কুশকর্ণী নদী, যাত্রা, সমাজ, আশ্রম, আন্দোলন

কুশকর্ণী যাত্রা প্রকৃতির নিঃশর্ত দানসমূহ পুনরুদ্ধারের দাবিতে পদযাত্রা। নদী ও জঙ্গল প্রকৃতির নিঃশর্ত দান। পদযাত্রা হবে ডিসেম্বরের ৩ ও ৪ তারিখ। অর্থাৎ, শনি ও রবিবার। ওই দুদিন আমরা ২৫/৩০ জন পদযাত্রী কুশকর্ণী নদীর উৎস থেকে মোহনা, এই ২২/২৪ কিলোমিটার পথ তার আশেপাশের গ্রামগুলোর মধ্যে দিয়ে হেটে যাবো।

কুশকর্ণীর উৎস সাহাবাদের কাছে। এখানকার লোক একে বলে কাঁদর, অর্থাৎ ছোট নদী। সাহাবাদ বীরভূমের রাজনগর ব্লকের শেষ গ্রাম। তারপরই ঝাড়খন্ড। কুশকর্ণী সাহাবাদ থেকে বেরিয়ে এঁকেবেঁকে ময়ূরাক্ষীতে গিয়ে মিশেছে। এর দুপাশে বহু গ্রাম। রানিগ্রাম, গাংমুড়ি, ছোটবাজার, মিরপুর, আড়ালি, সিরশে, গোলাপগঞ্জ, লাউজোর, কবিলাসপুর, রানীপুর, রাওতারা,  গণেশপুর, গামারকুন্ডু, সাজিনা, হরিপুর ইত্যাদি। কুশকর্নী ময়ূরাক্ষীতে গিয়ে মিশেছে সিউড়ির কাছে, খটঙ্গায়। এইসব গ্রামের ভেতর দিয়েই আমরা হেটে যাবো।

কুশকর্ণীর পাড়ের লোকজনদের নিয়েই কুশকর্ণীনদী সমাজ। এইসব মানুষদের সাথে কথা বলে দেখেছি যে এনারা এই নদীর সাথে তাদের নাড়ীর টান অনুভব করেন। এদের কাছেই গল্প শোনা পুজোর ঠিক আগে এসব অঞ্চলে বড় ষাট বা জিতা ষষ্ঠী পালন হতো। তার পান্না বা উজ্জাপন হত নদীর পাড়ে গিয়ে গ্রামের সবাই মিলে দই চিরে খেয়ে। তাছাড়া মহালয়ার তর্পণ আর পৌষসংক্রান্তির মকরস্নান তো ছিলই নদীতে।

একসময়ে এইসব গাঁয়ের মহিলারা এই নদী থেকেই খাওয়ার জল সংগ্রহ করতেন। নদীর পাড়ের বালিতে একটা ছোট গর্ত করে বাটি দিয়ে জল তুলে মাটির কলসিতে ভোরে তারা বাড়ি নিয়ে আসতেন। টলটলে মিষ্টি জল। সত্তরের দশক থেকে অবস্থাটা দ্রুত বদলাতে থাকে। বাড়তে থাকে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার। আর বর্ষায় সেসব ডিএপি (Di-ammonium Phosphate) ধোয়া জল ক্ষেত উপচে গিয়ে পড়তে থাকে নদীতে।

তাছাড়া এনারা জানালেন যে গত বিশ বছরে নদীর চরিত্রটাও অনেক পাল্টে গেছে।

নদীর পাড়ের সেই গাছগুলো আর নেই, যেমন বাবলা, অর্জুন, স্যাওড়া, সর, আরো কত কি। এখন কিভাবে জানি কাশবন, যা বরাবর নদীর দুধারে হতো, তা নদীর মূল গতিপথ দখল করে নিয়েছে। আর নদীর দুধার দখল করে নিয়েছে সর্বনাশা পার্থেনিয়াম। এক স্থানীয় চাষীর বক্তব্য, একসময় যে নদীর টলটলে জলের নিচে বলি দেখা যেত, এখন সেখানে পলির আস্তরণ। আর নদী ভরে যাচ্ছে বিভিন্ন উদ্ভিদ ও গাছগাছালিতে।

এসব কিছুর সঙ্গে আছে নদীর দুপারে গজিয়ে ওঠা অসংখ্য ইটভাটা। এইসব ইটভাটার কালো ধোঁয়ায় দূষিত হচ্ছে নদীর বাতাস। ভাটার পোড়া ছাইয়ে দূষিত হচ্ছে নদীর জল। ব্যাহত হচ্ছে নদীর গতিপথ।

এহেন কুশকর্ণীর পাড়ে কুশকর্ণী আশ্রম। না কোনো ধর্মকর্মের (religion অর্থে ধর্ম) আশ্রম নয়। প্রকৃতির সাথে সংস্কৃতির বোঝাপড়ার আশ্রম। এই বোঝাপড়ার অপর নাম পরিবেশ। অর্থাৎ, কুশকর্ণী আশ্রম প্রকৃতপ্রস্তাবে পরিবেশের আশ্রম।

আশ্রমের মধ্যে শ্রম শব্দটি লুকিয়ে আছে। তবে এই শ্রমের অর্থ পারমার্থিক জ্ঞান লাভের উদ্দেশ্যে শ্রম। অর্থাৎ, উৎপাদনে নিয়োজিত নিছক আর্থিক শ্রম (economic labour) নয়। আশ্রমিক শ্রমন সেই

জ্ঞান লাভের উদ্দেশ্যে শ্রম করতো। সেই শ্রম তাদের তপস্যার অংশ।

ঠিক সেভাবেই কুশকর্ণী আশ্রমে আমরা প্রকৃতির সাথে সংস্কৃতির বোঝাপড়া বিষয়ক নিবিড়তম জ্ঞান লাভের উদ্দেশ্যে নিজেদেরকে শ্রমে নিযুক্ত করবো। এই শ্রমনিযুক্তি হবে আমাদের জ্ঞানলাভের উপায়।

নিছক আর্থিক শ্রম সুনির্দিষ্টভাবে আধুনিক উৎপাদন সম্পর্কের দান। এবিষয়ে মার্ক্স বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। এহেন উৎপাদন সম্পর্কে মানুষ নিছক শ্রম সরবরাহকরি হিসেবে তার শ্রম বিক্রয় করতে বাধ্য হয় স্রেফ বেঁচে থাকার জন্য। তাই এখানে তার শ্রম কি উৎপাদন করছে সেটা তার কাছে গুরুত্ব পায়না। মানুষ এখানে শ্রম নামক এক বিশেষ পণ্যের বিক্রেতা মাত্র। এই পণ্য ঘন্টা ধরে মজুরির বিনিময়ে বিক্রয় করে সে অন্যান্য পণ্য খরিদ করে। আধুনিক তথা পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় অর্থের বিনিময়ে এই নিছক পণ্য ক্রয়বিক্রয়কেই আমরা জীবন বলে জানি। অথবা তাকে জীবন বলে মেনে নিতে বাধ্য হই।

ঠিক এই জায়গা থেকে বলা যেতে পারে যে, কুশকর্ণী আশ্রমে আমাদের শ্রমপ্রকল্প নিছক কোনো আর্থিক প্রকল্প নয়। তা পরিবেশ বিপর্যয়ের নিরিখে এক বিকল্প উৎপাদন সম্পর্ক সংবলিত অর্থপূর্ণ জীবনপ্রকল্প।

কুশকর্ণী আশ্রমে আমরা প্রকৃতির সাথে সংস্কৃতির বোঝাপড়া বিষয়ক নিবিড়তম জ্ঞানলাভে ব্রতী হবো, সেই জ্ঞানই প্রকৃতপ্রস্তাবে পারমার্থিক জ্ঞান। এবং তা আর্থিক তথা দৈনন্দিন ব্যবহারিক জ্ঞানও বটে।

পারমার্থিক জ্ঞানের সাথে আর্থিক জ্ঞানের সম্পর্ক বুজতে গেলে আমাদের নাগার্জুনের দ্বারস্থ হতে হবে।

পরিবেশ তথা আজকের পরিবেশ সংকটকে সার্বিকভাবে বোঝবার ক্ষেত্রে বৌদ্ধ চিন্তন ঐতিহ্য বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে। বৌদ্ধ চিন্তন ঐতিহ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধারণা প্রতীত্যসমুৎপাদ (dependent co-origination) এবং অনিত্যবাদ। প্রতীত্যসমুৎপাদের অর্থ জগতের প্রতিটি বস্তুর অস্তিত্ব একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ প্রতীত্যসমুৎপাদ আমাদের পশ্চিমা দর্শন তথা আধুনিক বিজ্ঞানের অন্যতম স্তম্ভ, একরৈখিক (তথা one is to one) কার্য কারণ সম্পর্কের (cause and effect relationshipএর) ভ্রম থেকে বের করে নিয়ে এসে পারস্পরিক কার্য কারণ সম্পর্কের (mutual causalityর) সত্যের সামনে এনে দাঁড় করায়।

