০
মহাপ্লাবন আসন্ন। তাই আমাদের অনতিবিলম্বে একটা নৌকো বানাতে হবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে যে, এমন কি কোনো নৌকো বানানো সম্ভব যাতে চড়ে আমরা একত্রিতভাবে এই বিপদের হাত থেকে পরিত্রাণ পেতে পারি?
সমস্যা হচ্ছে, এতদিনের অভিজ্ঞতা আমাদের অন্যকথা বলে। বলে, এবং তাত্ত্বিকভাবে বোঝায় যে আমরা কখনোই একই নৌকার যাত্রী নই। আমাদের নৌকো ভিন্ন। কারণ আমরা ভিন্ন। আমাদের গন্তব্য তথা যাত্রাপথও ভিন্ন।
আমরা কেউ গ্লোবাল সাউথ তো কেউ গ্লোবাল নর্থ; কেউ শ্রমিক তো কেউ মধ্যবিত্ত, বুর্জুয়া; কেউ প্রান্তিক চাষী তো কেউ বৃহৎ চাষী; কেউ সাদা তো কেউ কালো, মিশ্রবর্ণ; কেউ পুরুষ তো কেউ নারী, এলজিবিটিকিউ; কেউ হিন্দু তো কেউ মুসলমান, ইহুদি, খৃস্টান, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ; কেউ ব্রাহ্মণ তো কেউ শূদ্র, অতিশূদ্র; কেউ জাতি তো কেউ উপজাতি; কেউ নাগরিক তো কেউ উদ্বাস্তু; ইত্যাদি।
তাই ওরকম কোনো সর্বজনপরিত্রাণকরি মহাতরণী নির্মাণ করতে গেলে আমাদের কল্পনাকে প্রসারিত করতে হবে।
১
মহাপ্লাবনের কল্পনা ক্রমে আমাদের গ্রাস করছে।
বিজ্ঞানের রাজত্বে আমাদের বাস। সে আমাদের একভাবে পৃথিবীকে দেখায়, আমরা দেখি। একভাবে ভাবায় আমরা ভাবি। আমাদের এরকম ভাবনার রসদ যোগায় আইপিসিসির রিপোর্টে। সে প্রায় দু দশক আগে থাকতেই আমাদের সম্ভাব্য মহাপ্লাবনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। সেসব রিপোর্টে ব্যবহৃত বৈজ্ঞানিক ধারণাসমূহের অন্যতম হলো climate tipping points, tipping elements, feedbacks, tipping pointsএর cascading বা domino effect, runaway greenhouse effect, ইত্যাদি।
মহাপ্লাবনের ওই কল্পনার মূলে রয়েছে এহেন বহুবিধ বৈজ্ঞানিক ধারণাসমূহ। এই apocalyptic imaginationএর সত্যমিথ্যা হয়তো তর্কসপেক্ষ। তবু নিজের শরীরের অনুভবকে অস্বীকার বা উপেক্ষা করি কিভাবে? কিভাবে অস্বীকার করি coronary heart disease, endocrinal malfunction বা cancerএর মত আরো বহুবিধ অ-সুখকে যা ক্রমে মহামারীর আকার গ্রহণ করছে।
২
মডার্ন ফিলোসফির জনক ধরে নেওয়া হয় রেনে ডেকার্তেকে। তার জ্ঞানচর্চার মূল উদ্দেশ্য ছিল কিভাবে আমরা সন্দেহাতীতভাবে সত্যে উপনীত হতে পারি। সেই স্থির নিশ্চিত সত্যে পৌঁছনোর লক্ষে তিনি এক অভিনব উপায় প্রস্তাব করেন তার Discourses on Method গ্রন্থে। এই গ্রন্থের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো, যেকোন বস্তুর সত্য অনুধাবনের জন্য প্রথমে সেই পূর্ণ বস্তুকে তার ছোট ছোট অংশে ভাগ করে নিতে হবে। তারপর একে একে সেই অংশ সমূহের সত্যকে অনুধাবন করতে হবে। তার যুক্তি, অংশের সত্যসমূহকে একত্রিত করলে (পূর্ণ) বস্তুর সত্য অনুধাবন সম্ভব।
ডেকার্তে অনুসারী আধুনিক বিজ্ঞান জ্ঞানের বস্তুকে তার সুবিধামত উত্তরোত্তর ছোট ছোট অংশে ভাগ করে নিতে থাকে। যেমন মানুষ নামক জ্ঞানের বস্তুর জন্য নির্ধারিত হয় মানব বিজ্ঞান, এবং প্রকৃতি নামক জ্ঞানের বস্তুর জন্য নির্ধাটিত হয় প্রাকৃতিক বিজ্ঞান। তারপর সেই মানব বিজ্ঞানকে ভেঙে অর্থবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, ইতিহাস, নৃতত্ত্বসহ আরও বহু কিছু। আর প্রাকৃতিক বিজ্ঞানকে ভেঙে জড়বিজ্ঞান ও জীবনবিজ্ঞান। তারপর তাদেরকে আরো ভেঙে পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, ভূতত্ত্ব, ভূগোল, উদ্ভিদবিদ্যা, প্রাণীবিদ্যা, শরীরবিদ্যা, মনবিদ্যাসহ আরো বহু কিছু।
