“চারটি ন্যায় রয়েছে – ১/ ব্যক্তির ন্যায়, ২/ রাষ্ট্রের ন্যায়, ৩/ সামাজিক ন্যায়, এবং ৪/ প্রাকৃতিক ন্যায়। বর্তমানে আমাদের প্রত্যেকের প্রধান কর্তব্য হলো প্রাকৃতিক ন্যায়ের জন্য সচেষ্ট হওয়া”
– স্বামী শিবানন্দ সরস্বতীজী।
১৯৯৭ – ১৯৯৮ সালে হরিদ্বারের কংখলের জগজীতপুর গ্রামে গঙ্গা নদীর পাড়ে মাতৃসদন আশ্রম প্রতিষ্ঠার পর, কুম্ভক্ষেত্রে পাথর ভাঙার খাদান ও অবৈধ খনন বন্ধ করা এবং গঙ্গা নদী দিয়ে যান চলাচল বন্ধ করার দাবীতে আশ্রম প্রধান গুরুজী শিবানন্দ সরস্বতীর অনুমতি নিয়ে ১৯৯৮ সালের মার্চ মাস থেকে স্বামী গোকুলানন্দ সরস্বতী এবং গঙ্গাপুত্র স্বামী নিগামানন্দ সরস্বতীর প্রথম অনশন শুরু হয়। এরপর এই মাতৃসদন আশ্রম থেকে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত গঙ্গার অবিরলতা ও নির্মলতা নিয়ে, কুম্ভক্ষেত্রে পাথর খাদান ও অবৈধ খনন বন্ধ করা নিয়ে, উত্স মুখ থেকে ১২৫ কিলোমিটার পর্যন্ত সমস্ত রকম বাঁধ, জলবিদ্যুত্ প্রকল্প বন্ধ করার দাবীতে, গঙ্গা ভক্ত পরিষদ তৈরী করার জন্য এবং গঙ্গা নদীকে রক্ষা করা নিয়ে আইন প্রণয়নের দাবীতে ৬৭ বার অনশন করা হয়েছে।
ভাবা যায়, গঙ্গা নদীকে, পর্বতকে, কুম্ভক্ষেত্রকে তাদের প্রাকৃতিক রূপে বজায় রাখার জন্য একটি আশ্রমের সন্ন্যাসীরা ধারাবাহিক ভাবে ২৪ বছর ধরে অনশন, সত্যাগ্রহ চালিয়ে যাচ্ছেন।
এই সুদীর্ঘ সময়ে গুরুজী শিবানন্দ সরস্বতী, গঙ্গা নদীর দূষনমুক্ত নিরবিচ্ছিন্ন প্রবাহ বজায় রাখার জন্য বারবার কেন্দ্রীয় সরকার, রাজ্য সরকার, জেলা শাসক, প্রত্যেকের অন্যায় কার্যকলাপের বিরুদ্ধে তাঁর প্রতিবাদ সর্বসমক্ষে জানিয়ে চলেছেন এবং তাঁদের কথা শোনানোর জন্য বহুবার অনশন করেছেন।
যখন সারা ভারত জুড়ে নানা মতের সাধুরা অন্যান্য কাজে যুক্ত হয়ে রয়েছেন তখন গঙ্গাবক্ষে অবৈধ খনন বন্ধ করার জন্য আওয়াজ তোলায় ১৯৯৯ সালে খনি মাফিয়াদের হাতে খুন হন স্বামী গোকুলানন্দ।
পরবর্তীতে স্বামী নিগামানন্দ সরস্বতীজী জানুয়ারী ও জুন মাসে গঙ্গাবক্ষে অবৈধ খনন বন্ধ করার জন্য ৭০ দিন ধরে অনশন করেন। ২০১১ সালের ১৯এ ফেব্রুয়ারী থেকে স্বামী নিগামানন্দজী আবারো অবৈধ খননের বিরুদ্ধে অনশন শুরু করেন এবং ৬৮তম দিনে শারীরিক অবস্থার জন্য তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হলে সেখানে ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে বিষ প্রয়োগ করা হয়, ফলশ্রুতিতে ২০১১ সালের ১৩ই জুন, ১১৫তম দিনে স্বামী নিগামানন্দ সরস্বতী রহস্যজনক ভাবে মারা যান। মামলা হয়, ভারতের ইতিহাসে প্রথম আদালতের নির্দেশে একজন সন্ন্যাসীর দেহ সমাধি থেকে তুলে দ্বিতীয়বার ময়না তদন্ত হয় এইকথা জানতে যে সত্যিই বিষ প্রয়োগ করা হয়েছিল কিনা তা জানতে; সিবিআই তদন্ত হলেও তার রিপোর্ট এখনো জানা যায়নি। সাধারণ মানুষের কাছে এটি খুন ছাড়া আর কিছুই নয়।