অনিত্যবাদ বলছে জগৎ অনিত্য। প্রতীত্যসমুৎপাদ ও অনিত্যবাদ মিলে আমাদের এক পারস্পরিকভাবে নির্ভরশীল এবং সদা পরিবর্তনশীল জগতের সামনে এনে দাঁড় করায় যা নিউটনের একরৈখিক কার্যকারণনির্ভর সম্পর্কের নিত্য জগতের থাকে একেবারেই আলাদা।

কার্যকারণনির্ভর সম্পর্কের নিত্য জগতের সূত্র অনুযায়ী ক কারণ হলে কার্য হবে খ। যেমন নিউটনের প্রথম গতিসূত্র অনুযায়ী, বাইরে থেকে কোনো বল প্রযুক্ত না হলে স্থির বস্তু চিরকাল স্থির থাকবে এবং গতিশীল বস্তু চিরকাল সমবেগে সরলরেখায় বা সরল পথে গতিশীল থাকবে।

এহেন নিউটনিয় জগতের প্রতিস্পর্ধি পারস্পরিক কার্যকারণনির্ভর সম্পর্কের অনিত্য জগতের সূত্র বলছে যে: যতক্ষণ ক আছে ততক্ষণই খ আছে, আবার উল্টোদিকে, যতক্ষণ খ আছে ততক্ষণই ক আছে। তারা তাদের অস্তিত্বের জন্য একে অপরের ওপরে নির্ভরশীল এবং একে অপরের কারণে বিদ্যমান।

এই তত্ত্ব আমাদের মানুষ ও তার পরিবেশ তথা পরিবেশ সংকটের প্রতীত্যসমুৎপাদবাদী ও অনিত্যবাদী সম্পর্ককে আন্তঃস্থলে নিয়ে যায়, যার মূল কথা, এই পৃথিবীর প্রতিটি বস্তু একে অপরের সাথে এক গতিশীল (dynamic) পারস্পরিক নির্ভরতার সূত্রে আবদ্ধ।

সেই কারণে, আমরা যখন কোনো একটি বস্তুর, উদাহরণস্বরূপ, কার্বন ডাই অক্সাইডের উৎপাদন বৃদ্ধি করি, বা অরণ্য নিধন করি, তার প্রভাব পৃথিবীর অন্য প্রতিটি বস্তুর ওপর পড়ে, কারণ তারা একে অপরের সাথে এক গতিশীল পারস্পরিক নির্ভরতার সূত্রে আবদ্ধ।

নাগার্জুন তার মূলমাধ্যমিককারিকায় দুধরনের সত্যের কথা আলোচনা করেছেন। এই দুই সত্যকে তিনি বলছেন সংবৃতি সত্য (empirical truth) আর পরমার্থ সত্য (ultimate truth)।

নাগার্জুনের বক্তব্য, যেহেতু প্রতিটি বস্তুর অস্তিত্ব একে অপরের ওপর নির্ভরশীল, তাই কোনো বস্তুর স্বভাব (স্ব-ভাব) থাকতে পারেনা। যেমন আগুন নামক বস্তুর অস্তিত্ব জ্বালানি, বায়ু, উত্তাপ, ইত্যাদি বস্তুর অস্তিত্বের উপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ আগুন নামক বস্তুর কোনো স্ব-ভাব থাকতে পারেনা। সেই জায়গা থেকে আগুন

স্ব-ভাবশুন্য। এবং ঠিক এই জায়গা থেকে মানুষও স্ব-ভাবশুন্য। কারণ মানুষের অস্তিত্ব তার পরিবেশের অন্য সমস্ত বস্তুর উপর নির্ভরশীল।

এখন থেকে নাগার্জুন উপসংহার টানছেন যে বস্তুর অস্তিত্বের এই পারস্পরিক নির্ভরশীলতাই সংবৃতি সত্য। এবং তারা পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল কারণ তারা স্ব-ভাবশুন্য। এই স্ব-ভাবশুন্যতাই পরমার্থ সত্য।

অর্থাৎ, সংবৃতি সত্য আর পরমার্থ সত্যের অভ্যন্তরীণ সম্পর্কে এরকম দাঁড়াচ্ছে:

সংবৃতি সত্য = পারস্পরিক নির্ভরশীলতা

পারস্পরিক নির্ভরশীলতা = স্ব-ভাবশুন্যতা

স্ব-ভাবশুন্যতা = পরমার্থ সত্য

অর্থাৎ, সংবৃতি সত্য = পরমার্থ সত্য

এবং ঠিক এই জায়গা থেকেই কুশকর্ণী আশ্রমে আমরা চাষবাসসংক্রান্ত দৈনন্দিন কাজের মধ্যে থেকে প্রকৃতির সাথে সংস্কৃতির বোঝাপড়া বিষয়ক যে নিবিড়তম সংবৃতিজ্ঞানলাভে ব্রতী হবো তা এক-আধারে পারমার্থিক জ্ঞানও বটে।

এই সংবৃতিজ্ঞান পরিবেশের প্রতিটি উপাদানের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা বুঝতে সাহায্য করে আমাদের।

এখানে যে বিষয়টি বিশেষভাবে বোঝা দরকার তা হলো, ওই একইরকমের সংবৃতিজ্ঞানের আঙিনায় Ecological Systems Theoryও এনে আমাদের হাজির করে। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, বৌদ্ধ চিন্তন ঐতিহ্যের কাছে যাওয়া কেন? নাগার্জুনের কাছে যাওয়া কেন?

কারণ নাগার্জুন এই সংবৃতিজ্ঞানের আঙিনা থেকে আমাদের পারমার্থিক সত্যের দিকে, তথা শুন্যতার দিকে, স্ব-ভাবশুন্যতার দিকে, অনাত্মার দিকে নিয়ে যান।

নাগার্জুন আমাদের সেখানে নিয়ে যান, যেখানে আমরা উপলব্ধির করি যে পারস্পরিক নির্ভরশীলতার কারণেই আমরা তথা জীবজগৎ ও বস্তুজগৎ স্ব-ভাবশুন্য। আমাদের কোনো স্ব তথা আত্মা নেই। পারস্পরিক নির্ভরশীলতার জায়গা থেকেই আমরা একেক সময় একেকটি বিশেষ ভাবে উপনীত হই মাত্র। আত্মার মিথ্যে রূপ পরিগ্রহ করি। যেমন আধুনিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থার দৌলতে আমরা Homo Economicus বা অর্থনৈতিক মানুষের ভাবে তথা আত্মায়  উপনীত হয়েছি। এই অর্থনৈতিক মানুষ যুক্তিযুক্তভাবে তার অর্থনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করে চলে। উপভোক্তা হিসাবে তার লক্ষ সর্বোচ্চ উপভোগ, আর উৎপাদক হিসাবে তার লক্ষ সর্বোচ্চ মুনাফা। এবং এই ব্যবস্থা আমাদের তথা জীবজগৎ ও বস্তুজগৎকে এমন এক বিচিত্র পারস্পরিক নির্ভরশীলতার সম্পর্কের দিকে ঠেলে দিয়েছে যা এই পৃথিবীর বাস্তুতন্ত্রের পক্ষে বিপদজনক ও বিধ্বংসী।

আশ্রমে চাষবাসসংক্রান্ত নিযুক্তির পাশাপাশি এই চর্চাও আমাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

শ্রমের দ্বারা প্রকৃতির সাথে সংস্কৃতির এই বোঝাপড়া বিষয়ক পাঠ প্রক্রিয়ার পোশাকি নাম নিযুক্ত বাস্তুতন্ত্র (Engaged Ecology)। জলবায়ুর পরিবর্তন ও পরিবেশ বিপর্যয়ের পরিপ্রেক্ষিতে এই পাঠ প্রক্রিয়া।

এত বছর ধরে কলেজে পরিবেশ বিদ্যা পড়িয়ে এটা বুঝেছি যে বাস্তুতন্ত্রকে ক্লাসরুমে বসে বই পড়ে শেখা যায়না। তাকে জানতে গেলে তার সাথে নিবিড়ভাবে নিযুক্ত হতে হয়। মানুষের সচেতন মনের এই নিবিড় নিযুক্তির অন্যতম উদাহরণ কৃষিকাজ। সেই জায়গা থেকে কুশকর্ণী আশ্রমে আমরা কৃষিকাজে নিযুক্ত হবো। এবং এই নিযুক্তির মাধ্যমে আমরা বাস্তুতন্ত্রকে জানবো নিবিড়ভাবে।

সকাল বেলায় হাতেকলমে কৃষিকাজ। বিকেলে বা সন্ধ্যায় আলাপ আলোচনা ও সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান। এর মধ্যে থেকেই পাঠ। ক্লাসরুমের বাইরে, পাঠ্যপুস্তক বিহীন। পরীক্ষা, শংসাপত্র, ও সুনির্দিষ্ট কোনো পাঠক্রম বিহীন নিবিড়, নিযুক্ত পাঠ।

এই চর্চার মধ্যে থেকে আমরা বুঝবো যে আমাদের অর্থনৈতিক সম্পর্ক আসলে আমাদের বাস্তুতান্ত্রিক সম্পর্কেরই অংশ। আমাদের প্রতিটি অর্থনৈতিক আদানপ্রদান চূড়ান্তভাবে বাস্তুতান্ত্রিক আদানপ্রদান।

ক্লাসে পড়াতে পড়াতে ছাত্রছাত্রীদের প্রায়ই একটা প্রশ্ন করি। আচ্ছা, বলতো, আমরাও কলা খাই, আর হনুমানও কলা খায়। তো আমাদের এই কলা খাওয়ার সাথে হনুমানের কলা খাওয়ার কি পার্থক্য?