৩
ইউরোপের এই অসম্ভব জ্ঞানারোহনের বাসনাকে (will to knowledgeকে) প্রথম যিনি গুরুতর প্রশ্নের মুখে ঠেলে দেন তিনি হলেন ফ্রেডরিক নিটসে। তার বক্তব্যে, মানুষ তথা প্রাণীজগৎ ক্ষমতার বাসনার দ্বারা (will to powerএর দ্বারা) পরিচালিত। তাই তার মতে মানুষের এই জ্ঞানারোহনের বাসনা আসলে তার ক্ষমতা আরোহনের বাসনা।
পরবর্তীকালে মিশেল ফুকো নিটসের এই will to knowledge = will to powerএর সূত্র থেকে তার power-knowledgeএর তত্ত্ব গড়ে তোলেন। তার বিস্তারিত আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট হয় যে ইউরোপের জ্ঞানের জয়যাত্রা প্রকৃতপ্রস্তাবে তার ক্ষমতার জয়যাত্রা।
৪
মিশেল ফুকো তার জ্ঞান-ক্ষমতার তত্ত্বে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে dispositif নামক একটি বিশেষ ধারণা পেশ করেন। এই ধারণার মাধ্যমে তিনি উন্মোচিত করেন knowledge structure এবং প্রতিষ্ঠানের অন্তর্নিহিত সম্পর্ক। এবং তারা কিভাবে একে অপরের সাথে গাঁটছড়া বেঁধে ব্যক্তি ও সমষ্টি বা সমাজকে, নিয়ন্ত্রণ করে।
তার এই তত্ত্বের নিরিখে আমরা সহজেই political scienceএর discourse ও political institutionগুলির সম্পর্ক বুঝতে পারি। বুঝতে পারি তারা কিভাবে প্রতিনিয়ত একে অপরকে maintain করে, enhance করে। কিভাবে তারা একে অপরের সাথে তাল মিলিয়ে evolve করে। আর কিভাবেই বা তারা নিয়ন্ত্রণ করে মানুষ ও তার environmentকে।
এবং এই যুক্তি অন্যান্য প্রতিটি discourse এবং তার সংশ্লিষ্ট institutionসমূহের সম্পর্কের ক্ষেত্রে একইভাবে প্রযোজ্য। যেমন তা প্রযোজ্য economicsএর discourse এবং economic institutionসমূহের সম্পর্কের ক্ষেত্রে। যেমন তা প্রযোজ্য scientific discourseসমূহের সাথে scientific institutionসমূহের সম্পর্কের ক্ষেত্রে, সে scienceএর নাম physics হোক বা chemistry, sociology হোক বা anthropology, botany হোক বা zoology, medicine হোক বা psychiatry, বা অন্য যা কিছু।
৫
মানুষ ও তার পরিবেশকে নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে জ্ঞান-ক্ষমতার এই discourse কেন্দ্রিক তত্ত্বের পাশাপাশি সমপরিমাণ গুরুত্বের দাবি রাখে ideology কেন্দ্রিক জ্ঞান-ক্ষমতার তত্ত্বসমূহ।
Ideology মূলত একটি মার্ক্সিয় ধারণা। যে ধারণার বিস্তার পরবর্তীকালে হয় একদিকে ফ্রাঙ্কফ্রুট স্কুলের সাথে যুক্ত (বেঞ্জামিন, হরখাইমের, আদর্নো, মার্কুসি ইত্যাদি) ক্রিটিকাল তাত্তিকদের হাতে, ও অন্যদিকে আন্তোনিও গ্রামসির হেজেমনির তত্ত্বের মাধ্যমে।
জ্ঞান-ক্ষমতার এই ideology কেন্দ্রিক ধারণার সাহায্যে আমরা সহজেই বুঝতে পারি যে, কোনো একটি সমাজের আধিপত্যকামী সংস্কৃতি তথা ধারণাসমূহ, কিভাবে সেই সমাজের ক্ষমতাসীন শ্রেণীর অর্থনৈতিক তথা রাজনৈতিক স্বার্থকে চরিতার্থ করে।