২০০৫ সাল থেকে গঙ্গার অবিরলতার জন্য বাবা নাগনাথ যোগেশ্বর অনশন করতে থাকেন; তিনি বলেন গঙ্গা নদীকে দূষণ মুক্ত করার জন্য কাউকেই অন্য কিছু করতে হবে না, শুধু গঙ্গার বয়ে চলার পথে কোনও রকম বাঁধা না দিলেই হবে। মণিকর্ণিকা ঘাটের কাশী মহাশ্মশান পীঠে বাবা নাগনাথ বাস করতেন। তিনি বারংবার নদীর উপর বাঁধ নির্মাণ করে অত্যাধিক খরচ সাপেক্ষ জল-বিদ্যুত্ তৈরী করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছেন এবং তেহরী বাঁধ পরিত্যক্ত ঘোষণা করার দাবী জানিয়েছেন। ২০০৮ সালের ১৯এ জুলাই থেকে বাবা নাগনাথ এই দাবী গুলিকে সামনে রেখে বারবার অনশন করতে থাকেন এবং ২০১৪ সালের ১০ই জুলাই তারিখে অনশনরত অবস্থায় শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন। স্বামী নিগামানন্দ সরস্বতীর অনশনকে বাবা নাগনাথ সম্পূর্ণ ভাবে সমর্থন করেছিলেন।
আসুন পরিচিত হই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা এবং জীবনের শিক্ষার চুড়ান্ত নিদর্শন – অধ্যাপক গুরুদাস আগরওয়ালের সঙ্গে। অল্প করে বললেও জেনে রাখা যেতে পারে অধ্যাপক আগরওয়াল ছিলেন আইআইটি রুরকির সিভিল ইঞ্জিনীয়ার এবং বার্কলের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জীনিয়ারিংয়ের ডক্টরেট। আইআইটি কানপুরের শিক্ষক ও বিভাগীয় প্রধান এবং সেন্ট্রাল পল্যুশন কন্ট্রোল বোর্ডের প্রথম সদস্য-সচিব, গঙ্গা নদী নিয়ে তৈরী হওয়া অনেক সরকারী কমিটির সদস্য ও প্রধান। পরবর্তীতে ২০১১ সালে তিনি ‘সন্ন্যাস’ গ্রহণ করেন এবং স্বামী জ্ঞানস্বরূপ সানন্দ নামে পরিচিত হয়ে গঙ্গা নদীর উপর নির্ভরশীল প্রায় ৫০% ভারতবাসীর জন্য জীবনদায়িনী, প্রাকৃতিক ও পবিত্র মা গঙ্গা নদীর জন্য, ‘অবিরল ও নির্মল’ গঙ্গার জন্য, গঙ্গার গঙ্গত্বের জন্য, গঙ্গা ভক্ত পরিষদ তৈরী করার জন্য এবং গঙ্গা নদীকে রক্ষা করা নিয়ে আইন প্রণয়নের জন্য সারা জীবন ধরে চেষ্টা করে গেছেন। ২০০৮ সালের জুন মাস থেকে তিনি বারবার গঙ্গার অবিরলতা নিয়ে অনশন করেছেন; এবং ২০১০ সালের ২০এ জুলাই থেকে ২৪এ আগস্ট পর্যন্ত তাঁর অনশনের জন্যই তত্কালীন কেন্দ্রীয় সরকার প্রথমে ভাগীরথী নদীর উপর তৈরী হতে চলা ভৈরো ঘাঁটি, পালা-মানেরী ও লোহারি নাগ-পালা জলবিদ্যুত প্রকল্প বন্ধ করে দেন।
