শহীদ শংকর গুহ নিয়োগী

খুব বেশী কিছু জানি না , প্রথম নাম শুনি বিশ্ববিদ্যালয়ের আমার দুজন শিক্ষকের কাছ থেকে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে।  তবে আর একটু বিস্তারিত জানতে পেরেছিলাম পরিচিত কিছু সামাজিক আন্দোলনের কর্মী সাথীদের থেকে। ১৯৯১ সালে ২৮শে সেপ্টেম্বর গভীর রাতে ঘাতকের গুলিতে শহীদ হন শংকর গুহ নিয়োগী

কে এই শহীদ ?

আধময়লা পাজামা-পাঞ্জাবি পরিহিত এক দীর্ঘদেহী পুরুষের স্লোগানে শ্লোগান তুলছিল সমবেত জনতা – ‘জেলকা তালা টুটেগা, হামরা সাথী ছুটেগা’ – ছত্তিশগড় মুক্তি মোর্চার নেতা শংকর গুহনিয়োগী। … আমার জীবনে রাজনীতির প্রধান শিক্ষক নিয়োগীজীই।

এক মধ‍্যবিত্ত পরিবারে জন্ম শংকরের ( শংকর তাঁর আসল নাম নয়, আসল নাম ধীরেশ), আসামের নওগাঁও জেলার যমুনামুখ গ্রামে বাবার কর্মস্থলে তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা, … আসানসোলের সাঁকতোরিয়া কয়লাখনি অঞ্চলে জ‍্যাঠামশাইয়ের কাছে মাধ‍্যমিক,… জলপাইগুড়িতে আই এসসি পড়ার সময় ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত … ১৯৫৯ -এর খাদ‍্য আন্দোলনে.. কুশলী ছাত্রসংগঠক হিসেবে অবিভক্ত কমিউনিষ্ট পার্টির সদস‍্যপদ। আই এসসি-র ফল ভালো হয়নি। তাও পারিবারিক সুপারিশে উত্তরবঙ্গের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে সিট পান। এই অন‍্যায়কে মেনে নিতে না পেরে তাঁর ঘর ছাড়া।

১৯৬১ ভিলাই ইস্পাত কারখানায় ১৮ বছর বয়সে কোক ওভেন বিভাগে দক্ষ শ্রমিকের চাকরি। উচ্চশিক্ষার আকাঙ্ক্ষাও ছিল । দুর্গের বিজ্ঞান কলেজে প্রাইভেট ছাত্র হিসেবে বি এসসি এবং এ এম আই ই পড়তে লাগলেন। কলেজে ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে ধীরেশ। তাঁর নেতৃত্বে সফল ধর্মঘট করে সাফাইকর্মীদের দাবিদাওয়া আদায়। এ আই টি ইউ সি-র সঙ্গে থেকেও স্বাধীনভাবে শ্রমিকদের সমস‍্যা সমাধানে সংগঠিত করতে থাকেন। ১৯৬৪  সিপিআই ভাঙ্গলে ,সি পি আই এম -এ যোগ,  ১৯৬৯ সিপিআই এম-এল গঠিত হওয়ার কিছুদিন তিনি তার সঙ্গে ছিলেন। কিন্তু তৎকালীন পার্টির গণসংগঠন-গণআন্দোলন বর্জনের লাইনের সঙ্গে নিজের কাজকর্মকে মেলাতে না পারায় পার্টি থেকে বহিষ্কৃত।

ইতিমধ্যে ১৯৬৮ ভিলাই ইস্পাত কারখানার প্রথম সফল ধর্মঘটের নেতৃত্ব দিয়ে চাকরি খুইয়েছেন, ‘নকশালপন্থী’ তমকা লাগিয়ে খুঁজছে পুলিশ। আত্মগোপন করে হিন্দি সপ্তাহিক স্ফুলিঙ্গ ( প্রকাশ)। ছত্তিশগড় জাতি-সমস্যা নিয়ে রচিত তাঁর একটা পুস্তকা মহারাষ্ট্র থেকে ছেপে আসার পথে পুলিশ বাজেয়াপ্ত করে।

