ভক্ত সালবেগ

পুরীর জগন্নাথ দেবের রথের চাকা থমকে গেল। আরও জোর, আরও মানুষ, এমনকি হাতি এসে টেনেও রথের চাকা গড়ালো না। কিন্তু কেন এমন ঘটনা ? ঘটনার কারণ হল  জগন্নাথ দেবের একান্ত ভক্ত সালবেগ ঝড়-বৃষ্টিতে আটকে পড়েছেন। রথ চলে গেলে দেব দর্শন করা হবে না যে ভক্তের। তাঁর যে বছরে মাত্র একবার সুযোগ মেলে দেব দর্শনের। তাই তাঁর আকুতিতে রথের চাকা আটকে রেখেছেন স্বয়ং ভগবান। ভক্ত পৌঁছে  প্রণাম জানালেন, রথের চাকা এগিয়ে চলল আবার। এমনি বিশ্বাস ওড়িশাবাসীর। রথ এমন ভাবে কতক্ষণ আটকে রইল তাই নিয়ে নানা মিথ আছে। কেউ বলেন সাত দিন কেউ বলেন তিনমাস আবার তিনি আর ফেরেনি এমন কথাও শোনা যায়। এসব ষোড়শ শতকে কথা। মিথের সত্য মিথ্যা খোঁজা আমার মতন নাস্তিকের কর্ম নয়, আগ্রহও নেই। তবে কেন এই ঘটনার বিবরণ লিখতে বসা। বর্তমান সময় আমরা সম্প্রতির নানা উদাহরণ খুঁজি, ভারতে বৈচিত্র্যের মধ্যে যে মিলিত হওয়ার রসদ আছে তা এই সময় আলোচিত হওয়া বিশেষ প্রয়োজন। তেমনি এক উজ্জ্বল উদাহরণ ভক্ত সালবেগ। ওড়িশার মুঘল আমলের সুবেদার লালবেগ আকা “জাহাঙ্গীর কুলি খান” এঁর সন্তান সালবেগ। বাবার সঙ্গে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন মুঘল সম্রাট  জাহাঙ্গীরের পক্ষে। কোন এক সময় অসুস্থতার কারণে শয্যাশায়ী হলেন। ভক্ত সালবেগের মা ছিলেন হিন্দু পরিবারের কন্যা। তার কাছে ছোট বেলা থেকেই হিন্দু দেব দেবীর, পুরাণের কাহিনী শুনে বড় হয়েছেন। মায়ের পরামর্শে অসুস্থতার থেকে মুক্তি পেতে জগন্নাথ দেবের আরাধনা করতে শুরু করলেন। সুস্থ হয়েও উঠলেন। সুস্থ হয়ে ওঠার পর আরো আগ্রহ, আকর্ষণ বাড়ল জগন্নাথ দেবের প্রতি। দেবতার দর্শনের অভিলাষে পুরীর মন্দিরে পৌঁছালেন। কিন্তু মন্দিরের পুঁজারীরা মন্দিরে প্রবেশ করতে দিলেন না। পুরীর মন্দিরে অহিন্দুদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। ভক্ত তার দেবতাকে দর্শন না করে কোথাও যাবেন না। অগ্যতা পুরীতেই পর্ণ কুটির করে বসবাস করতে শুরু করলেন। ভজন কীর্তন ও তীর্থ ভ্রমণ করে দিন চললো। শুধু রথ যাত্রার দিন অবশ্যই পুরীতে থাকা চাই। কারণ সেই সময় প্রভু জগন্নাথ দেব রথে করে মাসির বাড়ি যাবেন। সর্ব সাধারণের ভগবান দর্শনের এটাই সেরা সুযোগ। এই ভাবেই বাকি জীবন কাটিয়ে চললেন মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের সুবেদারের সন্তান ও একসময়ের যোদ্ধা। আর লিখে চললেন একের পর এক কীর্তন। যা এখনও ধর্ম প্রাণ ওড়িশাবাসীর মনের গভীরে স্থান দখল করে আছে। তাঁর মৃত্যুর পর মাজার “ভক্ত সালবেগের সমাধি” পরিচয়ে পরিচিত হয়েছে। পুরীর রাজা স্বয়ং সেই সমাধি গড়ে দিলেন। পুরীর গ্র্যান্ড রোডে সেই সমাধি দেখে নেওয়া যায়। প্রতি রথ যাত্রায় সেই সমাধির কাছে এখনও কিছু সময় থেমে তারপর এগিয়ে যান মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করা ভক্ত সালবেগের প্রভু জগন্নাথ দেব।