২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে স্বামী সানন্দজী, প্রধানমন্ত্রী মাননীয় শ্রী নরেন্দ্র মোদী মহাশয়কে খোলা চিঠি লেখেন অলকানন্দা নদীর উপর হতে থাকা বিষ্ণুগাড-পিপলকোটি এবং মন্দাকিনী নদীর উপর হতে থাকা ফাটা-বুয়াং এবং সিংগলি-ভাটোয়ারি নিয়ে সমস্ত রকম নির্মাণ কাজ বন্ধ রাখার জন্য, গঙ্গা ভক্ত পরিষদ তৈরী করার জন্য এবং গঙ্গা নদীকে রক্ষা করা নিয়ে আইন প্রণয়নের জন্য। এরপরেও তিনি চিঠি দিয়ে গেছেন কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে কোনো উত্তর না পাওয়ায় শেষে মাতৃসদন আশ্রমে ২০১৮ সালের ২২এ জুন থেকে তিনি আমরণ অনশন শুরু করেন। ২০১৮ সালের ৯ই অক্টোবর থেকে তিনি জলগ্রহন করা বন্ধ করে দেন;
উত্তরাখণ্ড সরকার ও প্রশাসন ১০ই অক্টোবর আশ্রমে পুলিশ পাঠিয়ে স্বামী সানন্দজীকে বলপূর্বক গ্রেপ্তার করে ঋষিকেশের এইমস-এ ভর্তি করা হয় এবং ১১ই অক্টোবর সকালে হাসপাতালের বিছানা থেকেই নিজের হাতে আবারো প্রধানমন্ত্রী মাননীয় শ্রী নরেন্দ্র মোদী মহাশয়কে খোলা চিঠি লেখেন কিন্তু প্রতিবারের মতন এবারো কোনো উত্তর আসেনা; অবশেষে ২০১৮ সালের ১১ই অক্টোবর দুপুর বেলা অনশনের ১১২তম দিনে অস্বাভাবিক ভাবে গঙ্গা নদীর জন্য, মানুষের জন্য নিবেদিত এই মহান প্রাণ মারা যান। যা স্বামী নিগামানন্দ সরস্বতীজীর মতোই আরেকটি রহস্য মৃত্যু বলেই মানুষ মনে করে।
আসুন পরিচিত হই আরেকজন সন্ন্যাসীর সঙ্গে – সন্ত গোপাল দাসজী। হরিয়ানার এক সাধারণ মানুষ যিনি সন্ত হয়ে যান এবং গঙ্গা নদীর স্ংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। বেশ কয়েকবার মা গঙ্গাকে রক্ষা করার জন্য বিভিন্ন জায়গায় অনশন করেছেন ও আওয়াজ তুলেছেন, কিন্তু কোনো কাজ হয়নি।
পরবর্তীতে ২০১৮ সালের ২৪এ জুন তারিখ থেকে পবিত্র মা গঙ্গা নদীর স্ংরক্ষণের জন্য অনশন শুরু করেন এবং স্বামী জ্ঞানস্বরূপ সানন্দজীর হাসপাতালে রহস্য মৃত্যুর পর তিনি হরিদ্বারের মাতৃ সদন আশ্রমে এসে স্বামী শিবানন্দজীর অনুমতি নিয়ে সেখান থেকে তাঁর অনশন চালাতে থাকেন। তিনি গঙ্গাকে রক্ষা করার জন্য নিজের রক্ত দিয়ে চিঠি লিখে প্রধানমন্ত্রী মাননীয় শ্রী নরেন্দ্র মোদী মহাশয়কে দেন কিন্তু কোনো উত্তর আসেনি পরে ১৮ই অক্টোবর তাঁকে হরিদ্বারের জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। মাঝে তাঁকে দিল্লীর এইমসে ভর্তি করানো হয় বলে খবর আসে সেখান থেকেও কোনো খোঁজ পাওয়া না যাওয়ায় দিল্লী হাইকোর্টে হেবিয়াস কর্পাসের মামলা করা হয়। পরে হরিদ্বারের প্রশাসন জানায় তাঁকে সরকারী তত্ত্বাবধানে দেরহাদুনের হাসপাতালে ডিসেম্বর মাসের ৪ তারিখে ভর্তি করানো হয়েছে চিকিত্সার জন্য। ২০১৮ সালের ৬ই ডিসেম্বর তারিখ থেকে