হনুমান সরাসরি গাছ থেকে পেড়ে কলা খায়। তার মাঝে আর কিছু নেই। তাই হনুমানের কলা খাওয়া সম্পূর্ণভাবে একটি প্রাকৃতিক আদানপ্রদান। কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে সেই আদানপ্রদান শুধুমাত্র প্রাকৃতিক পরিসরে সীমাবদ্ধ নয়। তার মধ্যে সংস্কৃতি জড়িয়েপেঁচিয়ে (entangled হয়ে) আছে। এই entanglementএর কারণে কলা গাছে হওয়া সত্ত্বেও আমাদের তা বাজার থেকে পয়সা দিয়ে কিনে খেতে হয়।

এই সাংস্কৃতিক মধ্যস্থতার মধ্যে জড়িয়েপেঁচিয়ে আছে রাজনীতি, অর্থনীতি, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, শিল্প, দর্শন, ইতিহাস, মনস্তত্ত্বসহ আরো বহু কিছু।

মানুষ যে কলা খায় তা নিছক প্রকৃতির দান নয়। সেই কলা চাষ করতে হয়। চাষ একটি সাংস্কৃতিক কার্যকলাপ। সেই চাষ করার জন্য জঙ্গল সাফ করতে হয়। হাইব্রিড কলার বীজ তৈরি করতে হয়। সেই চাষের জন্য ট্রাক্টর, পাম্পসেট, রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করতে হয়। হিমেঘর নির্মাণ করতে হয় কলা রাখার জন্য। জাহাজ নির্মাণ করতে হয় তা রফতানি করার জন্য। ব্যাংক থেকে সুদে টাকা ধার নিতে হয় এই ব্যবসা করার জন্য।

মধ্য আমেরিকায় এই কলা চাষকে কেন্দ্র করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কুখ্যাত ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানি তো হন্ডুরাস ও গুয়াতমালায়কে একেবারে কলা প্রজাতন্ত্রে (Banana Republicএ) পরিণত করেছিল। সেই কলা রাজনীতির দৌলতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অভিধানে কলা প্রজাতন্ত্র নামক শব্দবন্ধের অনুপ্রবেশ। কলা প্রজাতন্ত্রের অর্থ একটি রাজনৈতিকভাবে অস্থির দেশ, যার অর্থনীতি সে দেশের প্রকৃতিমাতার নিঃশর্ত দানের রফতানির ওপর নির্ভরশীল। ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানির রাজনীতি ওই দুই দেশের সরকারকে পরিণত করেছিল কলা কোম্পানির হাতের পুতুলে। কলা কোম্পানির আগ্রাসনে লুন্ঠিত হয়েছিল হন্ডুরাসে ও গুয়াতমালার প্রকৃতি। তার সাথে ওখানকার মানুষের জীবনে নেমে এসেছিল নিদারুণ দুঃখযন্ত্রণা।

বস্তুতন্ত্রিক হস্তক্ষেপ তথা আগ্রাসনের এরকম বহু কাহিনীতে পৃথিবীর আকাশ, বাতাস, মাটি, জল মথিত হয়ে আছে। যেমন ক্ষুধা নিবৃত্তি ও উন্নয়নের অছিলায় ভারতবর্ষের মাটিতে সবুজ বিপ্লব নাম দিয়ে ষাটের দশকে সূচিত হয়েছিল আধুনিক শিল্পপ্রযুক্তিনির্ভর কৃষি। কৃষিতে সূচিত হয়েছিল (তথাকথিত) উচ্চ ফলনশীল হাইব্রিড বীজ। সূচিত হয়েছিল রাসায়নিক সার, আগাছানাশক ও কীটনাশক। সূচিত হয়েছিল পাম্পসেট ও ড্রিলসহ আধুনিক সেচ ব্যবস্থা। সূচিত হয়েছিল ট্রাক্টর ও হারভেস্টার। সূচিত হয়েছিল গুদামখানা ও হিমেঘর। সূচিত হয়েছিল কৃষি ঋণ প্রকল্প ও আরো বহু কিছু।

প্রতীত্যসমুৎপাদের নিয়ম মেনে এই (তথাকথিত) উচ্চ ফলনশীল হাইব্রিড বীজ সূচিত হওয়ার সাথে সাথে হারিয়ে গেল বহু লক্ষ প্রজাতির দেশি বীজ।

রাসায়নিক সার, আগাছানাশক ও কীটনাশক সূচিত  হওয়ার সাথে সাথে বিপর্যস্ত হলো মৃত্তিকার বাস্তুতন্ত্র। মৃত্যু হল মাটির উর্বরতা প্রদানকারী ব্যাকটেরিয়া ও কেঁচোকুলের। হারিয়ে গেল বহু প্রজাতির কীটপতঙ্গ, গাছগাছালি ও লতাপাতা। তার সাথে দূষিত হলো নদীনালাসহ সমস্ত প্রকারের জলাধার। পাম্পসেট ও ড্রিলসহ আধুনিক সেচ ব্যবস্থা সূচিত হওয়ার সাথে সাথে নেমে যেতে থাকলো ভৌমজলস্তর। ট্রাক্টর ও হারভেস্টার সূচিত হওয়ার সাথে সাথে হারিয়ে গেল হালের বলদ, গরুর গাড়ি। রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের দৌরাত্ম্যে আগেই লোপ পেয়েছিল গবের সার ও চোনার ব্যবহার।

তার সাথে প্রতীত্যসমুৎপাদের নিয়ম মেনে হারিয়ে গেল সেই সাবেকি কৃষি উৎপাদন প্রক্রিয়ার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়েপেঁচিয়ে থাকা ভারতবর্ষের সাবেকি উৎপাদন সম্পর্কসমূহ। যেমন কামারের বানানো সাবেকি কৃষি সরঞ্জাম অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়লো। অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়লো ধানের গোলা,

ঢেকি, সারগাদা। আর তার সাথে হারিয়ে গেল সেই সাবেকি গ্রাম্যজীবন, গ্রামসংস্কৃতি, লোকাচার, পালাপার্বন, আনন্দউৎসব, মূল্যবোধ, ইত্যাদি।

প্রকৃতি ও সংস্কৃতির ওপর এহেন আগ্রাসী হস্তক্ষেপ যা বাস্তুতন্ত্রকে ছিন্নভিন্ন করে, বিধ্বস্ত করে, তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ স্বাভাবিকভাবেই হবে আমাদের

আশ্রমের পাঠ্যপুস্তকবিহীন পাঠশালার সান্ধ্যসংলাপ ও আলোচনার অন্যতম বিষয়বস্তু।

সকালে হাতেকলমে চাষের কাজ আর সন্ধ্যার আলাপ আলোচনার মধ্যে দিয়ে আমরা খোঁজ করবো এমন এক সুস্থায়ী সংস্কৃতির যা কোনো অবস্থাতেই বাস্তুতন্ত্রের সাথে সংঘাতপূর্ণ হবেনা।

১০

১৮৭৮ সালের ভারতীয় বন আইনের মাধ্যমে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকেরা এদেশের অরণ্যের ওপর রাষ্ট্রের অধিকার কায়েম করে। তার ফলে এদেশের আরণ্যবাসী মানুষেরা অরণ্যের ওপর তাদের চিরাচরিত অধিকার হারায়। তুল্যমূল্যের বিচারে যেসব অরণ্য রাষ্ট্রীয় বণিকের চোখে দামি সাব্যস্ত হয় তাদেরকে তকমা দেওয়া হয় রিজার্ভ ফরেস্টের। অর্থাৎ সেখানথেকে একটুকরো জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করাও আইন ও রাষ্ট্রের চোখে অপরাধ। অথচ রেলপথ ও জাহাজ নির্মাণের জন্য চলতে থাকে নির্বিচারে অরণ্য নিধন।

এহেন বাতাবরণ নিজভূমে পরবাসী হওয়া সহজ সরল আরণ্যবাসী মানুষজনদের, তাদের যুগযুগের অরণ্যরক্ষার স্বাভাবিক প্রবণতা তথা সাংস্কৃতিক অভ্যাস থেকে ক্রমাগত দূরে ঠেলে দেয়। 

ইতিমধ্যেই দেশে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইনের মাধ্যমে জাকিয়ে বসেছে। এহেন ব্যবস্থার মাধ্যমে ঔপনিবেশিক শাসকেরা প্রকৃতির নিঃশর্ত দানসমূহ চিরস্থায়ী লুন্ঠনের পাকাপোক্ত বন্দোবস্ত করেন। ঔপনিবেশিক

