“দাদু বলতেন ঘোলা জল আসা মানে, নতুন মাছ আসার সম্ভাবনা। ২০০০ সালের পর আবার এই ঘোলা জল দেখলাম।” মাথাভাঙ্গা নদীর পারে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে, ফেলে আসা সোনালী দিনকে মনে করতে করতে, আনন্দের সুরে এরকম নানান কথা বলে চললেন মৎস্যজীবী দিলীপ হালদার।
মাথাভাঙ্গা ও চূর্ণী নদী পারের ৭২ কিমি অঞ্চল জুড়ে প্রায় ২০০০০ মৎস্যজীবী এখন জীবিকাহীন। (অতীতে বহু লেখায় এই সমস্যার কথা বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে, নতুন পাঠকের জন্য সমস্যার কারণটি সংক্ষেপে বলা হচ্ছে।) বাংলাদেশের কেরু কোম্পানীর দূষিত জল নদীতে ছাড়া হয়। দীর্ঘ এই দূষণের ফলে নিশ্চিহ্ন হয়েছে বহু মাছ, বিপন্ন হয়েছে অসংখ্য জীবন ও জীবিকা, বিঘ্ন ঘটেছে জীববৈচিত্র্যর ছন্দে। এই সমস্ত কিছুকে ভিত্তি করে বিগত বছর কেরু কোম্পানী আয় করেছে ৭০০ কোটি টাকা।
২০০০ সালের বন্যায় অজয়ের লাল ঘোলা জল পলাশী থেকে এখানে ঢুকেছিল। সেই শেষ নদীতে দীর্ঘস্থায়ী ঘোলা জল দেখেছিল গ্রামবাসীরা। এই তথ্য উঠে আসে সরাসরি গ্রামবাসীদের কাছ থেকে। পদ্মার ঘোলা জল অতি বর্ষার ফলে ক্ষণস্থায়ীভাবে কিছু সময়ে প্রবাহিত হয় এই নদীতে। তবে এবারের জল যেনো ভিন্ন, এতো ঘোলা জল, পদ্মার এরকম ঘোলা জল গ্রামবাসীরা দেখেছিল ২০০০ সালেরও আগে। মৎস্যজীবীদের কথায়, এইরকম ঘোলা জলে মাছ বেশী ভালো থাকে। এই সেই নদী যে নদী দুমাস আগেও ছিল স্নানের অযোগ্য, আজ যেনো তাকে চেনা যায় না।
দীর্ঘ এক মাস মৎস্যজীবীরা ও নদী কর্মীরা মাথাভাঙা ও চূর্ণী নদী পারের প্রায় ৫০টি গ্রামে একত্রিত আন্দোলন ও সচেতনমূলক প্রচার কর্মসূচি চালিয়ে ১৮ সেপ্টেম্বর জড়ো হয়েছিল “শিবনিবাস থেকে দর্শনা চলো, কেরুর দূষণ বন্ধ করো” এই অভিযানে। বাংলাদেশের দর্শনা অঞ্চলে কেরু কোম্পানির কারখানাটি অবস্থিত। নদীয়া জেলার মাজদিয়ার ঐতিহাসিক স্থান শিবনিবাস, এককালে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র তার রাজধানী এখানে স্থানান্তর করেন। শিবনিবাস থেকে গেদে বাংলাদেশ বর্ডার ১৯ কিমি পথ, বেশ কিছু মৎস্যজীবী ও নদী কর্মী ওইদিন হেঁটে পারি দেয় এই পথ। জমায়েত করা হয় গেদে রেলস্টেশনে, বিক্ষোভ দেখানো হয় মৈত্রী এক্সপ্রেসের সমুক্ষে।
মাস পেরিয়েছে এই আন্দোলনের, অধিকারের ও জীববৈচিত্র্যের তাগিদে জেগে উঠেছিলেন শয়ে শয়ে মৎস্যজীবী। কিছুটা ঘুম ভাঙে প্রশাসনের।
আজ নদী পারে দাঁড়িয়ে মৎস্যজীবীরা বললেন, কত বছর বাদে এমন ঘোলা জল, কতকাল পরে নদীতে ফিরছে বহু মাছের সম্ভাবনা, ইতিমধ্যে পাঙ্গাস, রুই, কাতলা, সিলিন্দী নদীতে কিছু কিছু পাওয়া যাচ্ছে। হাসি ফুটছে গণেশ হালদারদের মুখে, ওর স্ত্রী শখ করে বলেছিলেন “তুমি হালদার তোমার বাড়িতে একটি নৌকা রাখবে না ? তবে তুমি কীসের হালদার গো!”। নদীতে মাছ না থাকায় কিছুকাল আগে এই মৎস্যজীবী বেঁচে দিয়েছিলেন তার সাধের নৌকোটি, স্ত্রীয়ের আবদারের পর ধার দেনা করে কুড়ি হাজার টাকার একটি নৌকো ধীরে ধীরে বানাছিলেন তিনি। কিছুদিন আগেও এই নৌকো শুধু ঘাটে বেঁধে রাখা ছাড়া তার আর কোনো কাজের সম্ভাবনা ছিল না। এই ঘোলা জলে সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে আবার, হালদারের নৌকো আবার নদীতে জাল ফেলে ভেসে বেড়াবে। পৌঢ় মনোজ হালদারের পাটা শ্যাওলর কাদা ঘেঁটে গলদা চিংড়ি সংগ্ৰহ হয়তো আর গল্প কথা থাকবে না এই প্রজন্মের কাছে। ধারাবাহিক একত্রিত আন্দোলনই সোনালী নদীর নির্মল পথ এখনও মনে করছেন মৎস্যজীবীরা।
নদীতে এই ঘোলা জল ও মাছেদের আগমন নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক দিক। এই সময়ে যদি উৎসমুখটির পরিচর্যা করা যায় তবে আরও ভালো হবে নদীর জল। একইসঙ্গে নদীর আশেপাশে যেই খাল-বিল জলাশয়গুলি আছে সেখানে যদি নদীর জল যাওয়ার পথ প্রশস্ত করে দেওয়া যায় তাহলে এই জলাশয়গুলিও পুষ্ট হবে।
নদী বিশেষজ্ঞ সুপ্রতিম কর্মকার
নদী তার নিজের পথ নিজেই সৃষ্টি করে নেয় আমরা যদি বাঁধা সৃষ্টি না করি। পদ্মার জল নদীতে আসছে, সে জল কলকাতাতেও আসবে এটা গোটা দক্ষিণবঙ্গের জন্য একটি ভালো খবর।
নদীকর্মী তাপস দাস