সন্ত গোপাল দাসজীর আর কোনো খবর পাওয়া যায়নি। কি করে প্রশাসনিক হেফাজত থেকে ১৬৬ দিন ধরে অনশন চালানো একজন সন্ন্যাসী অদৃশ্য হয়ে গেলেন সেই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়নি। সন্ত গোপাল দাসজীর ৬০ বছর বয়সী মা শকুন্তলা দেবী ছেলের খোঁজ পেতে ডিসেম্বরের ১৪ তারিখ থেকে অনশনে বসেছেন, এই হলো আমাদের দেশের অবস্থা।
আরেকজন দুর্দান্ত মানুষ হলেন ব্রহ্মচারী দয়ানন্দ। মাতৃসদন আশ্রম প্রতিষ্ঠার কিছুদিন পর থেকেই দয়ানন্দজী আশ্রমের দেখাশোনা রক্ষণাবেক্ষণসহ সরকারী বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি দেওয়া, জেলাশাসকসহ নানা আধিকারিকদের অন্যায়, বেআইনী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে আওয়াজ তোলা, আদালতে কেস দাখিল করা, গঙ্গা নদী নিয়ে আন্দোলনকারী ব্যক্তি, সংগঠন, সহমর্মী বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা, ইত্যাদি যাবতীয় খুবই দরকারী কাজগুলি নীরবে করে চলেছেন।
দয়ানন্দজী জানাচ্ছেন, “মা গঙ্গাকে রক্ষা করার জন্য গঙ্গাবক্ষে খনন পুরোপুরি বন্ধ করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই এবং অবিরল ও নির্মল গঙ্গার জন্য মাতৃসদন আশ্রমের সন্ন্যাসীদের শান্তিপূর্ণ অনশনই হলো তাঁদের কথা শোনানোর একমাত্র শক্তিশালী মাধ্যম”। উনি আরো বলছেন “ভাবুন গঙ্গার জলের গুণগত মান কোথায় পৌঁছেছে যে, মানুষজন যখন গঙ্গা নদীকে দেখতে আসছেন তখন নদীর পাড়ে বসে তারা বোতলের জল পান করছে”।
“আমার জন্য নয় গঙ্গার জন্য চিন্তা করুন” – অবিরল ও নির্মল গঙ্গার জন্য চলতে থাকা অনশনের ১৫০ তম দিন পার হয়ে যাওয়ার পর ব্রহ্মচারী আত্মবোধানন্দজীকে তাঁর শরীরের অবস্থা কেমন আছে প্রশ্ন করা হলে এই উত্তর ভেসে এলো।
বন্ধুরা, আসুন পরিচিত হই আমার ভাই ব্রহ্মচারী আত্মবোধানন্দের সঙ্গে। মাতৃসদন আশ্রম প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত যাঁরাই গঙ্গা নদীর জন্য অনশন করেছেন তাঁদের সঙ্গে আমাদের অনেকেরই প্রত্যক্ষ যোগ ছিল না। মূলত: স্বামী জ্ঞানস্বরূপ সানন্দজীকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী (যদি অনশনে তাঁর মৃত্যু হয় তাহলে মাতৃসদন আশ্রম তাঁর তোলা দাবীগুলির সমর্থনে অনশন জারী রাখবেন যাতে রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকার তা মেনে নেন) আশ্রম প্রধান স্বামী শিবানন্দজী অনশনে বাসার উদ্যোগ নেন সেই সময় ব্রহ্মচারী আত্মবোধানন্দ গুরুজীর কাছে আবেদন রাখেন যে তাঁকে অনশনে বসার অনুমতি দেওয়া হোক, কারণ মানুষের জানা দরকার যে দক্ষিণ ভারতেও গঙ্গা প্রবাহিত