জলবায়ুর পরিবর্তনে বিঘ্নিত বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা

জলবায়ুর পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা কিন্তু আমরা খুব বাধ্য হলে তবেই করি। যেমন এই বছর শীতে ইউরোপের বহু শহরেই তাপমাত্রা কুড়ি ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের ওপর, কিন্তু ইউরোপ “গ্লোবাল ওয়ার্মিং” নিয়ে “স্পিকটি নট” হয়ে আছে। কারণ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে জ্বালানি সংকটে জ্বলছিল সারা ইউরোপ! স্বাভাবিক শীত পড়লে তাদের তীব্র জ্বালানি সংকট দেখা দিত, এ বছর তুলনামূলকভাবে উষ্ণ শীতকাল তাদের দ্বিচারীতা চালানোর পক্ষে সহায়ক হয়েছে।অন্যদিকে ভয়াবহ বন্যার পর পাকিস্তান তীব্র বিপদে। তারা দেউলিয়া হওয়ার মুখে, এই প্রসঙ্গে কিন্তু তারা “গ্লোবাল ওয়ার্মিং, গ্লোবাল ওয়ার্মিং” করে চলেছে।

দুই হাজার একুশে আফগানিস্তান, দুই হাজার বাইশে শ্রীলঙ্কার পর এবার পাকিস্তান একই কারণে শিরোনামে। তবে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সঙ্কটের কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞেরা অন্যতম কারণ হিসেবে দুই হাজার বাইশের ভয়ঙ্কর বন্যাকেও দায়ী করেছেন। দেখা গেছে যে কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগে নারী ও শিশুদের মৃত্যুর সম্ভাবনা চৌদ্দগুণ বেশি। খাদ্য নিরাপত্তা বা মন্বন্তরের ঝুঁকি বাড়ার সঙ্গেই প্রশাসনের রাশ আরও আলগা হয়, অল্প বয়সী মেয়েদের প্রতি যৌন শোষণ বালিকা বিবাহের ঘটনা বাড়ে। এমনিতেই পাকিস্তানে গ্রামের মেয়েরা অল্পবয়সে বিবাহিত হন এবং গর্ভধারণ করেন। নানান সংকটে সে দেশে ইতিমধ্যেই প্রায় এককোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।দেশজুড়ে আশ্রয়, খাদ্য, খাবার জল এবং ওষুধের সঙ্কট চলছে। দেউলিয়া হওয়ার আশঙ্কাটি সত্যি হলে, এবার সে দেশের অগণিত মহিলা ও শিশুরা তাঁদের শান্তি ও নিরাপত্তা জনিত বড় বিপদে পড়বেন।

