো করে বলাই ভালো। একটা শিরীষ গাছের তলায় দশ মিনিট দাঁড়িয়ে দেখলাম তিন রকম প্রজাপতি, দু রকম পিঁপড়ে, বুলবুলি, ময়না, শালিক, গুয়ে শালিক, ফিঙ্গে, সান বার্ড। সকলেই ব্রেকফাস্টে ব্যস্ত ছিল। আরও অনেক কিছু আছে – সব মনে পড়ছে না এখুনি। সব গাছ ভালো অবস্থায় নেই – কিছু গাছ রক্ষণাবেক্ষণ দরকার। কিছু হয়ত কেটে ফেলাও দরকার – কিন্তু এই সমীক্ষা করাও হয়নি, কোনও পরিকল্পনাও আছে বলে শুনিনি – ফলে সবার জন্য এক ওষুধ – খুন।
যশোর রোডের গাছ নিমিত্ত মাত্র – এখন আলোচনায় এসেছে কোনও কোনও মহলে, তাই তাকে উদাহরণ হিসাবে নেওয়া। ভারতবর্ষে ২০২১-২১-এ শুধু সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পে ৩১ লক্ষ বৃক্ষ কাটা হয়েছে। এর বাইরের হিসাব নেই। আমাদের রাজ্যেই যত সড়ক হয়েছে কলকাতা থেকে পশ্চিম অথবা উত্তরে যাওয়ার পথে, তাদের জন্য হাজার জাহার গাছ খুনের কোনও মামলা হয়নি। পশ্চিমবঙ্গ, ভারতবর্ষ বাদ দিন – গাছ কাটা নিয়ে সারা বিশ্বের মানসিকতা একই রকম – গাছ দিয়ে কাগজ হয়, কাঠ হয়, গাছ ফালতু ফালতু জায়গা দখল করে থাকে।
কিন্তু এই যে মুনাফার গাজর ঝুলিয়ে আমাদের দৌড়, বা বলা ভালো সমাজ-সরকার-ব্যবসা-বিজ্ঞাপনের তৈরি করে দেওয়া গাজরের পিছনে আমাদের দৌড় – তার শিকড় অনেক গভীরে। যা নিয়ে ভাবার সুযোগ, মানসিকতা পরিবর্তনের সুযোগ বা ব্যবহার বদলের সুযোগ অধিকাংশ মানুষকেই দেবে না এই সমাজ-সরকার-ব্যবসা-বিজ্ঞাপন। আমাদের ব্যস্ত রাখবে প্রতিদিনের জীবনযুদ্ধের ট্রেডমিলে। আমাদের লক্ষ্য আরও তেল খরচ, আরও ব্যাবসা, আরও পণ্য, আরও মুনাফা, আরও মানুষে মানুষে অসাম্য, আরও, আরও, আরও। উন্নয়ন আর গ্রোথের পাগলা ঘোড়াকে শান্ত না করতে পারলে ছুটকো ছাটকা বেড়া সে মানবে না – ক্রমাগত খাদের দিকেই সে দৌড়ে যাবে। যশোর রোডের গাছ তার কাছে এক মুঠো ঘাস। তাকে রাস্তা বদল করার জন্য যে বৃহত্তর রাজনীতি লাগে – ঠুঁটো জগন্নাথ জাতি সংঘ তার রাস্তা দেখাতে পারেনি। পারবে এমন আশাও তো দেখি না।
একটা কথা খুব পরিষ্কার করে কপালে লিখে নেওয়া দরকার। সভ্যতার পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেছে। যদি মানুষ নামক অকৃতজ্ঞ প্রাণীটির তথাকথিত উন্নয়নে অসুবিধাও হয়, তাহলেও একটি গাছও খুন করা উচিত নয়, একটি পুকুরেরও শ্বাসরোধ করা উচিত নয়, একটি নদীরও হাত পা বেঁধে রাখা উচিত নয়, একটি জমিকেও বিষ দিয়ে গর্ভাধান করা উচিত নয়। তাতে যাইই হয়ে যাক না কেন।
উপরের কথাগুলিই শেষ কথা। তবু উপসংহার থাকে – তাকে মধ্যপন্থা নামেও ডাকা যায়, অথবা ভাবা যায় ট্রান্জিসনের আপাত সমাধান হিসাবে। মূর্খের মত কেবল বিউটিফিকেশনের নামে যেখানে যা পারছি গাছ না লাগিয়ে শিকড় ও ক্যানোপি অনুযায়ী কোথায় কোন গাছ লাগানো হবে সে ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া হোক। রাস্তার পাশে গাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা হোক – দরকারে অপারেশন করতে হবে, কিন্তু সরকার সে গাছের মালিক বলে যখন খুশি বিনা চিন্তায় কেটে ফেলবেন না এই আশাটুকু রাখার মত পরিস্থিতি তৈরি হোক। গাছ বাঁচিয়ে রাস্তা তৈরির উপায় বেরোক। কেটে ফেলতে তো সবাই পারে – আপনি যদি কোনও প্রত্যঙ্গ বাঁচাতেই না পারলেন, তবে তো আপনি হাতুড়ে ডাক্তারের বেশি কিছু নন। ফ্লাইওভারের বদলে সুড়ঙ্গ দিয়ে কাজ হয় কিনা ভাবুন। গাছকে বুলেভার্ডে রেখে তার দু পাশে রাস্তা তৈরি করা যায় কি না দেখুন – এ সবের উদাহরণ পৃথিবী জুড়ে কম নেই। কিন্তু ঠুলি পড়ে চললে চাবুক ছাড়া তো ঘোড়া রাস্তা বুঝতে পারে না!
আরও পড়ুন – চা দর্পণ