হয়। আসলে, ভারতের সব নদীই আধ্যাত্মিক ভাবনায় গঙ্গা নদী। গুরুজীর আদেশ পেয়ে ২০১৮ সালের ২৪এ অক্টোবর তারিখ থেকে কেরালার অধিবাসী ২৬ বছর বয়সী ব্রহ্মচারী আত্মবোধানন্দ তাঁর অনশন শুরু করেন। কিছুদিনের মধ্যেই খবর পাই স্বামী সানন্দজীর দাবীগুলির এবং আত্মবোধানন্দের অনশন চলাকালীন এর সমর্থনে আইআইটির অধ্যাপক শ্রী সন্দীপ পাণ্ডেজী একটি পদযাত্রার পরিকল্পনা করেছেন। সেই ডাকে সারা দিয়ে দিল্লির যন্তরমন্তর থেকে ৮ দিনে ২৪০ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে পৌঁছাই হরিদ্বারের মাতৃসদন আশ্রমে, দেখা হয় ব্রহ্মচারী আত্মবোধানন্দের সঙ্গে। প্রথম দেখাতেই ওকে আমার নিজের ভাই বলে মনে হয় তাই যতবার ওঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে কথা হয়েছে ততবারই ওকে ভাই বলেই ডাক দিয়েছি আর আত্মবোধানন্দও একগাল হেসে সাড়া দিয়ে জিজ্ঞাসা করেছে দাদা আপ ক্যায়সে হো। অনশনের ১৫০ তম দিন পার হয়ে যাওয়ার পর যখন ওঁর দেহ শীর্ণকায় হয়ে পড়েছে তখনও ভাইয়ের মুখের হাসি ছিল উজ্জ্বল আর চোখের দৃষ্টি ছিল দৃঢ়তায় ভরা আর মুখে বলছে “আমার জন্য নয় গঙ্গার জন্য চিন্তা করুন”।
পরবর্তীতে ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের আগে পরিস্থিতিগত বাধ্যবাধকতায় কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে ন্যাশনাল মিশন ফর ক্লিন গঙ্গার ডাইরেক্টর জেনারেল রাজীব রঞ্জন মিশ্র নিজে মাতৃসদন আশ্রমে এসে স্বামী সানন্দজীর দাবীগুলি মেনে নেওয়া হবে বলে প্রথমে মৌখিক এবং পরে দাবীমত লিখিত প্রতিশ্রুতি দিলে এবং অনশন প্রত্যাহার করার অনুরোধ জানালে গুরুজীর নির্দেশে ২০১৯ সালের ৫ই মে ১৯৪ দিনে আমার ভাই ব্রহ্মচারী আত্মবোধানন্দ তাঁর অনশন সাময়িক ভাবে স্থগিত করে। যদিও প্রতিবারের মতো এবারো কেন্দ্রীয় সরকার নিজেদের দেওয়া লিখিত প্রতিশ্রুতি পালন করে না। তারপর গঙ্গা নদী দিয়ে ক্ষীণ ধারায় কিছু জল বয়ে গেছে কিন্তু কাজের কাজ কিছুই পাওয়া যায়নি সরকারের থেকে।
“যদি ভয়ই পেতাম তাহলে কি আর তপস্যায়, অনশনে বসতাম? মা গঙ্গার জন্য জীবন দেওয়াটা বড় কথা নয় যা দরকারী তা হলো এবার আর কোনো মিথ্যা প্রতিশ্রুতিতে কাজ হবে না, গঙ্গাজীর অবিরলতা ও নির্মলতা নিয়ে স্পষ্ট কাজ শুরু না হলে অনশন চলবে তাতে প্রাণ গেলে যাবে”।
– ব্রহ্মচারিনী পদ্মাবতী