রাষ্ট্রের অংশীদার তথা সহযোগী হিসেবে খ্যাত

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের এই নিলামী জমিদারকুল। তারা ক্রমাগত বাড়তি রাজস্ব আয়ের তাগিদে ইন্ধন দেন নতুন প্রজা বসিয়ে, তাদের জমিদারির অন্তর্গত জঙ্গল ক্রমান্বয়ে সাফ করে বাড়তি চাষাবাদের। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কল্যাণেই এদেশে সূচিত হয় জমিসহ প্রকৃতির অন্যান্য প্রতিটি নিঃশর্ত দানসমূহের সাথে মানুষের সংবেদনহীন অপব্যবহারের সম্পর্ক।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এদেশে এক অভূতপূর্ব কৃষিসম্পর্কের সূচনা করে। এই অদ্ভুত বন্দোবস্ত এদেশের কৃষকদের রাতারাতি নিজভূমিতে রায়তি প্রজা তথা ভাড়াটিয়ায় পরিনত করে। যখন তখন বিনা অজুহাতে খাজনা বৃদ্ধি এবং অনাদায়ে উচ্ছেদের আশঙ্কা তাদের জমির গুনমান রক্ষার সাংস্কৃতিক অভ্যাস থেকে ক্রমাগত দূরে ঠেলে দেয়।

১১

স্বাধীনতার পরে অবস্থার গুণগত পরিবর্তন বিশেষ কিছু হয়না। আরণ্যবাসী মানুষের অরণ্যের ওপর অধিকার স্বপ্নই থেকে যায়। উল্টে উন্নয়নের নাম করে কোথাও খনি, কোথাও শিল্প বা কোথাও রেলপথ ও সড়কের জন্য নির্বিচারে ধ্বংস করা হতে থাকে একের পর এক অরণ্য। 

এদিকে খাতায়কলমে জমিদারি বিলুপ্ত হলেও, জমিদার শ্রেণীর হাতেই থেকে যায় নামে বা বেনামে বিপুল পরিমান জমি। আর তারপর তো স্বাধীনতার বছর কুড়ি ঘুরতে না ঘুরতেই দেশে শুরু হয়ে যায় রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের (সবুজ)বিপ্লব।

তবে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে উন্নয়নের অছিলায় বৃহত্তম যে ধ্বংসলীলা সংগঠিত হয়, নিঃসন্দেহে তার মধ্যে পড়ে অতিকায় সমস্ত মাল্টিপারপাস প্রজেক্টসহ অসংখ্য ছোট ও বড় নদীবাঁধ, যা একইসাথে দেশের নদনদী ও অরণ্যের সর্বনাশ ডেকে আনে। মানুষের চোখের সামনে তাদের প্রিয় নদনদীর জল চুরি করে উন্নয়নের কারবারীদের হাতে তুলে দেয় ভারতরাষ্ট্র।

১২

কুশকর্ণী নদীর ওপরেও নির্মাণ করা হয়েছে একাধিক কংক্রিটের চেক ড্যাম। তার পার্শ্ববর্তী অরণ্যে কবেই সাফ করে আবাদ করা হয়েছে। অরণ্যের ছিটেফোঁটা যা পরে আছে তা পশুপাখিদের আবাস (habitat) হিসাবে যথেষ্ট নয়। আশেপাশের গ্রামগুলোতে হনুমানের উপদ্রব দেখলেই এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে জঙ্গলে ওদের খাবার নেই। ফলে বাড়ছে মানুষ-পশু সংঘাত।

এটা বুঝতে হবে যে নদী, অরণ্য, পশুপাখি, এই সব কিছু নিয়েই বাস্তুতন্ত্র তার জীবনতন্তুজাল বোনে। মানুষ এই জীবনতন্তুজালের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

১৭৫৭র পলাশীর যুদ্ধে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের পর আক্ষরিক অর্থেই শুরু হয় কর্পোরেট ‘কোম্পানির’ শাসন। শুরু হয় এই ভৌগোলিক পরিসরের প্রকৃতির যাবতীয় নিঃশর্ত দানসমূহের পন্যায়ন তথা ব্যবসায়িক তকমা প্রদান করে নির্বিচারে লুঠতরাজ। এবং তার সাথে নষ্ট হয়ে যেতে থাকে মানুষের সাথে মাটি, জলাশয়, অরণ্য ও নদনদীর চিরাচরিত সম্পর্ক। 

মাটি, জলাশয়, অরণ্য ও নদনদীর ওপর মানুষের সার্বজনীন অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবিতে, এবং তার পাশাপাশি প্রকৃতির নিঃশর্ত দানসমূহের সাথে মানুষের চিরাচরিত সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের উদ্দেশ্য আমাদের কুশকর্ণী যাত্রা।

১৩

পলাশীর যুদ্ধের ঠিক একশো বছর পরে, ১৮৫৭র দেশ জুড়ে বিদ্রোহের (যা সিপাই বিদ্রোহ বা স্বাধীনতার প্রথম যুদ্ধ হিসেবে খ্যাত) পরিপ্রেক্ষিতে, ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাস হওয়া ১৮৫৮ সালের ভারত সরকার আইনের মাধ্যমে দেশে খাতাকলমে কোম্পানির রাজত্ব শেষ হয়ে স্থাপিত হয় মহারানীর শাসন। লুঠতরাজের ওপর লাগে সংসদিয় সিল ছাপ্পা।

আমরা আজকের ভারতবর্ষের যে রাষ্ট্রকাঠামো ও অর্থনৈতিক কাঠামো দেখি তার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয় ব্রিটিশ শাসনকালে। এই সময়ে এই ভূখণ্ডের অর্থনীতি এক আন্তর্জাতিক, আধুনিকপ্রযুক্তিনির্ভর, নিষ্কাশনমূলক, উন্নয়নাভিমুখী, ভোগবাদী, প্রকৃতিবিধ্বংসী অর্থনীতির অংশ হয়ে ওঠে। কৃষিক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে অর্থকরী ফসলের চাষ শুরু হয়। যেমন বাংলায় পাট, আসামে চা, উত্তর প্রদেশে আখ, পাঞ্জাবে গম ও মহারাষ্ট্রে তুলো। তার সাথে ছিল তৈলবীজ, তামাক, আফিম, ইত্যাদি। তার সাথে হাতে হাত ধরে ছিন্নভিন্ন হতে থাকে গ্রামজীবনের সাবেকি তন্তুজাল। দেশের প্রত্যন্ত প্রান্ত থেকে সেসব কাঁচামাল পরিবহনের জন্য রেললাইন পাতা হয়। নির্মিত হয় বন্দর। সেসব ব্যবসাকে ঘিরে গজিয়ে ওঠে একাধিক ছোট বড় শহর। আর গজিয়ে ওঠে একদল অর্থবান ব্যবসায়ী। আজকের ভারতবর্ষের পরিপক্ক পুঁজিপতিশ্রেণীর জন্ম এহেন সময়ের গর্ভে।

১৮৫৮ থেকে ১৯৪৭এর মধ্যে ব্রিটিশ সরকার

ভারতবর্ষের মানুষ ও প্রকৃতিকে শাসন তথা নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে প্রায় ১৯৬টি আইন প্রণয়নের করে। তার মধ্যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ১৮৬১ শালের ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসেস অ্যাক্ট। এর মাধ্যমে তারা একটি সুসংহত আমলাতান্ত্রিক কাঠামো গড়ে তোলে এদেশে। ১৮৬২তে চালু হয় ইন্ডিয়ান পেনাল কোড (IPC)।  তার সাথে হাতে হাত ধরে ঔপনিবেশিক পথেই সংগঠিত হতে থাকে এদেশের আধুনিক নগর কেন্দ্রিক জীবন। ১৮৫৭ সালে কলকাতা, বোম্বে ও মাদ্রাজে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হওয়ার দৌলতে উন্মেষ হয় এক ইংরেজি জানা, তথাকথিত আধুনিক, শহুরে মধ্যবিত্ত সমাজের।

আমরা আজকে ভারতবর্ষ নামক যে সত্তাকে মানসচক্ষে অনুধাবন করি, ভারতবাসী হিসাবে যে আত্মপরিচয় আমরা বহন করি, যে ভাষায় আমরা কথা বলি, যে চশমা দিয়ে আমরা দেখি, যে মস্তিষ্ক দিয়ে আমরা ভাবি, যে হৃদয় দিয়ে আমরা অনুভব করি, সে সবকিছুরই বীজ বপিত হয় অদ্ভুত এই ঔপনিবেশিক সময়ের গর্ভে। ১৭৫৭ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এদেশের শাসনভার গ্রহণ করার পর তাদের ওপর রাষ্ট্র পরিচালনা সংক্রান্ত বহুবিধ আইনি দায়িত্ব এসে পড়ে। তার পরিপ্রেক্ষিতে ১৭৭২ সালে বাংলার বড় লাট ওয়ারেন হেস্টিংস ঘোষণা করেন যে বিবাহ, বিষয়সম্পত্তি তথা উত্তরাধিকার সংক্রান্ত যাবতীয় বিবাদের সুষ্ঠ মীমাংসার জন্য কোম্পানি মুসলমানদের ক্ষেত্রে যেমন কোরানের নির্দেশ মেনে চলবে, ঠিক তেমনই, বাকি অমুসলমান ‘জেনটু’দের ক্ষেত্রে (তখনো এদেশের অমুসলমান ‘জেনটু’দের গায়ে হিন্দুর তকমা লাগেনি) শাস্ত্রের নির্দেশ মেনে চলবে।

