একটা খবর খুব ধাক্কা দিয়েছিল মনটাকে। খবরটি প্রকাশিত হয়েছিল একটি দৈনিক সংবাদপত্রে। সুন্দরবনের চুনকুড়ি নদীর চরটা অবলীলায় বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। অভিযোগের তীর পঞ্চায়েত প্রধানের দিকে।
একটা নদীর বুকে চর নির্মাণে নদীর একটা বড় ভূমিকা থাকে। সুন্দরবনের ক্ষেত্রে সেই চর নির্মাণে বড় ভূমিকা পালন করে জোয়ার ভাটাও। চর জাগে নদীর বুকে। নদীর গতিপথ পাল্টে যায়। আবার নতুন করে নদী চলে। মোহনাতে এসে ‘সক্রিয় বদ্বীপ’ অঞ্চলে নদীর এটাই খেলা। সুন্দরবনের মানুষেরা সে কথা জানে। নদীর সম্পর্কে জানতে তাদের বই পড়ে বুঝতে হয়নি। তাদের দৈনন্দিন জীবনের অভিজ্ঞতা নদী নিয়ে অনেক কথায় তাদের শিখিয়ে পড়িয়ে তুলেছে।
তা সত্ত্বেও সুন্দরবনের নদীগুলোর সঙ্গে মানুষের বোঝাপড়ার সম্পর্কটি কেন এতোটা আলগা হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ? বহুবার কথাটা উঠেছে, সুন্দরবনে মানুষ বসবাস শুরু করেছিল জোর করে। তবে ঐতিহাসিক মতামত ধরলে গঙ্গারিডি সভ্যতার নানা নিদর্শন মিলেছে সুন্দরবনের নানা এলাকায়। কাজেই সুন্দরবন মানুষের বসবাসের জায়গা একেবারেই নয়, এমন কথা বলাটা বোধহয় পুরোপুরি ঠিক নয়। উল্টে বলা যেতে পারে, আমাদের প্রতিদিনের পাপের খেসারত দিতে হচ্ছে সুন্দরবনের মানুষদের। পর্যটনের নামে প্লাস্টিকের দূষণ, কলকাতা শহরতলির বর্জ্য বিদ্যাধরী নদীর পথ ধরে সুন্দরবনবনে পৌঁছে যাওয়া, উষ্ণায়নের প্রভাবে সমুদ্রের জলের স্ফীতি, বার বার সাইক্লোনের তান্ডবে বিপন্ন সুন্দরবনের মানুষের জীবন ও জীবিকা… এই সব কিছুতেই মাশুল গুণতে হচ্ছে সুন্দরবনের সাধারণ মানুষের। প্রতিদিনের বিপন্নতার সঙ্গে ঘর করতে করতে সুন্দরবনের মানুষদের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেছে। তাদের বিপন্নতার সামনে পরিবেশ বাঁচানোর কথা কেবলই সৌখিন কথা ছাড়া আর কিছুই নয়। দূষিত ও নোনা জলের দাপটে সেখানে সেখানে মিষ্টি জলের মাছের পরিমাণ কমছে। মাছ ও কাঁকড়া ধরতে ক্রমশ গভীর জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়তে হয়। জীবনকে বন্যপশু বাঘের কাছে বাজি রেখে। অরন্যের অধিকার স্বীকৃত থাকা সত্ত্বেও সেই অধিকারকে যাপন করতে পারে না এখানকার মানুষ। তাহলে কোন পথে এই বিপন্ন মানুষদের ভবিষ্যৎ? উত্তর অমিল।
একথা ঠিক, নদীর বাঁচা কিংবা মরা, এই দুটোই সুন্দরবনের মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলে। সেকথা অভিযুক্ত পঞ্চায়েতের প্রধান বোঝেননা, এমনটি ভাবার কোন জায়গা নেই। আসলে পরিবেশ সম্পর্কে কতটা মূল্যবোধ গড়ে উঠতে হবে, তা নিয়ে কোন চর্চা প্রশাসনিক মহলে নিরন্তর হয় না। প্রয়োজন ছিল পঞ্চায়েতগুলোতে পরিবেশের মূল্যবোধ নির্মাণের পাঠদানের ব্যবস্থা।
একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে নদীর চর দখল করে সেখানে কিছুদিন পর সেখানে তৈরি হত চিংড়ি চাষের ভেড়ি। আর সেই ভেড়িতেই শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন সুন্দরবনের পরিবারের মহিলারা। যাদের স্বামীরা কাজের সন্ধানে গেছেন সুন্দরবন ছেড়ে অনেক দূর দেশে। সেই সব মহিলাদের কাছে জীবন চালানোর জন্য কিছুটা আর্থিক উপার্জন দরকার। তার হাতের কাছে বিকল্প বলতে ভেড়িতে কাজ করা ছাড়া আর কিছু নেই। এখানেই বিপন্ন পরিবেশ মানুষকে অসহায় করে তোলে। আর সেই অসহায়তার সুযোগ নেয় আর্থিক সামাজিক ভাবে স্বচ্ছল মানুষেরা। যারা প্রতিনিধিত্ব করে পুঁজির।
কাজেই এই অসম লড়াইয়ে পরিবেশের প্রতি মূল্যবোধ নির্মাণের পারিপার্শ্বিকতার সঙ্গে সঙ্গে রাষ্টেরো একটা দায়বদ্ধতা থাকে। যার উৎস লুকিয়ে আছে ভারতীয় সংবিধানের ‘ডাইরেক্টিভ প্রিন্সিপাল অব স্টেট পলিসিতে’। কাজেই ভক্ষককেই রক্ষা করার দ্বায়িত্বটা হাতে তুলে দিলে কেমন হয়, সেই বিষয়টি দেখবার সময় এসে গেছে।
আরও পড়ুন – প্রবৃদ্ধি ও পৃথিবী