দুই বছর আগে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) তাদের বার্ষিক রিপোর্টে বলেছে যে বিশ্বব্যাপী দশ কোটি মানুষ সাম্প্রতিক কালে তাঁদের বাড়িঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। কারণ হিসেবে আছে ইউক্রেনে যুদ্ধ, বিভিন্ন গৃহযুদ্ধ, মানবাধিকার লঙ্ঘন, খাদ্য নিরাপত্তা, জলবায়ু সংকট। বেশ কয়েকটি গবেষণায় দেখা গেছে যে জলবায়ু পরিবর্তন গৃহযুদ্ধ বা গণহত্যার মতো সংঘাতকে আরও অবশ্যম্ভাবী করে তোলে। জলবায়ু পরিবর্তনকে কিন্তু অনেকেইএই শতাব্দীর শান্তি ও নিরাপত্তার সবচেয়ে বড় ঝুঁকি বলে মনে করছেন। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, খরার প্রাবল্য, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং তীব্র ঝড় পৃথিবীর সর্বত্র মানুষের জীবন ও জীবিকাকে প্রভাবিত করছে। ক্রমবর্ধমান বন্যা, যুদ্ধ, খরা বা তাপপ্রবাহে প্রথমে মানুষজন অন্য প্রদেশে বা দেশে আসেন। সেখানে মানুষজন আগত অচেনা মানুষজনের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন হন না, কারণ তাঁদেরও অনেকেরই জীবন বা জীবিকা এঁদের আগমণে প্রভাবিত হয়। সীমিত রসদ বা পরিকাঠামো নির্দিষ্ট সংখ্যক মানুষের চেয়ে বেশি মানুষ ভাগ করতে শুরু করেন, ফলে সংঘাত হয় ও শান্তি বিঘ্নিত হয়। অধিক মাত্রায় এই সংঘাত পৌঁছালে তা গৃহযুদ্ধের দিকে যাবে। ভৌগলিক ও জলবায়ুর প্রতিকূলতাও যে রিফিউজিদের জন্য কত সাংঘাতিক হতে পারে তার উদাহরণ হাতের কাছেই আছে। সবচেয়ে ভালভাবে জানেন একদা বাংলাদেশ থেকে এসে যাঁরা দন্ডকারণ্য বা ছত্তিশগড়ের মানা ক্যাম্পে ছিলেন। বর্তমানে কিন্তু বিশ্বজুড়েই পরিবেশ রিফিউজি বাড়ছে, এবং জলবায়ু পরিবর্তন আরগৃহযুদ্ধের জন্যই বাড়ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর গৃহযুদ্ধ বিশ্বজুড়ে বেড়েই চলেছে। গৃহযুদ্ধগুলিতে কিন্তু আন্তর্জাতিক যুদ্ধের চেয়েও বেশি সংখ্যক হতাহতের ঘটনা ঘটে গেছে। জলবায়ুর পরিবর্তন পরিবেশকে পরিবর্তন করছে, চরমভাবাপন্ন আবহাওয়ার জন্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়ছে। যে দেশগুলি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিপদের মুখে সেখানে প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি এবং ইউসি বার্কলে গবেষকরা দেখেছেন যে গড় বার্ষিক তাপমাত্রাএক ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লেও গৃহযুদ্ধের সম্ভাবনাসাড়ে চার শতাংশ বৃদ্ধি ঘটে। তার জন্য আর্থিক বৈষম্য, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং শান্তি ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে। স্বভাবতই প্রান্তিক মানুষদের ক্ষেত্রে এসবের প্রভাব প্রাণঘাতী হয়ে উঠছে।

এই আলোচনায় সোমালিয়া ছাড়া হয়না। দেশটি কয়েক দশক চলছে গৃহযুদ্ধ এবং তা সাম্প্রতিক সময়ের অন্যতম সুদীর্ঘ। পরপর খরা এবং বন্যার পর ছাব্বিশ লক্ষেরও বেশি বাস্তুচ্যুত সোমালি নাগরিক আপাতত পথে। ক্রমবর্ধমান জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত প্রভাবগুলি যেমন খরা-বন্যা তো আছেও,এছাড়াও ভূমিক্ষয়ও কারণ।দুই হাজার আঠারোর এপ্রিলে সোমালিয়ার আকস্মিক বন্যায় সাত লক্ষেরও বেশি পরিবেশ রিফিউজির শান্তি ও নিরাপত্তাবিপন্ন হয়, প্রায় দুই লক্ষাধিকমানুষ বাস্তুচ্যুতইহন। এরপরই সুদীর্ঘ খরায়প্রায় সত্তর লক্ষ মানুষের সোমালি বিপন্নহন। রাজধানী মোগাদিশুতেই বেশিরভাগ মানুষ উপস্থিত হন। মোগাদিশু’র ত্রাণ শিবিরগুলি আপাততনারী পাচার এবং শিশুদের শোষণের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। সোমালিয়ার সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী আল-শাবাবের তরুণ বা শিশুযোদ্ধাদের মধ্যে অসংখ্য কিন্তু এই বাস্তুচ্যুতশান্তি ও নিরাপত্তা-বিঘ্নিত শিবিরগুলি থেকেই উঠে এসেছেন। ।