এমতাবস্থায় সরকার তার লিখিত প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করায় হরিদ্বারের মাতৃসদন আশ্রম থেকে মাত্র ২৩ বছর বয়সী ব্রহ্মচারিনী পদ্মাবতী তাঁর পূর্বের গুরুভাইদের আত্মবলিদানে মর্মাহত হয়ে এবং গঙ্গাজীর দুর্দশা দেখে তাঁকে রক্ষা করতে তপস্যা করার মনস্থির করে ২০১৯ সালের ২২এ নভেম্বর তারিখে প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি চিঠি দিয়ে জানিয়েছিলেন যে, আগামী ১০ দিনের মধ্যে সরকারী ভাবে দেওয়া লিখিত প্রতিশ্রুতিগুলি কার্যকর না করা হলে আবার অনশন শুরু করা হবে।
আসুন পরিচিত হই দেশের নতুন তরুণ আইকন মাতৃসদন আশ্রমের আশ্রমিক আমার বোন ব্রহ্মচারিনী পদ্মাবতীর সঙ্গে। বিহারের মেয়ে ২৩ বছরের পদ্মাবতী দর্শন নিয়ে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেছে। ছোট থেকেই ওর মনে প্রকৃতি পরিবেশের জন্য ভালোবাসা ছিল পাশাপাশি ছিল আধ্যাত্বিক চিন্তা। এই দুই ভাবনা এক হয়েই বোন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল মাতৃ সদন আশ্রমে থাকার, গত ২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে দীক্ষা নেয় গুরুজী শিবানন্দ সরস্বতীর কাছে। তারপর ইতিহাস,- যখন আমরা নানা বিষয়ে সারা ভারত জুড়ে অল্প বয়সী ছাত্র-ছাত্রীদের, সরকার ও প্রশাসনের সামনে দাঁড়িয়ে আওয়াজ তুলতে দেখছি, সেই সময় মিথ্যা প্রতিশ্রুতিতে আমার ভাই ব্রহ্মচারী আত্মবোধানন্দের ১৯৪ দিনের অনশন সাময়িক স্থগিত রাখার পর সরকার কর্তৃক দাবী না মানা হওয়ায় যখন আলোচনা হচ্ছে পরবর্তী সত্যাগ্রহ অনশনের তখনই পদ্মাবতী সামনে এসে নির্ভীক গলায় বলছে গুরুজী এবার আমাকে অনশনে বাসার অনুমতি দিন। এবং অনুমতি পাওয়ার পর ২০১৯ সালের ১৫ই ডিসেম্বর থেকে ২০২০ সালের ২৮এ মার্চ পর্যন্ত ১০৫ দিন ধরে অনশন করে ব্রহ্মচারিনী পদ্মাবতী। এরমধ্যে প্রশাসন তার সমস্ত ঘৃন্যরূপ ও পেশী শক্তির প্রদর্শন করে আশ্রম থেকে পদ্মাবতীকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় এবং মানসিক স্থিরতা ও দৈহিক ক্ষতি করার জন্য তাঁকে বিষ প্রয়োগ করে। বর্তমানে আমার বোন ব্রহ্মচারিনী পদ্মাবতী স্বাভাবিক চলাফেরা করার শক্তি হারিয়ে মানসিক অসুস্থ অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে।
একটি অদ্ভুত ঘটনার দিকে আপনাদের নজর দিতে বলবো, – উত্তরাখণ্ডের মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন যে, “উত্তরাখণ্ডে গঙ্গা পবিত্রই আছে, গঙ্গার জল পানযোগ্য এবং গঙ্গা অবিরল ভাবেই বয়ে চলেছে; তাই উত্তরাখণ্ডে কাউকেই গঙ্গার জন্য বসার দরকার নেই, এটা উচিত নয়; উত্তরাখণ্ডের মাটি হরতাল করার জন্য নয়, এটা সাধু-সন্তদের জন্য, পূজার জন্য, আরাধনার জন্য, ওনাদের এখানে আরাধনা করা উচিত”।