মার্ক্সের মতে কোনো একটি সমাজের সামাজিক চেতনার মূলে রয়েছে তার বস্তুতন্ত্রিক বাস্তবতা (material reality)। এবং এই বাস্তবতার কেন্দ্রে রয়েছে মানুষের উৎপাদনশীল শ্রম (productive labour)। পুঁজিবাদ মানুষের এই উৎপাদনশীল শ্রম appropriate করে, ও প্রাকৃতিক সম্পদকে পণ্যে পরিণত করে।
৬
জ্ঞান-ক্ষমতার এই তত্ত্বসমূহ আমাদের বুঝতে সাহায্য করে কিভাবে জ্ঞানের সাংস্কৃতিক উৎপাদন (cultural production of knowledge) সামাজিক ক্ষমতার পুনরাৎপাদনের (reproduction of social powerএর) মাধ্যমে মানুষের আনুগত্য (consent) আদায় করে নেয়। যে আনুগত্য আজ আমাদের পরিবেশ বিপর্যয়ের দোরগোড়ায় এনে দাড় করিয়েছে।
আর আনুগত্য আদায়ের এই রাজনীতির নির্ভুল বিশ্লেষণের ও বোঝাপড়ার উপরেই নির্ভর করছে আমাদের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা। অর্থাৎ, কিভাবে আমরা প্রতিরোধ গড়ে তুলব। বিশেষত এই উশর সময়ে।
৭
কিন্তু জ্ঞান-ক্ষমতার অক্ষে মানুষের আনুগত্য আদায়ের রাজনীতি, ও তার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রশ্নে কিছু গুরুতর সমস্যা আছে।
প্রথম সমস্যা ক্ষমতার locationএ। জ্ঞান-ক্ষমতার ideology সংক্রান্ত তত্ত্বসমূহের বিচারে ক্ষমতার অবস্থান (location) হচ্ছে শ্রেণী বা class (যেমন পুঁজিবাদী সমাজের ক্ষেত্রে পুঁজিপতি শ্রেণী), ও সেই শ্রেণীর স্বার্থবাহি সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ। এর বিপক্ষে জ্ঞান-ক্ষমতার discourse সংক্রান্ত তত্ত্বসমূহের বিচারে ক্ষমতার অবস্থান হচ্ছে discourse (যেমন বিজ্ঞানের সন্ধর্ভ বা বয়ান)।
দ্বিতীয় সমস্যা ক্ষমতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রশ্নে। এবং এই প্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রশ্নটি যেহেতু আমাদের কাছে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, তাই এই জায়গাটা একটু পরিষ্কার করা দরকার।
প্রতিরোধের প্রশ্নে জ্ঞান-ক্ষমতার অক্ষের এক প্রান্তে অবস্থান করছেন মার্ক্স। আর তার ওপর প্রান্তে অবস্থান করছেন ফুকো। আর বলা যেতে পারে যে এনাদেরএই দুই বিপরীত অবস্থানের মধ্যবর্তী বিন্দুতে অবস্থান করছেন গ্রামসি।
গ্রামসি আর মার্ক্সের মাঝের জায়গাটাকে আপাতত ফাঁকা রাখছি, কারণ সমস্যার বিশ্লেষণের প্রশ্নে ফ্রাঙ্কফ্রুট স্কুলের সাথে যুক্ত ক্রিটিকাল তাত্তিকরা অনবদ্য হলেও, তারা প্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রশ্নে কোনো সুনির্দিষ্ট দিশা দিয়ে যেতে পারেননি।
উল্টো দিকে গ্রামসি আর ফুকোর মাঝের জায়গাটায় আমরা রাখতে পারি Laclau এবং Mouffe বা Murray Bookchinএর মত কিছু Post-Marxist, Anarchist তাত্তিকদের।
জ্ঞান-ক্ষমতাতত্ত্বের এই আক্ষের এক প্রান্তে অবস্থিত ধ্রুপদী মার্ক্স সমাজবিপ্লবের মাধ্যমে পুঁজিপতি শ্রেণীর হাত থেকে বলপূর্বক ক্ষমতা ছিনিয়ে নেয়ার কথা বলছেন। আর তার অপর প্রান্তে অবস্থিত ফুকো বলছেন যে না তা কখনোই সম্ভব নয় কারণ ক্ষমতার ওরকম কোনো সুনির্দিষ্ট কেন্দ্র হয়না। ফুকোর মতে power is everywhere, এবং তাই তিনি এই micro physics of powerএর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার কথা বলছেন। এহেন প্রতিরোধের উপায় হিসেবে তিনি প্রস্তাব করেছেন care of selfএর তত্ত্ব।