১৭৭৬ শালে ইংরেজ ভাষাবিদ (Philologist)

উইলিয়াম জোন্স ঔপনিবেশিক পৃষ্ঠপোষকতায় এমতউদ্দেশ্যে খুঁজেপেতে মনুস্মৃতি ইংরেজিতে অনুবাদ করেন, যা হিন্দু আইন ও পরবর্তীকালে ভারতীয় জনগণনার ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়। ব্রিটিশ শাসনকালে এদেশে ১৮৭২ সাল থেকে জনগণনার কাজ শুরু হয়। প্রথম পূর্ণাঙ্গ জনগণনা হয় ১৮৮১ সালে। এবং এই আইনি ও জনগণনার চক্করে এদেশের অমুসলমান জনগোষ্ঠীর গায়ে সামগ্রিকভাবে “হিন্দু” নামক একটি সরকারি তকমা লাগে, যা পরবর্তীকালে তাদের আত্মপরিচয় হয়ে ওঠে। এবং ঔপনিবেশিক জনগণনার দৌলতে মনুস্মৃতির বর্গবিভাজন শ্রেণীবদ্ধ সরকারি নথিতে (classified documentএ) পরিণত হয়।

এদেশের জনসাধারণের মনে তাদের এই নতুন আত্মপরিচয়ের যে স্বাভাবিকায়ন (normalization) ঘটেছিল তার সবথেকে বড় প্রমাণ, ১৮১৬ সাল নাগাদ (তথাকথিত) বাংলার নবজাগরণের পুরোধাপুরুষ রাজা রামমোহন রায়ের লেখায় হিন্দু ধর্ম (Hinduism) কথাটি পাওয়া যাচ্ছে। (এবং সেটাই সম্ভবত Hinduism শব্দটির প্রথম ব্যবহার)।

১৪

এই নতুন সামাজিক আত্মপরিচয়ের পাশাপাশি আর একটি ঘটনা ঘটে যেটা আমাদের এই আলোচনার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

মনুস্মৃতির অনুবাদক উইলিয়াম জোন্স ছিলেন বহু ভাষায় পারদর্শী একজন ভাষাবিদ (Philologist)। সংস্কৃত ভাষার মহিমা তাকে শুধুমাত্র চমৎকৃত করে এমন নয়, তিনি এর সাথে ইউরোপের আর দুই ধ্রুপদী ভাষা, যথাক্রমে গ্রিক ও ল্যাটিন সাথে অদ্ভুত মিল খুঁজে পান। তার মতে এদের মধ্যে সংস্কৃত সর্বোৎকৃষ্ট। তার উপকল্প অনুযায়ী এই তিন ভাষার জন্ম কোন এক অত্যুৎকৃষ্ট প্রাচীন ভাষা থেকে, যা আজ হারিয়ে গেছে।

সে সময়ে ইউরোপে একটি ধারণা বিশেষভাবে প্রচলিত হয়েছিল, তা এরকম: যে ভাষা যত বেশি সমৃদ্ধ, সে সভ্যতা তত বেশি সমৃদ্ধ। এখন এই অঙ্ক অনুযায়ী ধ্রুপদী ভারতীয় সভ্যতা ধ্রুপদী গ্রিসীয় বা রোমান সভ্যতার থেকে ঢের বেশি সমৃদ্ধ ছিল। আর ঠিক এই জায়গা থেকে আর্য তত্ত্বের (Aryan Theoryর) প্রস্তাব পেশ করেন উইলিয়াম জোন্স। এবং তার পরবর্তী সময়ে এই তত্ত্বের পূর্ণাঙ্গ রূপদান করেন বেদ, বেদান্ত ও উপনিষদের অনুবাদক তথা প্রাচ্যবাদী পন্ডিত ফ্রেডরিক ম্যাক্স মুলার। এই তত্ত্বের মূল কথা হলো ক্যকেশিয় অঞ্চল থেকে কোনো এক জাতি ইউরোপ থেকে ভারতবর্ষ অবধি বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। এই জাতিরই হাত ধরে ভারতবর্ষে বৈদিক সভ্যতার উন্মেষ ঘটে।

ইন্ডলজির (Indologyর) জনক ম্যাক্স মুলার প্রায় একক প্রচেষ্টায় (তথাকথিত) ‘আধুনিক’ ভারতীয় মননের ধাঁচাটি তৈরি করে দেন। ম্যাক্স মুলারের ভাবনায় অনুপ্রাণিত হন রাজা রামমোহন রায় থেকে স্বামী বিবেকানন্দ। এহেন অনুপ্রেরণার মূল কথা আমাদের এদেশের হৃৎগৌরব পুনরুদ্ধার করতে হবে। “ভারত আবার জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে”। আর এটাই হচ্ছে ভারতীয় উন্নয়নকামনার মূল কথা।

১৫

শিল্পবিপ্লবউত্তর ইউরোপের মানদন্ডে নিজেদেরকে মেপে, তার সমকক্ষ হতে চাওয়ার বাসনা তথা উন্নয়নকামিতা অচিরেই নগর কেন্দ্রিক, ইংরেজি জানা, ভারতীয় মধ্যবিত্ত সমাজের ধ্যানজ্ঞান হয়ে দাঁড়ায়।

১৯৪৭এ ক্ষমতা হস্তান্তরের মাধ্যমে ভারতবর্ষ তথাকথিত অর্থে স্বাধীনতা লাভ করে ঠিকই। কিন্তু তার সাথে সে উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করে সেই ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রকাঠামো, সেই আমলাতন্ত্র, সেই আইন ব্যবস্থা, সর্বোপরি সেই শিক্ষা ব্যবস্থা তথা সেই ঔপনিবেশিক পথে প্রাপ্ত ইউরোপীয় আধুনিকতার জ্ঞানতাত্ত্বিক কাঠামো। আর সেই জ্ঞান প্রকল্পের ওপর নির্ভর করেই স্বাধীন ভারতবর্ষের উন্নয়নের যাত্রা শুরু হয় নেহেরুজির নেতৃত্বে, জঙ্গল কেটে, নদীতে বাঁধ দিয়ে।

আর এহেন ঔপনিবেশিক জ্ঞান প্রকল্পেরই অংশ আমাদের আজকের এই জাত, ধর্ম ও বর্ণের মনু এবং যজ্ঞবল্ক স্মৃতিশাস্ত্র উৎসারিত, রাষ্ট্র স্বীকৃত আত্মপরিচয় যা স্বাধীন ভারতরাষ্ট্রের নাগরিকরা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করে ১৯৪৭এ।

ক্রমে উন্নয়নের রাজনীতি ও আত্মপরিচয়ের রাজনীতি স্বাধীন ভারতবর্ষের স্বাধীনতাউত্তর ভোট কেন্দ্রিক রাজনীতির প্রধান দুটি অক্ষে পরিণত হয়।

১৬

১৯৮৪ সালে ইন্দিরা গান্ধীর নৃশংস হত্যার পর দেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন রাজীব গান্ধী। তার ওই পাঁচ বছরের শাসনকালকে এদেশের ইতিহাসে উন্নয়ন ও আত্মপরিচয়ের রাজনীতির উড্ডয়নকাল হিসেবে দেখা যেতে পারে।

যেমন, উন্নয়নের রাজনীতির প্রশ্নে তার সরকার বিরোধীদের সমস্তপ্রকার বিরোধিতা উপেক্ষা করে ভারতের অর্থনীতিকে উন্মুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু করেন।

(এখানে মনে রাখতে হবে যে নব্যউদারবাদের কান্ডারীরা ইতিমধ্যেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রোনাল্ড রেগান, এবং গ্রেট ব্রিটেনে মার্গারেট থ্যাচারের হাত ধরে, আন্তর্জাতিক অর্থনীতির খোলনলচে বদলে দিতে শুরু করেছেন। গোটা পৃথিবী জুড়ে বাজতে শুরু করেছে বিশ্বায়নের ঢাকঢোল।)

এবং আত্মপরিচয়ের রাজনীতির প্রশ্নে, প্রথমতঃ ১৯৮৬ সালে কট্টরপন্থী মুসলমানদের খুশি করতে রাজীব গান্ধীর সরকার শাহ বানু মামলার শীর্ষ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে গিয়ে মুসলিম মহিলা (অধিকার ও বিচ্ছেদ সুরক্ষা) আইন প্রণয়ন করে।