জলবায়ুর পরিবর্তন সংক্রান্ত শান্তি ও নিরাপত্তা বিপন্নতার প্রসঙ্গ এলেসিরিয়ার ক্ষতস্থানটিও দেখতে হবে।দুই হাজার এগারো সালের ছাব্বিশে জানুয়ারি সিরিয়ায় দেশব্যাপী গণ বিক্ষোভ একসময় অভ্যুত্থানে রূপ নেয়, তারপর থেকে সিরিয়ায়শেষ বারো বছর গৃহযুদ্ধ চলছে। এর পেছনে ছিল অর্থনৈতিক দুর্দশা, দুর্নীতিগ্রস্ত নেতৃত্ব এবং দুই হাজার সাত থেকে দুই হাজার দশ অবধি চলা লাগাতার খরা। আবার সেই খরা, যার ছায়ার নামই দুর্ভিক্ষ! এবং যার কারণে কৃষকরা তাদের ক্ষুধার্ত পরিবারের জন্য খাদ্যের সন্ধানে যথারীতি শহরে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিল এবং প্রতিকূল অবস্থায় পড়েছিল। জলবায়ু পরিবর্তন সিরিয়ার দুর্বল অর্থনীতি, দুর্নীতিগ্রস্তপ্রশাসন এবং আর্থিক বৈষম্যকে সঙ্গে নিয়ে গৃহযুদ্ধের জন্য মঞ্চ তৈরি করেই রেখেছিল। খরা ও দুর্ভিক্ষের সঙ্গে এবার গৃহযুদ্ধেও দেশটি এক যুগ ধরে জর্জরিত।

আরও কয়েকদশক আগেচলুন। তখন বিশ্বের ষষ্ঠ-বৃহৎ মিষ্টি জলের হ্রদ ছিল আফ্রিকার চাদ। সেটিএক দশক-ব্যাপী খরার কারণে সংকুচিত হচ্ছিল। প্রাকৃতিক কারণের সঙ্গে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনও খরাকে দীর্ঘস্থায়ী করেছিল। সাহারার উপান্তেকিন্তু নাইজার-নাইজেরিয়া- ক্যামেরুন-চাদ, এই দেশগুলি জন্য চাদ হ্রদই জীবন ছিল। সত্তরের দশকে হ্রদটিরসঙ্কোচন শুরুর পর আশেপাশের মানুষজন সরতে শুরু করেন। অন্য দেশ এবং প্রদেশে প্রবেশের জন্য অশান্তি শুরু হয়। পূর্ববর্ণিত কারণগুলির জন্য স্থানীয় কৃষক এবং পশুপালকদের মধ্যে সংঘর্ষ বাড়তে থাকে এবং সুদানের শান্তি ও নিরাপত্তা ভয়াবহভাবে বিপন্ন হয়।দুর্ভিক্ষ জর্জরিত সুদানে বৃষ্টি কমে গিয়েছিল এবং উর্বর জমি অনুর্বর হয়ে পড়েছিল। সামাজিক ও রাজনৈতিক  অস্থিরতার সঙ্গে খাদ্যাভাব গৃহযুদ্ধ নিয়ে আসে, রাষ্ট্রও যথারীতি সহিংস ভূমিকা নেয়।এরই মধ্যে দুই বছর আগে এক বন্যায় আবার সুদানের পুনর্বাসন নগরই ভেসে যায় এবং পঁয়ত্রিশ হাজার রিফিউজির জীবন বিপন্ন হয়।জাতিসংঘ খাদ্য ও পানীয় জলের নিরাপত্তাহীনতার সমস্যার সঙ্গে ক্রমবর্ধমান খরা ও কৃষিজমির অনুর্বরতাকেও একই সারিতে রাখে। জলবায়ু পরিবর্তন দৃশ্যমান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই,বিশেষজ্ঞরা সুদানের গৃহযুদ্ধকে আধুনিক জলবায়ু পরিবর্তন-জনিত সংঘাতের প্রথম উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বায়ুমণ্ডলে কার্বনের নিঃসরণ উল্লেখযোগ্যভাবে না কমলে গড় তাপমাত্রা বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। খরা বাড়লে আরও সংঘাত বাড়বে, শান্তি ও নিরাপত্তা বারংবার বিপন্ন হবে। এভাবেইজলবায়ু পরিবর্তন শুধু মানুষের জীবিকা নয়, তাদের জীবনকেও বিপন্ন করে তুলছে। “জলবায়ু পরিবর্তনই এসব সংকটের কারণ ”এমন যদিও বা না বলি তবুও এমন কিন্তু বলতেই পারি যে, জলবায়ু পরিবর্তনইআর্থ-সামাজিক বা রাজনৈতিক মঞ্চে উত্তেজনাজনিত সংঘর্ষগুলিকে ত্বরাণ্বিত করছে। বিশ্বজুড়ে চাষযোগ্য জমি কমছে, তাই যে অঞ্চলগুলিতে তা এখনও আছে, সেই জায়গাগুলি সবারই বুক দিয়ে আগলানোর সময় এসেছে। সম্প্রতি যে দশটি দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বহুপাক্ষিক শান্তি বৈঠকটি আয়োজিত হয়েছিল, তার আটটি দেখলাম এমন দেশে, যেখানে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি রয়েছে। শান্তি বজায় রাখা কঠিন, কিন্তু সচেতনতা বজায় রাখার চর্চার অভাবও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাকে বাড়িয়ে তুলছে।বিশ্বশান্তি বজায় রাখার আন্তর্জাতিক মঞ্চগুলি এখনও কিন্তু এই উদীয়মান ঝুঁকিগুলিকে দূরদৃষ্টি নিয়ে বিবেচনা করছে না, সেটা উদ্বেগজনক।