ফুকোর মতে, নিজের শরীর, মন ও আত্মার (mind, body and soulএর) উপর আমাদের যে স্বাভাবিক অধিকার, তা আমরা হারিয়েছি। স্কুল আমাদের এই ব্যবস্থা মোতাবেক একজন law abiding ও productive citizen হিসাবে গড়ে তুলতে চায়। সে পথে আমাদের শরীর বাধা হয়ে দাঁড়ালে তার জন্য হাসপাতাল আছে। সে পথে আমাদের মন বাধা হয়ে দাঁড়ালে তার জন্য পাগলাগারোদ আছে। আর সে পথে আমাদের আত্মা (i.e., Christian connotationএ soul) বাধা হয়ে দাঁড়ালে তার জন্য জেলখানা আছে। এবং এই ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার নিমিত্তে আমরাই ওই স্কুলের শিক্ষক, ওই হাসপাতাল ও পাগলাগারোদের চিকিৎসক, বা ওই জেলখানার জেলার। আবার প্রকৃতিকে নির্বিচারে লুঠ করবার নিমিত্তে আমরাই ওই কর্পোরেটপোষিত টেকনোক্রাট-ইঞ্জিনিয়ার।
ফুকো তাই তার care of selfএর তত্ত্বে নিজের নিজের শরীর, মন ও আত্মার উপর আমাদের যে স্বাভাবিক অধিকার, তা পুনার্জনের কথা বলছেন। অর্থাৎ মার্ক্সের ঠিক উল্টো অবস্থানে দাঁড়িয়ে তিনি ব্যক্তিগত স্তরে প্রতিরোধের কথা বলছেন।
এই দুই প্রান্তের মধ্যবর্তী অবস্থানে দাঁড়িয়ে গ্রামসি হেজেমনির বিরুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদি সাংস্কৃতিক war of positionsএর কথা বলছেন।
গ্রামসি এবং ফুকোর মধ্যবর্তী অবস্থানে দাঁড়িয়ে Laclau এবং Mouffe বলছেন একধরনের pluralist form of political actionএর কথা যেখানে মানুষ তাদের বিভিন্ন subject position থেকে বিভিন্ন issueতে counter hegemonic blocks গড়ে তুলবেন। আর পাশে দাঁড়িয়ে Murray Bookchin বলছেন anarchist syndicalismএর কথা।
৮
এই জ্ঞান-ক্ষমতা কেন্দ্রিক তত্ত্বসমূহের বিভিন্ন অবস্থান থেকে বাস্তবে প্রতিরোধ কতটা সম্ভব হয়েছে তা হলফ করে বলা মুশকিল। কিন্তু ওই অক্ষের এক প্রান্তে অবস্থিত মার্ক্সের সমাজবিপ্লবের তত্ত্ব, ও তার অপর প্রান্তে অবস্থিত ফুকোর care of selfএর তত্ত্ব যে বিশেষ সুবিধা করে উঠতে পারেনি এটা পরিষ্কার।
সমাজবিপ্লব বিপ্লবীকে ক্ষমতার আসনে অধিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে মাত্র। ক্ষমতাকে নির্মূল করতে সক্ষম হয়নি।
এর উল্টোদিকে শরীর, মন ও আত্মার স্বাধীনতার বাসনা সেই ব্যক্তি care of selfতত্ত্ব অনুশীলনকরিকে নিজের অজান্তেই কখন না জানি জড়িয়ে ফেলেছে neoliberal individualismএর মায়াজালে।
আসলে সমস্যা হচ্ছে যে, সেই care of selfতত্ত্ব অনুশীলনকরির মতো ideal neoliberal subjectও শরীর, মন ও আত্মার স্বাধীনতারই খোঁজ করে। এখন, এই neoliberal subjectএর সেই স্বাধীনতার location হচ্ছে market, খোলা বাজার। আর (fortunately or) unfortunately ওই care of selfতত্ত্ব অনুশীলনকরি যে পৃথিবীর মুখোমুখি হয় সে পৃথিবী বাস্তবে already এক জাগতিক বাজারে (supermarktএ) পরিণত হয়েছে। আর গোটা পৃথিবীটাই (অর্থাৎ, গোটা civilizational spaceটাই) যখন বাজারে পরিণত হয়েছে, তখন বাজারের বাইরে (অর্থাৎ, market parameterএর বাইরে) সে আর তার শরীর, মন ও আত্মার স্বাধীনতাটার পরিসর পাবেটা কোথায়?