দ্বিতীয়তঃ ১৯৮৯ সালে তার সরকার কট্টরপন্থী হিন্দুদের খুশি করতে বিশ্ব হিন্দু পরিষদকে অযোধ্যার বিতর্কিত ভূমিতে শিল্যান্যাস করবার অনুমতি প্রদান করে।

১৯৮৯ সালের নির্বাচনে রাজীব সরকারের পতনের পর প্রধানমন্ত্রী হন বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহ। তার সরকার মন্ডল কমিশনের প্রস্তাব বাস্তবায়নের মধ্যে দিয়ে এহেন আত্মপরিচয়ের রাজনীতিকে একটা অন্য মাত্রায় নিয়ে যান।

১৯৯০এ বিজেপি সভাপতি লাল কৃষ্ণ আদবানি অযোধ্যায় রাম মন্দির স্থাপনের দাবিতে দেশ জুড়ে রথযাত্রা শুরু করেন। এহেন রাজনীতি তাদের ১৯৯১ সালের নির্বাচনে লোকসভায় ১২১টি আসন পাইয়ে দেয়। তারা হয়ে ওঠেন দেশের প্রধান বিরোধী দল।

ভারতবর্ষে আত্মপরিচয়ের রাজনীতিরই অতিভীষণ রূপ কট্টর হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি। এহেন রাজনীতির জঘন্যতম উদাহরণ সংঘটিত হয় ১৯৯২ শালের ৬ই ডিসেম্বর বাবরি মসজিদের ধ্বংস ও তার পরবর্তীতে দেশজুড়ে দাঙ্গার মাধ্যমে।

১৭

১৯৯১ সালে দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হন নরসিংহ রাও। তার সরকারের অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। দেশ তখন গলা অবধি অর্থনৈতিক সংকটে নিমজ্জিত। অর্থনীতির ভাষায়, একই সাথে বাণিজ্য ঘাটতি (অর্থাৎ, রফতানির তুলনায় আমদানি বেশি) ও রাজস্ব ঘাটতি (অর্থাৎ, সরকারের আয়ের তুলনায় ব্যয় বেশি)। অবস্থা এমনই গুরুতর যে, দেশ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক অর্থ সংস্থা থেকে যা ঋণ নিয়েছে তার সুদ দেওয়ারও পয়সা (ডলার) নেই।

(এখানে মনে রাখতে হবে যে ইতিমধ্যেই ভেঙে পড়েছে সোভিয়েত ইউনিয়নসহ গোটা ইস্টার্ন ব্লক।)

এমতাবস্থায় নরসিংহ রাও সরকার দেশের সোনা বন্দক রেখে তাৎক্ষণিকভাবে ঋণ খেলাপির দায় থেকে দেশকে রক্ষা করলেও এর চূড়ান্ত দাম দিতে হয় দেশের মানুষ ও প্রকৃতিকে। এহেন অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলা করতে গিয়ে দেশের সরকারকে আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডারের আরোপিত যাবতীয় জনস্বার্থবিরোধী ও পরিবেশবিধ্বংসী নব্যউদারবাদী কাঠামোগত সংশোধন নীতি (Structural Reform Policy) মেনে নিতে হয়। এবং এই কাঠামোগত সংশোধন আজকের এই নব্যউদারবাদী সর্বগ্রাসী উপভোক্তা অর্থনীতির বিস্তারের রাস্তা জীবনের সর্বক্ষেত্রে উন্মুক্ত করে দেয়।

১৮

উন্নয়ন ও কট্টর হিন্দুত্ববাদী আত্মপরিচয়ের স্লোগানকে সামনে রেখেই ২০১৪ শালে লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি জয়ী হয়। দেশের প্রধানমন্ত্রী হন নরেন্দ্র মোদি।

আর গত আট বছর ধরে আমরা দেখছি কিভাবে উন্নয়নের স্বপ্ন, আর হিন্দুত্ববাদী শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় একে অপরের সহযোগী হয়ে উঠছে।

গত আট বছর ধরে আমরা দেখছি কিভাবে একদিকে ধর্মীয় উন্মাদনা, আরেকদিকে উন্নয়নের মাদকতায় বিভোর হয়ে আছে দেশের উপভোক্তা সমাজ। যেন তারা দেখেও দেখতে পাচ্ছেনা যে এই প্রজাতন্ত্র ক্রমে কি ভীষণ বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে চলেছে। দেশের ৭৫০০ কিলোমিটার তটরেখা বেয়ে সমুদ্র যেভাবে এগিয়ে আসছে তা আর দুচার বছরের মধ্যে দেশের মানচিত্রটাকেই পাল্টে দেবে। সবুজ বিপ্লব বলয়ের রাজ্য পাঞ্জাব ও হরিয়ানা সহ দেশের একচতুর্থাংশ মরুভূমিতে রূপান্তরিত হতে চলেছে। হিমালয়ের বরফ গোলে যাচ্ছে দ্রুত। একে একে সবকটি নদী মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ছে। মৌসুমী বায়ু লণ্ডভণ্ড। একটার পর একটা ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়ছে অন্ধ্র, উড়িষ্যা আর বাংলার উপকূলে। ভৌমজলস্তর ক্রমশঃ নিম্নগামী। বায়ু ভয়ংকরভাবে দূষিত। চারিদিকে বর্জ্যের স্তুপ। চারিদিকে পরিবেশ উদ্বাস্তু যারা উদ্বাস্তু হিসাবে চিহ্নিত নন। বাড়ছে জলবায়ু

সংঘাত।

গত আট বছর ধরে আমরা দেখছি কিভাবে জনগণের ঘাড় ভেঙে সরকারি আনুকূল্যে আদানি পৃথিবীর দ্বিতীয় অর্থবান ব্যক্তিতে পরিণত হচ্ছেন, কিভাবে তার মুনাফা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, আর দারিদ্র্য সীমার নীচে চলে যাচ্ছেন আরো বেশি বেশি মানুষ। কিভাবে প্রকৃতির নিঃশর্ত দান, জল, জঙ্গল, জমি তুলে দেওয়া হচ্ছে তার হাতে। তার উদাহরণ ছত্তিশগড়ের হাসদেও অরণ্য, তার উদাহরণ বাংলার  দেউচা পাচামি, তার উদাহরণ ঝাড়খণ্ডের গোড্ডা।

এরকম একটি রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কুশকর্ণী নদী সমাজের উদ্যোগে কুশকর্ণী নদী যাত্রা। এই যাত্রার উদ্দেশ্য ভবিষ্যতে একটি পূর্ণাঙ্গ নদী আন্দোলন গড়ে তোলা। এবং যেহেতু কুশকর্ণী এসে পড়েছে ময়ূরাক্ষীতে, আর ময়ূরাক্ষী এসে পড়েছে গঙ্গায়, তাই ভবিষ্যতে এই আন্দোলনের অভিমুখ হবে ময়ূরাক্ষীকে ধরে ভারতবর্ষের বৃহত্তর নদনদী আন্দোলনের সাথে সংযুক্ত হওয়া।

১৯

ফুকোর মতে নব্যউদারবাদ এক বিশেষ ধরনের শাসনপ্রক্রিয়া (governmentality)। একদিকে থেকে নব্যউদারবাদ যেমন এক সক্রিয় বাজার সৃষ্টির রাজনীতি (an active politics of market creation), অন্যদিক থেকে তা ঠিক তেমনই এক বিশেষ ধরনের পরিবেশ প্রযুক্তি (technology of the environment)। ফুকো এখানে অবশ্যই অর্থনৈতিক পরিবেশের কথা বলছেন।

অর্থাৎ, নব্যউদারবাদ একদিকে যেমন নতুন বাজার সৃষ্টি করে, অন্যদিকে তা এমন এক অর্থনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করে যা নব্যউদারবাদী বিষয়ীকে (neoliberal subjectকে) এক বিশেষ উপভোক্তাবাদী ও উদ্যোগবাদী আচরণের (consumerist and entrepreneurial behaviourএর) দিকে চালিত করে। এবং তা পুরোটাই সে করে বাজারের কারসাজির (market mechanismএর) মারফত।

এই নব্যউদারবাদী শাসনপ্রক্রিয়া মোটামুটিভাবে তিনটি প্রণালীতে ক্রিয়া করে, যা যথাক্রমে: ফিন্যান্স পুঁজির প্রণালী (এক); প্রযুক্তির প্রণালী (দুই); এবং জ্ঞানতাত্ত্বিকতার প্রণালী (তিন)।