এই কথার উত্তর ব্রহ্মচারিনী পদ্মাবতী এবং স্বামী শিবানন্দ সরস্বতীজী একদম চাঁছাছোলা ভাষায় দিয়েছেন, মূল যে কথাটা গুরুজী বলেছেন তা হলো গঙ্গার জল যদি পরিশ্রুতই হয় তাহলে নিজেরা এবং অতিথিরাও কেন বোতলের জল পান করছেন। পাশাপাশি দেশের সব জায়গায় এই ঔদ্ধ্বত্যের প্রতিবাদ হওয়া প্রয়োজন। একটি প্রশ্নের উত্তরে আমার বোন পদ্মাবতী বলছে “যদি ভয়ই পেতাম তাহলে কি আর তপস্যায়, অনশনে বসতাম? মা গঙ্গার জন্য জীবন দেওয়াটা বড় কথা নয় যা দরকারী তা হলো এবার আর কোনো মিথ্যা প্রতিশ্রুতিতে কাজ হবে না, গঙ্গাজীর অবিরলতা ও নির্মলতা নিয়ে স্পষ্ট কাজ শুরু না হলে অনশন চলবে তাতে প্রাণ গেলে যাবে”।
প্রকৃতি-পরিবেশ, নদীর জন্য নিবেদিত প্রাণ এই আধ্যাত্মিক পরিবেশ কর্মীদের কথা আমাদের সকলের জানা দরকার। আমরা যারা নিজেদের পরিবেশ কর্মী, নদী কর্মী, বিজ্ঞান কর্মী বলি তাদের নতুন করে ভেবে দেখার সময় হয়েছে, – গঙ্গা নদী, পর্বত, কুম্ভক্ষেত্র অর্থাত্ সার্বিকভাবে পরিবেশের জন্য সততা, ত্যাগ, তপস্যা, আত্মবলিদানের এই ধারাকে কি করে ব্যাখ্যা করবো, কি করে নিজেদের অন্তরে এই ভাবনাকে চালিত করবো? আজকের এই সময়ে যখন সার্বিক ভাবে পরিবেশের প্রতি কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার, প্রশাসন, নীতি-নির্ধারণকারীদের অসংবেদনশীলতাই প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছে, পাশাপাশি সাধারণের সম্বলগুলিকেও নির্লজ্জ ভাবে কর্পোরেটদের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে।
বন্ধুরা, হরিদ্বারের মাতৃসদন আশ্রমের সন্ন্যাসী-সন্ন্যাসিনীরা সমস্ত রকম বাঁধার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে স্পষ্টভাবে দাবীগুলি সকলের সামনে রাখছেন, অনশন করছেন – অবিরল ও দূষণ মুক্ত গঙ্গা নদীর জন্য, পরিবেশ-প্রকৃতি ও গঙ্গার প্রাকৃতিক রূপ বজায় রাখার জন্য, মানুষের তৈরী সভ্যতার বিপদ কমানোর জন্য, আমাদের সকলের জন্য। “গঙ্গাকে অবিরল বইতে দাও” আসুন আমরা সবাই দেশের সব জায়গায় এই স্লোগান ছড়িয়ে দেই। বন্ধুরা, আসুন, যোগ দিন, আওয়াজ তুলুন গঙ্গা নদীকে তাঁর প্রাকৃতিক রূপে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য কারণ অবিরল ও নির্মল গঙ্গাই পারবে দেশের কমবেশী ৫০% নদীপারের মানুষদের বাঁচিয়ে রাখতে। আমাদের লক্ষ্য হওয়া দরকার মাতৃসদন আশ্রমের এই সংকল্প এবং অসাধারণ লড়াইয়ের কথা দেশের সর্বত্র সমস্ত মাধ্যমে সবরকম ভাবে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা।
আসুন আমরা সকলে মিলে মাতৃসদন আশ্রমের সন্ন্যাসী-সন্ন্যাসিনীদের প্রত্যেকের ত্যাগ, অনশন, মৃত্যুর ইতিহাস স্মরণে রাখি আর চেষ্টা করি যে যেমন ভাবে পারি অল্প কিছু করার।