৯
এমতাবস্থায় স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে যে, তাহলে প্রতিরোধের কি উপায়? বিশেষত এরকম একটা আপদকালীন সময়ে, যখন মাথার ওপর মহাপ্রলয়ের মেঘ নাচানাচি করছে।
এখানে একটা কথা বেশ পরিষ্কার, জ্ঞান-ক্ষমতার অক্ষের বিভিন্ন বিন্দুতে অবস্থিত যে সকল তত্ত্ব আমরা এপর্যন্ত আলোচনা করলাম তা সবই আসলে ক্ষমতা দিয়ে ক্ষমতাকে মোকাবেলার করার তত্ত্ব। এবং এই প্রতিটি তত্বেরই পূর্বানুমান মানুষ তথা প্রাণীজগৎ ক্ষমতার বাসনার দ্বারা (will to powerএর দ্বারা) পরিচালিত।
এবং এই will to powerএর সত্যকে মেনে নিয়ে জ্ঞান-ক্ষমতার অক্ষের বিভিন্ন বিন্দুতে অবস্থিত যে সকল তত্ত্ব আমরা এখনও আলোচনা করার সুযোগ পায়নি, যেমন raceর তত্ত্ব, বা genderএর তত্ত্ব, বা postcolonial তত্ত্ব, বা subaltern তত্ত্ব, তা সবই আসলে ওই ক্ষমতা দিয়ে ক্ষমতাকে মোকাবেলার করার তত্ত্ব।
১০
ঠিক এইখানে আমার প্রস্তাব, প্রতিরোধের উপায় খুঁজতে গিয়ে আমাদের সর্বপ্রথম ওই will to powerএর সত্যকে প্রশ্ন করা উচিত।
অর্থাৎ, আমার প্রথম প্রশ্ন: সত্যিই কি মানুষ তথা প্রাণীজগৎ এরকম কোন essential (intrinsic) বাসনার দ্বারা পরিচালিত?
আর দ্বিতীয় প্রশ্ন: প্রথম প্রশ্নের উত্তর যদি negetive হয়, তাহলে কি ক্ষমতা দিয়ে ক্ষমতাকে মোকাবেলা করার কৌশল (strategy) আমাদের গ্রহণ করা উচিত?
১১
প্রথম প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমি অবশ্যই western philosophyর অঙ্গন ত্যাগ করে নাগার্জুনের দ্বারস্থ হতে চাই। তার শুন্যতার ধারণাকে উত্তরণের মই হিসাবে ব্যবহার করে আমরা খুব সহজেই দেখতে পাই (দর্শন অর্থে দেখতে পাই) যে মানুষ তথা প্রাণীজগৎ যদি এরকম কোন essential (intrinsic) বাসনার দ্বারা পরিচালিত হত, তাহলে তারা স্বভাবসম্পন্ন হত, যা শুন্যতার ধারণার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
নাগার্জুনের মতে মানুষ তথা জগৎ সংসার স্বভাবশূন্য (স্ব-ভাব-শূন্য)। স্ব-ভাব থাকতে হলে তাকে আত্মা (স্ব/ স্বয়ম) হতে হবে, তাকে নিত্য হতে হবে, যা বৌদ্ধমতে সম্ভব নয়।
অর্থাৎ, এরকম কোন essential বাসনার অস্তিত্ব একধরনের metaphysical imagination মাত্র, যা অনাত্মায় আত্মত্ত্ব দান করে।
সমস্যা হচ্ছে এই metaphysical imaginationকে সত্য ধরে নিয়েই জ্ঞান-ক্ষমতার যাবতীয় তত্ত্ব নির্মিত হয়েছে। এবং সেই জ্ঞান-ক্ষমতাকে প্রতিরোধের যাবতীয় তত্ত্বও স্বাভাবিকভাবে ওই একই metaphysical imaginationর ফসল।
এধরনের কল্পনাকে সত্যজ্ঞান করাকে বৌদ্ধমতে অবিদ্যা বলা হয়।
১২
বুদ্ধ অস্তিত্বের তিনটি লক্ষনকে চিহ্নিত করেছিলেন। যথাক্রমে: অনাত্মা, অনিত্য ও দুঃখ। Modern western philosophyর নিরিখে এই তিনটি লক্ষণের এরকম একটা অর্থ দাড় করানো যেতে পারে:
অনাত্মা: অর্থাৎ, there is no constant subject of our variable experiences.