ছত্তিশগড়কে জানার জন‍্য , ছত্তিশগড়ী জনতাকে জানার জন‍্য ১৯৬৮ থেকে গ্রামে-গ্রামে আত্মগোপন। কখনো ছাগল বিক্রেতা, কখনো ফেরিওয়ালা, কখনো জেলে, কখনো পি ডাব্লু ডি-র শ্রমিক। এর সাথে সাথে মানুষকে সংগঠিত করার কাজ – দৈহান বাঁধ তৈরির আন্দোলন, সেচের জলের দাবিতে বালোদের কৃষকদের আন্দোলন, মোঙ্গরা বাঁধ তৈরির বিরুদ্ধে আদিবাসীদের আন্দোলন….. ১৯৭১ দানীটোলা কোয়াজার্ইট খনিতে ঠিকা শ্রমিকের কাজ, ‘শংকর’ এই সময়কার ছদ্মনাম। ১৯৭৫ – জরুরি অবস্থায় মিসা-এ গ্রেপ্তার। ১৯৭৭ জরুরি অবস্থা শেষে মুক্তি পেয়ে দল্লী-রাজহরার ঠিকা খনিশ্রমিকদের স্বাধীন সংগঠন – ছত্তিশগড় মাইন্স শ্রমিক সংঘ ( সি এম এস এ ) গঠন ; পতাকা লাল-সবুজ।

১৯৭৭, মে মাসে আইডল ওয়েজ এবং বর্ষার আগে ঘর-মেরামতের ১০০ টাকার দাবিতে আন্দোলন। ৩১ মে দাবী মেনে নেয় , কিন্তু ১ জুন ঠিকাদাররা চুক্তি অস্বীকার করে। শুরু হয় শ্রমিক ধর্মঘট। ২ রা জুন নিয়োগীকে গ্রেপ্তার করা এবং পুলিশেকে ঘিরে রেখে নেতার মুক্তির দাবী হলে , ঘেরাও ভাঙ্গতে দুদফায় পুলিশের গুলিতে নারী শ্রমিক  অনুসূইয়া বাই ও বালক সুদামা সহ মোট ১১ জন শহীদ হন। ১৮ দিন লম্বা ধর্মঘট চলার পর শ্রমিকদের দাবী মেনে নিয়োগী ছাড়া পান। 

ইউনিয়নের একের পর এক অর্থনৈতিক আন্দোলন বিজয় লাভ করে, শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি একলাফে অনেকটাই বেড়ে যায়, কিন্তু বাড়ে না জীবনের মান । শ্রমিকরা মদের পেছনে পয়সা খরচ করা বাড়িয়ে দেয়। নিয়োগীর, এক অভিনব #শরাববন্দি আন্দোলনে প্রায় এক লক্ষ মানুষ মদের নেশা থেকে মুক্ত হয়। এই আন্দোলন চালাতে গিয়ে ১৯৮১  বন্দি হতে হয় শংকর গুহনিয়োগীকে। ..

নিয়োগী বললেন ট্রেড ইউনিয়ন কেবল শ্রমিকের দিনের আট ঘন্টা-এর জন‍্য নয়, এই নিয়ে দল্লী-রাজহারায় অনেকগুলো নতুন পরীক্ষা নিরিক্ষা চালায় নতুন ইউনিয়ন। ….শ্রমিকদের বাসস্থানের উন্নতির জন‍্য গঠিত হয় মহল্লা কমিটি, ঠিকা শ্রমিকদের শিশুদের জন‍্য ইউনিয়নের নেতৃত্বে ৬ ঠা প্রাইমারি স্কুল, নিরক্ষর শ্রমিকদের জন‍্য বয়স্ক শিক্ষা কর্মসূচি, স্বাস্থ্য আন্দোলন শুরু হয় #সাফাই আন্দোলন রূপ নিয়ে, ১৯৮২ শহীদ ডিস্পেন্সারির কাজ, ১৯৮৩ শহিদ দিবসে ১৯৭৭-এর শহিদের স্মরণে শহীদ হাসপাতাল। শ্রমিকদের অবসর-বিনোদন ও সুস্থ সংস্কৃতির জন‍্য নয়া আঞ্জোর, শরীর-চর্চার জন‍্য শহিদ সুদামা ফুটবল ক্লাব, রেড-গ্রিন অ্যাথলেটিক ক্লাব। ছত্তিশগড়ের শোষণ-মুক্তি ও ছত্তিশগড়ে শ্রমিক-কৃষকের রাজ স্থাপনের লক্ষ্যে গড়ে তোলা হয় ছত্তিশগড় মুক্তি মোর্চা। জনবিরোধী বননীতিকে চ‍্যালেঞ্জ জানিয়ে ইউনিয়নের দপ্তরের পিছনে এক মডেল বন-সৃজন করা হয়।