নব্বইয়ের দশক থেকে বিশ্ব ব্যাঙ্ক এবং আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডারের সুপারিশে ভারতীয় অর্থনীতির উদারিকরণের প্রক্রিয়া শুরু হয়। প্রথমে দেশের মুদ্রার বিনিময় হারকে নিয়ন্ত্রণমুক্ত করা হয়। অনেকাংশেই নিয়ন্ত্রণমুক্ত করা হয় দেশের ব্যাঙ্ক তথা অর্থ ব্যবস্থাকে। শিল্প ও বাণিজ্যক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রকারের সরকারি নিয়ন্ত্রণ ও নিষেধাজ্ঞা ক্রমে শিথিল করা হয়। সরকারি মালিকানাধীন সুবৃহৎ কোম্পানিগুলির দায়িত্ব সরকার একে একে তুলে দিতে থাকে বেসরকারি হাতে। একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ আইন তুলে নেওয়া হয়। কমানো হয় কর্পোরেট ট্যাক্স ও আমদানি শুল্ক, ইত্যাদি। দেশের অর্থনৈতিক অর্গল খুলে দেওয়ার এই প্রক্রিয়াটিকেই আমরা সক্রিয় বাজার সৃষ্টির রাজনীতি হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি।

এই প্রক্রিয়ার ফলে শুরু হয় ভারতবর্ষের নব্যমুক্ত অর্থনীতিতে বিপুল পরিমাণ আন্তর্জাতিক পুঁজির অনুপ্রবেশ তথা বিনিয়োগ। (অর্থাৎ, নব্যউদারবাদী শাসনপ্রক্রিয়া: প্রণালী এক)। এই বিনিয়োগের ফলে একের পর এক দেশি ও বিদেশি কোম্পানি, দেশের বিভিন্ন ছোটবড় শহরে, তাদের ঝা চকচকে অফিস হাঁকিয়ে হরেক রকমের ব্যবসা ফেঁদে বসে। দেশ ছেয়ে যায় তথ্যপ্রযুক্তি এবং বিভিন্ন ধরনের সেবাদ্রব্য সরবরাহকরি কোম্পানিতে। ছেয়ে যায় বিদেশি কোম্পানির ব্যাক অফিসে, ফাস্ট ফুডের শৃঙ্খলে আর ঝকঝকে সব শপিংমলে। সেই সব শপিংমল থেকে সহজ ঋণের দৌলতে ঘরে ঘরে পৌঁছে যায় টিভি, ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিন। গাড়ি বা এয়ার কন্ডিশনারও পিছিয়ে থাকেনা। আর হাত বাড়ালেই সহজ কিস্তিতে হোম লোনের মাধ্যমে দু বা তিন কামরার ছোটবড় ফ্লাট। সাথে বেসরকারি স্কুল কলেজ আর হাসপাতাল।

এর পাশাপাশি ঘরে ঘরে পৌঁছে যায় রঙিন টেলিভিশনের সাথে প্রথমে ডিশ এন্টেনা, ও পরে কেবল লাইনের মাধ্যমে অগুনতি দেশি ও বিদেশি টিভি চ্যানেল। তারপর ঘরে ঘরে ঢুকে পড়ে টেলিফোন। তারপর পৌঁছে যায় পেজার। তারপর অনুপ্রবেশ ঘটে কম্পিউটার ও ল্যাপটপের। তারপর পৌঁছে যায় হাতে হাতে মোবাইল ফোন। তারপর তার জায়গা দখল করে নেয় মনহরনি আধুনিক স্মার্ট ফোন ও ট্যাবলেট, সাথে অফুরন্ত ইন্টারনেট। (অর্থাৎ, নব্যউদারবাদী শাসনপ্রক্রিয়া: প্রণালী দুই)।

নব্যউদারবাদী শাসনপ্রক্রিয়ার প্রণালী একের (পুঁজির) মাধ্যমে সমাজের একাংশের হাতে, মূলত ইংরেজি জানা, শহুরে, শিক্ষিত, মধ্যবিত্তের হাতে, অর্থের যোগান  বাড়ানোর ব্যবস্থা করে দেয়। উদাহরণ স্বরূপ, স্কুল ও কলেজ শিক্ষকদের মাইনে নব্বইয়ের দশক থেকে ক্রমাগতভাবে বাড়ানো হতে থাকে। একইভাবে মাইনে বাড়ানো হতে থাকে বিভিন্ন স্তরের সরকারি আমলা ও কর্মচারীদের। অর্থাৎ তাদেরকে সূচতুরভাবে উপভোক্তা শ্রেণীতে পরিণত করার ব্যবস্থা করা হয়। এটাই নব্যউদারবাদী বাজার সৃষ্টির রাজনীতি। অর্থাৎ, নব্যউদারবাদী সরকারের কাজ করবারের পদ্ধতিগত ফারাক হচ্ছে, যে, সে আর জনগণের করের পয়সায় জনগণের মঙ্গল করার কথা ভাবেনা। সে ভাবে করের পয়সা ব্যবহার করে কিভাবে নতুন নতুন বাজার সৃষ্টি করা যায়, বা কিভাবে যে বাজারগুলো আছে তার কলরব বৃদ্ধি করা যায়।

এর পাশাপাশি নব্যউদারবাদী শাসনপ্রক্রিয়া প্রণালী দুইয়ের (প্রযুক্তির) মাধ্যমে উপভোক্তা তথা জনগণের আচরণের ওপর প্রভাব বিস্তারের তথা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। যেমন ধরুন আপনি হয়তো গুগলে কিছু দেখছেন বা খুঁজছেন। ধরা যাক আপনি আপনি জৈব চাষ সম্বন্ধে জানার চেষ্টা করছেন। আপনি পরমুহূর্তেই দেখবেন যে আপনার চারিদিকে জৈব চাষ সংক্রান্ত বিভিন্ন কোর্স, বইপত্র, বীজ ইত্যাদির pop up আপনার মোবাইলের পর্দায় ভেসে উঠছে। ফেসবুকের মাধ্যমে জৈব চাষ সংক্রান্ত বিভিন্ন খবরাখবর আপনি পেতে শুরু করবেন। ইউটিউব আপনাকে জৈব চাষের বিভিন্ন ভিডিও দেখাতে শুরু করবে।

এখন থেকে দুটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে যায়। (এক), গুগুল আপনার গতিপ্রকৃতির ওপর নজর রাখছে। অর্থাৎ, আপনি যখন গুগুলের থেকে কিছু জানার চেষ্টা করছেন, তখন উল্টে গুগুল আপনাকে জানার চেস্তা করছে। (দুই) গুগুল আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করছে, ঠিক যেমন একজন বিশ্বস্ত চাকর তার মনিবকে পরামর্শ দিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে। এবং এই এক ও দুইয়ের মাধ্যমে সে আপনার আচরণকে প্রভাবিত করছে ও নিয়ন্ত্রণ করছে।

২০

নব্যউদারবাদী শাসনপ্রক্রিয়া জ্ঞানতাত্ত্বিকতার প্রণালীর মাধ্যমে (অর্থাৎ, প্রণালী তিনের মাধ্যমে)

এই গোটা নব্যউদারবাদী বিন্যাসের (Neoliberal Orderএর) স্বাভাবিকায়ন (Normalization) ঘটিয়েছে। এর প্রমাণ আমাদের চারিদিকে ছড়িয়ে আছে।

যেমন আজ আমরা খুব ‘স্বাভাবিকভাবেই’ শিক্ষাকে পয়সা দিয়ে ক্রয় করি এবং বিক্রয় করি। বা যেমন আমরা খুব ‘স্বাভাবিকভাবেই’ অর্থ উপার্জনের তাগিদেই পড়াশোনা করি। (চারিদিকে শুধু স্কুল, কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞাপন। চারিদিকে হরেক রকম কোর্সের অফার। অর্থাৎ, কোন পড়াশোনা করলে কোন চাকরি পাবো)।

যেমন আমরা খুব ‘স্বাভাবিকভাবেই’ বেড়াতে যাই এবং packaged নিসর্গকে পয়সা দিয়ে কিনি।

যেমন আমরা খুব ‘স্বাভাবিকভাবেই ‘বলি ecosystem services বা natural resources.

যেমন আমরা খুব ‘স্বাভাবিকভাবেই’ আমাদের কাজের নৈতিক দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করি (সে NTPCর ইঞ্জিনিয়ার হোক আর Hindustan Fertilizerএর Sales Representative.