অনিত্য: অর্থাৎ, we cannot bathe in the same river twice
দুঃখ: অর্থাৎ, ওই subjectএর দুঃখের অভিজ্ঞতা তো দুঃখের বটেই, এমনকি তার আপাত সুখমন্ডিত অভিজ্ঞতাও বাস্তবে তার দুঃখের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কারণ জগৎ অনিত্য। তাই সুখও অনিত্য। তাই সুখের অভিজ্ঞতার ওই মুহূর্তে অতিক্রান্ত হওয়া মাত্র তাকে পুনরায় দুঃখ চেপে ধরে।
দুঃখ চেপে ধরে কারণ ওই আপাত সুখময় অভিজ্ঞতার মুহূর্তটিকে সে আঁকড়ে ধরতে চায়। একে, এই আঁকড়ে ধরাকে বুদ্ধ বলছেন তৃষ্ণা।
বুদ্ধের মতে এই তৃষ্ণাই আমাদের যাবতীয় দুঃখের (sufferingএর) কারণ।
তার সাথে বুদ্ধ এও বলছেন যে এই দুঃখের নিবারণ সম্ভব। তার জন্য তৃষ্ণার নিরোধ প্রয়োজন।
১৩
আর দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর হ্যাঁ, Buddhist Situational Ethicsএর মূল্যবোধকে সম্বল করে,
ক্ষমতা দিয়ে ক্ষমতাকে মোকাবেলা করার কৌশল (strategy) আমরা অবশ্যই গ্রহণ করতে পারি যদি আমাদের উদ্দেশ্য মানুষের দুঃখ (এক্ষেত্রে climate suffering) নিবারণ হয়। আর যদি তার আগে আমরা ক্ষমতার তৃষ্ণাকে (বৌদ্ধ অর্থে তৃষ্ণা) নিরোধ করতে সক্ষম হই।
আর সেই তৃষ্ণাকে তখনই নিরোধ করা সম্ভব যখন আমরা বুঝবো যে will to powerকে সত্যজ্ঞান করা অবিদ্যা মাত্র। মানুষ তথা প্রাণীজগতের এরকম কোন স্ব-ভাব থাকতে পারে না, কারণ তারা স্ব-ভাব-শূন্য।
অর্থাৎ, জ্ঞান-ক্ষমতার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এই পৃথিবীকে আমরা সংবৃতি সত্য (provisional/empirical truth)
ধরে এগোবো। তাকে মোকাবেলা করবো, কিন্তু তার ফাঁদে পড়বো না।
১৪
আর এই ক্ষমতা দিয়ে ক্ষমতাকে মোকাবেলা করার কৌশলগত প্রশ্নে, আমি গ্রামসি ও ফুকোর মধ্যবর্তী অবস্থানে থাকা Laclau এবং Mouffe যেভাবে pluralist form of political actionএর কথা বলছেন, যেখানে মানুষ তাদের বিভিন্ন subject position থেকে বিভিন্ন issueতে সম্ভাব্য counter hegemonic blocks গড়ে তুলতে পারে, তার কথা বলবো।
১৫
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, পরিবেশ সংক্রান্ত কোন issueতে আমরা সর্ববৃহৎ counter hegemonic block গড়ে তুলতে পারি? এমন কোন issue থাকতে পারে যেখানে irrespective of their subject positions সব ধরনের মানুষ একটি জায়গায় এসে একত্রিত হতে পারে? হ্যাঁ, সে মানুষের কেউ গ্লোবাল সাউথ হলে কেউ গ্লোবাল নর্থ; কেউ শ্রমিক হলে কেউ মধ্যবিত্ত, বুর্জুয়া; কেউ প্রান্তিক চাষী হলে কেউ বৃহৎ চাষী; কেউ সাদা হলে কেউ কালো, মিশ্রবর্ণ; কেউ পুরুষ হলে কেউ নারী, এলজিবিটিকিউ; কেউ হিন্দু হলে কেউ মুসলমান, ইহুদি, খৃস্টান; কেউ ব্রাহ্মণ হলে কেউ শূদ্র, অতিশূদ্র; কেউ জাতি হলে কেউ উপজাতি; কেউ নাগরিক হলে কেউ উদ্বাস্তু; ইত্যাদি।