শংকর গুহ নিয়োগী র অভিনব নেতৃত্বে ছত্তিশগড়ের বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষ লাল-সবুজ পতাকা তুলে নিতে থাকে। মধ‍্যপ্রদেশের – দূর্গ, বস্তার, রাজনাদগাঁও, রায়পুর, বিলাসপুরে ছত্তিশগড় মুক্তি মোর্চার সংগঠন ও আন্দোলন ছড়িয়ে পড়তে থাকে। শংকরের নেতৃত্বে ভিলাইয়ে ১৯৯০-এ শুরু হওয়া লড়াই কারখানার মালিকদের আতঙ্কিত করে তোলে। অথচ শ্রমিকদের দাবিগুলো – বেঁচে থাকার মতো বেতন, স্থায়ী শিল্পে স্থায়ী চাকরি, ইউনিয়নে সংগঠিত হওয়ার অধিকার। আন্দোলনের পক্ষে দেশের জনমত সংগ্রহের উদ্দেশ্যে সেপ্টেম্বরে নিয়োগী র নেতৃত্বে এক বিশাল শ্রমিক দল রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীকে ডেপুটেশন দিয়ে এল। তার পক্ষকাল পরে ২৮ শে সেপ্টেম্বর নিয়োগীকে হত‍্যা করা হলো। …দেশি পিস্তলের বুলেটের ছ-টা ছররা পিঠ ফুঁড়ে হৃৎপিণ্ডকে ফুটো করে দিয়েছে।

সপরিবারে থাকতেন একটা মাটির দোচালা ঘরে, পরতেন খদ্দেরের পাজামা-পাঞ্জাবি, কখনো তা ফাটা আধময়লা, পায়ে রবারের চপ্পল বা কম দামি কেডস ! তাঁর নেতৃত্বে লোহাখনির ঠিকা শ্রমিকদের নূন্যতম দৈনিক মজুরি ২-৩ টাকা থেকে বেড়ে ৯০ টাকারও বেশি হয়েছিল, অথচ মৃত্যুর আগে প্রতি মাসে সংগঠন থেকে সর্বক্ষণের কর্মী হিসেবে তিনি নিতেন মাত্র  ৮০০ টাকা।

সংগঠনের কাজ সেরে বাড়ি ফিরতেন মিঝ রাতে, অথচ সকালে উঠে ঠিক একটু সময় বার করে নিতেন ছেলেমেয়েদের পড়ানোর জন‍্য বা বাড়ির পেছনের তরকারির বাগিচার পরিচর্যার জন‍্য…..”

সূত্র : Punyabrata Goon , শংকর গুহ নিয়োগী র সঙ্গে কয়েক বছর, বুক মার্ক, কলকাতা, ২০১৬

( লিখতে লিখতে ২৮ তারিখ থেকে ২৯ তারিখ রাতের পোষ্ট হয়ে গেলো ; দুঃখিত )

তাপস বর্মণ

পরিবেশ ও শান্তি আন্দোলন কর্মী

২৯ সেপ্টেম্বর ২০২২

আরও পড়ুন – বজবজে কোমাগাতামারু শহীদ দিবস উদযাপন