যেমন আমরা খুব ‘স্বাভাবিকভাবেই’ আমাদের প্রতিটি সামাজিক এবং বাস্তুতান্ত্রিক সম্পর্ককে অর্থনৈতিক সম্পর্কে অনুবাদ করে নিই।

অর্থাৎ, আমরা নব্বইয়ের দশকে থেকে এই ক বছরে, অর্থাৎ, গত তিরিশ বত্তিরইস বছরে, নতুন মানুষ হয়ে উঠেছি, নব্যউদারবাদী মানুষ।

২১

নব্যউদারবাদী রাজত্বে ওই ইংরেজি জানা, শহুরে, শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত অংশের মানুষের বাইরে যারা পড়েন তাদের অবস্থা ভয়নক ভাবে খারাপ হয়েছে। তাদের অবস্থা কতটা খারাপ হয়েছে তা বোঝাবার জন্য statistics যথেষ্ট নয়। তার জন্য আমাদের তাকাতে হবে ভারতবর্ষের কৃষকদের দিকে (তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে ১০,৮৮১ জন কৃষিজীবী আত্মহত্যা করেছেন)।

আর তার সাথে মিলিয়ে দেখবার জন্য আমাদের তাকাতে হবে গৌতম আদানির দিকে (তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে গৌতম আদানির সম্পদ ৪৯ বিলিয়ন ডলার বৃদ্ধি পেয়েছে।)।

আর তার সাথে পাল্লা দিয়ে খারাপ হয়েছে পরিবেশ ও প্রকৃতির অবস্থা। গঙ্গার সন্তান হিসাবে নিজেকে প্রচার করে বিজেপি প্রার্থী নরেন্দ্র মোদি বারাণসীর মানুষের মন ভুলিয়ে পাঁচ লাখেরও বেশি ভোটে জিতলেন। আর তারপর তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে তার সেই গঙ্গা মাইয়ার উদ্ধারের নাম করে নদীটির কি ভয়ংকর সর্বনাশ করে চলেছেন তা আমরা প্রতিদিন দেখতে পাচ্ছি। আবার তিনি হিন্দু পুণ্যার্থীদের জন্য চারধাম যাত্রার সুবিধা করে দেওয়ার নাম করে এক বিশাল হাইওয়ে প্রকল্পের অছিলায় ৫০৮.৬৬ হেক্টর জঙ্গলের জমিকে উন্নয়নের কাজে (অপ)ব্যবহারের ব্যবস্থা করছেন। কেটে ফেলার ব্যবস্থা করেছেন ৫০,০০০ গাছ।

২২

নব্যউদারবাদের এই ত্রিশূল আক্রমণ এত শানিত যে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা বেশ কঠিন। কেন কঠিন তা বোঝার জন্য বিশেষ কোনো তাত্ত্বিক বিচারে না গিয়েও, পাঠক একটু মনোযোগ দিয়ে চারিদিকে তাকালেই এর সহজ উত্তর খুজে পাবেন।

একটা সময়ে যেসব স্কুল কলেজের মাস্টারমশাইরা বিপ্লবী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতেন, তাদের স্থানাধিকারী মাস্টারমশাইরা আজ উপভোক্তা সমাজের গর্বিত নাগরিক।

সেসব আন্দোলনের সহযোগি যেসব শিল্পীরা প্রতিস্পর্ধি সংস্কৃতির কথা বলতেন, তাদের স্থানাধিকারী আজকের তথাকথিত প্রতিস্পর্ধি শিল্পীরাই আজ নব্যউদারবাদী শাসনপ্রক্রিয়ার দৌলতে নিজেদের শিল্পকে পণ্যে পরিণত করতে ব্যস্ত।

প্রতিবাদ  তো সেই কবেই পণ্যে পরিণত হয়েছে মিডিয়ার আশীর্বাদে। পরিবেশ আন্দোলনের একটা বড় অংশই আজ সরকারি বা বেসরকারি অর্থে লালিত। বাকি পরিবেশ আন্দোলনের নেতৃত্বের একটা বড় অংশ আজ পন্যাইত Ramon Magsaysay Award আর Right Livelihood Awardএর দৌলতে।

২৩

এরকম একটা অদ্ভুত পিচ্ছিল মাটির ওপর দিয়ে পদযাত্রীরা হাঁটবেন কুশকর্ণীর ধার দিয়ে আগামী ৩রা ও ৪ঠা ডিসেম্বর (২০২২)। এরকম একটা চোরাবালির স্রোতের ওপর দাঁড়িয়ে কুশকর্ণী নদী সমাজ সেই পদযাত্রা সংগঠিত করছেন সাহস করে। 

বোঝাই যাচ্ছে যে এহেন নব্যউদারবাদী পরিবেশে পরিবেশের ওপর নব্যউদারবাদী আক্রমণ প্রতিহত করা কত কঠিন। আক্রমণটা বাইরে যেমন, ভেতরেও তেমন।

এই বাইরের এবং ভেতরের আক্রমণ একসাথে প্রতিহত করবার জন্যই একইসাথে কুশকর্ণী নদী সমাজ ও কুশকর্ণী আশ্রমের প্রাসঙ্গিকতা।

এমতাবস্থায় বাইরের প্রতিরোধ এবং ভেতরের প্রতিরোধ একসাথে, হাতে হাত ধরে, সমান্তরাল ভাবে করতে না পারলে উপায় নেই। আর তার জন্যই প্রতীত্যসমুৎপাদকে (dependent co-origination)

বোঝা।

বুঝতে হবে যে আমি এবং এই জগৎসংসার একই সথে উৎপাদিত হচ্ছি। বুঝতে হবে যে আমি প্রতি মুহূর্তে উৎপাদিত হচ্ছি। সেই আমার ওপর কখনো বা ঔপনিবেশিক আত্মপরিচয় আরোপিত হচ্ছে, কখনো বা হিন্দুত্ববাদী আত্মপরিচয়। তাই প্রথমতঃ আমাদের সমস্তপ্রকারের আত্মপরিচয়ের উর্ধে উঠতে হবে। বুঝতে হবে আত্মপরিচয় মাত্রই সংবৃতি সত্য।

আর আত্মপরিচয় মাত্রই যে সংবৃতি সত্য তা একবার বুঝতে পারলে তখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসবে, তাহলে পারমার্থিক সত্য কি?

আর এখানেই বৌদ্ধ চিন্তন ঐতিহ্যে নাগার্জুনের বিশেষত্ব যা আমরা ইতিপূর্বে (অংশ # ৬যে) খানিকটা আলোচনা করেছি, আর তা হলো:

সংবৃতি সত্য = পরমার্থ সত্য

কিন্তু এই সমীকরণে পৌঁছাতে গেলে একটু রাস্তা ঘুরে আসতে হবে। এবং তা হলো;

সংবৃতি সত্য = পারস্পরিক নির্ভরশীলতা (১)

পারস্পরিক নির্ভরশীলতা = স্ব-ভাবশুন্যতা (২)

স্ব-ভাবশুন্যতা = পরমার্থ সত্য (৩)

(১) অনুযায়ী: ঔপনিবেশিক জগৎসংসার আর ঔপনিবেশিক আমি একই সাথে উৎপাদিত হয়েছি; এবং একইভাবে নব্যউদারবাদী জগৎসংসার আর নব্যউদারবাদী আমি একই সাথে উৎপাদিত হয়েছি।

(২) অনুযায়ী: সেই আমি, এবং সেই জগৎসংসার দুইই স্ব-ভাবশুন্য

(৩) স্ব-ভাবশুন্যতা = পরমার্থ সত্য; অর্থাৎ সেই স্ব-ভাবশুন্যতাকে কোনো প্রকারের ধারণা দিয়ে বোঝার চেষ্টা করা, বা তার ওপরে কোনো প্রকারের ধারণা আরোপ করা অবিদ্যা ছাড়া আর কিছু নয়।

সেই অবিদ্যার বশবর্তী হয়ে আধুনিকতা তথা পুঁজিবাদ (যা একে অপরের সাথে জড়িয়ে পেঁচিয়ে আছে) আজ আমাদের এখানে এনে দাঁড় করিয়েছে।

আধুনিকতার সেই জ্ঞানকে অবিদ্যা বলছি কারণ সে

সংবৃতি সত্য আর পরমার্থ সত্যের সম্পর্ক বুঝতে পারেনি। সংবৃতির আপাত এবং খণ্ডিত সত্যকেই আধুনিক বিজ্ঞান বাড়ে বাড়ে পরমার্থ সত্য বলে ভুল করেছে। সেই ভুলের মাশুল আমরা গুনছি।

২৪

পরমার্থ সত্য আমার সাথে জগৎসংসারের কোনো ফারাক করছে না (কারণ তারা স্ব-ভাবশুন্য)। আর

সংবৃতি সত্য বলছে যে আমি ও জগৎসংসার একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল।

তাই বৌদ্ধ চিন্তন ঐতিহ্য মেনে সংবৃতি স্তরে (empirical levelএ) আমি বা আমরা এমন কিছু করতে যাবোনা যা এই পারস্পরিক নির্ভরশীলতার জায়গাটিকে নষ্ট করে।

আর তার সাথে আমি (অবশ্যই, কঠিন অনুশীলনের মাধ্যমে) এমন কোনোপ্রকার আত্মপরিচয়ের তথা অবিদ্যার ফাঁদে পড়বো না, (যে আত্মপরিচয়ের সর্বস্ব উপাদান নাম, যস, খ্যাতি, অর্থ, ক্ষমতা, ইত্যাদি), যা আমাকে ওই পারস্পরিক নির্ভরশীলতার জায়গাটির ওপর হস্তক্ষেপ করতে প্ররোচিত করতে পারে।

আর এই অনুশীলনের জন্যই  কুশকর্ণী নদী সমাজের পাশাপাশি কুশকর্ণী আশ্রমের প্রাসঙ্গিকতা। অর্থাৎ, একইসাথে বাইরের এবং ভেতরের প্রতিরোধ গড়ে তোলা।

আরও পড়ুন – দ্বারকেশ্বর নদের উৎস সন্ধানে