আমি এরকম একটাই জায়গা খুঁজে পেয়েছি। আর সেই জায়গাটা হলো climate sufferingএর জায়গা। আমরা, পৃথিবীর ৯৯% মানুষ প্রকৃতপ্রস্তাবে climate sufferer, irrespective of our subject positions. ক্ষমতা, টাকা, গায়ের রং, ভৌগোলিক অবস্থান বা লিঙ্গের প্রশ্নে আমি কোন পক্ষে তা বিশেষ matter করে না climate catastropheর প্রশ্নে।
আর তা যে করেনা তার প্রমান Ronald Reagan, তার প্রমান Steve Jobs. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি বা Apple কোম্পানির অধিকর্তা হওয়া সত্ত্বেও cancer তাদের ক্ষমা করেনি।
অর্থাৎ, climate sufferer বলতে আমি শুধুমাত্র সুন্দরবনের ঘূর্ণিঝড় কবলিত মানুষের কথা বা পাকিস্তানের বন্যা বিধ্বস্ত মানুষের কথা বলছিনা। তারা তো climate sufferer বটেই। কিন্তু ব্যাপকতম অর্থে আমরা সবাই climate sufferer.
Environmental degradationএর সাথে সাথে যে তিনটি প্রধান অসুখ, যথাক্রমে, coronary heart disease, endocrinal malfunction এবং cancer, আজ যা আজ ঘরে ঘরে ছেয়ে গেছে, সে অ-সুখের location জ্ঞান-ক্ষমতা কেন্দ্রিক medical science মানুষের শরীরে ঠাওড়ালেও, আসলে সে তো জলবায়ুই অসুখ।
Ronald Reaganএর skin cancerএর সাথে south of Canadaর মাথার ওপরে অবস্থিত ozone holeএর correlation কি আমরা একেবারেই উড়িয়ে দিতে পারি? বা Steve Jobsএর pancreatic cancerএর সাথে বহুবিধ environmental factorsএর নিবিড় সম্পর্ককে কি আমরা অস্বীকার করতে পারি?
Climate suffering আমাদের সময়ের এমন এক universal experience যা আমাদের সবাইকে (আমরা ৯৯% কে) এক জায়গায় নিয়ে আসতে পারে।
১৬
এখানে একটাই প্রশ্ন আসতে পারে, তাহলে ৯৯% কেন? কেন, কারণ বাকি ১% হচ্ছে climate opportunists, যারা ভাবছে যে এই বিপর্যয়ের ঘোলা জলে তারা মাছ ধরবে।
Bill Gates জানে যে climate changeএর কারণে crop failure হবে। তাই সে আগে থাকতেই আমেরিকার সব কৃষিজমি কিনে রাখছে। আর তার laboratoryতে চলছে climate resistant GM শস্যের পরীক্ষানিরীক্ষা। Climate যত deteriorate করে তত তার মজা। ৯৯%এর সর্বনাশ হলেও তার তো পৌষমাস।
এরকমই Donald Trump ভাবে একদিকে যখন Las Vegas ডুবে যাবে তখন অন্যদিকে Greenlandএর বরফ গোলে যাবে। তাই সে গোটা গ্রীনল্যান্ডটা কিনে রাখতে চায়। লাস ভেগাস ডুবে গেলে সেখানকার বড়োলোকদের জন্য সে একটা নতুন বিলাসবহুল শহর বানাবে।
Vladimir Putin চায় North Seaর বরফ গোলে যাক। তখন সব জাহাজ ওখান দিয়ে যাতায়াত করবে আর সেই route থাকবে তার নিয়ন্ত্রণে।
না, এরা বুঝবে না। তাইতো আজও বিশ্বজুড়ে fuel subsidy উঠলো না। বরং তা উত্তরোত্তর বেড়ে চলছে। IMFএর পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০২০ সালে fossil fuel subsidyর পরিমাণ ছিল 5.9 USD যা global GDPর 6.8%. IMF আশা করছে যে ২০২৫ সাল নাগাদ এই ভর্তুকির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়াবে global GDPর 7.4%.