বর্তমানে ভারতের প্রায় সর্বত্রই আমাদের রাজ্য বা কেন্দ্র সরকারগুলি পরিবেশের প্রতি নির্দয়। মানুষের ওপর আমরাও যে খুব সদয় তা বলছি না, কারণ পাহাড়ের মানুষদের প্রতি সমতলের মানুষজনের খুব বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করার রেওয়াজ তো দেখিনা। উত্তর পূর্বের মানুষদের উদ্দেশ্যে ছোঁড়া ‘চিংকি’ বা ‘চীনেম্যান’ ইত্যাদি শব্দ কানে আসেই। দক্ষিণ ভারতেও তাঁদের অনেক খারাপ অভিজ্ঞতা হয়েছে। তবে সরকারের নিষ্ঠুর মনোভাবটা হয়ত যোশীমঠের মানুষ ও গৃহপালিত পশুদের পুনর্বাসন দেওয়ার সময়েই আমরা দেখতে পাব।

আমরা জানি মধ্য আফ্রিকা ও আফগানিস্তান খাদ্যাভাবে ধুঁকছে। তবে ভারতেও কিন্তু ত্রিশ শতাংশ শিশু কম ওজন নিয়ে জন্মায়, যা সর্বনিম্ন দেশগুলির মধ্যে অন্যতমই শুধু নয়, মধ্য আফ্রিকার প্রায় দ্বিগুণ। দুই হাজার পঞ্চাশ সালের মধ্যে ভারতেইপাঁচ কোটি মানুষকে জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে গৃহচ্যুত হতে হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে, এর সঙ্গে যোগ হবে পড়শী দেশগুলি থেকে আসা গৃহচ্যুত মানুষজন। যা পুরো দেশের শান্তি ও নিরাপত্তার পরীক্ষা নেবে, কিন্তু সে নিয়ে সরকারের বা আমাদের কোন পরিকল্পনা বা প্রস্তুতি চোখে পড়ছে না। সরকার এবং দেশের মানুষ যদি মনে করেন গৃহচ্যুত মানুষজনপ্রতিকূল পরিবেশে এসে এবং জীবনধারণের ন্যূনতম রসদগুলি না পেয়ে খুব শিষ্ট নাগরিকের মতন আচরণ করবেন, তাহলে বিপদ। সম্ভবত দেশের মানুষের জন্য বুলেট ট্রেন না চালিয়ে, সত্যিটা স্বীকার করার সময় এসেছে। নিজেদের দেশের পরিবেশ রিফিউজি বিষয়ক তথ্য ও উপাত্তগুলি খতিয়ে না দেখে, আমরা সম্ভবত একটি টাইম বোমার ওপর বসে পিকনিক করছি।