তাই আমরা ৯৯%, united in suffering
১৭
এখানে একটা কথা মনে রাখতে হবে, ওই ১% climate opportunistদের বিরুদ্ধে climate sufferersদের এই environmental front কিন্তু প্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রশ্নে একটা কৌশলগত (strategic) পদক্ষেপ মাত্র। অর্থাৎ এখানে climate suffererরা, বা তার অপর (other) হিসাবে climate opportunistরা, কেউই কোনো essential entity নন। শুধুমাত্র climate suffering নামক একটি বিশেষ experience তাদের আপাতত এক জায়গায় এনেছে।
অর্থাৎ, Gayatri Spivakএর ধারণাকে অনুসরণ করে বলা যেতে পারে যে এখানে এই climate suffererরা প্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রশ্নে একটি strategically essential group মাত্র, তার বেশি কিছু নয়।
১৮
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই আমরা ৯৯% এর প্রধান রাজনৈতিক কর্মসূচি কি হবে?
সেই কর্মসূচি তো আমাদের দেখিয়ে গেছেন গান্ধী। Boycott Consumerism, Boycott Capitalism, Boycott Market, Boycott Money.
আর হ্যাঁ, এই boycott ক্ষমতার সাথে ক্ষমতার মোকাবেলার পথে নয়, তা করতে হবে তৃষ্ণার নিরোধের পথে, যে পথ বুদ্ধ আমাদের দেখিয়ে গেছেন ২৬০০ বছর আগে।
১৯
শেষ প্রশ্ন। কি হবে এই আমরা ৯৯% এর প্রতিরোধের পন্থা বা কৌশল?
Boycottএর বিভিন্ন উপায়ের কথা আমরা ভাবতে পারি। এই কৌশলগত প্রশ্নে দুজনকে আমার খুব প্রাসঙ্গিক মনে হয়। এক, Vaclav Benda, আর দুই, লালন শাহ।
Vaclav Benda Czechoslovakiaর authoritarian regimeএর বিরুদ্ধে একধরনের সমান্তরাল ব্যবস্থা (Parallel Polis) গড়ে তোলার কথা বলছেন যেখানে রাষ্ট্রের নজর এড়িয়ে (undergroundএ) বিকল্প তথা নান্দনিক যাপনের মাধ্যমে প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব।
Vaclav Bendaদের অনেক আগে এদেশে লালন শাহ তার বিকল্প তথা নান্দনিক যৌথ যাপনের মাধ্যমে একইসাথে আধিপত্যকামী হিন্দু (ব্রাহ্মণ্যবাদী) ও মুসলমান সমাজ, এবং ঔপনিবেশিক শাসকদের মদতপুষ্ট জমিদারের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন।
২০
অর্থাৎ, একইসঙ্গে গড়ে তুলতে হবে ভেতরের এবং বাইরের প্রতিরোধ।
বাইরে ক্ষমতার বিরুদ্ধে, (strategically) ক্ষমতার ভাষায়, ক্ষমতার চোখে চোখ রেখে প্রতিরোধ।
আর ভেতরে বিকল্প যাপনের মাধ্যমে গোটা ক্ষমতার paradigmকে renounce করার মাধ্যমে প্রতিরোধ। অর্থ তথা বাজারব্যবস্থাকে যথাসম্ভব প্রত্যাখ্যান করার মাধ্যমে প্রতিরোধ। ভোগবাদকে প্রত্যাখ্যান করার মাধ্যমে প্রতিরোধ। নিজেদের প্রয়োজনীয় প্রতিটি জিনিস স্বশ্রমে উৎপাদন করে নেওয়ার মাধ্যমে প্রতিরোধ।
অর্থাৎ, পরিবেশ বিধ্বংসী পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এক সর্বাত্মক প্রতিরোধ।
আরও পড়ুন – সৌন্দর্যশাস্ত্র ও দলমিলিয়ে দেওয়ালচিত্র রাজনগর, বীরভূম